পোল্ট্রি শিল্পে অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার: সুপারবাগের বড় হুমকি
- Update Time : ০৭:১৯:৫৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৫
- / ৭২ Time View
গত তিন দশকে বাংলাদেশের কৃষিখাতে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সাফল্যের অন্যতম উদাহরণ হয়ে উঠেছে পোল্ট্রি বা ব্রয়লার মুরগি শিল্প। একসময় ঘরের আঙিনায় সীমিতভাবে পালন করা হাঁস-মুরগি এখন রূপ নিয়েছে বিশাল বাণিজ্যিক খাতে, যা দেশের মানুষের প্রাণিজ প্রোটিনের চাহিদা পূরণে বড় ভূমিকা রাখছে। তবে এই উৎপাদন বিপ্লবের আড়ালে ধীরে ধীরে জমছে সম্ভাব্য এক গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকির সংকট।
খামারে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের ফলে ব্রয়লার মুরগির শরীরে তৈরি হচ্ছে মাল্টিড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়া বা ‘সুপারবাগ’, যা মানুষের জীবনরক্ষাকারী ওষুধকে ক্রমেই অকার্যকর করে তুলছে। শুধু এখানেই সমস্যা থেমে নেই, অপরিকল্পিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে, ফলে পোল্ট্রি শিল্প একসময় পরিবেশের জন্যও বড় ধরনের হুমকিতে পরিণত হচ্ছে।
সম্প্রতি প্রকাশিত ‘এশিয়ান-অস্ট্রালাশিয়ান জার্নাল অফ ফুড সেফটি অ্যান্ড সিকিউরিটি’-তে প্রকাশিত এক বিশদ পর্যালোচনা প্রতিবেদনে এমন উদ্বেগজনক চিত্র উঠে এসেছে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) ফার্মাকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. শফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে একদল গবেষক এই গবেষণাটি বিশ্লেষন করেছেন।
গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের পোল্ট্রি খামারগুলো থেকে সংগৃহীত ই. কোলাই (E. coli) ব্যাকটেরিয়ার নমুনার মধ্যে ৭৫ শতাংশেরও বেশি ‘মাল্টিড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট’ বা একাধিক ওষুধ প্রতিরোধে সক্ষম।
আতঙ্কের বিষয় হলো, মুরগির অন্ত্রে ‘এমসিআর-১’ (mcr-1) জিনের উপস্থিতি পাওয়া গেছে, যা কলিস্টিন নামক অ্যান্টিবায়োটিককে অকার্যকর করে দেয়। উল্লেখ্য, কোলিস্টিন মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি অ্যান্টিবায়োটিক।
গবেষণা প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, দেশের মোট ব্রয়লার উৎপাদনের ৭০-৮০ শতাংশই আসে ক্ষুদ্র ও মাঝারি খামারিদের কাছ থেকে। এসব খামারিরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভেটেরিনারি চিকিৎসকের পরামর্শ নেন না। বরং ফিড ডিলার বা ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের কথায় রোগ হওয়ার আগেই ‘সুরক্ষা’ বা ‘ইনস্যুরেন্স’ হিসেবে মুরগিকে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়াচ্ছেন।
ফলে সিপ্রোফ্লক্সাসিন, এনরোফ্লক্সাসিন এবং টেট্রাসাইক্লিনের মতো ওষুধের ব্যাপক অপব্যবহারের ফলে মুরগির মাংসে ওষুধের অবশিষ্টাংশ থেকে যাচ্ছে, যা সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি।
খুচরা বাজার থেকে সংগৃহীত ব্রয়লার মাংসের নমুনা বিশ্লেষণে নিয়মিতভাবে বিভিন্ন অ্যান্টিবায়োটিকের অবশিষ্টাংশ পাওয়া গেছে। নমুনার ২২ শতাংশে ফ্লোরোকুইনোলোন এবং ১৮ শতাংশে টেট্রাসাইক্লিনের অবশিষ্টাংশ পাওয়া গেছে।
খাদ্যচক্রের মাধ্যমে মানুষের শরীরে এভাবে অল্পমাত্রার অ্যান্টিবায়োটিকের দীর্ঘমেয়াদি প্রবেশ অ্যালার্জি, অঙ্গ-প্রতঙ্গের সরাসরি বিষক্রিয়া এবং মানব অন্ত্রের মাইক্রোবায়োমের ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে পারে। যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ও সামগ্রিক স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।
জনস্বাস্থ্যের পাশাপাশি পরিবেশের ওপরও এই শিল্পের নেতিবাচক প্রভাব স্পষ্ট। গবেষণার তথ্যমতে, একটি ব্রয়লার মুরগি তার জীবনচক্রে প্রায় ১.৫ থেকে ২ কেজি বর্জ্য (লিটার) ত্যাগ করে। দেশে বছরে ২০০ মিলিয়নের বেশি মুরগি উৎপাদিত হয়, যার বিপুল বর্জ্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে অপরিশোধিত অবস্থায় জমিতে বা জলাশয়ে ফেলা হচ্ছে। এতে ভূগর্ভস্থ পানি ও নদীনালায় নাইট্রেট ও ফসফরাস মিশে পানি দূষিত করছে এবং অ্যামোনিয়া গ্যাস নিঃসরণ ঘটাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সংকট মোকাবিলায় ‘ওয়ান হেলথ’ বা এক স্বাস্থ্য নীতির কোনো বিকল্প নেই যেখানে- মানুষ, প্রাণী ও পরিবেশের স্বাস্থ্য অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। একটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে অন্যটিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই আমাদেরকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। গবেষকরা অ্যান্টিবায়োটিকের বিকল্প হিসেবে কিছু টেকসই প্রযুক্তির সুপারিশ করেছেন, এর মধ্যে অন্যতম অ্যান্টিবায়োটিকের বিকল্প হিসেবে প্রোবায়োটিক ও প্রিবায়োটিক, অ্যান্টিবায়োটিকের বিকল্প কার্যকরি ভেষজ ঔষধ রয়েছে।
এছাড়া বায়োসিকিউরিটি জোরদারকরণ, টিকাদান কর্মসূচি নিশ্চিতকরণ, নিরাপদ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, খামারিদের অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে সচেতনতা বৃদ্ধিকরণ, সরকারের অ্যান্টিবায়োটিকের অবাধ বিক্রয় বন্ধ করতে কঠোর নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, গবেষকদের টেকসই প্রযুক্তি উদ্ভাবন, নিরাপদ ও টেকসইভাবে উৎপাদিত মুরগির মাংসের চাহিদা ভোক্তা নিশ্চিত করতে হবে।
গবেষণাপত্রের প্রধান লেখক অধ্যাপক ড. মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, ব্রয়লার শিল্প আমাদের প্রোটিনের চাহিদা পূরণ করছে, লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি করেছে। কিন্তু অ্যান্টিবায়োটিক সংকট এই অর্জনকে ম্লান করে দিতে পারে। সময় থাকতে আমরা যদি সচেতন হই এবং ‘ওয়ান হেলথ’ নীতির সমন্বিতভাবে কাজ করি, তাহলে এই শিল্পকে একটি নিরাপদ, লাভজনক ও টেকসই ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যেতে পারব। আমাদের আজকের সিদ্ধান্তই নির্ধারণ করবে আগামী প্রজন্মের জন্য আমরা কতটা নিরাপদ ও পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার নিশ্চিত করতে পারি।
Please Share This Post in Your Social Media
-
সর্বশেষ
-
জনপ্রিয়



































































































































































































