ঢাকা ০৩:০৮ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
ব্রেকিং নিউজঃ
সন্তানদের নতুন জামা পরিয়ে রাতে ঘর থেকে বের হয়ে আর ফিরলেন না বাবা প্রধানমন্ত্রীর জিরো টলারেন্স নীতির ফলে দেশে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ নির্মুল হয়েছেঃ সিলেটে আইজিপি বড় পরিসরে আর. কে. মিশন রোডে ব্র্যাক ব্যাংকের শাখা উদ্বোধন সৌদিতে প্রথমবারের মতো সুইমস্যুট পরে র‌্যাম্পে হাঁটলেন মডেলরা ‘আয়রনম্যান’ চরিত্রে ফিরতে ‘আপত্তি নেই’ রবার্ট ডাউনি জুনিয়রের বাংলাদেশের গণতন্ত্র ধ্বংসের জন্য ভারত সরকার দায়ী : কর্নেল অলি বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সিরিজ নিয়ে শঙ্কা কাঠালিয়ায় ডাকাতের গুলিতে আহত ২ বিএনপি একটা জালিয়ত রাজনৈতিক দল : পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেয়র তাপস মনগড়া ও অসত্য বক্তব্য দিচ্ছেন : সাঈদ খোকন

সারাবিশ্বে বাড়ছে যৌনরোগ ‘সিফিলিস’

নওরোজ স্বাস্থ্য ডেস্ক
  • Update Time : ১১:২২:২১ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৪ জুলাই ২০২৩
  • / ৮০ Time View

বিশ্বের প্রাচীনতম যৌনরোগের অন্যতম হলো সিফিলিস। একসময় এর বিস্তার কমে গিয়েছিলো মনে করা হলেও সাম্প্রতিক সময়ে সারাবিশ্বে এই রোগ উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে।

চৌদ্দশ নব্বইয়ের দশকে রেকর্ড সংখ্যক রোগী শনাক্তের পর থেকে সিফিলিস রোগকে বিভিন্ন নামে ডাকা হয়েছে।

সেগুলো হলো-“ফরাসি রোগ”, “নিয়াপলিটান রোগ”, “পোলিশ রোগ” ইত্যাদি। তবে সিফিলিসের একটি নাম স্থায়ী হয়ে রয়ে গেছে। সেটি হলো, “চরম নকলবাজ”। সিফিলিস অন্যান্য রোগের সংক্রমণকে নকল করতে ওস্তাদ এবং এর প্রাথমিক লক্ষণগুলো খুব সহজেই নজর এড়িয়ে যায়।

সময়মত চিকিৎসা করা না হলে, সিফিলিসের পরিণতি গুরুতর হতে পারে। এ বছরের এপ্রিল মাসে যুক্তরাষ্ট্রে যৌন সংক্রামিত রোগ বা এসটিআই-এর সর্বশেষ তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। এতে দেখা গেছে, দেশটিতে সিফিলিসের সংক্রমণ বৃদ্ধি পেয়েছে সবচেয়ে বেশি।

২০২০ সাল থেকে ২০২১ সালের মধ্যে সিফিলিসের কেস ৩২% বেড়ে গত ৭০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যায় পৌঁছেছে। যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র সিডিসি সতর্ক করছে, সিফিলিসের মহামারি কমে আসার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। সিডিসি কিছু “আতঙ্কজনক” নতুন প্রবণতার দিকে ইঙ্গিত করছে যার কারণে এই রোগের সংক্রমণ হঠাৎ করেই বেড়ে গেছে। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে “কনজেনিটাল সিফিলিস” অর্থাৎ জন্মগত সিফিলিস, যেখানে গর্ভাবস্থায় মায়ের মাধ্যমে সন্তানের দেহে এই রোগের সংক্রমণ ঘটে। আর মা সাধারণত এতে সংক্রমিত হন তার যৌন সঙ্গীর কাছ থেকে। এই রোগের সংক্রমণে মৃত সন্তান প্রসব, শিশু মৃত্যু এবং আজীবন স্বাস্থ্য সমস্যা ঘটতে পারে।

