ঢাকা ০৫:৩৫ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১২ অগাস্ট ২০২৫, ২৭ শ্রাবণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

দুর্নীতির অভিযোগ থেকে বাঁচতে সাবেক অধ্যক্ষ মাহেদুলের মিথ্যা অভিযোগ

কামরুল হাসান টিটু, রংপুর ব্যুরো
  • Update Time : ০৭:৪৯:৫২ অপরাহ্ন, সোমবার, ১১ অগাস্ট ২০২৫
  • / ৩৩ Time View

টাকার চুক্তিতে পরীক্ষাকেন্দ্রে নকল সরবরাহ, বিএড সনদ জালিয়াতি, টিউশন ফির টাকা আত্মসাৎ এবং সংবাদ প্রকাশের প্রতিবাদে সাংবাদিকের হাঁটু ভাঙ্গার হুমকি দেয়াসহ নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে সাময়িক বরখাস্ত হয়েছিলেন রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ বেগম রোকেয়া স্মৃতি গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মাহেদুল আলম।

অভিযোগ উঠেছে, নিজের বিরুদ্ধে ওঠা অনিয়ম ও দুর্নীতি ঢাকতে এবার তিনি তার বিরুদ্ধে সোচ্চার শিক্ষক ও বিভিন্ন ব্যক্তির নামে নগরীর কোতয়ালী থানা ও মিঠাপুকুর থানায় আলাদা দুটি অভিযোগ দায়ের করেছেন।

গত বৃহস্পতিবার (৭ আগস্ট) নগরীর কোতয়ালী থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করেন মাহেদুল আলম। অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দ্বন্দ্বের প্রেক্ষিতে সিনিয়র শিক্ষক রাজ্জাকুর রহমান, রেজাউল করিম, মাকসুদুর রহমান ও আব্দুল কাইয়ুম মিয়ার একটি অভিযোগের প্রেক্ষিতে গত বুধবার জেলা শিক্ষা অফিস প্রাঙ্গণে তদন্ত চলছিল।

অধ্যক্ষ মাহেদুল আলম অভিযোগে উল্লেখ করেন, তদন্ত চলাকালে রাজ্জাকুর রহমানের নির্দেশে তার ছেলে রাতুলসহ ছাত্রদল নেতা মো. মাহফুজ উল আলম মীমের নেতৃত্বে মামুন, রাসেল ও অজ্ঞাত বহিরাগতরা হঠাৎ তার ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং মারধরের চেষ্টা করে। উপস্থিত লোকজনের হস্তক্ষেপে তিনি রক্ষা পান।

তিনি আরও অভিযোগ করেন, অভিযুক্তরা তাকে রংপুর শহরে থাকতে দেবে না বলে হুমকি দেয় এবং বহিরাগত লোকজন দিয়ে তুলে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনার কথা জানায়। একা পেলে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকিও দেওয়া হয়। এতে তিনি ও তার পরিবার চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন বলে দাবি করেন।

তবে রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের কোতয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আতাউর রহমান জানান, অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি। তদন্তে প্রাণনাশের হুমকি দেয়া বা এরকম কিছু পাওয়া যায়নি।

এদিকে মিঠাপুকুর থানায় দায়ের করা আরেকটি অভিযোগে মাহেদুল আলম লিখেছেন, গত ৮ আগস্ট বিকেলে গ্রামের বাড়ি মিঠাপুকুরের ভাঙনী ইউনিয়নের রাধানগর গ্রাম থেকে রংপুর নগরীর মূলাটোলে আসার পথে সদরপুর এলাকায় পৌঁছালে রাজ্জাকুর রহমানের (ওই প্রতিষ্ঠানের বর্তমান ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ)  নির্দেশে আব্দুল মমিন নামের একজন তাকে মারধর করেন, এতে তার শরীরে জখম হয়। পরে রাজ্জাকুর রহমান ভয় দেখিয়ে তার কাছ থেকে তিনটি ফাঁকা স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নেন।

তবে অভিযুক্ত আব্দুল মমিন জানান, ২০২৩ সালে অফিস সহকারী পদে নিয়োগ দেওয়ার কথা বলে মাহেদুল আলম তার কাছ থেকে ৭ লাখ টাকা নেন। পরে নিয়োগপত্র দিয়ে অক্টোবর মাসে তাকে যোগদান করানো হয়। কিন্তু পরে তিনি জানতে পারেন, তার নিয়োগ নিয়ম বহির্ভূতভাবে হয়েছে। বিষয়টি জানালে মাহেদুল তাকে বেতন হওয়ার আগে প্রতিমাসে ১০ হাজার টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন, তবে তা আর বাস্তবায়ন করেননি। পরে তিনি তাকে চাপ দিলে তার দেয়া টাকা ফেরত দিতে চাইলেও বছরের পর বছর থেকে তিনি তাকে ঘুরাচ্ছেন। টাকা ফেরতের দাবিতে বিভাগীয় কমিশনার, ইউএনও ও মিঠাপুকুর থানায় অভিযোগ করেন আব্দুল মমিন।

