ঢাকা ০৭:৪৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ০৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
দৃপ্ত গলায় অন্যায়ের প্রতিবাদ

নিউজ করায় ফাঁসানো হয়েছে আমাকে: নওরোজ সম্পাদক

নিজস্ব প্রতিবেদক
  • Update Time : ০৪:৩৪:৪৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ৮ ডিসেম্বর ২০২৫
  • / ২০৪ Time View

আদালতে দৈনিক নওরোজ সম্পাদক শামসুল হক দুররানী।

আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে দৃপ্ত গলায় অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছেন দৈনিক নওরোজ সম্পাদক শামসুল হক দুররানী। ভুয়া মামলায় কারাগারের পাঠানোর আদেশের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ এ সিনিয়র সাংবাদিক বলেছেন, বিচারকরা অন্যায় করলে কি নিউজ করা যাবে না? আমি নিউজ করেছি, তাই ফাঁসানো হয়েছে আমাকে। গতকাল রোববার ঢাকার আদালতের কাঠগড়ায় দেখা যায় এ দৃশ্য। এখানে দাঁড়ানো মানুষের মুখে সাধারণত দেখা যায় আতঙ্ক, অনিশ্চয়তা কিংবা নীরব মেনে নেওয়া। কিন্তু সেই কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে গতকাল রোববার অন্যরকম দৃশ্য দেখলেন সাংবাদিকেরা।

আদালতে নেমে আসে নীরবতা

শুনানি শেষ হওয়ার পর আদালতে এক ধরনের নীরবতা নেমে আসে। জামিন নামঞ্জুর। সিকিউরিটি গার্ডেরা তাঁকে কারাগারের পথে নিয়ে যাচ্ছে। সাংবাদিকেরা নোট নিচ্ছেন। দুররানীর মুখেও তখন আর আগের মতো জোয়ার নেই, তবে তিক্ততা রয়ে গেছে। আদালত ভবনের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্য যেন বলে দিচ্ছিল—কোনো একটি মামলার কাগজে-কলমে লেখা গল্পের আড়ালে থাকে মানুষ, থাকে ক্ষমতাকাঠামো, থাকে প্রতিবাদ আর প্রশ্নের লড়াই।

এই পুরো ঘটনাই এখন একটি মামলার অংশ। তদন্ত, সাক্ষ্য, আদালতের রায়—এসবের মধ্য দিয়েই জানা যাবে কোন অভিযোগ সত্য, কোন দাবির ভিত্তি আছে আর কতটুকু নেই। কিন্তু সাংবাদিকতার দৃষ্টিতে, আইনের আদালতের পাশাপাশি আরেকটি আদালত সবসময় থেকেই যায়—জনমতের আদালত, যেখানে প্রতিটি প্রশ্ন প্রতিটি মানুষের ভিন্নভাবে ধরা পড়ে। দুররানীর শেষ উচ্চারণ সেই আদালতের উদ্দেশেই যেন- ‘আমি শুধু নিউজ করেছি।’

জমে থাকা ক্ষোভকে প্রকাশ করলেন দৃপ্ত কণ্ঠে

শামসুল হক দুররানীর বিরুদ্ধে অভিযোগ- এক ঠিকাদারের কাছ থেকে ২০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি এবং ভয়ভীতি দেখানো। মামলাটি দায়ের করেন জামালপুরের ঠিকাদার রাজিবুল ইসলাম। আদালতের নথি অনুসারে, কাজের ওপর ‘ঝামেলা’ তৈরি হয়েছিল; এরপর এক ফোনকল, তারপর সাভার বাসস্ট্যান্ডে সাক্ষাৎ- আর সেখানেই নওরোজ সম্পাদক নাকি টাকা দাবি করেন। তবে এই অভিযোগ পুরোটাই অস্বীকার করেছেন তিনি।

জামিন চাইতে গিয়ে আদালতে আত্মসমর্পণ করেন তিনি। কিন্তু সেই আবেদন নামঞ্জুর হয়। আদালতের আদেশে তিনি সোজা কারাগারের পথে। ‘আমি নিউজ করেছি, তাই মামলা’ বলেন, শামসুল হক দুররানী।

কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে তিনি শ্বাস নিলেন গভীরভাবে, যেন বহুদিন জমে থাকা ক্ষোভকে প্রকাশ করার সময় এসেছে। তিনি দাবি করলেন—তার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাটি “মিথ্যা” এবং এর পেছনে আছে এক সময় চাঁপাইনবাবগঞ্জের জেলা জজ থাকা বর্তমান আইন সচিব লিয়াকত আলী মোল্লার পরোক্ষ ভূমিকা। কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেছেন, অতীতে নওরোজে প্রকাশিত কিছু খবর—যেখানে কয়েকটি মাদক ও বিস্ফোরক মামলায় আসামিদের জামিন দেওয়ার প্রসঙ্গ ছিল। অভিযোগ করেন, সেই সংবাদ প্রকাশের পরই জজের বদলি হয়। “আমার নিউজে তিনি ক্ষুব্ধ ছিলেন,”—দাবি সম্পাদকের। তবে এসবই দুররানীর পক্ষ থেকে উত্থাপিত অভিযোগ; সেগুলোর সত্যতা আদালতে বা তদন্তে এখনো যাচাই হয়নি।

নিশ্চুপ অপর পক্ষ

এখানেই গল্পটা আরও ধোঁয়াশায় ঢেকে যায়। আইন সচিব লিয়াকত আলী মোল্লা বা উপসচিব গোলজার রহমান—দুররানীর অভিযোগের যাঁরা কেন্দ্রবিন্দু—তাঁদের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। একপক্ষের বক্তব্য যখন তীব্র, অপরপক্ষের নীরবতা তখন আরও প্রশ্ন তৈরি করে, যদিও নীরবতা মানেই দায় নয়; বরং এটি আইনি প্রক্রিয়া চলার কারণে বক্তব্য না দেওয়ার সিদ্ধান্তও হতে পারে।

একটি মামলার দুই গল্প

এই মামলার দুইটি সংস্করণ এখন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে—

বাদীর গল্প:

একজন ঠিকাদার, যিনি কাজে বাধা পাচ্ছিলেন। এক কল, এক সাক্ষাৎ, তারপর টাকার দাবি ও হুমকি।

বিবাদীর গল্প:

একজন সংবাদ সম্পাদক, যিনি দাবি করছেন— “সাংবাদিকতা করার ফলেই ফাঁসানো হয়েছে আমাকে।”

সময়ের অপেক্ষা—কোন গল্প সত্য, সেটি আদালতই নির্ধারণ করবেন। সংবাদমাধ্যম বনাম ক্ষমতা: পুরনো গল্পের নতুন অধ্যায় এ গল্প পুরোপুরি নতুন নয়। দেশের সংবাদমাধ্যম কর্মীরা প্রায়ই বিভিন্ন মামলার মুখোমুখি হন—কখনও সাইবার আইনে, কখনও মানহানিতে, কখনও প্রভাবশালী কারও অভিযোগে। অনেকসময় সত্যিকার অপরাধ রয়েছে, আবার কখনও অভিযোগ ওঠে হয়রানির।

দুররানীর বক্তব্য সেই লড়াইয়েরই একটি প্রতিধ্বনি— “বিচারকরা অন্যায় করলে কি নিউজ করা যাবে না?” অভিযোগ সত্য কি না, তা প্রক্রিয়া শেষে জানা যাবে; কিন্তু প্রশ্নটি থেকে যায় সাংবাদিকতার পরিসরে।

Please Share This Post in Your Social Media

দৃপ্ত গলায় অন্যায়ের প্রতিবাদ

নিউজ করায় ফাঁসানো হয়েছে আমাকে: নওরোজ সম্পাদক

নিজস্ব প্রতিবেদক
Update Time : ০৪:৩৪:৪৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ৮ ডিসেম্বর ২০২৫

আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে দৃপ্ত গলায় অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছেন দৈনিক নওরোজ সম্পাদক শামসুল হক দুররানী। ভুয়া মামলায় কারাগারের পাঠানোর আদেশের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ এ সিনিয়র সাংবাদিক বলেছেন, বিচারকরা অন্যায় করলে কি নিউজ করা যাবে না? আমি নিউজ করেছি, তাই ফাঁসানো হয়েছে আমাকে। গতকাল রোববার ঢাকার আদালতের কাঠগড়ায় দেখা যায় এ দৃশ্য। এখানে দাঁড়ানো মানুষের মুখে সাধারণত দেখা যায় আতঙ্ক, অনিশ্চয়তা কিংবা নীরব মেনে নেওয়া। কিন্তু সেই কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে গতকাল রোববার অন্যরকম দৃশ্য দেখলেন সাংবাদিকেরা।

আদালতে নেমে আসে নীরবতা

শুনানি শেষ হওয়ার পর আদালতে এক ধরনের নীরবতা নেমে আসে। জামিন নামঞ্জুর। সিকিউরিটি গার্ডেরা তাঁকে কারাগারের পথে নিয়ে যাচ্ছে। সাংবাদিকেরা নোট নিচ্ছেন। দুররানীর মুখেও তখন আর আগের মতো জোয়ার নেই, তবে তিক্ততা রয়ে গেছে। আদালত ভবনের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্য যেন বলে দিচ্ছিল—কোনো একটি মামলার কাগজে-কলমে লেখা গল্পের আড়ালে থাকে মানুষ, থাকে ক্ষমতাকাঠামো, থাকে প্রতিবাদ আর প্রশ্নের লড়াই।