সিডিসি’র যৌন রোগ প্রতিরোধ বিভাগের পরিচালক লিয়েন্ড্রো মেনা বিবিসিকে বলেন, “পনের বা বিশ বছর আগে আমরা ভেবেছিলাম যে আমরা সিফিলিস নির্মূলের কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। তবে কোন সন্দেহ নেই যে এখন আমরা সিফিলিসের বৃদ্ধি দেখতে পাচ্ছি, এমন এক হারে যেটি আমরা গত ২০ বছরে দেখিনি।” সিফিলিসের সংক্রমণ যে কেবল যুক্তরাষ্ট্রে ঘটছে তা কিন্তু না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী সিফিলিসের ৭১ লক্ষ নতুন কেস ধরা পড়েছে। ২০২০ সালে ব্রিটেনে ১৯৪৮ সালের পর থেকে সিফিলিস কেস সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। সিফিলিস রোগ বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি যৌন স্বাস্থ্য বিষয়ক সেবা দানকারীরা একেবারে সামনে থেকে প্রত্যক্ষ করছেন।

ব্রিটেনের এসটিআই ফাউন্ডেশনের কো-চেয়ার জোডি ক্রসম্যান বিবিসিকে বলেন, “২০০৫ সালে যখন আমি প্রথমবারের যৌন স্বাস্থ্য নিয়ে নার্সিং শুরু করি, তখন প্রাথমিক পর্যায়ের সিফিলিস কেস খুঁজে পাওয়া ছিল খুবই বিরল, এমনকি শহরের কেন্দ্রস্থলের ক্লিনিকেও এটা দেখা যেতো না।” ২০২০ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে সিফিলিস সংক্রমণের হার ৮.৪% বেড়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এখন বেশিরভাগ শহর-ভিত্তিক ক্লিনিকগুলিতে প্রতিদিন কমপক্ষে দুই থেকে তিনজন রোগীকে সিফিলিস চিকিৎসার জন্য হাজির হতে দেখা যায়।”সিফিলিসের সংক্রমণ ঘটে ট্রেপোনেমা প্যালিডাম নামের একটি ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে। এই রোগের লক্ষণগুলোতে রয়েছে চারটি ধাপ। প্রথম ধাপে নারী বা পুরুষের যৌনাঙ্গে এক ধরনের ব্যথাহীন কালশিটে বা ফুসকুড়ি দেখা দেয়। এই পর্যায়ে পেনিসিলিন ইনজেকশনের একটি ইন্ট্রামাসকুলার ডোজ সংক্রমণের বিরুদ্ধে সবচেয়ে কার্যকর উপায় হিসেবে বিবেচিত হয়। তবে চিকিৎসা না করা হলে সিফিলিসের কারণে দীর্ঘমেয়াদী স্নায়বিক এবং কার্ডিওভাসকুলার রোগ হতে পারে।

কানাডায় ২০১১ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে সিফিলিস রোগের ঘটনা বেড়েছে ৩৮৯%, অন্যান্য যৌন রোগের সংক্রমণের তুলনায় যা অনেক বেশি। সা¤প্রতিক দশকগুলিতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সিফিলিসের ঘটনা ঘটছে সমকামী, উভকামী এবং অন্যান্য পুরুষদের মধ্যে যারা পুরুষদের সাথে যৌনসংগম করেন। তবে বিশ্বের কিছু দেশে পুরুষদের মধ্যে সিফিলিসের কেস কমে আসছে।

