ঢাকা ১০:০৭ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
ব্রেকিং নিউজঃ

পনেরোই আগস্টের শোকাবহ স্মৃতি

কমল চৌধুরী
  • Update Time : ০৮:৪৩:১১ অপরাহ্ন, সোমবার, ৭ অগাস্ট ২০২৩
  • / ৪৪ Time View

১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস পালিত হচ্ছে। পনেরোই আগস্ট বাঙালি ও বাংলাদেশের কালপঞ্জিতে একটি ঘৃণিত দিন। ১৯৭৫ সালের এই দিনে মানব সভ্যতার ইতিহাসের বর্বরতম হত্যাকাণ্ডের শিকার হয় বাঙালি জাতির সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

একই দিনে একই সময়ে আরো দুটি বাড়ি ,একটি সরকারি স্থাপনা ও মোহাম্মদপুরের বস্তিঘরে আক্রমণ চালিয়ে বঙ্গবন্ধুর আত্মীয়-স্বজনদের হত্যা করা হয়। খুনিদের ছোড়া গোলায় বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর সড়কের ৬৭৭ নম্বর বাড়ির উত্তরে সামান্য দূরে নিহত হন শিশুসহ ১৩ জন সাধারণ মানুষ।

ঐদিন বঙ্গবন্ধুর খুনিদের তিনটি মূল দলের একটি দলের নরঘাতকমেজর ডালিম মন্ত্রিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর আপন ভগ্নিপতি ও মন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বাড়িতে হত্যাকাণ্ড শেষ করে বাংলাদেশ বেতারের তৎকালীন শাহবাগ কেন্দ্রটি দখল করে কুৎসিত প্রচারণা চালায়।

পনেরোই আগস্ট ঘৃণিত এবং ধিক্কার জানানোর দিন হলেও আমরা বঙ্গবন্ধুর স্বজনদের আত্মত্যাগের আর্তি জানাই গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে। বঙ্গবন্ধুর জঘন্যতম এই হত্যাকাণ্ডের আরো যাঁরা শাহাদতবরণ করেন তারা হলেন- বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতুন নেছা রেণু, পুত্র শেখ কামাল, পুত্র শেখ জামাল, কনিষ্ঠ পুত্র কিশোর শেখ রিসাল উদ্দীন ওরফে রাসেল, পুত্রবধূ সুলতানা, পুত্রবধূ রোজী, বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত, সেরনিয়াবাতের পুত্র, কন্যা, নাতি ও ভাইপো যথাক্রমে কিশোরী বেবী, কিশোর আরিফ, সুকান্ত বাবু ও শহীদ। ধানমন্ডির একটি বাড়িতে প্রাণ হারান বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য ও যুব নেতা শেখ ফজলুল হক মণি, তার স্ত্রী আরজু মণি, আবদুর রব সেরনিয়াবাতের জ্যেষ্ঠ কন্যা এবং বঙ্গবন্ধুর বাড়ি আক্রান্ত হওয়ার পর উদ্ধার করতে আসা তার সামরিক সচিব বিগ্রেডিয়ার জেনারেল জামিল উদ্দীন আহমেদ।

বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে অপারেশন করার একই সময়ে খুনি মহিউদ্দীনের গোলায় মোহাম্মদপুরে নিহত হন- রিজিয়া বেগম, শিশু নাসিমা, রাশেদা বেগম, সাবেরা বেগম, আনোয়ারা বেগম, আনোয়ারা বেগম-২, সয়ফুল বিবি, হাবিবুর রহমান, আবদুল্লাহ রফিজল, শাহাবুদ্দীন ও আমিনুদ্দীন। আর বঙ্গবন্ধুর বাড়ি ও অন্য বাড়িতে নিহত পুলিশ পরিদর্শক সিদ্দিকুর রহমান, তিনজন অতিথি এবং চারজন গৃহকর্মী।বাঙালি জাতির সবচেয়ে শোকাবহ ও বেদনাঘন দিন ১৫ আগস্ট। প্রতিবছরই ফিরে ফিরে আসে মর্মন্তুদ দিনটি। এইদিন- নদী-মেখলার এই নরম-শ্যামল মাটির প্রতিটি বাঙালির হৃদয় কেঁদে ওঠে, মন ভারী হয়ে ওঠে, মননে আঘাত লাগে। কতিপয় মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী ও স্বাধীনতার পরাজিত শক্তি ছাড়া সকলের অন্তর পোড়ে সারাটা দিন। ঐদিন আরও বেশি কষ্টের জল ঝরে যখন সকলের কর্ণপ্রহরে প্রবেশ করে তাঁর বজ্রকণ্ঠের সেই বলিষ্ঠ উচ্চারণ-“তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে…রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেবো, এদেশকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ…এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে লক্ষ লক্ষ বাঙালির জনসমুদ্রে দেওয়া এই জগদ্বিখ্যাত ঐতিহাসিক অমর ভাষণটি যখন বাংলাদেশের পথে-প্রান্তরে, পাড়া-মহল্লায় মুজিব প্রেমিকরা বার বার বাজান তখন আমাদের চেতনার নির্জীব,মলিন ও মেঘাচ্ছন্ন পথটি রৌদ্রকরজ্জোল হয়ে ওঠে। তখন আবাল-বৃদ্ধ থেকে শুরু করে নবীন প্রজন্মের সকলেই মনে মনে হৃদয়-নিংড়ানো উচ্চারণ করেন-কেন এই বিশাল হৃদয়ের মানুষটিকে জঘন্য কায়দায় হত্যা করা হলো? কেন? কেন? কেন? অজস্র বার এই প্রশ্ন সকলের মনকে দগ্ধ করে। অনেকেই বলেন, বজ্রকণ্ঠের সেই প্রিয় মানুষটি আজ আমাদের নয়নের সমুখে নেই, বিশ্বাসই হতে চায় না যেন। যন্ত্রণায় যেন উচ্চারণ করেন রবীন্দ্রনাথের সেই হৃদয়-নিংড়ানো উচ্চারণ- ‘তুমি কী কেবলই ছবি, শুধু পটে আঁকা?’

আজ থেকে ৪৭ বছর আগে ১৯৭৫ সালের এই দিনে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা, মহান স্বাধীনতার রূপকার জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবার নির্মমভাবে হত্যা করে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারী ও স্বাধীনতা বিরোধী একদল কুচক্রী-ঘৃণ্য নরপশুর দল। যারা দেশপ্রেমিকবাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আদর্শ-বিচ্যুত স্বার্থবাদী ও বিকৃত মানসিকতার কয়েকজন সেনাসদস্য। এই ঘৃণ্য সদস্যরা ঐদিন ভোররাতে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের ঐতিহাসিক বাড়িতে ভারী অস্ত্রের আঘাতে বঙ্গবন্ধুসহ পরিবারের ১৭ জন মানুষকে এক এক করে নির্মমভাবে হত্যা করে। কাপুরুষোচিত এই হত্যাকাÐে বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবী স্তব্ধ হয়ে যায়। ইন্দোনেশিয়ার সুকর্ণ, কিউবার ফিদেল ক্যাস্ট্রো,যুগোস্লাভিয়ার মার্শাল টিটোসহ সে সময়কার সেরা সেরা রাষ্ট্রনায়ক ও সরকার প্রধানরা স্তম্ভিত,হতভম্ব,মর্মাহত হয়ে গিয়েছিলেন। ১৯৭৪ সালে যিনি জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দিয়েছিলেন। তিনি কমনওয়েলথ সম্মেলনের ভাষণে বলেছিলেন, পৃথিবী আজ দুই ভাগে বিভক্ত ,শোষিত ও শাসিত-আমি শোষিতের পক্ষে। এই উচ্চারণ শুনে বিশ্বনেতারা মুজিবের সাহসী ও মানবপ্রেমের শ্রেষ্ঠ আবেগের বহিঃপ্রকাশ দেখেছেন। কেউ বলেছেন, আমি হিমালয়কে দেখিনি কিন্তু মুজিবকে দেখলাম। কেউ বলেছেন,মুজিব হলেন রাজনীতির কবি।

