ঢাকা ০৫:০৫ অপরাহ্ন, বুধবার, ১২ মার্চ ২০২৫, ২৮ ফাল্গুন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
ব্রেকিং নিউজঃ
নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে শর্টকোড চালুর সিদ্ধান্ত কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু হচ্ছে বাস ট্র্যাকিং সিস্টেম ধর্ষণকারীর মৃত্যুদণ্ডের দাবিতে গাজীপুরে ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ মিছিল নোয়াখালীতে নামাজ পড়তে গেলে মসজিদের শৌচাগারে শিশুকে বলৎকার বান্দরবানে দলবদ্ধ ধর্ষণের মামলায় ৪ আসামীর যাবজ্জীবন, ১ লাখ টাকা জরিমানা ধর্ষণ বিরোধী স্লোগানে মুখরিত কুবি ক্যাম্পাস বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়কসহ ৭ জন কারাগারে মেয়েকে ইভটিজিংয়ের প্রতিবাদ করায় বাবাকে কুপিয়ে জখম কিশোরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বহির্বিভাগের টিকিট বাণিজ্য ধর্ষণের বিরুদ্ধে কুবিতে মানববন্ধন 

আয়নাঘর ঘুরে যে বর্ণনা দিলেন তাসনিম খলিল

সোশ্যাল মিডিয়া
  • Update Time : ০৬:২৩:৪১ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
  • / ৪২ Time View

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমকর্মী ও ভুক্তভোগীদের নিয়ে বুধবার (১২ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে আয়নাঘর পরিদর্শন করেন। এ সময় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে আয়নাঘর পরিদর্শন করেন নেত্র নিউজের এডিটর-ইন-চিফ তাসনিম খলিল।

আয়নাঘর ঘুরে যা যা দেখেছেন তা নিয়ে নিজের ভেরিফায়েড ফেসুবক পেজে একটি পোস্ট দিয়েছেন তাসনিম খলিল। বৃহস্পতিবার (১৩ ফেব্রুয়ারি) দুপুর সোয়া ১২টার দিকে দেওয়া এক পোস্টে আয়নাঘরের খুঁটিনাটি বিষয় তুলে ধরেন তিনি। যার শিরোনাম দেন, ‘আয়নাঘরে যা দেখলাম’।

ফেসবুক পোস্টে তিনি লেখেন- আয়নাঘরের সবগুলো সেলের দেয়ালে নতুন রং করা হয়েছে — কটকটে গোলাপী। ডিজিএফআইয়ের কোন ফেমিনিস্ট কর্মকর্তা এই কাজ করেছে কে জানে! যেই করেছে সে সেলগুলোর মাঝখানের ডিভাইডার দেয়ালগুলো ভেঙে ফেলেছে; এগজস্ট ফ্যানগুলো খুলে ফেলেছে; দরজাগুলো ফ্রেম থেকে খুলে ফেলেছে; করিডোরের পাশের দেয়ালটা অনেকটাই ভেঙে ফেলেছে।

পাঠকদের জন্য তাসনিম খলিলের পোস্টটি তুলে ধরা হলো-

১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ — বাংলাদেশের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআইয়ের গোপন বন্দিশালা ও নির্যাতনকেন্দ্র জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেল (জেআইসি)। এর কোডনেইম বা ছদ্মনাম আয়নাঘর। এই আয়নাঘর নিয়েই ২০২২ সালে নেত্র নিউজে প্রকাশিত হয়েছিল ‘আয়নাঘরের বন্দী’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি।

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার সাথে সেই আয়নাঘরে ঢুকছি, অথচ আমার মাথায় ঘুরছে আম গাছ আর কাঁঠাল গাছ। আম গাছ কি এমন নাকি কাঁঠাল গাছ ওমন? গাছ দেখলে চিনবো তো? ঘটনা হলো, আমাকে এই আয়নাঘরের পাশে একটা কাঁঠাল গাছ খুঁজে বের করতে হবে।