যেমন, কানাডায় পুরুষদের মধ্যে সিফিলিসের সংক্রমণের হার কমেছে। কিন্তু একই সময়ে শুধুমাত্র কানাডায় না, সারবিশ্বেই নারীদের মধ্যে সিফিলিসের হার বেড়েছে। এর ফলে অনেক দেশে এখন কনজেনিটাল সিফিলিসের হার বেড়েছে। উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশ জুড়ে ২০২১ সালে মা-থেকে শিশুর মধ্যে সিফিলিসের সংক্রমণের কেস ছিল ৩০,০০০টি।

গর্ভাবস্থায় মায়ের দেহ থেকে অনাগত শিশুর দেহে সিফিলিসের সংক্রমণ ঘটলে তার পরিণতি হতে পারে বিপর্যয়কর: প্রসূতির গর্ভপাত হতে পারে, মৃত সন্তান প্রসব কিংবা অকাল প্রসব ঘটতে পারে, নবজাতকের জন্মের সময় ওজন কম হতে পারে এবং জন্মের পরপরই শিশুর মৃত্যুও ঘটতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগত সিফিলিসের হার এখন বাড়ছে। ২০১৬ সালের তুলনায় ২০২০ সালে সিফিলিসের কেস বেড়েছে ৩.৫ গুণ। ২০২১ সালে এই হার আরও বেড়েছে, যার ফলে ঐ বছর ২২০ টি মৃত-প্রসব এবং শিশু মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।

সিফিলিস রোগের মহামারির পেছনে যেসব সমস্যা কারণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে তা হলো- যৌনরোগ পরীক্ষা কেন্দ্রে সেবা নিতে গিয়ে সমস্যা, সিফিলিসকে ঘিরে লজ্জা, সামাজিক কুসংস্কার এবং সম্ভবত ভাষাগত বাধা। ব্রাজিলের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, স্কুলে যাননি এমন কৃষ্ণাঙ্গ নারীদের মধ্যে জন্মগত সিফিলিসের হার অনেক বেশি। অনেক ক্ষেত্রেই, সিফিলিস স্ক্রিনিং করে এমন পরীক্ষাকেন্দ্রে গিয়ে সেবা নেওয়ার ক্ষেত্রে নারীদের সমস্যায় পড়তে হয়।

ক্যালিফোর্নিয়ার কার্ন কাউন্টির আরেকটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, কনজেনিটাল সিফিলিসের সংক্রমণ নির্ভর করছে নারীদের ইমিগ্রেশন স্ট্যাটাস, মেডিকেল ইনস্যুরেন্স, এবং গর্ভবতী মহিলাদের ওপর যৌন সহিংসতা কিংবা বাড়িতে সহিংসতার ওপর। এসব নারীদের মধ্যে অর্ধেকই হলেন হিস্প্যানিক, লাতিনো কিংবা স্প্যানিশ বংশোদ্ভূত।

অস্ট্রেলিয়ায় ২০২০ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, সিফিলিসের হার ২০১৫ সালের তুলনায় প্রায় ৯০% বৃদ্ধি পেয়েছে। যদিও জীবনযাত্রার ব্যয়-সংকট এবং কোভিড মহামারি নানা দেশের জনস্বাস্থ্য পরিষেবা খাতকে দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, সেখানে যৌন রোগ সংক্রমণের প্রতিও মানুষের আচরণ এবং দৃষ্টিভঙ্গিতেও পরিবর্তন ঘটেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এইচআইভি সংক্রমণের ঝুঁকি কমে আসায় কনডম ব্যবহার কিংবা যৌনরোগের বিরুদ্ধে অন্যান্য প্রতিরোধ নিতে মানুষের মধ্যে আগ্রহ এখন অনেকটাই কমে গেছে।

