ঢাকা ১১:৫১ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
ব্রেকিং নিউজঃ

টানা ৫দিন পানিবন্দি মানুষের দুর্ভোগ

মোঃ ইব্রাহিম শেখ, চট্রগ্রাম ব্যুরো
  • Update Time : ১২:৫৭:০৬ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৯ অগাস্ট ২০২৩
  • / ৯৩ Time View

ঘরে পানি। রান্নাঘরে চুলা জ্বালানোর সুযোগ নেই। বাধ্য হয়ে অনেকে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে চলে গেছেন। যারা কষ্ট করে আছেন তারা দোকান থেকে কিনে খাচ্ছেন’।
গত সোমবার দুপুরে নগরের চকবাজার কাপাসগোলা মুহাম্মদ আলী শাহ দরগাহ লেইনের বাসিন্দা আবদুল হামিদ ওই এলাকার সামগ্রিক চিত্র তুলে ধরে এ কথা বলেন ।

তিনি জানান, সোমবারসহ টানা চারদিন পানিবন্দি হয়ে আছেন ওই এলাকার লোকজন। অবশ্য বিকেলে থেকে পানি নামতে শুরু করে সেখানে।
শুধু মুহাম্মদ আলী শাহ লেইন না। পুরো নগরের নিম্নাঞ্চলগুলোর চিত্র একই। অতিবৃষ্টি ও জোয়ারের কারণে সৃষ্ট জলাবদ্ধতায় আজসহ টানা ৫দিন কার্যত পানিবন্দি ছিলেন তারা। এসময় বিশুদ্ধ পানির সংকট তৈরি হয়। একইসঙ্গে ঘরে পানি ঢুকে যাওয়ায় ব্যাহত হয় রান্নাসহ দৈনন্দিন কাজকর্ম। কিছু কিছু এলাকায় অবশ্য বৃষ্টি থামলে পানি নেমে যায়। বৃষ্টি শুরু হলে আবার পানি জমে গিয়েছিল। সবমিলিয়ে দুর্ভোগে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেন নগরবাসী। সরেজমিন পরিদর্শনে গতকাল দুপুরেও বহু সড়কে পানি দেখা গেছে। হাঁটু থেকে কোমর সমান পানি ছিল এদিনও। কিছু এলাকায় সড়কে জমে যাওয়া পানিতে জাল দিয়ে মাছ ধরেন লোকজন। যাতায়াতে ব্যবহার করা হয় নৌকা।

এছাড়া সোমবার (৭ আগস্ট) নগরের দেড়শ’র অধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। মঙ্গলবার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর।

খালে পানি নেই, তবু ডুবে আছে সড়ক : সোমবার সকাল প্রায় ১১টা পর্যন্ত ডুবেছিল মুরাদপুর সংলগ্ন মোহাম্মদপুর সড়ক। অথচ এই সময়ে সড়ক সংলগ্ন চশমা খালে পানির স্তর ছিল অনেক নিচে। শুধু সোমবার নয়, গত কয়েকদিন ধরে এ চিত্র ছিল সেখানে। এর কারণ হিসেবে জানা গেছে, মোহাম্মদপুর সড়কটির পানি ছোট্ট একটি নালা দিয়ে প্রবাহিত হয়ে পড়ে চশমা খালে। গত কয়েক বছর ধরে এ নালাটি পরিষ্কার করেনি কোনো সংস্থা। ফলে ভরাট হয়ে যায় নালাটি। তাই নিষ্কাশনের পথ বন্ধ থাকায় স্বাভাবিকভাবেই ডুবে যায় সড়ক।

সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা গেছে, এ সড়কের মুখে চশমা খালের উপর একটি কালভার্ট আছে। সে কালভার্ট পার হওয়া মাত্রই হাঁটু থেকে কোমর সমান পানি। গত তিন দিনে জলাবদ্ধতায় সড়কের দুইপাশের প্রায় প্রতিটি দোকানে ও বাসায় পানি ঢুকেছে। নষ্ট হয়েছে অনেক দোকানের মালামাল। বাসায় পানি ঢোকায় বসতিদের ভোগান্তি ছিল চরমে। অনেক বাসার নিচতলায় থাকা পানির মোটর নষ্ট হয়ে যায়। এতে ভবনে পানি তুলতে না পারায় সংকট তৈরি হয় খাবার এবং ব্যবহারের পানির।
স্থানীয়দের অভিযোগ, চশমা খাল সিডিএ’র মেগা প্রকল্পের আওতায় হলেও মোহাম্মদপুর সড়কের নালা পরিষ্কারের দায়িত্ব চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের। দীর্ঘ কয়েক বছর নালাটি পরিস্কার করেনি সংস্থাটি। তাই খালে পানি কম থাকলেও খাল থেকে উঁচু সড়কজুড়ে জলাবদ্ধতা হয়।

সড়কে মাছ ধরছেন লোকজন : পুরাতন চান্দগাঁও সিএন্ডবি এলাকায় গতকালও ডুবেছিল সড়ক। দুপুরে সেখানে হাতজাল দিয়ে স্থানীয়দের মাছ ধরতে দেখা গেছে। একই সময়ে বহাদ্দারহাট মৌলভী পুকুর পাড় এলাকায় একসঙ্গে পাঁচ–ছয় জনকে রাস্তায় জাল মেরে মাছ ধরার কথা জানান প্রত্যক্ষদর্শীরা। অঙিজেন–কুয়াইশ সড়কেও জাল দিয়ে মাছ ধরার ছবি ফেসবুকে পোস্ট করেছেন রেজাউল নামে এক পথচারী। এছাড়া হালিশহর, বাকলিয়াসহ আরো কয়েকটি এলাকায় ডুবে যাওয়া সড়কে জাল দিয়ে মাছ ধরার কথা জানান স্থানীয়রা।

সড়কে নৌকা : হালিশহর জেলা পুলিশ লেইন পানিতে ডুবে যায়। সেখানে যাতায়াতে ব্যবহার করা হয় নৌকা। শমসের পাড়া এলাকায়ও নৌকায় পানিবন্দি লোকজনের যাতায়াত করার খবর পাওয়া গেছে।

পানিবন্দি মানুষের দুর্ভোগ : গতকাল দুপুরে জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া মাদ্রাসার মাঠে এবং সামনের সড়কে হাঁটুর বেশি পানি দেখা গেছে। ওই এলাকার বেশিরভাগ বাসা–বাড়ির নিচতলায় পানি ঢুকে যাওয়ায় সীমাহীন দুর্ভোগ ছিল স্থানীয়দের। চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সুন্নিয়া মাদ্রাসায় অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা হোস্টেল এবং আশেপাশের এলাকায় ব্যাচেলর বাসায় থাকেন। ব্যাচেলর বাসায় পানি ঢুকে যাওয়ায় রান্না করতে পারেননি বেশিরভাগ শিক্ষার্থী। একইসঙ্গে পানির জন্য খাবারের দোকান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি স্থানীয়দেরও ভোগান্তি হয়।

সোমবার দুপুরের দিকে প্রায় কোমর সমান পানি ছিল নগরের শান্তিবাগ আবাসিক এলাকায়। স্থানীয় বাসিন্দা রাশেদ জানান, পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন এলাকার লোকজন।
পশ্চিম মোহরার বাসিন্দা খোরশেদ আলমদার বলেন, বাসা–বাড়িতে পানি ঢুকে গেছে। অতীতে পানি উঠেনি এমন এলাকাও ডুবেছে। মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে। অনন্যা আবাসিক এলাকা, পশ্চিম কুয়াইশ, শিকারপুর ইউনিয়ন, অনন্যা আবাসিক এলাকা সংলগ্ন লালাচন্দ্র বিল, পশ্চিম বাথুয়া, পশ্চিম মোহরা, বাড়িয়াপাড়া নিয়ে বিশাল এলাকজুড়ে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। ওই এলাকার পানি প্রবাহের অন্যতম মাধ্যম কৃষ্ণ খাল ও কুয়াইশ খাল দীর্ঘদিন ভরাট হয়ে আছে। খাল দুটি ডাস্টবিনে পরিণত হয়েছে। এতে পানি নিষ্কাশনে বাধাগ্রস্ত হওয়ায় বিশাল এলাকাজুড়ে জলাবদ্ধতা হচ্ছে। পশ্চিম মোহরা গোলাপের দোকান সংলগ্ন ব্রিজের নিচে বিভিন্ন সেবা সংস্থার পাইপ গেছে। সেখানেও ময়লা জমে থাকে।