‘আয়নাঘরের বন্দী’ প্রকাশিত হওয়ার পর এই বন্দীশালার বেশ কয়েকজন সাবেক বাসিন্দার সাথে আমার কথা হয়েছে। ঘণ্টার পর ঘন্টা আমি তাদের ইন্টারভিউ রেকর্ড করেছি। তাদেরই একজন সারভাইভার- ৩। তার বর্ণনায় উনি দীর্ঘ কয়েকটা মাস যে সেলে ছিলেন সেই সেলের দরজায় দাঁড়ালে সামনের দেয়ালের ঘুলঘুলি দিয়ে একটা কাঁঠাল গাছ দেখা যেত। সেই গাছটি খুঁজে পেলে ওই বর্ণনার একটা শক্ত ভেরিফিকেশন হয়। অথচ, বন্দীশালার গেটে দাঁড়িয়ে আমি কাঁঠাল গাছ দেখতে কেমন সেটাই ভুলে গেছি।

ঠিক তখনই মনে পড়লো। আরেহ, এই গেটটাইতো একটা ভেরিফিকেশন! শেখ মোহাম্মদ সেলিম (সারভাইভার- ১) যে কলাপসিবল গেটের কথা বলেছিলেন, কয়েক ধাপ সিঁড়ির কথা বলেছিলেন। এই সেই কলাপসিবল গেট, এই সেই সিঁড়ি। উপরে সবুজের মধ্যে সাদা লেখা সাইনবোর্ড: ‘করোনা আইসোলেশন সেন্টার’। ডিজিএফআইয়ের কোন রসিক কর্মকর্তা এই কাজ করেছে কে জানে! আইসোলেশন সেন্টার বটে।

গেট দিয়ে ঢুকে করিডোর ধরে এগোলাম। ডান দিকের একটা রুমে অনেকগুলো কাঠের দরজা এবং লোহার শিকের দরজা ফেলে রাখা। আরেকটু সামনে যেতেই পিছন থেকে কেউ একজন বলে উঠলেন, ‘তাসনিম ভাই, এই আয়নাঘরের নামটা কিন্তু আমরা আপনার কাছ থেকেই প্রথম শুনেছিলাম।’

ঘুরে তাকিয়ে দেখি সেনাবাহিনীর একজন অফিসার। চেহারায় খুবই তরুণ কিন্তু র‍্যাঙ্ক ব্যাজ অনুযায়ী অনেক সিনিয়র। মিটিমিটি হাসছেন, ‘আপনি কী খুঁজছেন আমি জানি। বড় এগজস্ট ফ্যানগুলো খুঁজছেনতো? আসেন আমি দেখাচ্ছি।’

অফিসারের পিছনে হাঁটছি। দুই-তিনটা সরু করিডোর ধরে যেতেই উনি আঙুল তুলে দেখালেন, ‘ওই যে।’

আমার বামে কয়েকটা সেল, ডানে দেয়াল আর সামনে ওই এগজস্ট ফ্যান। ফ্যান দেখতে দেখতেই বামে তাকালাম। দরজার উপরে সেলের নম্বর লেখা। এটা ১৯ নম্বর সেল। সাথে সাথে ফোনের খোঁজে আমার হাত পকেটে। মোবাশ্বেরকে একটা ভিডিও কল করতে হবে। মোবাশ্বের হাসান, খ্যাতনামা রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও গবেষক — আমার বন্ধু এবং আয়নাঘরের প্রাক্তন বন্দী। এখন অস্ট্রেলিয়ায় থাকে। তিন-চার রিঙ্গেই মোবাশ্বের কল ধরলো। সম্ভবত ঘুমাচ্ছিলো — উর্ধাঙ্গ উদলা।

‘বস! গায়ে একটা কাপড় দেন, আপ্নেতো পিনাকী না!’ তাড়াতাড়ি একটা শার্ট গায়ে দেয় মোবাশ্বের। আর আমি ফোন নাকের উপরে তুলে লোহার দরজা খুলে সেলে ঢুকি, ‘আপ্নেতো বলছিলেন আপ্নেরে ১৯ নম্বর সেলে রাখছিলো। দেখেনতো!’

