রংপুরে বছরে ৮৬০ হেক্টর আবাদযোগ্য জমি হারাচ্ছে কৃষি, শহরমুখী হচ্ছেন কৃষকরা
- Update Time : ০৭:৩১:২০ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৫
- / ২৩ Time View
রংপুরে কৃষকরা কৃষিকাজে আগ্রহ হারিয়ে শহরমুখী হচ্ছে। কমে আসছে কৃষিজমির পরিমাণ। অন্যদিকে অনেক এলাকার উর্বর জমি চলে যাচ্ছে আবাসন ও শিল্প প্রকল্পের দখলে। এক হিসাবে দেখা গেছে, রংপুরে প্রতি বছর আবাদযোগ্য জমি কমছে গড়ে ৮৬০ হেক্টর। এর প্রভাব পড়ছে সার্বিক কৃষি উৎপাদনে।
রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, পাঁচ বছর আগে জেলার মোট আবাদযোগ্য জমি ছিল ২ লক্ষ ১ হাজার ৪৯১ হেক্টর, যা বর্তমানে কমে দাঁড়িয়েছে ১ লক্ষ ৮৯ হাজার ৫১৪ হেক্টরে। অর্থাৎ, মাত্র পাঁচ বছরে আবাদযোগ্য জমি কমেছে ১১ হাজার ৯৭৭ হেক্টর জমি। এর বড় অংশই বোরো, আমন, আউশ চাষযোগ্য উর্বর জমি।
রংপুরের খটখটিয়া এলাকার বাসিন্দা সজীব ভুঁইয়া জানান, জেলার জনসংখ্যা বাড়ার পাশাপাশি অন্যান্য জেলা থেকেও মানুষ কর্মসংস্থানের জন্য আসছেন। ফলে অনেক কৃষিজমি এখন বসতবাড়ি ও বাণিজ্যিক স্থাপনার জন্য ব্যবহার হচ্ছে। জলকর, উত্তম, কুকরুল, দর্শনা, বাহার কাছনা ও বুড়িরহাট রোড এলাকায় আগে যে কৃষিজমি দেখা যেত, এখন সেখানে আবাসন ও শিল্প প্রকল্প গড়ে উঠেছে। এখন রাস্তাঘাট সম্প্রসারণ, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও বসতবাড়ির কারণে কৃষিজমি অনেক কমে গেছে। এমনকি তিন-চার ফসলি জমিতেও এসকল প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। এই হারে জমি হারালে ভবিষ্যতে খাদ্য উৎপাদন ও অর্থনীতি প্রভাবিত হতে পারে।
রংপুর অঞ্চলের অর্থনীতি মূলত কৃষিনির্ভর এবং কৃষিই এখানকার মানুষের প্রধান পেশা। তবে সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এই অঞ্চলে কৃষি পরিবারের সংখ্যা ক্রমশ কমছে। বর্তমানে এই অঞ্চলে কৃষি পরিবারের সংখ্যা ৬ লক্ষ ১১ হাজার ৩৩৯। যার মধ্যে বর্তমানে জেলায় বড় কৃষক পরিবারের সংখ্যা রয়েছে ১.১৪ শতাংশ। যেখানে কয়েক বছর আগেও ছিলো প্রায় ১.৬৭ শতাংশ। এছাড়াও, ভুমিহীন কৃষক পরিবারের সংখ্যা রয়েছে ১৭.৮৫ শতাংশ, প্রান্তিক কৃষক পরিবারের সংখ্যা রয়েছে ৩৮.৩৬ শতাংশ, ক্ষুদ্র কৃষক পরিবারের সংখ্যা রয়েছে ৩৩.১৪ শতাংশ, মাঝারি কৃষক পরিবারের সংখ্যা রয়েছে ৯.৫২ শতাংশ। অর্থাৎ, দিনে দিনে কমছে জেলার বড় কৃষকের সংখ্যা।
রংপুরে কাউনিয়া উপজেলার এক কৃষক মমিনুল ইসলাম বলেন, এখন কৃষি কাজে খরচ অনেক বেড়ে গেছে। দেখা যায়, সারের দাম বেশি থাকে আবার আমরা ফসলের ন্যায্য মূল্য পাইনা এজন্য আর চাষের কাজ করতে ইচ্ছা হয়না।
আরও বেশ কয়েকজন কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ন্যায্যমূল্যের অভাব ও উৎপাদন খরচ বাড়ার কারণে তারা ধীরে ধীরে কৃষিকাজে আগ্রহ হারাচ্ছেন। অনেকেই পরিমিত আয়ের নিশ্চয়তা না থাকায় ঢাকাসহ বড় শহরমুখী হয়ে বিকল্প উপার্জনের পথ বেছে নিচ্ছেন।
রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার কৃষক রহিম মিয়ার সঙ্গে কথা বলেও একই কথা শোনা গেল। তিনি বলেন, চাষ তো করতে চাই, কিন্তু ন্যায্যমূল্য পাবো তার তো কোনো গ্যারান্টি নাই। সারের দাম, সেচের খরচ সবই বাড়তি। কষ্ট করে মাঠে কাজ করি, আর শেষে ফসলটা কম দামে বেচতে হয়। এর চেয়ে ঢাকায় রিকশা চালাইলেই বরং বেশি টাকা আসে। এখন আর চাষাবাদে তেমন মনই লাগে না।