স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, গতকাল বিকেলেও চকবাজার কাপাসগোলা মুহাম্মদ আলী শাহ দরগাহ লেইন এলাকায় অনেক ঘরে পানি ছিল। সন্ধ্যার পর থেকে পানি নামতে শুরু করে। এছাড়া রাত পৌনে ৮টার দিকেও কে বি আমান আলী রোড, ওমর আলী মাতব্বর রোড, ফুলতলা, সৈয়দ শাহ রোড, রাহাত্তারপুল, মাজারগেইট, শান্তিনগর, আশেপাশের এলাকার সড়কে পানি ছিল।

এছাড়া বিকেলেও ফুলতলা, বিএড কলেজ গেইট, পূর্ব ষোলশহর, ঘাসিয়ার পাড়া, বাদশা চেয়ারম্যান ঘাটা, বারইপাড়া, বাদুরতলা, ষোলকবহর, বড় গ্যারেজ, নতুন চান্দগাঁও থানা, বড় কবরস্থান, পুলিশ বিট, মাজার গেইট, বগার বিল, শান্তি নগর, কাজী অফিস, পশ্চিম বাকলিয়া ডিসি রোড, ফালাহ গাজী মসজিদ থেকে ডিসি রোড হয়ে মিয়ার বাপের মসজিদ পর্যন্ত, আবদুল লতিফ বাই লেইন, চকবাজার আধুনিক চক সুপার মার্কেটের পূর্ব দিকের রাস্তা, চকবাজার কাঁচা বাজার জামে মসজিদের দক্ষিণ দিকের রাস্তায় পানি জমেছিল।
দক্ষিণ আগ্রাবাদের বাসিন্দা শহীদ বলেন, রোববার দুপুর থেকে পানি ঢুকছে। নিচতলার প্রায় পুরোটা পানির নিচে। পানির মোটর থেকে শুরু করে সবকিছু তলিয়ে যাওয়ায় নষ্ট হয়ে গেছে। এখন খাবার পানির সংকটে আছি।

টানা চার দিনের দুর্ভোগ : বর্ষার শেষ দিকে এসে মৌসুমের প্রথম ভারী বৃষ্টি হয়েছে গত ২ আগস্ট। ওইদন ছিল পূর্ণিমার জোয়ার। দু’য়ের সম্মিলনে এদিন জলাবদ্ধতার পুরনো রূপ ফিরে আসে নগরে। রাস্তাঘাট, অলি–গলিসহ তলিয়ে যায় নিচু এলাকা। পানি ঢুকে যায় অনেক দোকানপাটেও। এতে ভোগান্তি ও দুর্ভোগে পড়েন নগরবাসী।
এরপর একদিন বিরতি দিয়ে ৪ আগস্ট থেতে গতকাল ৭ আগস্ট পর্যন্ত টানা চারদিন অতি বৃষ্টি ও জোয়ারে আবারও প্লাবিত হয় নিম্নাঞ্চল। এতে দুর্ভোগ চরমে পৌঁছে।
সড়কজুড়ে বড় বড় গর্ত : ভারী বৃষ্টিতে নগরে বিভিন্ন সড়কে বড় বড় গর্ত সৃষ্টি হয়েছে। সলিং ও ইট উঠে গিয়ে সৃষ্ট এসব গর্তের কারণে ব্যাহত হচ্ছে যান চলাচল। পরিদর্শনে ষোলশহর ২ নম্বর গেট, মুরাদপুর, মোহাম্মদপুর, বহদ্দারহাট, বারিক বিল্ডিংসহ বিভিন্ন এলাকায় গর্ত দেখা গেছে। চসিকের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানান, ক্ষতিগ্রস্ত সড়কের তালিকা তৈরি করে শীঘ্রই মেরামত করা হবে।

সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ : অতিবৃষ্টি ও জলাবদ্ধতার কারণে আজ মঙ্গলবার চট্টগ্রাম মহানগরীর সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। গতকাল মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (সাধারণ প্রশাসন) রূপক রায়ের এ স্বাক্ষরে এ বিষয়ে নির্দেশনা দেয়া হয়। এতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ ও নথিপত্র দুর্যোগ পরিস্থিতিতে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় সংরক্ষণ করতে হবে বলেও উল্লেখ করা হয়।

অবশ্য গতকালও নগরে ১১৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয়য় ও ৪০টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শ্রেণি কার্যক্রম সমায়িক বন্ধ ছিল বলে চট্টগ্রাম জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস ও জেলা শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা গেছে। এছাড়া জলাবদ্ধতাকবলিত এলাকায় বিশেষ করে পূর্ব বাকলিয়া, সরাইপাড়া, পাঁচলাইশসহ এলাকায় বিদ্যমান চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো গতকাল বন্ধ ছিল বলে জানান সংস্থাটির প্রধান শিক্ষা কর্মকর্তা লুৎফুন নাহার।

তিনি বলেন, জলাবদ্ধতার জন্য যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্লাস নেয়া সম্ভব হবে না সেগুলো বন্ধ রাখতে বলেছি। আজ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের নির্দেশনা মেনে চসিক পরিচালিক সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও বন্ধ থাকবে বলে জানান তিনি।

বৃষ্টিপাতের পরিমাণ : গতকাল সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় ১৫৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করে পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিস। যা বিকেল ৩টায় ছিল ২১৬ দশমিক ৪ মিলিমিটার। একই সময়ে আমবাগান আবহাওয়া অফিসে রেকর্ড হয় ২০৮ দশমিক ৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত।

Please Share This Post in Your Social Media

টানা ৫দিন পানিবন্দি মানুষের দুর্ভোগ

Update Time : ১২:৫৭:০৬ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৯ অগাস্ট ২০২৩

ঘরে পানি। রান্নাঘরে চুলা জ্বালানোর সুযোগ নেই। বাধ্য হয়ে অনেকে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে চলে গেছেন। যারা কষ্ট করে আছেন তারা দোকান থেকে কিনে খাচ্ছেন’।
গত সোমবার দুপুরে নগরের চকবাজার কাপাসগোলা মুহাম্মদ আলী শাহ দরগাহ লেইনের বাসিন্দা আবদুল হামিদ ওই এলাকার সামগ্রিক চিত্র তুলে ধরে এ কথা বলেন ।

তিনি জানান, সোমবারসহ টানা চারদিন পানিবন্দি হয়ে আছেন ওই এলাকার লোকজন। অবশ্য বিকেলে থেকে পানি নামতে শুরু করে সেখানে।
শুধু মুহাম্মদ আলী শাহ লেইন না। পুরো নগরের নিম্নাঞ্চলগুলোর চিত্র একই। অতিবৃষ্টি ও জোয়ারের কারণে সৃষ্ট জলাবদ্ধতায় আজসহ টানা ৫দিন কার্যত পানিবন্দি ছিলেন তারা। এসময় বিশুদ্ধ পানির সংকট তৈরি হয়। একইসঙ্গে ঘরে পানি ঢুকে যাওয়ায় ব্যাহত হয় রান্নাসহ দৈনন্দিন কাজকর্ম। কিছু কিছু এলাকায় অবশ্য বৃষ্টি থামলে পানি নেমে যায়। বৃষ্টি শুরু হলে আবার পানি জমে গিয়েছিল। সবমিলিয়ে দুর্ভোগে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেন নগরবাসী। সরেজমিন পরিদর্শনে গতকাল দুপুরেও বহু সড়কে পানি দেখা গেছে। হাঁটু থেকে কোমর সমান পানি ছিল এদিনও। কিছু এলাকায় সড়কে জমে যাওয়া পানিতে জাল দিয়ে মাছ ধরেন লোকজন। যাতায়াতে ব্যবহার করা হয় নৌকা।