মোবাশ্বের ভিডিও কলে সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। রুমের দেয়াল, উপরে ছোট এগজস্ট ফ্যান, ‘এইটাইতো মনে হইতেছে ম্যান!’ কিন্তু তার আরও ভেরিফিকেশন দরকার, ‘সেল থেকে বাইর হইলে ডান দিকে কয়েকটা স্টেপ গেলেই একটা বাথরুম থাকার কথা, দেখেন।’ আমি সেল থেকে বের হই, ডানে ঘুরি। সামনে কয়েক স্টেপ গিয়েই বাথরুমে ঢুকি। ভিডিও কলে মোবাশ্বের চিৎকার করে উঠে, ‘ইয়েস ম্যান! এই বাথরুম আমি ইউজ করছি। আমি এখানেই ছিলাম, আমারে এখানেই রাখছিলো!’

১৯ নম্বর সেলের ভেরিফিকেশন ডান। কল কেটে আবার করিডোর ধরে যাই। এদিকে দশটা, ওদিকে দশটা। এই সেকশনে মোট বিশটা সেল। ওই পাশে আরেকটা বাথরুমে একটা হাই কমোড। হাসিনুর রহমান (সারভাইভার- ২) যেমনটা বর্ণনা করেছিলেন। অনেকটাই মিলে যায়। আরেকটা সেকশনে যাই।

এদিকে পাঁচটা সেলের দরজা, ওদিকে পাঁচটা সেলের দরজা। এই সেকশনে মোট দশটা সেল। এই সেকশনেই শেখ মোহাম্মদ সেলিম ছিলেন। এই সেকশনেই সারভাইভার- ৩ ছিলেন। এই সেকশনেই সারভাইভার- ৪ ছিলেন। ২০১৬ সালে এই সেকশনে যারা বন্দী ছিলেন তাদের প্রায় প্রত্যেকের নাম-বৃত্তান্ত আমার মুখস্থ। তাদের ওই থাকার সকল চিহ্ন মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে।

সবগুলো সেলের দেয়ালে নতুন রং করা হয়েছে — কটকটে গোলাপী। ডিজিএফআইয়ের কোন ফেমিনিস্ট কর্মকর্তা এই কাজ করেছে কে জানে! যেই করেছে সে সেলগুলোর মাঝখানের ডিভাইডার দেয়ালগুলো ভেঙ্গে ফেলেছে; এগজস্ট ফ্যানগুলো খুলে ফেলেছে; দরজাগুলো ফ্রেম থেকে খুলে ফেলেছে; করিডোরের পাশের দেয়ালটা অনেকটাই ভেঙ্গে ফেলেছে।

আমি ভাঙ্গা দেয়াল দিয়ে বাইরে তাকাই। ঠিক বাইরে কয়েকটা কাঁঠাল গাছ। আমি চিৎকার করে নেত্র নিউজের ডিরেক্টর অফ ফটোগ্রাফি জীবন আহমেদকে ডাকি, ‘জীবন, জীবন! এইগুলা কাঁঠাল গাছ না?’ ‘জি ভাইয়া, এইগুলা কাঁঠাল গাছ’। আমি হাসি। জীবন হাসে। নেত্র নিউজের স্টাফ রিপোর্টার মিরাজ হাসে। কাঁঠাল গাছগুলো ওরা মুছে ফেলেনি — আয়নাঘরের স্বাক্ষী হয়ে কাঁঠাল গাছগুলো এখনও দাঁড়িয়ে আছে।

আয়নাঘর পরিদর্শন শেষে আওয়ামী লীগ শাসনামলকে ‘আইয়ামে জাহিলিয়াতের’ সঙ্গে তুলনা করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গুম কমিশনকে আয়নাঘর আবিষ্কারের জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে ড. ইউনূস বলেন, ‘আইয়ামে জাহিলিয়াত বলে একটা কথা আছে না, গত সরকার এই আইয়ামে জাহিলিয়াতকে প্রতিষ্ঠিত করে গেছে সর্বত্র।’