বিশেষজ্ঞদের মতে, জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে খাদ্য চাহিদাও বাড়ছে। গত পাঁচ বছরে রংপুরে জনসংখ্যা বেড়েছে প্রায় দেড় লাখ। উন্নত প্রযুক্তি ও শস্যের নতুন জাত ব্যবহারের ফলে হেক্টর প্রতি উৎপাদন বাড়ছে, কিন্তু আবাদযোগ্য জমি কমে যাওয়ায় সার্বিকভাবে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ প্রায় অপরিবর্তিত রয়েছে। একসময় রংপুর থেকে দেশের অন্যান্য জেলায় খাদ্য সরবরাহ করা হতো। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে শিগগিরই নিজ জেলার মানুষের খাদ্য চাহিদা মেটাতেও কষ্ট হয়ে যাবে।
এ ব্যাপারে রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক মো. সাইফুল ইসলাম জানান, উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়া, ন্যায্যমূল্য না পাওয়া এবং জমি কমে যাওয়ার প্রভাব কৃষি পরিবারগুলোর জীবিকায় চাপ তৈরি করছে। ফলে অনেক কৃষি পরিবার শহরমুখী হচ্ছে অন্য পেশার তাগিদে। এখনই সমন্বিত পদক্ষেপ না নিলে ভবিষ্যতে খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়তে পারে।
এদিকে, অপরিকল্পিত নগরায়ন ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে দেশের কৃষিজমি দ্রুতই কমে যাচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে কৃষিজমি সংরক্ষণ, ভূমির জোনভিত্তিক পরিকল্পনা এবং পাহাড়-টিলা, বন, জলাশয়ের ভূমি রক্ষায় ‘ভূমি ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ ও কৃষি ভূমি সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৫’ প্রণয়ন করেছে সরকার। এ অধ্যাদেশ অনুযায়ী অনুমোদন ব্যতীত কৃষিভূমি অকৃষিকাজে ব্যবহার ও কৃষিজমিতে বাণিজ্যিক আবাসন, রিসোর্ট, শিল্পপ্রতিষ্ঠান বা কারখানা নির্মাণ হবে অপরাধ। যার জন্য পেতে হবে শাস্তি।
সম্প্রতি ভূমি মন্ত্রণালয় এ অধ্যাদেশের খসড়া চূড়ান্ত করেছে। উপদেষ্টা পরিষদের অনুমোদনের পর গেজেট জারির মাধ্যমে এটি কার্যকর হবে।
অধ্যাদেশের ৬ নম্বর ধারা অনুযায়ী সরকার ভূমিকে ১৮ শ্রেণিভুক্ত করবে। এই ধারায় বলা হয়েছে, সরকার জোনিং ম্যাপ প্রণয়নের উদ্দেশ্যে ভূমিকে ১৮ শ্রেণিভুক্ত করবে এবং জাতীয় স্বার্থে খাদ্য নিরাপত্তা ও পরিবেশ সংরক্ষণ বিবেচনায় প্রয়োজনে নতুন জোন সৃজন, বিদ্যমান জোন একত্রীকরণ, পৃথকীকরণ ও বিলুপ্ত করতে পারবে।
শ্রেণিগুলো হলো– ১. কৃষি অঞ্চল, ২. বিশেষ কৃষি অঞ্চল, ৩. কৃষি-মৎস্য চাষ অঞ্চল, ৪. নদী ও খাল, ৫. জলাশয়, জলাধার ও জলাভূমি, ৬. পরিবহন ও যোগাযোগ অঞ্চল, ৭. শহরে আবাসিক অঞ্চল, ৮. গ্রামীণ বসতি অঞ্চল, ৯. মিশ্র ব্যবহার, ১০. বাণিজ্যিক অঞ্চল, ১১. শিল্প অঞ্চল, ১২. প্রাতিষ্ঠানিক ও নাগরিক সুবিধা অঞ্চল, ১৩. বন ও রক্ষিত এলাকা অঞ্চল, ১৪. পরিবেশগতভাবে সংকটাপন্ন এলাকা/পরিবেশগতভাবে সংবেদনশীল এলাকা, ১৫. সাংস্কৃতিক-ঐতিহ্য অঞ্চল, ১৬. পাহাড়-টিলা, ১৭. পতিত এবং ১৮. অন্যান্য।
এ বিষয়ে ভূমি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব এ এস এম সালেহ আহমেদ বলেন, বর্তমানে বিভিন্ন উন্নয়ন কাজে কৃষিজমি ব্যবহার হচ্ছে এবং এর পরিমাণ কমে যাচ্ছে। আমাদের দেশে তো জমির পরিমাণ কম। বাংলাদেশ কৃষিভিত্তিক দেশ। কৃষিজমি যদি এভাবে কমে যায় খাদ্য ঘাটতি হবে। সেজন্য কৃষিজমির সুরক্ষায় মূলত এই অধ্যাদেশ করা হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, শুধু কৃষিজমি নয়, এই অধ্যাদেশের মাধ্যমে অন্যান্য জমি যেমন বন, পাহাড়, জলাশয় সেগুলোর সুরক্ষা দিতে চাইছি। এই অধ্যাদেশ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ হয়ে উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদন পেলে দ্রুতই কার্যকর করা হবে।
Please Share This Post in Your Social Media
-
সর্বশেষ
-
জনপ্রিয়








































































































































































