এছাড়া সোমবার (৭ আগস্ট) নগরের দেড়শ’র অধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। মঙ্গলবার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর।

খালে পানি নেই, তবু ডুবে আছে সড়ক : সোমবার সকাল প্রায় ১১টা পর্যন্ত ডুবেছিল মুরাদপুর সংলগ্ন মোহাম্মদপুর সড়ক। অথচ এই সময়ে সড়ক সংলগ্ন চশমা খালে পানির স্তর ছিল অনেক নিচে। শুধু সোমবার নয়, গত কয়েকদিন ধরে এ চিত্র ছিল সেখানে। এর কারণ হিসেবে জানা গেছে, মোহাম্মদপুর সড়কটির পানি ছোট্ট একটি নালা দিয়ে প্রবাহিত হয়ে পড়ে চশমা খালে। গত কয়েক বছর ধরে এ নালাটি পরিষ্কার করেনি কোনো সংস্থা। ফলে ভরাট হয়ে যায় নালাটি। তাই নিষ্কাশনের পথ বন্ধ থাকায় স্বাভাবিকভাবেই ডুবে যায় সড়ক।

সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা গেছে, এ সড়কের মুখে চশমা খালের উপর একটি কালভার্ট আছে। সে কালভার্ট পার হওয়া মাত্রই হাঁটু থেকে কোমর সমান পানি। গত তিন দিনে জলাবদ্ধতায় সড়কের দুইপাশের প্রায় প্রতিটি দোকানে ও বাসায় পানি ঢুকেছে। নষ্ট হয়েছে অনেক দোকানের মালামাল। বাসায় পানি ঢোকায় বসতিদের ভোগান্তি ছিল চরমে। অনেক বাসার নিচতলায় থাকা পানির মোটর নষ্ট হয়ে যায়। এতে ভবনে পানি তুলতে না পারায় সংকট তৈরি হয় খাবার এবং ব্যবহারের পানির।
স্থানীয়দের অভিযোগ, চশমা খাল সিডিএ’র মেগা প্রকল্পের আওতায় হলেও মোহাম্মদপুর সড়কের নালা পরিষ্কারের দায়িত্ব চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের। দীর্ঘ কয়েক বছর নালাটি পরিস্কার করেনি সংস্থাটি। তাই খালে পানি কম থাকলেও খাল থেকে উঁচু সড়কজুড়ে জলাবদ্ধতা হয়।

সড়কে মাছ ধরছেন লোকজন : পুরাতন চান্দগাঁও সিএন্ডবি এলাকায় গতকালও ডুবেছিল সড়ক। দুপুরে সেখানে হাতজাল দিয়ে স্থানীয়দের মাছ ধরতে দেখা গেছে। একই সময়ে বহাদ্দারহাট মৌলভী পুকুর পাড় এলাকায় একসঙ্গে পাঁচ–ছয় জনকে রাস্তায় জাল মেরে মাছ ধরার কথা জানান প্রত্যক্ষদর্শীরা। অঙিজেন–কুয়াইশ সড়কেও জাল দিয়ে মাছ ধরার ছবি ফেসবুকে পোস্ট করেছেন রেজাউল নামে এক পথচারী। এছাড়া হালিশহর, বাকলিয়াসহ আরো কয়েকটি এলাকায় ডুবে যাওয়া সড়কে জাল দিয়ে মাছ ধরার কথা জানান স্থানীয়রা।

সড়কে নৌকা : হালিশহর জেলা পুলিশ লেইন পানিতে ডুবে যায়। সেখানে যাতায়াতে ব্যবহার করা হয় নৌকা। শমসের পাড়া এলাকায়ও নৌকায় পানিবন্দি লোকজনের যাতায়াত করার খবর পাওয়া গেছে।