শুধু রাজধানী ঢাকা নয়, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে থাকা আয়নাঘরও খুঁজে বের করা হবে বলে জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিব শফিকুল আলম। তিনি বলেন, দেশে ৭০০ থেকে ৮০০ আয়নাঘর আছে। জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার নির্দেশেই এসব হয়েছে।

Please Share This Post in Your Social Media

আয়নাঘর ঘুরে যে বর্ণনা দিলেন তাসনিম খলিল

সোশ্যাল মিডিয়া
Update Time : ০৬:২৩:৪১ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমকর্মী ও ভুক্তভোগীদের নিয়ে বুধবার (১২ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে আয়নাঘর পরিদর্শন করেন। এ সময় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে আয়নাঘর পরিদর্শন করেন নেত্র নিউজের এডিটর-ইন-চিফ তাসনিম খলিল।

আয়নাঘর ঘুরে যা যা দেখেছেন তা নিয়ে নিজের ভেরিফায়েড ফেসুবক পেজে একটি পোস্ট দিয়েছেন তাসনিম খলিল। বৃহস্পতিবার (১৩ ফেব্রুয়ারি) দুপুর সোয়া ১২টার দিকে দেওয়া এক পোস্টে আয়নাঘরের খুঁটিনাটি বিষয় তুলে ধরেন তিনি। যার শিরোনাম দেন, ‘আয়নাঘরে যা দেখলাম’।

ফেসবুক পোস্টে তিনি লেখেন- আয়নাঘরের সবগুলো সেলের দেয়ালে নতুন রং করা হয়েছে — কটকটে গোলাপী। ডিজিএফআইয়ের কোন ফেমিনিস্ট কর্মকর্তা এই কাজ করেছে কে জানে! যেই করেছে সে সেলগুলোর মাঝখানের ডিভাইডার দেয়ালগুলো ভেঙে ফেলেছে; এগজস্ট ফ্যানগুলো খুলে ফেলেছে; দরজাগুলো ফ্রেম থেকে খুলে ফেলেছে; করিডোরের পাশের দেয়ালটা অনেকটাই ভেঙে ফেলেছে।

পাঠকদের জন্য তাসনিম খলিলের পোস্টটি তুলে ধরা হলো-

১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ — বাংলাদেশের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআইয়ের গোপন বন্দিশালা ও নির্যাতনকেন্দ্র জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেল (জেআইসি)। এর কোডনেইম বা ছদ্মনাম আয়নাঘর। এই আয়নাঘর নিয়েই ২০২২ সালে নেত্র নিউজে প্রকাশিত হয়েছিল ‘আয়নাঘরের বন্দী’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি।

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার সাথে সেই আয়নাঘরে ঢুকছি, অথচ আমার মাথায় ঘুরছে আম গাছ আর কাঁঠাল গাছ। আম গাছ কি এমন নাকি কাঁঠাল গাছ ওমন? গাছ দেখলে চিনবো তো? ঘটনা হলো, আমাকে এই আয়নাঘরের পাশে একটা কাঁঠাল গাছ খুঁজে বের করতে হবে।

‘আয়নাঘরের বন্দী’ প্রকাশিত হওয়ার পর এই বন্দীশালার বেশ কয়েকজন সাবেক বাসিন্দার সাথে আমার কথা হয়েছে। ঘণ্টার পর ঘন্টা আমি তাদের ইন্টারভিউ রেকর্ড করেছি। তাদেরই একজন সারভাইভার- ৩। তার বর্ণনায় উনি দীর্ঘ কয়েকটা মাস যে সেলে ছিলেন সেই সেলের দরজায় দাঁড়ালে সামনের দেয়ালের ঘুলঘুলি দিয়ে একটা কাঁঠাল গাছ দেখা যেত। সেই গাছটি খুঁজে পেলে ওই বর্ণনার একটা শক্ত ভেরিফিকেশন হয়। অথচ, বন্দীশালার গেটে দাঁড়িয়ে আমি কাঁঠাল গাছ দেখতে কেমন সেটাই ভুলে গেছি।

