ঢাকা ০৬:২৩ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

নাব্যতা সংকটে সিলেটের সুরমার উৎসমুখ আমলসীদ

মো.মুহিবুর রহমান, সিলেট
  • Update Time : ০২:৫৭:১৪ অপরাহ্ন, সোমবার, ১১ মার্চ ২০২৪
  • / ৩৯ Time View

ভরাট হয়ে নাব্যতা সংকটে পড়েছে দেশের দীর্ঘতম নদী সুরমার উৎসমুখ সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার আমলসীদ এলাকা। একারনে বছরের আট মাসই পানি থাকে না সুরমা নদীতে।

এ ছাড়া উৎসমুখ থেকে ৩২ কিলো মিটারের মধ্যে নদীতে জেগেছে অন্তত ৩৫টি চর। এতে বিপাকে পড়েছেন নদী তীরবর্তী মানুষ। নদীর গতিপথ বদলে যাওয়াসহ কৃষিখাতেও পড়েছে নেতিবাচক প্রভাব। আবার বর্ষা মৌসুমে নদী উপচে তলিয়ে যায় আশপাশের এলাকা। পুরো সিলেটজুড়েই তখন দেখা দেয় ভয়াবহ বন্যা।স্থানীয় এলাকাবাসী ও পরিবেশ কর্মীরা দীর্ঘদিন থেকেই এই নদীর উৎসমুখ খননের দাবি জানিয়ে আসছেন।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারাও মনে করেন, দ্রুত নদীটির উৎসমুখ খনন করা প্রয়োজন। তবে সীমান্ত নদী হওয়ায় যৌথ নদী কমিশনের মাধ্যমে এই নদী খনন করতে হবে বলে জানান তারা।

পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্র জানায়, প্রায় ২৪৯ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের সুরমা দেশের দীর্ঘতম নদী। ভারতের আসাম রাজ্য থেকে বরাক নদী সিলেটের জকিগঞ্জের অমলসীদ এসে সুরমা ও কুশিয়ারা নামে দুই ভাগে বিভক্ত হয়েছে। সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে সুরমা নদী মেঘনায় মিলিত হয়েছে।তবে বছরের পর বছর ধরে পলি জমে ভরাট হয়ে গেছে বরাক ও সুরমার সংযোগস্থল। ফলে বরাক থেকে আসা পানি সুরমায় না এসে চলে যায় কুশিয়ারায়। এতে বর্ষাকালের কয়েকমাস ছাড়া সারা বছরই পানিশূন্য থাকে এক সময়ের খরস্রোতা নদী সুরমা।শুষ্ক মৌসুমে নদীজুড়ে অসংখ্য চর জেগে ওঠে। ফলে হেঁটেই পার হওয়া যায় নদী। এ সময় বন্ধ হয়ে পড়ে নৌ চলাচল। নদী তীরবর্তী মানুষদের জীবিকারও অন্যতম উৎস সুরমা। পানিশূন্য হয়ে পড়ায় জকিগঞ্জ, কানাইঘাট, সিলেট সদর, গোলাপগঞ্জ উপজেলার নদীপাড়ের কৃষি ও মৎস্যজীবী মানুষেরা পড়েছেন বিপাকে। সিলেট নগরীর শাহজালাল সেতু থেকে দক্ষিণ সুরমার কুচাই পর্যন্ত দীর্ঘ এলাকাজুড়ে জেগেছে বিশাল চর। চরের ওপর কোথাও গজিয়েছে সবুজ ঘাস। দেখে মনে হবে খেলার মাঠ। নদীর দু’পাশ দিয়ে বইছে সরু পানির ধারা। শুধু নগরীর আশপাশের এই এলাকাতেই এই অবস্থা নয়, এই নদীর পুরোটাজুড়েই এখন এমন করুণ দশা।

পাউবো সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ জানান, উৎসমুখ ভরাট হয়ে যাওয়ায় বর্ষকালে বরাক থেকে আসা পানির মাত্র ৫ থেকে ১০ শতাংশ সুরমায় প্রবেশ করে। আর অন্যান্য মৌসুমে পানি প্রবেশ করে না বললেই চলে, সব পানি চলে যায় কুশিয়ারায়। ফলে বছরের প্রায় আট মাসই পানিশূন্য থাকে সুরমা। এই সময় কানাইঘাটের লোভা পর্যন্ত পুরো নদী মরে যায়।

তিনি জানান, পানি শূন্যতার কারণে জকিগঞ্জের অমলসীদ থেকে কানাইঘাট উপজেলার ৩২ কিলোমিটার এলাকায় ৩৫টি চর জেগে উঠেছে। নদীর বাকি অংশেও এখন অসংখ্য চর জাগছে। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেটের সাধারণ সম্পাদক ও সুরমা রিভার ওয়াটার কিপার আব্দুল করিম কিম জানান, ‘শুষ্ক মৌসুমে সুরমা নদীতে যে সামান্য পানি দেখা যায়, তা বরাক থেকে আসে না। এগুলো লোভা নদীর পানি। সুরমা কানাইঘাটে এসে লোভার সঙ্গে মিশেছে।’