ঘটনার দিনের বিবরণ দিতে গিয়ে আব্দুল মমিন বলেন, গত শুক্রবার বিকেলের দিকে পায়রাবন্দের সদরপুর প্রামে ওই প্রতিষ্ঠানের পিয়ন হায়দার আলীর বাসার সামনে মাহেদুল আলমকে দেখতে পান। এসময় তিনি গাড়ি থেকে নেমে তার তার কাছে যান এবং তার দেয়া টাকা ফেরত চাইলে বাকবিতন্ডা শুরু হয়।  একপর্যায়ে স্থানীয়দের মধ্যস্থতায় একটি জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে দুই কিস্তিতে টাকা ফেরতের শর্তে স্বাক্ষর করেন মাহেদুল। এ সময় মাহেদুল স্ট্যাম্পে কী লেখা হবে তা বলে দিচ্ছিলেন এবং হায়দার আলী তা লিখছিলেন। মারধর বা জোর করে স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নেয়ার অভিযোগ পুরোপুরি মিথ্যা বলে জানান তিনি।

ঘটনার সময়কার একটি ভিডিও এই প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। ভিডিওতে দেখা যায়, একটি ঘরের ভেতরে একটি জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে লিখছেন প্রতিষ্ঠানের পিয়ন হায়দার আলী, আর পাশেই বসে অধ্যক্ষ মাহেদুল আলম তাকে বলে দিচ্ছেন কী লিখতে হবে।

এ বিষয়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত পিয়ন হায়দার আলী বলেন, ‘সেদিন মমিন সেখানে ছিল। সেখানে কোন শিক্ষক উপস্থিত ছিলেন না, মিথ্যা কথা বলব কেন।’

বর্তমান ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ রাজ্জাকুর রহমান অভিযোগ করে বলেন, শুক্রবার ছুটির দিন তিনি রংপুর শহরের নিজ বাসায় ছিলেন, অথচ তার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। মাহেদুল আলমের অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রতিবাদ করায় তাকে ও আরও কয়েকজন শিক্ষককে নানাভাবে হয়রানি করার চেষ্টা চলছে। তার দাবি, এসব মিথ্যা মামলার উদ্দেশ্য হলো ভয়ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রতিবাদ থামিয়ে দেওয়া। তিনি ঘটনার দ্রুত ও সুষ্ঠু তদন্তের আহ্বান জানিয়েছেন।

মিঠাপুকুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নূরে আলম বলেন, আমাদের কাছে এজাহার দিয়েছেন উনি (মাহেদুল আলম)। অভিযোগটি তদন্ত করা হচ্ছে। তদন্ত শেষে বিষয়টি জানাতে পারব।

Please Share This Post in Your Social Media

দুর্নীতির অভিযোগ থেকে বাঁচতে সাবেক অধ্যক্ষ মাহেদুলের মিথ্যা অভিযোগ

কামরুল হাসান টিটু, রংপুর ব্যুরো
Update Time : ০৭:৪৯:৫২ অপরাহ্ন, সোমবার, ১১ অগাস্ট ২০২৫

টাকার চুক্তিতে পরীক্ষাকেন্দ্রে নকল সরবরাহ, বিএড সনদ জালিয়াতি, টিউশন ফির টাকা আত্মসাৎ এবং সংবাদ প্রকাশের প্রতিবাদে সাংবাদিকের হাঁটু ভাঙ্গার হুমকি দেয়াসহ নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে সাময়িক বরখাস্ত হয়েছিলেন রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ বেগম রোকেয়া স্মৃতি গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মাহেদুল আলম।

অভিযোগ উঠেছে, নিজের বিরুদ্ধে ওঠা অনিয়ম ও দুর্নীতি ঢাকতে এবার তিনি তার বিরুদ্ধে সোচ্চার শিক্ষক ও বিভিন্ন ব্যক্তির নামে নগরীর কোতয়ালী থানা ও মিঠাপুকুর থানায় আলাদা দুটি অভিযোগ দায়ের করেছেন।

গত বৃহস্পতিবার (৭ আগস্ট) নগরীর কোতয়ালী থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করেন মাহেদুল আলম। অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দ্বন্দ্বের প্রেক্ষিতে সিনিয়র শিক্ষক রাজ্জাকুর রহমান, রেজাউল করিম, মাকসুদুর রহমান ও আব্দুল কাইয়ুম মিয়ার একটি অভিযোগের প্রেক্ষিতে গত বুধবার জেলা শিক্ষা অফিস প্রাঙ্গণে তদন্ত চলছিল।

অধ্যক্ষ মাহেদুল আলম অভিযোগে উল্লেখ করেন, তদন্ত চলাকালে রাজ্জাকুর রহমানের নির্দেশে তার ছেলে রাতুলসহ ছাত্রদল নেতা মো. মাহফুজ উল আলম মীমের নেতৃত্বে মামুন, রাসেল ও অজ্ঞাত বহিরাগতরা হঠাৎ তার ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং মারধরের চেষ্টা করে। উপস্থিত লোকজনের হস্তক্ষেপে তিনি রক্ষা পান।