ঠিক তখনই মনে পড়লো। আরেহ, এই গেটটাইতো একটা ভেরিফিকেশন! শেখ মোহাম্মদ সেলিম (সারভাইভার- ১) যে কলাপসিবল গেটের কথা বলেছিলেন, কয়েক ধাপ সিঁড়ির কথা বলেছিলেন। এই সেই কলাপসিবল গেট, এই সেই সিঁড়ি। উপরে সবুজের মধ্যে সাদা লেখা সাইনবোর্ড: ‘করোনা আইসোলেশন সেন্টার’। ডিজিএফআইয়ের কোন রসিক কর্মকর্তা এই কাজ করেছে কে জানে! আইসোলেশন সেন্টার বটে।

গেট দিয়ে ঢুকে করিডোর ধরে এগোলাম। ডান দিকের একটা রুমে অনেকগুলো কাঠের দরজা এবং লোহার শিকের দরজা ফেলে রাখা। আরেকটু সামনে যেতেই পিছন থেকে কেউ একজন বলে উঠলেন, ‘তাসনিম ভাই, এই আয়নাঘরের নামটা কিন্তু আমরা আপনার কাছ থেকেই প্রথম শুনেছিলাম।’

ঘুরে তাকিয়ে দেখি সেনাবাহিনীর একজন অফিসার। চেহারায় খুবই তরুণ কিন্তু র‍্যাঙ্ক ব্যাজ অনুযায়ী অনেক সিনিয়র। মিটিমিটি হাসছেন, ‘আপনি কী খুঁজছেন আমি জানি। বড় এগজস্ট ফ্যানগুলো খুঁজছেনতো? আসেন আমি দেখাচ্ছি।’

অফিসারের পিছনে হাঁটছি। দুই-তিনটা সরু করিডোর ধরে যেতেই উনি আঙুল তুলে দেখালেন, ‘ওই যে।’

আমার বামে কয়েকটা সেল, ডানে দেয়াল আর সামনে ওই এগজস্ট ফ্যান। ফ্যান দেখতে দেখতেই বামে তাকালাম। দরজার উপরে সেলের নম্বর লেখা। এটা ১৯ নম্বর সেল। সাথে সাথে ফোনের খোঁজে আমার হাত পকেটে। মোবাশ্বেরকে একটা ভিডিও কল করতে হবে। মোবাশ্বের হাসান, খ্যাতনামা রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও গবেষক — আমার বন্ধু এবং আয়নাঘরের প্রাক্তন বন্দী। এখন অস্ট্রেলিয়ায় থাকে। তিন-চার রিঙ্গেই মোবাশ্বের কল ধরলো। সম্ভবত ঘুমাচ্ছিলো — উর্ধাঙ্গ উদলা।

‘বস! গায়ে একটা কাপড় দেন, আপ্নেতো পিনাকী না!’ তাড়াতাড়ি একটা শার্ট গায়ে দেয় মোবাশ্বের। আর আমি ফোন নাকের উপরে তুলে লোহার দরজা খুলে সেলে ঢুকি, ‘আপ্নেতো বলছিলেন আপ্নেরে ১৯ নম্বর সেলে রাখছিলো। দেখেনতো!’