আমাদের দেশের প্রখ্যাত কবি নির্মলেন্দু গুণও বঙ্গবন্ধুকে কবি আখ্যা দিয়ে তাঁর কবিতায় বলেছেন, ‘কখন আসবেন কবি…’। এই অমর কবি মাত্র ৫৫ বছরের জীবনে অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা, আন্দোলন-সংগ্রাম, জেল-জুলুম, অত্যাচার নির্যাতন সহ্য করে, মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে শোষিত বাঙালিদের জন্য এনে দিয়েছিলেন হাজার বছরের কাক্ষিত মুক্তি ও স্বাধীনতা। দীর্ঘ ২৪ বছরের পাকিস্তানি শোষণ, বঞ্চনা, অত্যাচার ও অবহেলা থেকে জাতিকে মুক্ত করার লক্ষ্যে স্বাধীনতার ডাক দিয়ে দীর্ঘ নয় মাস। পাকিস্তানের কারাগারের প্রকোষ্ঠে বন্দি ছিলেন। সেই কারাগারে তাকে মৃত্যুভয় দেখানো হলে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি বাঙালি, বাংলা আমার ভাষা, বাংলাদেশ আমার মাতৃভূমি।’

তিনি আরও এ বলেছিলেন যে, তাকে যদি কারাগারে মেরে ফেলা হয়, তবে তাঁর লাশ যেন বাংলার মাটিতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু সাহসী-বীর মুজিবকে পাকিস্তানি কুচক্রী মহল মারতে পারেনি। অথচ দেশীয় কুচক্রীরা আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের সহায়তায় মুজিবকে হত্যা করল তার আপন আলয় ৩২ নম্বরের সেই বিখ্যাত বাড়িতে আর স্বাধীন সার্বভৌম দেশের মাটিতে। ভাবা যায়! বাঙালি জাতির জন্য যার জীবনের এক চতুর্থাংশ সময় জেলে কেটেছে, জাতির সেই মহানায়ক হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অমর স্মৃতি বাঙালির হৃদযে চির অম্লান থাকবে। পনেরোই আগস্টের শোকাবহ স্মৃতি বাঙালি জাতি কখনো ভুলবে না।

Please Share This Post in Your Social Media

পনেরোই আগস্টের শোকাবহ স্মৃতি

Update Time : ০৮:৪৩:১১ অপরাহ্ন, সোমবার, ৭ অগাস্ট ২০২৩

১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস পালিত হচ্ছে। পনেরোই আগস্ট বাঙালি ও বাংলাদেশের কালপঞ্জিতে একটি ঘৃণিত দিন। ১৯৭৫ সালের এই দিনে মানব সভ্যতার ইতিহাসের বর্বরতম হত্যাকাণ্ডের শিকার হয় বাঙালি জাতির সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

একই দিনে একই সময়ে আরো দুটি বাড়ি ,একটি সরকারি স্থাপনা ও মোহাম্মদপুরের বস্তিঘরে আক্রমণ চালিয়ে বঙ্গবন্ধুর আত্মীয়-স্বজনদের হত্যা করা হয়। খুনিদের ছোড়া গোলায় বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর সড়কের ৬৭৭ নম্বর বাড়ির উত্তরে সামান্য দূরে নিহত হন শিশুসহ ১৩ জন সাধারণ মানুষ।

ঐদিন বঙ্গবন্ধুর খুনিদের তিনটি মূল দলের একটি দলের নরঘাতকমেজর ডালিম মন্ত্রিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর আপন ভগ্নিপতি ও মন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বাড়িতে হত্যাকাণ্ড শেষ করে বাংলাদেশ বেতারের তৎকালীন শাহবাগ কেন্দ্রটি দখল করে কুৎসিত প্রচারণা চালায়।

