ঢাকা ০৪:১১ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ০১ নভেম্বর ২০২৫, ১৬ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
ভিডিও ভাইরাল, জেলাজুড়ে ক্ষোভ ও নিন্দার ঝড়

পরকীয়ার অভিযোগে নারীকে প্রকাশ্যে বেধড়ক মারধর

ইকবাল হোসাইন, উখিয়া প্রতিনিধি
  • Update Time : ০১:৫৫:৪৪ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৩১ অক্টোবর ২০২৫
  • / ৪৮৯ Time View

নারীকে প্রকাশ্যে অমানবিকভাবে বেধড়ক মারধর করা হয়েছে

কক্সবাজারের সীমান্তবর্তী উপজেলা টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর এলাকায় পরকীয়ার অভিযোগ তুলে এক নারীকে প্রকাশ্যে অমানবিকভাবে বেধড়ক মারধর করা হয়েছে। নির্মম এ নির্যাতনের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর সারাদেশে ক্ষোভ, নিন্দা ও আলোচনার ঝড় উঠেছে।

ভিডিওতে দেখা যায়, মধ্যবয়সী এক নারী মাটিতে লুটিয়ে আছেন। তার দুই হাত মোটা রশি দিয়ে বাঁধা, রশিতে রক্তের দাগ। চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজন যুবক তাকে বেত ও লাঠি দিয়ে নির্বিচারে প্রহার করছে। নির্যাতনের এক পর্যায়ে একজন চিৎকার করে বলে, “রাতের বেলায় আপত্তিকর অবস্থায় ধরা পড়ছে।” এরপর আরও কয়েকজন উল্লাসধ্বনি দেয়।

ভিডিওতে আরও দেখা যায়, আরেকজন যুবককেও মারধর করা হচ্ছে—যাকে ‘পরকীয়া প্রেমিক’ বলে দাবি করছে নির্যাতনকারীরা। তবে স্থানীয়দের অভিযোগ, ঘটনাটি পরিকল্পিতভাবে সাজানো হয়েছে এবং নারীটিকে ঘর থেকে জোর করে টেনে বের করে এনে এভাবে নির্যাতন চালানো হয়।
নির্যাতনের শিকার নারী প্রবাসীর স্ত্রী

স্থানীয়রা জানান, নির্যাতনের শিকার নারীটি এক প্রবাসীর স্ত্রী। তার স্বামী বর্তমানে বিদেশে কর্মরত। স্বামীর অনুপস্থিতির সুযোগে কিছু বখাটে যুবক ঘরে ঢুকে নারীটিকে টেনে-হিঁচড়ে বাইরে নিয়ে যায় এবং তথাকথিত ‘সামাজিক বিচার’-এর নামে প্রকাশ্যে মারধর করে।

একজন স্থানীয় বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “ওই নারীকে রাতের বেলায় টেনে বের করে মারধর করা হয়েছে। ঘটনাটি যে মানবিকতার সব সীমা অতিক্রম করেছে, সেটা ভিডিও দেখলেই বোঝা যায়।”

ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে এলাকায়। মঙ্গলবার রাতে ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে স্থানীয় ও আশপাশের এলাকায় উত্তেজনা দেখা দেয়।

নেটিজেনরা ক্ষোভ প্রকাশ করে লিখেছেন, “অভিযোগ থাকলে আদালত আছে, কিন্তু এভাবে প্রকাশ্যে নারীকে নির্যাতন করার অধিকার কারও নেই।”

আরেকজন মন্তব্য করেন,“এটা কোনো বিচার নয়, বরং বর্বরতা। আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া সমাজে ভয়াবহ দৃষ্টান্ত তৈরি করবে।”

অনেকে ভিডিওর নিচে মন্তব্য করে দ্রুত প্রশাসনের হস্তক্ষেপ ও দোষীদের গ্রেফতারের দাবি জানিয়েছেন।

আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মীদের ক্ষোভ

কক্সবাজার জেলা জজ আদালতের সিনিয়র আইনজীবী শিপ্ত বড়ুয়া বলেন,“ধরে নিলেও কেউ অপরাধ করেছে, তবু আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার অধিকার কারও নেই। এটি সরাসরি ফৌজদারি অপরাধ। যারা এভাবে নির্যাতন চালিয়েছে, তারাই এখন অপরাধী। আইন এমন কর্মকাণ্ডের জন্য কঠোর শাস্তির বিধান রেখেছে।”মানবাধিকার সংগঠনগুলোর দাবি—এই ভিডিও শুধু এক নারীর উপর নির্মম নির্যাতনের প্রমাণ নয়, এটি পুরো সমাজে ভয়াবহ বার্তা দেয় যে আইন ও প্রশাসনের ভয়ে কেউ ভীত নয়।

তারা বলেন, “ভিডিওতে যেসব মুখ দেখা গেছে, তাদের চিহ্নিত করে দ্রুত আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রশাসনের নীরবতা সমাজে আরও সহিংসতার জন্ম দিতে পারে।”