মোবাশ্বের ভিডিও কলে সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। রুমের দেয়াল, উপরে ছোট এগজস্ট ফ্যান, ‘এইটাইতো মনে হইতেছে ম্যান!’ কিন্তু তার আরও ভেরিফিকেশন দরকার, ‘সেল থেকে বাইর হইলে ডান দিকে কয়েকটা স্টেপ গেলেই একটা বাথরুম থাকার কথা, দেখেন।’ আমি সেল থেকে বের হই, ডানে ঘুরি। সামনে কয়েক স্টেপ গিয়েই বাথরুমে ঢুকি। ভিডিও কলে মোবাশ্বের চিৎকার করে উঠে, ‘ইয়েস ম্যান! এই বাথরুম আমি ইউজ করছি। আমি এখানেই ছিলাম, আমারে এখানেই রাখছিলো!’

১৯ নম্বর সেলের ভেরিফিকেশন ডান। কল কেটে আবার করিডোর ধরে যাই। এদিকে দশটা, ওদিকে দশটা। এই সেকশনে মোট বিশটা সেল। ওই পাশে আরেকটা বাথরুমে একটা হাই কমোড। হাসিনুর রহমান (সারভাইভার- ২) যেমনটা বর্ণনা করেছিলেন। অনেকটাই মিলে যায়। আরেকটা সেকশনে যাই।

এদিকে পাঁচটা সেলের দরজা, ওদিকে পাঁচটা সেলের দরজা। এই সেকশনে মোট দশটা সেল। এই সেকশনেই শেখ মোহাম্মদ সেলিম ছিলেন। এই সেকশনেই সারভাইভার- ৩ ছিলেন। এই সেকশনেই সারভাইভার- ৪ ছিলেন। ২০১৬ সালে এই সেকশনে যারা বন্দী ছিলেন তাদের প্রায় প্রত্যেকের নাম-বৃত্তান্ত আমার মুখস্থ। তাদের ওই থাকার সকল চিহ্ন মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে।

সবগুলো সেলের দেয়ালে নতুন রং করা হয়েছে — কটকটে গোলাপী। ডিজিএফআইয়ের কোন ফেমিনিস্ট কর্মকর্তা এই কাজ করেছে কে জানে! যেই করেছে সে সেলগুলোর মাঝখানের ডিভাইডার দেয়ালগুলো ভেঙ্গে ফেলেছে; এগজস্ট ফ্যানগুলো খুলে ফেলেছে; দরজাগুলো ফ্রেম থেকে খুলে ফেলেছে; করিডোরের পাশের দেয়ালটা অনেকটাই ভেঙ্গে ফেলেছে।

আমি ভাঙ্গা দেয়াল দিয়ে বাইরে তাকাই। ঠিক বাইরে কয়েকটা কাঁঠাল গাছ। আমি চিৎকার করে নেত্র নিউজের ডিরেক্টর অফ ফটোগ্রাফি জীবন আহমেদকে ডাকি, ‘জীবন, জীবন! এইগুলা কাঁঠাল গাছ না?’ ‘জি ভাইয়া, এইগুলা কাঁঠাল গাছ’। আমি হাসি। জীবন হাসে। নেত্র নিউজের স্টাফ রিপোর্টার মিরাজ হাসে। কাঁঠাল গাছগুলো ওরা মুছে ফেলেনি — আয়নাঘরের স্বাক্ষী হয়ে কাঁঠাল গাছগুলো এখনও দাঁড়িয়ে আছে।

আয়নাঘর পরিদর্শন শেষে আওয়ামী লীগ শাসনামলকে ‘আইয়ামে জাহিলিয়াতের’ সঙ্গে তুলনা করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গুম কমিশনকে আয়নাঘর আবিষ্কারের জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে ড. ইউনূস বলেন, ‘আইয়ামে জাহিলিয়াত বলে একটা কথা আছে না, গত সরকার এই আইয়ামে জাহিলিয়াতকে প্রতিষ্ঠিত করে গেছে সর্বত্র।’

শুধু রাজধানী ঢাকা নয়, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে থাকা আয়নাঘরও খুঁজে বের করা হবে বলে জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিব শফিকুল আলম। তিনি বলেন, দেশে ৭০০ থেকে ৮০০ আয়নাঘর আছে। জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার নির্দেশেই এসব হয়েছে।