পনেরোই আগস্ট ঘৃণিত এবং ধিক্কার জানানোর দিন হলেও আমরা বঙ্গবন্ধুর স্বজনদের আত্মত্যাগের আর্তি জানাই গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে। বঙ্গবন্ধুর জঘন্যতম এই হত্যাকাণ্ডের আরো যাঁরা শাহাদতবরণ করেন তারা হলেন- বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতুন নেছা রেণু, পুত্র শেখ কামাল, পুত্র শেখ জামাল, কনিষ্ঠ পুত্র কিশোর শেখ রিসাল উদ্দীন ওরফে রাসেল, পুত্রবধূ সুলতানা, পুত্রবধূ রোজী, বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত, সেরনিয়াবাতের পুত্র, কন্যা, নাতি ও ভাইপো যথাক্রমে কিশোরী বেবী, কিশোর আরিফ, সুকান্ত বাবু ও শহীদ। ধানমন্ডির একটি বাড়িতে প্রাণ হারান বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য ও যুব নেতা শেখ ফজলুল হক মণি, তার স্ত্রী আরজু মণি, আবদুর রব সেরনিয়াবাতের জ্যেষ্ঠ কন্যা এবং বঙ্গবন্ধুর বাড়ি আক্রান্ত হওয়ার পর উদ্ধার করতে আসা তার সামরিক সচিব বিগ্রেডিয়ার জেনারেল জামিল উদ্দীন আহমেদ।

বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে অপারেশন করার একই সময়ে খুনি মহিউদ্দীনের গোলায় মোহাম্মদপুরে নিহত হন- রিজিয়া বেগম, শিশু নাসিমা, রাশেদা বেগম, সাবেরা বেগম, আনোয়ারা বেগম, আনোয়ারা বেগম-২, সয়ফুল বিবি, হাবিবুর রহমান, আবদুল্লাহ রফিজল, শাহাবুদ্দীন ও আমিনুদ্দীন। আর বঙ্গবন্ধুর বাড়ি ও অন্য বাড়িতে নিহত পুলিশ পরিদর্শক সিদ্দিকুর রহমান, তিনজন অতিথি এবং চারজন গৃহকর্মী।বাঙালি জাতির সবচেয়ে শোকাবহ ও বেদনাঘন দিন ১৫ আগস্ট। প্রতিবছরই ফিরে ফিরে আসে মর্মন্তুদ দিনটি। এইদিন- নদী-মেখলার এই নরম-শ্যামল মাটির প্রতিটি বাঙালির হৃদয় কেঁদে ওঠে, মন ভারী হয়ে ওঠে, মননে আঘাত লাগে। কতিপয় মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী ও স্বাধীনতার পরাজিত শক্তি ছাড়া সকলের অন্তর পোড়ে সারাটা দিন। ঐদিন আরও বেশি কষ্টের জল ঝরে যখন সকলের কর্ণপ্রহরে প্রবেশ করে তাঁর বজ্রকণ্ঠের সেই বলিষ্ঠ উচ্চারণ-“তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে…রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেবো, এদেশকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ…এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে লক্ষ লক্ষ বাঙালির জনসমুদ্রে দেওয়া এই জগদ্বিখ্যাত ঐতিহাসিক অমর ভাষণটি যখন বাংলাদেশের পথে-প্রান্তরে, পাড়া-মহল্লায় মুজিব প্রেমিকরা বার বার বাজান তখন আমাদের চেতনার নির্জীব,মলিন ও মেঘাচ্ছন্ন পথটি রৌদ্রকরজ্জোল হয়ে ওঠে। তখন আবাল-বৃদ্ধ থেকে শুরু করে নবীন প্রজন্মের সকলেই মনে মনে হৃদয়-নিংড়ানো উচ্চারণ করেন-কেন এই বিশাল হৃদয়ের মানুষটিকে জঘন্য কায়দায় হত্যা করা হলো? কেন? কেন? কেন? অজস্র বার এই প্রশ্ন সকলের মনকে দগ্ধ করে। অনেকেই বলেন, বজ্রকণ্ঠের সেই প্রিয় মানুষটি আজ আমাদের নয়নের সমুখে নেই, বিশ্বাসই হতে চায় না যেন। যন্ত্রণায় যেন উচ্চারণ করেন রবীন্দ্রনাথের সেই হৃদয়-নিংড়ানো উচ্চারণ- ‘তুমি কী কেবলই ছবি, শুধু পটে আঁকা?’