পুলিশের বক্তব্য ও অবস্থান

বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ ইন্সপেক্টর দূর্জয় বিশ্বাস বলেন, “এ ঘটনায় এখনো কেউ লিখিত অভিযোগ দেয়নি। তবে আমরা ভিডিওটি দেখেছি। ঘটনাস্থল শনাক্তের চেষ্টা চলছে। অভিযোগ পেলে বা প্রমাণ পেলে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

পুলিশের একটি সূত্র জানায়, ভিডিওর ফুটেজ বিশ্লেষণ করে ইতিমধ্যে কয়েকজনকে চিহ্নিত করার কাজ শুরু হয়েছে।

স্থানীয়দের অভিযোগ: ‘সামাজিক বিচারের নামে’ নারীর উপর অত্যাচার নিয়মিত ঘটনা

স্থানীয়দের দাবি, শামলাপুরসহ টেকনাফের কিছু এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে “সামাজিক বিচারের” নামে নারী নির্যাতনের সংস্কৃতি চালু রয়েছে। প্রশাসনের পর্যাপ্ত নজরদারি না থাকায় এ ধরনের ঘটনা বারবার ঘটছে।

একজন প্রবীণ নাগরিক বলেন, “এলাকায় যখন কোনো পারিবারিক ঝামেলা হয়, তখন কিছু যুবক নিজেদের ‘বিচারক’ সাজে। তারা নারী-পুরুষ উভয়কেই প্রকাশ্যে অপমান ও মারধর করে। প্রশাসন কঠোর না হলে এই বর্বরতা থামবে না।”

প্রশাসনের হস্তক্ষেপ ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি ঘটনাটি ভাইরাল হওয়ার পর মানবাধিকার সংগঠন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সচেতন মহল দোষীদের দ্রুত গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন।

তারা বলেন, “এটি শুধু একটি নারী নির্যাতনের ঘটনা নয়, বরং আইনের শাসনের প্রতি প্রকাশ্য অবমাননা। এমন ঘটনা থামাতে প্রশাসনের উচিত দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া এবং এলাকায় আইন-শৃঙ্খলা জোরদার করা।”

টেকনাফের মতো সংবেদনশীল সীমান্ত অঞ্চলে প্রকাশ্যে নারী নির্যাতনের এই ঘটনা শুধু একটি ভিডিও নয়, বরং সমাজে আইন ও মানবতার সীমারেখা কতটা দুর্বল হয়ে পড়েছে তার জ্বলন্ত প্রমাণ।

প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে স্থানীয়রা বলছেন অভিযোগ থাকলে আদালত আছে, আইন আছে; কিন্তু এমন বর্বরতা আর নয়।

Please Share This Post in Your Social Media

ভিডিও ভাইরাল, জেলাজুড়ে ক্ষোভ ও নিন্দার ঝড়

পরকীয়ার অভিযোগে নারীকে প্রকাশ্যে বেধড়ক মারধর

ইকবাল হোসাইন, উখিয়া প্রতিনিধি
Update Time : ০১:৫৫:৪৪ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৩১ অক্টোবর ২০২৫

কক্সবাজারের সীমান্তবর্তী উপজেলা টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর এলাকায় পরকীয়ার অভিযোগ তুলে এক নারীকে প্রকাশ্যে অমানবিকভাবে বেধড়ক মারধর করা হয়েছে। নির্মম এ নির্যাতনের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর সারাদেশে ক্ষোভ, নিন্দা ও আলোচনার ঝড় উঠেছে।

ভিডিওতে দেখা যায়, মধ্যবয়সী এক নারী মাটিতে লুটিয়ে আছেন। তার দুই হাত মোটা রশি দিয়ে বাঁধা, রশিতে রক্তের দাগ। চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজন যুবক তাকে বেত ও লাঠি দিয়ে নির্বিচারে প্রহার করছে। নির্যাতনের এক পর্যায়ে একজন চিৎকার করে বলে, “রাতের বেলায় আপত্তিকর অবস্থায় ধরা পড়ছে।” এরপর আরও কয়েকজন উল্লাসধ্বনি দেয়।

ভিডিওতে আরও দেখা যায়, আরেকজন যুবককেও মারধর করা হচ্ছে—যাকে ‘পরকীয়া প্রেমিক’ বলে দাবি করছে নির্যাতনকারীরা। তবে স্থানীয়দের অভিযোগ, ঘটনাটি পরিকল্পিতভাবে সাজানো হয়েছে এবং নারীটিকে ঘর থেকে জোর করে টেনে বের করে এনে এভাবে নির্যাতন চালানো হয়।
নির্যাতনের শিকার নারী প্রবাসীর স্ত্রী

স্থানীয়রা জানান, নির্যাতনের শিকার নারীটি এক প্রবাসীর স্ত্রী। তার স্বামী বর্তমানে বিদেশে কর্মরত। স্বামীর অনুপস্থিতির সুযোগে কিছু বখাটে যুবক ঘরে ঢুকে নারীটিকে টেনে-হিঁচড়ে বাইরে নিয়ে যায় এবং তথাকথিত ‘সামাজিক বিচার’-এর নামে প্রকাশ্যে মারধর করে।