এই পুরো ঘটনাই এখন একটি মামলার অংশ। তদন্ত, সাক্ষ্য, আদালতের রায়—এসবের মধ্য দিয়েই জানা যাবে কোন অভিযোগ সত্য, কোন দাবির ভিত্তি আছে আর কতটুকু নেই। কিন্তু সাংবাদিকতার দৃষ্টিতে, আইনের আদালতের পাশাপাশি আরেকটি আদালত সবসময় থেকেই যায়—জনমতের আদালত, যেখানে প্রতিটি প্রশ্ন প্রতিটি মানুষের ভিন্নভাবে ধরা পড়ে। দুররানীর শেষ উচ্চারণ সেই আদালতের উদ্দেশেই যেন- ‘আমি শুধু নিউজ করেছি।’

জমে থাকা ক্ষোভকে প্রকাশ করলেন দৃপ্ত কণ্ঠে

শামসুল হক দুররানীর বিরুদ্ধে অভিযোগ- এক ঠিকাদারের কাছ থেকে ২০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি এবং ভয়ভীতি দেখানো। মামলাটি দায়ের করেন জামালপুরের ঠিকাদার রাজিবুল ইসলাম। আদালতের নথি অনুসারে, কাজের ওপর ‘ঝামেলা’ তৈরি হয়েছিল; এরপর এক ফোনকল, তারপর সাভার বাসস্ট্যান্ডে সাক্ষাৎ- আর সেখানেই নওরোজ সম্পাদক নাকি টাকা দাবি করেন। তবে এই অভিযোগ পুরোটাই অস্বীকার করেছেন তিনি।

জামিন চাইতে গিয়ে আদালতে আত্মসমর্পণ করেন তিনি। কিন্তু সেই আবেদন নামঞ্জুর হয়। আদালতের আদেশে তিনি সোজা কারাগারের পথে। ‘আমি নিউজ করেছি, তাই মামলা’ বলেন, শামসুল হক দুররানী।

কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে তিনি শ্বাস নিলেন গভীরভাবে, যেন বহুদিন জমে থাকা ক্ষোভকে প্রকাশ করার সময় এসেছে। তিনি দাবি করলেন—তার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাটি “মিথ্যা” এবং এর পেছনে আছে এক সময় চাঁপাইনবাবগঞ্জের জেলা জজ থাকা বর্তমান আইন সচিব লিয়াকত আলী মোল্লার পরোক্ষ ভূমিকা। কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেছেন, অতীতে নওরোজে প্রকাশিত কিছু খবর—যেখানে কয়েকটি মাদক ও বিস্ফোরক মামলায় আসামিদের জামিন দেওয়ার প্রসঙ্গ ছিল। অভিযোগ করেন, সেই সংবাদ প্রকাশের পরই জজের বদলি হয়। “আমার নিউজে তিনি ক্ষুব্ধ ছিলেন,”—দাবি সম্পাদকের। তবে এসবই দুররানীর পক্ষ থেকে উত্থাপিত অভিযোগ; সেগুলোর সত্যতা আদালতে বা তদন্তে এখনো যাচাই হয়নি।

নিশ্চুপ অপর পক্ষ

এখানেই গল্পটা আরও ধোঁয়াশায় ঢেকে যায়। আইন সচিব লিয়াকত আলী মোল্লা বা উপসচিব গোলজার রহমান—দুররানীর অভিযোগের যাঁরা কেন্দ্রবিন্দু—তাঁদের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। একপক্ষের বক্তব্য যখন তীব্র, অপরপক্ষের নীরবতা তখন আরও প্রশ্ন তৈরি করে, যদিও নীরবতা মানেই দায় নয়; বরং এটি আইনি প্রক্রিয়া চলার কারণে বক্তব্য না দেওয়ার সিদ্ধান্তও হতে পারে।

একটি মামলার দুই গল্প

এই মামলার দুইটি সংস্করণ এখন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে—

বাদীর গল্প:

একজন ঠিকাদার, যিনি কাজে বাধা পাচ্ছিলেন। এক কল, এক সাক্ষাৎ, তারপর টাকার দাবি ও হুমকি।

বিবাদীর গল্প:

একজন সংবাদ সম্পাদক, যিনি দাবি করছেন— “সাংবাদিকতা করার ফলেই ফাঁসানো হয়েছে আমাকে।”

সময়ের অপেক্ষা—কোন গল্প সত্য, সেটি আদালতই নির্ধারণ করবেন। সংবাদমাধ্যম বনাম ক্ষমতা: পুরনো গল্পের নতুন অধ্যায় এ গল্প পুরোপুরি নতুন নয়। দেশের সংবাদমাধ্যম কর্মীরা প্রায়ই বিভিন্ন মামলার মুখোমুখি হন—কখনও সাইবার আইনে, কখনও মানহানিতে, কখনও প্রভাবশালী কারও অভিযোগে। অনেকসময় সত্যিকার অপরাধ রয়েছে, আবার কখনও অভিযোগ ওঠে হয়রানির।

দুররানীর বক্তব্য সেই লড়াইয়েরই একটি প্রতিধ্বনি— “বিচারকরা অন্যায় করলে কি নিউজ করা যাবে না?” অভিযোগ সত্য কি না, তা প্রক্রিয়া শেষে জানা যাবে; কিন্তু প্রশ্নটি থেকে যায় সাংবাদিকতার পরিসরে।