তিনি আরও অভিযোগ করেন, অভিযুক্তরা তাকে রংপুর শহরে থাকতে দেবে না বলে হুমকি দেয় এবং বহিরাগত লোকজন দিয়ে তুলে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনার কথা জানায়। একা পেলে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকিও দেওয়া হয়। এতে তিনি ও তার পরিবার চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন বলে দাবি করেন।

তবে রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের কোতয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আতাউর রহমান জানান, অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি। তদন্তে প্রাণনাশের হুমকি দেয়া বা এরকম কিছু পাওয়া যায়নি।

এদিকে মিঠাপুকুর থানায় দায়ের করা আরেকটি অভিযোগে মাহেদুল আলম লিখেছেন, গত ৮ আগস্ট বিকেলে গ্রামের বাড়ি মিঠাপুকুরের ভাঙনী ইউনিয়নের রাধানগর গ্রাম থেকে রংপুর নগরীর মূলাটোলে আসার পথে সদরপুর এলাকায় পৌঁছালে রাজ্জাকুর রহমানের (ওই প্রতিষ্ঠানের বর্তমান ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ)  নির্দেশে আব্দুল মমিন নামের একজন তাকে মারধর করেন, এতে তার শরীরে জখম হয়। পরে রাজ্জাকুর রহমান ভয় দেখিয়ে তার কাছ থেকে তিনটি ফাঁকা স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নেন।

তবে অভিযুক্ত আব্দুল মমিন জানান, ২০২৩ সালে অফিস সহকারী পদে নিয়োগ দেওয়ার কথা বলে মাহেদুল আলম তার কাছ থেকে ৭ লাখ টাকা নেন। পরে নিয়োগপত্র দিয়ে অক্টোবর মাসে তাকে যোগদান করানো হয়। কিন্তু পরে তিনি জানতে পারেন, তার নিয়োগ নিয়ম বহির্ভূতভাবে হয়েছে। বিষয়টি জানালে মাহেদুল তাকে বেতন হওয়ার আগে প্রতিমাসে ১০ হাজার টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন, তবে তা আর বাস্তবায়ন করেননি। পরে তিনি তাকে চাপ দিলে তার দেয়া টাকা ফেরত দিতে চাইলেও বছরের পর বছর থেকে তিনি তাকে ঘুরাচ্ছেন। টাকা ফেরতের দাবিতে বিভাগীয় কমিশনার, ইউএনও ও মিঠাপুকুর থানায় অভিযোগ করেন আব্দুল মমিন।

ঘটনার দিনের বিবরণ দিতে গিয়ে আব্দুল মমিন বলেন, গত শুক্রবার বিকেলের দিকে পায়রাবন্দের সদরপুর প্রামে ওই প্রতিষ্ঠানের পিয়ন হায়দার আলীর বাসার সামনে মাহেদুল আলমকে দেখতে পান। এসময় তিনি গাড়ি থেকে নেমে তার তার কাছে যান এবং তার দেয়া টাকা ফেরত চাইলে বাকবিতন্ডা শুরু হয়।  একপর্যায়ে স্থানীয়দের মধ্যস্থতায় একটি জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে দুই কিস্তিতে টাকা ফেরতের শর্তে স্বাক্ষর করেন মাহেদুল। এ সময় মাহেদুল স্ট্যাম্পে কী লেখা হবে তা বলে দিচ্ছিলেন এবং হায়দার আলী তা লিখছিলেন। মারধর বা জোর করে স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নেয়ার অভিযোগ পুরোপুরি মিথ্যা বলে জানান তিনি।

ঘটনার সময়কার একটি ভিডিও এই প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। ভিডিওতে দেখা যায়, একটি ঘরের ভেতরে একটি জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে লিখছেন প্রতিষ্ঠানের পিয়ন হায়দার আলী, আর পাশেই বসে অধ্যক্ষ মাহেদুল আলম তাকে বলে দিচ্ছেন কী লিখতে হবে।

এ বিষয়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত পিয়ন হায়দার আলী বলেন, ‘সেদিন মমিন সেখানে ছিল। সেখানে কোন শিক্ষক উপস্থিত ছিলেন না, মিথ্যা কথা বলব কেন।’

বর্তমান ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ রাজ্জাকুর রহমান অভিযোগ করে বলেন, শুক্রবার ছুটির দিন তিনি রংপুর শহরের নিজ বাসায় ছিলেন, অথচ তার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। মাহেদুল আলমের অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রতিবাদ করায় তাকে ও আরও কয়েকজন শিক্ষককে নানাভাবে হয়রানি করার চেষ্টা চলছে। তার দাবি, এসব মিথ্যা মামলার উদ্দেশ্য হলো ভয়ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রতিবাদ থামিয়ে দেওয়া। তিনি ঘটনার দ্রুত ও সুষ্ঠু তদন্তের আহ্বান জানিয়েছেন।

মিঠাপুকুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নূরে আলম বলেন, আমাদের কাছে এজাহার দিয়েছেন উনি (মাহেদুল আলম)। অভিযোগটি তদন্ত করা হচ্ছে। তদন্ত শেষে বিষয়টি জানাতে পারব।