জাপানের গবেষকরা ডেটিং অ্যাপ এবং সিফিলিসের সঙ্গে সম্পর্ক থেকে মানুষের যৌন অভ্যাসের পরিবর্তন দিকটি বোঝার চেষ্টা করছেন। গবেষণা থেকে তারা এই উপসংহারে পৌঁছেছেন যে ডেটিং অ্যাপ ব্যবহারের সঙ্গে “সিফিলিস সংক্রমণের সম্পর্ক উল্লেখযোগ্য।“ এসব অ্যাপের ব্যবহারের ফলে অনিরাপদ যৌনমিলনের ঘটনা ক্রমশই বাড়ছে। সাসাকি চিওয়াওয়া, যিনি জাপানের যুব সম্প্রদায় এবং যৌন সংস্কৃতি নিয়ে লেখালেখি করেন, তিনিও যৌনকর্মীদের সাথে কথোপকথনের সময় একই চিত্র দেখতে পেয়েছেন।

চিওয়াওয়া বলেন, “এখন বেশি সংখ্যক যৌনকর্মীরা আর কনডম ব্যবহার করছেন না এবং তাদের গ্রাহকদের এসটিআই পরীক্ষারও কোনো বাধ্যবাধকতা নেই “ অন্যদিকে, যৌনকর্মীরা যদি সংক্রমিত হন, তখন তারা একে “দুর্ভাগ্য” বলে ধরে নেন। “স্বাস্থ্যের ঝুঁকির চেয়ে অর্থ উপার্জনকেই তারা অগ্রাধিকার দেন।”

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিফিলিস রোগের চিকিৎসায় অ্যান্টিবায়োটিক ও পেনিসিলিন এখনও বেশ কার্যকরী। তবে তারা বলছেন, নিরাপদ যৌন চর্চাকে উৎসাহিত করার জন্য আরও বেশি পরীক্ষার প্রয়োজন। সিফিলিসের সঙ্গে সামাজিক কুসংস্কার দূর করতে আরও বেশি করে প্রচারণার পাশাপাশি এই বিষয়টি নিয়ে জনসচেতনতাও বাড়াতে হবে। তবে বিজ্ঞানীরা এখনও পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেননি যে কেন অন্যান্য যৌনরোগের তুলনায় সিফিলিস বেশি দ্রুত হারে বাড়ছে।

সিডিসি’র যৌন রোগ প্রতিরোধ বিভাগের পরিচালক লিয়েন্ড্রো মেনা বলছেন, এই রোগের যেসব প্রচলিত জীবাণু রয়েছে সেগুলো যে আরও বেশি মারাত্মক হয়ে উঠেছে তারও কোন জোরালো প্রমাণ নেই। অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা কমে আসার সঙ্গে সিফিলিস সংক্রমণ বেড়েছে এই ব্যাখ্যাও মেনে নেওয়া যায় না বলে জানান কানাডার গবেষক আইজ্যাক বোগোচ।

Please Share This Post in Your Social Media

সারাবিশ্বে বাড়ছে যৌনরোগ ‘সিফিলিস’

Update Time : ১১:২২:২১ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৪ জুলাই ২০২৩

বিশ্বের প্রাচীনতম যৌনরোগের অন্যতম হলো সিফিলিস। একসময় এর বিস্তার কমে গিয়েছিলো মনে করা হলেও সাম্প্রতিক সময়ে সারাবিশ্বে এই রোগ উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে।

চৌদ্দশ নব্বইয়ের দশকে রেকর্ড সংখ্যক রোগী শনাক্তের পর থেকে সিফিলিস রোগকে বিভিন্ন নামে ডাকা হয়েছে।

সেগুলো হলো-“ফরাসি রোগ”, “নিয়াপলিটান রোগ”, “পোলিশ রোগ” ইত্যাদি। তবে সিফিলিসের একটি নাম স্থায়ী হয়ে রয়ে গেছে। সেটি হলো, “চরম নকলবাজ”। সিফিলিস অন্যান্য রোগের সংক্রমণকে নকল করতে ওস্তাদ এবং এর প্রাথমিক লক্ষণগুলো খুব সহজেই নজর এড়িয়ে যায়।