একজন স্থানীয় বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “ওই নারীকে রাতের বেলায় টেনে বের করে মারধর করা হয়েছে। ঘটনাটি যে মানবিকতার সব সীমা অতিক্রম করেছে, সেটা ভিডিও দেখলেই বোঝা যায়।”

ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে এলাকায়। মঙ্গলবার রাতে ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে স্থানীয় ও আশপাশের এলাকায় উত্তেজনা দেখা দেয়।

নেটিজেনরা ক্ষোভ প্রকাশ করে লিখেছেন, “অভিযোগ থাকলে আদালত আছে, কিন্তু এভাবে প্রকাশ্যে নারীকে নির্যাতন করার অধিকার কারও নেই।”

আরেকজন মন্তব্য করেন,“এটা কোনো বিচার নয়, বরং বর্বরতা। আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া সমাজে ভয়াবহ দৃষ্টান্ত তৈরি করবে।”

অনেকে ভিডিওর নিচে মন্তব্য করে দ্রুত প্রশাসনের হস্তক্ষেপ ও দোষীদের গ্রেফতারের দাবি জানিয়েছেন।

আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মীদের ক্ষোভ

কক্সবাজার জেলা জজ আদালতের সিনিয়র আইনজীবী শিপ্ত বড়ুয়া বলেন,“ধরে নিলেও কেউ অপরাধ করেছে, তবু আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার অধিকার কারও নেই। এটি সরাসরি ফৌজদারি অপরাধ। যারা এভাবে নির্যাতন চালিয়েছে, তারাই এখন অপরাধী। আইন এমন কর্মকাণ্ডের জন্য কঠোর শাস্তির বিধান রেখেছে।”মানবাধিকার সংগঠনগুলোর দাবি—এই ভিডিও শুধু এক নারীর উপর নির্মম নির্যাতনের প্রমাণ নয়, এটি পুরো সমাজে ভয়াবহ বার্তা দেয় যে আইন ও প্রশাসনের ভয়ে কেউ ভীত নয়।

তারা বলেন, “ভিডিওতে যেসব মুখ দেখা গেছে, তাদের চিহ্নিত করে দ্রুত আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রশাসনের নীরবতা সমাজে আরও সহিংসতার জন্ম দিতে পারে।”

পুলিশের বক্তব্য ও অবস্থান

বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ ইন্সপেক্টর দূর্জয় বিশ্বাস বলেন, “এ ঘটনায় এখনো কেউ লিখিত অভিযোগ দেয়নি। তবে আমরা ভিডিওটি দেখেছি। ঘটনাস্থল শনাক্তের চেষ্টা চলছে। অভিযোগ পেলে বা প্রমাণ পেলে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

পুলিশের একটি সূত্র জানায়, ভিডিওর ফুটেজ বিশ্লেষণ করে ইতিমধ্যে কয়েকজনকে চিহ্নিত করার কাজ শুরু হয়েছে।

স্থানীয়দের অভিযোগ: ‘সামাজিক বিচারের নামে’ নারীর উপর অত্যাচার নিয়মিত ঘটনা

স্থানীয়দের দাবি, শামলাপুরসহ টেকনাফের কিছু এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে “সামাজিক বিচারের” নামে নারী নির্যাতনের সংস্কৃতি চালু রয়েছে। প্রশাসনের পর্যাপ্ত নজরদারি না থাকায় এ ধরনের ঘটনা বারবার ঘটছে।

একজন প্রবীণ নাগরিক বলেন, “এলাকায় যখন কোনো পারিবারিক ঝামেলা হয়, তখন কিছু যুবক নিজেদের ‘বিচারক’ সাজে। তারা নারী-পুরুষ উভয়কেই প্রকাশ্যে অপমান ও মারধর করে। প্রশাসন কঠোর না হলে এই বর্বরতা থামবে না।”

প্রশাসনের হস্তক্ষেপ ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি ঘটনাটি ভাইরাল হওয়ার পর মানবাধিকার সংগঠন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সচেতন মহল দোষীদের দ্রুত গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন।

তারা বলেন, “এটি শুধু একটি নারী নির্যাতনের ঘটনা নয়, বরং আইনের শাসনের প্রতি প্রকাশ্য অবমাননা। এমন ঘটনা থামাতে প্রশাসনের উচিত দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া এবং এলাকায় আইন-শৃঙ্খলা জোরদার করা।”

টেকনাফের মতো সংবেদনশীল সীমান্ত অঞ্চলে প্রকাশ্যে নারী নির্যাতনের এই ঘটনা শুধু একটি ভিডিও নয়, বরং সমাজে আইন ও মানবতার সীমারেখা কতটা দুর্বল হয়ে পড়েছে তার জ্বলন্ত প্রমাণ।

প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে স্থানীয়রা বলছেন অভিযোগ থাকলে আদালত আছে, আইন আছে; কিন্তু এমন বর্বরতা আর নয়।