আজ থেকে ৪৭ বছর আগে ১৯৭৫ সালের এই দিনে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা, মহান স্বাধীনতার রূপকার জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবার নির্মমভাবে হত্যা করে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারী ও স্বাধীনতা বিরোধী একদল কুচক্রী-ঘৃণ্য নরপশুর দল। যারা দেশপ্রেমিকবাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আদর্শ-বিচ্যুত স্বার্থবাদী ও বিকৃত মানসিকতার কয়েকজন সেনাসদস্য। এই ঘৃণ্য সদস্যরা ঐদিন ভোররাতে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের ঐতিহাসিক বাড়িতে ভারী অস্ত্রের আঘাতে বঙ্গবন্ধুসহ পরিবারের ১৭ জন মানুষকে এক এক করে নির্মমভাবে হত্যা করে। কাপুরুষোচিত এই হত্যাকাÐে বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবী স্তব্ধ হয়ে যায়। ইন্দোনেশিয়ার সুকর্ণ, কিউবার ফিদেল ক্যাস্ট্রো,যুগোস্লাভিয়ার মার্শাল টিটোসহ সে সময়কার সেরা সেরা রাষ্ট্রনায়ক ও সরকার প্রধানরা স্তম্ভিত,হতভম্ব,মর্মাহত হয়ে গিয়েছিলেন। ১৯৭৪ সালে যিনি জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দিয়েছিলেন। তিনি কমনওয়েলথ সম্মেলনের ভাষণে বলেছিলেন, পৃথিবী আজ দুই ভাগে বিভক্ত ,শোষিত ও শাসিত-আমি শোষিতের পক্ষে। এই উচ্চারণ শুনে বিশ্বনেতারা মুজিবের সাহসী ও মানবপ্রেমের শ্রেষ্ঠ আবেগের বহিঃপ্রকাশ দেখেছেন। কেউ বলেছেন, আমি হিমালয়কে দেখিনি কিন্তু মুজিবকে দেখলাম। কেউ বলেছেন,মুজিব হলেন রাজনীতির কবি।

আমাদের দেশের প্রখ্যাত কবি নির্মলেন্দু গুণও বঙ্গবন্ধুকে কবি আখ্যা দিয়ে তাঁর কবিতায় বলেছেন, ‘কখন আসবেন কবি…’। এই অমর কবি মাত্র ৫৫ বছরের জীবনে অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা, আন্দোলন-সংগ্রাম, জেল-জুলুম, অত্যাচার নির্যাতন সহ্য করে, মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে শোষিত বাঙালিদের জন্য এনে দিয়েছিলেন হাজার বছরের কাক্ষিত মুক্তি ও স্বাধীনতা। দীর্ঘ ২৪ বছরের পাকিস্তানি শোষণ, বঞ্চনা, অত্যাচার ও অবহেলা থেকে জাতিকে মুক্ত করার লক্ষ্যে স্বাধীনতার ডাক দিয়ে দীর্ঘ নয় মাস। পাকিস্তানের কারাগারের প্রকোষ্ঠে বন্দি ছিলেন। সেই কারাগারে তাকে মৃত্যুভয় দেখানো হলে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি বাঙালি, বাংলা আমার ভাষা, বাংলাদেশ আমার মাতৃভূমি।’

তিনি আরও এ বলেছিলেন যে, তাকে যদি কারাগারে মেরে ফেলা হয়, তবে তাঁর লাশ যেন বাংলার মাটিতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু সাহসী-বীর মুজিবকে পাকিস্তানি কুচক্রী মহল মারতে পারেনি। অথচ দেশীয় কুচক্রীরা আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের সহায়তায় মুজিবকে হত্যা করল তার আপন আলয় ৩২ নম্বরের সেই বিখ্যাত বাড়িতে আর স্বাধীন সার্বভৌম দেশের মাটিতে। ভাবা যায়! বাঙালি জাতির জন্য যার জীবনের এক চতুর্থাংশ সময় জেলে কেটেছে, জাতির সেই মহানায়ক হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অমর স্মৃতি বাঙালির হৃদযে চির অম্লান থাকবে। পনেরোই আগস্টের শোকাবহ স্মৃতি বাঙালি জাতি কখনো ভুলবে না।