সময়মত চিকিৎসা করা না হলে, সিফিলিসের পরিণতি গুরুতর হতে পারে। এ বছরের এপ্রিল মাসে যুক্তরাষ্ট্রে যৌন সংক্রামিত রোগ বা এসটিআই-এর সর্বশেষ তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। এতে দেখা গেছে, দেশটিতে সিফিলিসের সংক্রমণ বৃদ্ধি পেয়েছে সবচেয়ে বেশি।

২০২০ সাল থেকে ২০২১ সালের মধ্যে সিফিলিসের কেস ৩২% বেড়ে গত ৭০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যায় পৌঁছেছে। যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র সিডিসি সতর্ক করছে, সিফিলিসের মহামারি কমে আসার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। সিডিসি কিছু “আতঙ্কজনক” নতুন প্রবণতার দিকে ইঙ্গিত করছে যার কারণে এই রোগের সংক্রমণ হঠাৎ করেই বেড়ে গেছে। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে “কনজেনিটাল সিফিলিস” অর্থাৎ জন্মগত সিফিলিস, যেখানে গর্ভাবস্থায় মায়ের মাধ্যমে সন্তানের দেহে এই রোগের সংক্রমণ ঘটে। আর মা সাধারণত এতে সংক্রমিত হন তার যৌন সঙ্গীর কাছ থেকে। এই রোগের সংক্রমণে মৃত সন্তান প্রসব, শিশু মৃত্যু এবং আজীবন স্বাস্থ্য সমস্যা ঘটতে পারে।

সিডিসি’র যৌন রোগ প্রতিরোধ বিভাগের পরিচালক লিয়েন্ড্রো মেনা বিবিসিকে বলেন, “পনের বা বিশ বছর আগে আমরা ভেবেছিলাম যে আমরা সিফিলিস নির্মূলের কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। তবে কোন সন্দেহ নেই যে এখন আমরা সিফিলিসের বৃদ্ধি দেখতে পাচ্ছি, এমন এক হারে যেটি আমরা গত ২০ বছরে দেখিনি।” সিফিলিসের সংক্রমণ যে কেবল যুক্তরাষ্ট্রে ঘটছে তা কিন্তু না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী সিফিলিসের ৭১ লক্ষ নতুন কেস ধরা পড়েছে। ২০২০ সালে ব্রিটেনে ১৯৪৮ সালের পর থেকে সিফিলিস কেস সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। সিফিলিস রোগ বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি যৌন স্বাস্থ্য বিষয়ক সেবা দানকারীরা একেবারে সামনে থেকে প্রত্যক্ষ করছেন।

ব্রিটেনের এসটিআই ফাউন্ডেশনের কো-চেয়ার জোডি ক্রসম্যান বিবিসিকে বলেন, “২০০৫ সালে যখন আমি প্রথমবারের যৌন স্বাস্থ্য নিয়ে নার্সিং শুরু করি, তখন প্রাথমিক পর্যায়ের সিফিলিস কেস খুঁজে পাওয়া ছিল খুবই বিরল, এমনকি শহরের কেন্দ্রস্থলের ক্লিনিকেও এটা দেখা যেতো না।” ২০২০ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে সিফিলিস সংক্রমণের হার ৮.৪% বেড়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এখন বেশিরভাগ শহর-ভিত্তিক ক্লিনিকগুলিতে প্রতিদিন কমপক্ষে দুই থেকে তিনজন রোগীকে সিফিলিস চিকিৎসার জন্য হাজির হতে দেখা যায়।”সিফিলিসের সংক্রমণ ঘটে ট্রেপোনেমা প্যালিডাম নামের একটি ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে। এই রোগের লক্ষণগুলোতে রয়েছে চারটি ধাপ। প্রথম ধাপে নারী বা পুরুষের যৌনাঙ্গে এক ধরনের ব্যথাহীন কালশিটে বা ফুসকুড়ি দেখা দেয়। এই পর্যায়ে পেনিসিলিন ইনজেকশনের একটি ইন্ট্রামাসকুলার ডোজ সংক্রমণের বিরুদ্ধে সবচেয়ে কার্যকর উপায় হিসেবে বিবেচিত হয়। তবে চিকিৎসা না করা হলে সিফিলিসের কারণে দীর্ঘমেয়াদী স্নায়বিক এবং কার্ডিওভাসকুলার রোগ হতে পারে।