পানিবন্দি মানুষের দুর্ভোগ : গতকাল দুপুরে জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া মাদ্রাসার মাঠে এবং সামনের সড়কে হাঁটুর বেশি পানি দেখা গেছে। ওই এলাকার বেশিরভাগ বাসা–বাড়ির নিচতলায় পানি ঢুকে যাওয়ায় সীমাহীন দুর্ভোগ ছিল স্থানীয়দের। চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সুন্নিয়া মাদ্রাসায় অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা হোস্টেল এবং আশেপাশের এলাকায় ব্যাচেলর বাসায় থাকেন। ব্যাচেলর বাসায় পানি ঢুকে যাওয়ায় রান্না করতে পারেননি বেশিরভাগ শিক্ষার্থী। একইসঙ্গে পানির জন্য খাবারের দোকান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি স্থানীয়দেরও ভোগান্তি হয়।

সোমবার দুপুরের দিকে প্রায় কোমর সমান পানি ছিল নগরের শান্তিবাগ আবাসিক এলাকায়। স্থানীয় বাসিন্দা রাশেদ জানান, পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন এলাকার লোকজন।
পশ্চিম মোহরার বাসিন্দা খোরশেদ আলমদার বলেন, বাসা–বাড়িতে পানি ঢুকে গেছে। অতীতে পানি উঠেনি এমন এলাকাও ডুবেছে। মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে। অনন্যা আবাসিক এলাকা, পশ্চিম কুয়াইশ, শিকারপুর ইউনিয়ন, অনন্যা আবাসিক এলাকা সংলগ্ন লালাচন্দ্র বিল, পশ্চিম বাথুয়া, পশ্চিম মোহরা, বাড়িয়াপাড়া নিয়ে বিশাল এলাকজুড়ে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। ওই এলাকার পানি প্রবাহের অন্যতম মাধ্যম কৃষ্ণ খাল ও কুয়াইশ খাল দীর্ঘদিন ভরাট হয়ে আছে। খাল দুটি ডাস্টবিনে পরিণত হয়েছে। এতে পানি নিষ্কাশনে বাধাগ্রস্ত হওয়ায় বিশাল এলাকাজুড়ে জলাবদ্ধতা হচ্ছে। পশ্চিম মোহরা গোলাপের দোকান সংলগ্ন ব্রিজের নিচে বিভিন্ন সেবা সংস্থার পাইপ গেছে। সেখানেও ময়লা জমে থাকে।

স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, গতকাল বিকেলেও চকবাজার কাপাসগোলা মুহাম্মদ আলী শাহ দরগাহ লেইন এলাকায় অনেক ঘরে পানি ছিল। সন্ধ্যার পর থেকে পানি নামতে শুরু করে। এছাড়া রাত পৌনে ৮টার দিকেও কে বি আমান আলী রোড, ওমর আলী মাতব্বর রোড, ফুলতলা, সৈয়দ শাহ রোড, রাহাত্তারপুল, মাজারগেইট, শান্তিনগর, আশেপাশের এলাকার সড়কে পানি ছিল।

এছাড়া বিকেলেও ফুলতলা, বিএড কলেজ গেইট, পূর্ব ষোলশহর, ঘাসিয়ার পাড়া, বাদশা চেয়ারম্যান ঘাটা, বারইপাড়া, বাদুরতলা, ষোলকবহর, বড় গ্যারেজ, নতুন চান্দগাঁও থানা, বড় কবরস্থান, পুলিশ বিট, মাজার গেইট, বগার বিল, শান্তি নগর, কাজী অফিস, পশ্চিম বাকলিয়া ডিসি রোড, ফালাহ গাজী মসজিদ থেকে ডিসি রোড হয়ে মিয়ার বাপের মসজিদ পর্যন্ত, আবদুল লতিফ বাই লেইন, চকবাজার আধুনিক চক সুপার মার্কেটের পূর্ব দিকের রাস্তা, চকবাজার কাঁচা বাজার জামে মসজিদের দক্ষিণ দিকের রাস্তায় পানি জমেছিল।
দক্ষিণ আগ্রাবাদের বাসিন্দা শহীদ বলেন, রোববার দুপুর থেকে পানি ঢুকছে। নিচতলার প্রায় পুরোটা পানির নিচে। পানির মোটর থেকে শুরু করে সবকিছু তলিয়ে যাওয়ায় নষ্ট হয়ে গেছে। এখন খাবার পানির সংকটে আছি।