তিনি বলেন, ‘এক যুগ আগে থেকে সুরমার উৎসমুখ ভরাট হওয়া শুরু হয়েছে। গত কয়েক বছরে তা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এভাবে চলতে থাকলে এক সময় সুরমা মরা গাঙে পরিণত হবে।’ ২০২২ সালে সিলেট অঞ্চলে ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়। বন্যার এই তীব্রতার জন্যও সুরমার ভরাট হয়ে যাওয়াকে দায়ী করা হয়। ওই বন্যার পর ২০২৩ সালে প্রায় ৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে সিলেট নগরী ও আশপাশের ১৮ কিলোমিটার এলাকায় সুরমা নদী খনন করা হয়। তবে পুরো নদী খনন করা না হলে তেমন সুফল মিলবে না বলে দাবি বিশেষজ্ঞদের।

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ও পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক, নগর পরিকল্পনাবিদ ড. জহির বিন আলম জানান, ‘পুরো সুরমা নদী একসঙ্গে খনন করা প্রয়োজন। বিশেষত উৎসমুখ খনন করা জরুরি। তা নাহলে কোনো সুফল পাওয়া যাবে না।’

জকিগঞ্জের বারোঠাকুরী ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মহসিন মর্তুজা চৌধুরী জানান, ‘নদী পানিশূন্য হয়ে পড়ায় এ অঞ্চলের কৃষিজীবী ও মৎস্যজীবীরা বিপাকে পড়েছেন। কমে এসেছে ফসল উৎপাদন। সেচের অভাবে অনেক জমিতেই এখন উৎপাদন আর আগের মতো হয় না।’তিনি বলেন, ‘শুষ্ক মৌসুমে পানি পাওয়া যায় না, আবার তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ায় বর্ষা মৌসুমে কয়েক দিনের বৃষ্টিতেই নদী ভরে বন্যা দেখা দেয়।’ এছাড়া উৎসমুখে পলি জমায় দিন দিন নদীর গতিপথও পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে জানিয়ে তিনি দ্রুত উৎসমুখ খননের দাবি জানান।

পাউবো সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশও মনে করেন সুরমার উৎসমুখ দ্রুত খনন করা প্রয়োজন। তিনি বলেন, ‘আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এ ব্যাপারে আলোচনা করছি। একাধিক প্রকল্প প্রস্তাবনা ও মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া আছে, কিন্তু এই নদী ভারত থেকে এসেছে। প্রথম ২৫ কিলোমিটার সীমান্ত লাইন দিয়ে গেছে। ফলে নদী খননের জন্য যৌথ নদী কমিশন থেকে উদ্যোগ নিতে হবে।’

Please Share This Post in Your Social Media

নাব্যতা সংকটে সিলেটের সুরমার উৎসমুখ আমলসীদ

Update Time : ০২:৫৭:১৪ অপরাহ্ন, সোমবার, ১১ মার্চ ২০২৪

ভরাট হয়ে নাব্যতা সংকটে পড়েছে দেশের দীর্ঘতম নদী সুরমার উৎসমুখ সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার আমলসীদ এলাকা। একারনে বছরের আট মাসই পানি থাকে না সুরমা নদীতে।

এ ছাড়া উৎসমুখ থেকে ৩২ কিলো মিটারের মধ্যে নদীতে জেগেছে অন্তত ৩৫টি চর। এতে বিপাকে পড়েছেন নদী তীরবর্তী মানুষ। নদীর গতিপথ বদলে যাওয়াসহ কৃষিখাতেও পড়েছে নেতিবাচক প্রভাব। আবার বর্ষা মৌসুমে নদী উপচে তলিয়ে যায় আশপাশের এলাকা। পুরো সিলেটজুড়েই তখন দেখা দেয় ভয়াবহ বন্যা।স্থানীয় এলাকাবাসী ও পরিবেশ কর্মীরা দীর্ঘদিন থেকেই এই নদীর উৎসমুখ খননের দাবি জানিয়ে আসছেন।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারাও মনে করেন, দ্রুত নদীটির উৎসমুখ খনন করা প্রয়োজন। তবে সীমান্ত নদী হওয়ায় যৌথ নদী কমিশনের মাধ্যমে এই নদী খনন করতে হবে বলে জানান তারা।

পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্র জানায়, প্রায় ২৪৯ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের সুরমা দেশের দীর্ঘতম নদী। ভারতের আসাম রাজ্য থেকে বরাক নদী সিলেটের জকিগঞ্জের অমলসীদ এসে সুরমা ও কুশিয়ারা নামে দুই ভাগে বিভক্ত হয়েছে। সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে সুরমা নদী মেঘনায় মিলিত হয়েছে।তবে বছরের পর বছর ধরে পলি জমে ভরাট হয়ে গেছে বরাক ও সুরমার সংযোগস্থল। ফলে বরাক থেকে আসা পানি সুরমায় না এসে চলে যায় কুশিয়ারায়। এতে বর্ষাকালের কয়েকমাস ছাড়া সারা বছরই পানিশূন্য থাকে এক সময়ের খরস্রোতা নদী সুরমা।শুষ্ক মৌসুমে নদীজুড়ে অসংখ্য চর জেগে ওঠে। ফলে হেঁটেই পার হওয়া যায় নদী। এ সময় বন্ধ হয়ে পড়ে নৌ চলাচল। নদী তীরবর্তী মানুষদের জীবিকারও অন্যতম উৎস সুরমা। পানিশূন্য হয়ে পড়ায় জকিগঞ্জ, কানাইঘাট, সিলেট সদর, গোলাপগঞ্জ উপজেলার নদীপাড়ের কৃষি ও মৎস্যজীবী মানুষেরা পড়েছেন বিপাকে। সিলেট নগরীর শাহজালাল সেতু থেকে দক্ষিণ সুরমার কুচাই পর্যন্ত দীর্ঘ এলাকাজুড়ে জেগেছে বিশাল চর। চরের ওপর কোথাও গজিয়েছে সবুজ ঘাস। দেখে মনে হবে খেলার মাঠ। নদীর দু’পাশ দিয়ে বইছে সরু পানির ধারা। শুধু নগরীর আশপাশের এই এলাকাতেই এই অবস্থা নয়, এই নদীর পুরোটাজুড়েই এখন এমন করুণ দশা।

পাউবো সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ জানান, উৎসমুখ ভরাট হয়ে যাওয়ায় বর্ষকালে বরাক থেকে আসা পানির মাত্র ৫ থেকে ১০ শতাংশ সুরমায় প্রবেশ করে। আর অন্যান্য মৌসুমে পানি প্রবেশ করে না বললেই চলে, সব পানি চলে যায় কুশিয়ারায়। ফলে বছরের প্রায় আট মাসই পানিশূন্য থাকে সুরমা। এই সময় কানাইঘাটের লোভা পর্যন্ত পুরো নদী মরে যায়।

তিনি জানান, পানি শূন্যতার কারণে জকিগঞ্জের অমলসীদ থেকে কানাইঘাট উপজেলার ৩২ কিলোমিটার এলাকায় ৩৫টি চর জেগে উঠেছে। নদীর বাকি অংশেও এখন অসংখ্য চর জাগছে। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেটের সাধারণ সম্পাদক ও সুরমা রিভার ওয়াটার কিপার আব্দুল করিম কিম জানান, ‘শুষ্ক মৌসুমে সুরমা নদীতে যে সামান্য পানি দেখা যায়, তা বরাক থেকে আসে না। এগুলো লোভা নদীর পানি। সুরমা কানাইঘাটে এসে লোভার সঙ্গে মিশেছে।’

তিনি বলেন, ‘এক যুগ আগে থেকে সুরমার উৎসমুখ ভরাট হওয়া শুরু হয়েছে। গত কয়েক বছরে তা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এভাবে চলতে থাকলে এক সময় সুরমা মরা গাঙে পরিণত হবে।’ ২০২২ সালে সিলেট অঞ্চলে ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়। বন্যার এই তীব্রতার জন্যও সুরমার ভরাট হয়ে যাওয়াকে দায়ী করা হয়। ওই বন্যার পর ২০২৩ সালে প্রায় ৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে সিলেট নগরী ও আশপাশের ১৮ কিলোমিটার এলাকায় সুরমা নদী খনন করা হয়। তবে পুরো নদী খনন করা না হলে তেমন সুফল মিলবে না বলে দাবি বিশেষজ্ঞদের।

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ও পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক, নগর পরিকল্পনাবিদ ড. জহির বিন আলম জানান, ‘পুরো সুরমা নদী একসঙ্গে খনন করা প্রয়োজন। বিশেষত উৎসমুখ খনন করা জরুরি। তা নাহলে কোনো সুফল পাওয়া যাবে না।’

জকিগঞ্জের বারোঠাকুরী ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মহসিন মর্তুজা চৌধুরী জানান, ‘নদী পানিশূন্য হয়ে পড়ায় এ অঞ্চলের কৃষিজীবী ও মৎস্যজীবীরা বিপাকে পড়েছেন। কমে এসেছে ফসল উৎপাদন। সেচের অভাবে অনেক জমিতেই এখন উৎপাদন আর আগের মতো হয় না।’তিনি বলেন, ‘শুষ্ক মৌসুমে পানি পাওয়া যায় না, আবার তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ায় বর্ষা মৌসুমে কয়েক দিনের বৃষ্টিতেই নদী ভরে বন্যা দেখা দেয়।’ এছাড়া উৎসমুখে পলি জমায় দিন দিন নদীর গতিপথও পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে জানিয়ে তিনি দ্রুত উৎসমুখ খননের দাবি জানান।

পাউবো সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশও মনে করেন সুরমার উৎসমুখ দ্রুত খনন করা প্রয়োজন। তিনি বলেন, ‘আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এ ব্যাপারে আলোচনা করছি। একাধিক প্রকল্প প্রস্তাবনা ও মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া আছে, কিন্তু এই নদী ভারত থেকে এসেছে। প্রথম ২৫ কিলোমিটার সীমান্ত লাইন দিয়ে গেছে। ফলে নদী খননের জন্য যৌথ নদী কমিশন থেকে উদ্যোগ নিতে হবে।’