কানাডায় ২০১১ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে সিফিলিস রোগের ঘটনা বেড়েছে ৩৮৯%, অন্যান্য যৌন রোগের সংক্রমণের তুলনায় যা অনেক বেশি। সা¤প্রতিক দশকগুলিতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সিফিলিসের ঘটনা ঘটছে সমকামী, উভকামী এবং অন্যান্য পুরুষদের মধ্যে যারা পুরুষদের সাথে যৌনসংগম করেন। তবে বিশ্বের কিছু দেশে পুরুষদের মধ্যে সিফিলিসের কেস কমে আসছে।

যেমন, কানাডায় পুরুষদের মধ্যে সিফিলিসের সংক্রমণের হার কমেছে। কিন্তু একই সময়ে শুধুমাত্র কানাডায় না, সারবিশ্বেই নারীদের মধ্যে সিফিলিসের হার বেড়েছে। এর ফলে অনেক দেশে এখন কনজেনিটাল সিফিলিসের হার বেড়েছে। উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশ জুড়ে ২০২১ সালে মা-থেকে শিশুর মধ্যে সিফিলিসের সংক্রমণের কেস ছিল ৩০,০০০টি।

গর্ভাবস্থায় মায়ের দেহ থেকে অনাগত শিশুর দেহে সিফিলিসের সংক্রমণ ঘটলে তার পরিণতি হতে পারে বিপর্যয়কর: প্রসূতির গর্ভপাত হতে পারে, মৃত সন্তান প্রসব কিংবা অকাল প্রসব ঘটতে পারে, নবজাতকের জন্মের সময় ওজন কম হতে পারে এবং জন্মের পরপরই শিশুর মৃত্যুও ঘটতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগত সিফিলিসের হার এখন বাড়ছে। ২০১৬ সালের তুলনায় ২০২০ সালে সিফিলিসের কেস বেড়েছে ৩.৫ গুণ। ২০২১ সালে এই হার আরও বেড়েছে, যার ফলে ঐ বছর ২২০ টি মৃত-প্রসব এবং শিশু মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।

সিফিলিস রোগের মহামারির পেছনে যেসব সমস্যা কারণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে তা হলো- যৌনরোগ পরীক্ষা কেন্দ্রে সেবা নিতে গিয়ে সমস্যা, সিফিলিসকে ঘিরে লজ্জা, সামাজিক কুসংস্কার এবং সম্ভবত ভাষাগত বাধা। ব্রাজিলের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, স্কুলে যাননি এমন কৃষ্ণাঙ্গ নারীদের মধ্যে জন্মগত সিফিলিসের হার অনেক বেশি। অনেক ক্ষেত্রেই, সিফিলিস স্ক্রিনিং করে এমন পরীক্ষাকেন্দ্রে গিয়ে সেবা নেওয়ার ক্ষেত্রে নারীদের সমস্যায় পড়তে হয়।

ক্যালিফোর্নিয়ার কার্ন কাউন্টির আরেকটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, কনজেনিটাল সিফিলিসের সংক্রমণ নির্ভর করছে নারীদের ইমিগ্রেশন স্ট্যাটাস, মেডিকেল ইনস্যুরেন্স, এবং গর্ভবতী মহিলাদের ওপর যৌন সহিংসতা কিংবা বাড়িতে সহিংসতার ওপর। এসব নারীদের মধ্যে অর্ধেকই হলেন হিস্প্যানিক, লাতিনো কিংবা স্প্যানিশ বংশোদ্ভূত।

অস্ট্রেলিয়ায় ২০২০ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, সিফিলিসের হার ২০১৫ সালের তুলনায় প্রায় ৯০% বৃদ্ধি পেয়েছে। যদিও জীবনযাত্রার ব্যয়-সংকট এবং কোভিড মহামারি নানা দেশের জনস্বাস্থ্য পরিষেবা খাতকে দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, সেখানে যৌন রোগ সংক্রমণের প্রতিও মানুষের আচরণ এবং দৃষ্টিভঙ্গিতেও পরিবর্তন ঘটেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এইচআইভি সংক্রমণের ঝুঁকি কমে আসায় কনডম ব্যবহার কিংবা যৌনরোগের বিরুদ্ধে অন্যান্য প্রতিরোধ নিতে মানুষের মধ্যে আগ্রহ এখন অনেকটাই কমে গেছে।

জাপানের গবেষকরা ডেটিং অ্যাপ এবং সিফিলিসের সঙ্গে সম্পর্ক থেকে মানুষের যৌন অভ্যাসের পরিবর্তন দিকটি বোঝার চেষ্টা করছেন। গবেষণা থেকে তারা এই উপসংহারে পৌঁছেছেন যে ডেটিং অ্যাপ ব্যবহারের সঙ্গে “সিফিলিস সংক্রমণের সম্পর্ক উল্লেখযোগ্য।“ এসব অ্যাপের ব্যবহারের ফলে অনিরাপদ যৌনমিলনের ঘটনা ক্রমশই বাড়ছে। সাসাকি চিওয়াওয়া, যিনি জাপানের যুব সম্প্রদায় এবং যৌন সংস্কৃতি নিয়ে লেখালেখি করেন, তিনিও যৌনকর্মীদের সাথে কথোপকথনের সময় একই চিত্র দেখতে পেয়েছেন।

চিওয়াওয়া বলেন, “এখন বেশি সংখ্যক যৌনকর্মীরা আর কনডম ব্যবহার করছেন না এবং তাদের গ্রাহকদের এসটিআই পরীক্ষারও কোনো বাধ্যবাধকতা নেই “ অন্যদিকে, যৌনকর্মীরা যদি সংক্রমিত হন, তখন তারা একে “দুর্ভাগ্য” বলে ধরে নেন। “স্বাস্থ্যের ঝুঁকির চেয়ে অর্থ উপার্জনকেই তারা অগ্রাধিকার দেন।”

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিফিলিস রোগের চিকিৎসায় অ্যান্টিবায়োটিক ও পেনিসিলিন এখনও বেশ কার্যকরী। তবে তারা বলছেন, নিরাপদ যৌন চর্চাকে উৎসাহিত করার জন্য আরও বেশি পরীক্ষার প্রয়োজন। সিফিলিসের সঙ্গে সামাজিক কুসংস্কার দূর করতে আরও বেশি করে প্রচারণার পাশাপাশি এই বিষয়টি নিয়ে জনসচেতনতাও বাড়াতে হবে। তবে বিজ্ঞানীরা এখনও পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেননি যে কেন অন্যান্য যৌনরোগের তুলনায় সিফিলিস বেশি দ্রুত হারে বাড়ছে।

সিডিসি’র যৌন রোগ প্রতিরোধ বিভাগের পরিচালক লিয়েন্ড্রো মেনা বলছেন, এই রোগের যেসব প্রচলিত জীবাণু রয়েছে সেগুলো যে আরও বেশি মারাত্মক হয়ে উঠেছে তারও কোন জোরালো প্রমাণ নেই। অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা কমে আসার সঙ্গে সিফিলিস সংক্রমণ বেড়েছে এই ব্যাখ্যাও মেনে নেওয়া যায় না বলে জানান কানাডার গবেষক আইজ্যাক বোগোচ।