টানা চার দিনের দুর্ভোগ : বর্ষার শেষ দিকে এসে মৌসুমের প্রথম ভারী বৃষ্টি হয়েছে গত ২ আগস্ট। ওইদন ছিল পূর্ণিমার জোয়ার। দু’য়ের সম্মিলনে এদিন জলাবদ্ধতার পুরনো রূপ ফিরে আসে নগরে। রাস্তাঘাট, অলি–গলিসহ তলিয়ে যায় নিচু এলাকা। পানি ঢুকে যায় অনেক দোকানপাটেও। এতে ভোগান্তি ও দুর্ভোগে পড়েন নগরবাসী।
এরপর একদিন বিরতি দিয়ে ৪ আগস্ট থেতে গতকাল ৭ আগস্ট পর্যন্ত টানা চারদিন অতি বৃষ্টি ও জোয়ারে আবারও প্লাবিত হয় নিম্নাঞ্চল। এতে দুর্ভোগ চরমে পৌঁছে।
সড়কজুড়ে বড় বড় গর্ত : ভারী বৃষ্টিতে নগরে বিভিন্ন সড়কে বড় বড় গর্ত সৃষ্টি হয়েছে। সলিং ও ইট উঠে গিয়ে সৃষ্ট এসব গর্তের কারণে ব্যাহত হচ্ছে যান চলাচল। পরিদর্শনে ষোলশহর ২ নম্বর গেট, মুরাদপুর, মোহাম্মদপুর, বহদ্দারহাট, বারিক বিল্ডিংসহ বিভিন্ন এলাকায় গর্ত দেখা গেছে। চসিকের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানান, ক্ষতিগ্রস্ত সড়কের তালিকা তৈরি করে শীঘ্রই মেরামত করা হবে।

সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ : অতিবৃষ্টি ও জলাবদ্ধতার কারণে আজ মঙ্গলবার চট্টগ্রাম মহানগরীর সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। গতকাল মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (সাধারণ প্রশাসন) রূপক রায়ের এ স্বাক্ষরে এ বিষয়ে নির্দেশনা দেয়া হয়। এতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ ও নথিপত্র দুর্যোগ পরিস্থিতিতে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় সংরক্ষণ করতে হবে বলেও উল্লেখ করা হয়।

অবশ্য গতকালও নগরে ১১৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয়য় ও ৪০টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শ্রেণি কার্যক্রম সমায়িক বন্ধ ছিল বলে চট্টগ্রাম জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস ও জেলা শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা গেছে। এছাড়া জলাবদ্ধতাকবলিত এলাকায় বিশেষ করে পূর্ব বাকলিয়া, সরাইপাড়া, পাঁচলাইশসহ এলাকায় বিদ্যমান চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো গতকাল বন্ধ ছিল বলে জানান সংস্থাটির প্রধান শিক্ষা কর্মকর্তা লুৎফুন নাহার।

তিনি বলেন, জলাবদ্ধতার জন্য যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্লাস নেয়া সম্ভব হবে না সেগুলো বন্ধ রাখতে বলেছি। আজ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের নির্দেশনা মেনে চসিক পরিচালিক সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও বন্ধ থাকবে বলে জানান তিনি।

বৃষ্টিপাতের পরিমাণ : গতকাল সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় ১৫৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করে পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিস। যা বিকেল ৩টায় ছিল ২১৬ দশমিক ৪ মিলিমিটার। একই সময়ে আমবাগান আবহাওয়া অফিসে রেকর্ড হয় ২০৮ দশমিক ৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত।