ঢাকা ০৫:১৭ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৫, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

দারিদ্র্যকে জয় করে মোসাহিদের বিসিএস সাফল্য

সাজিদুর রহমান, কুবি
  • Update Time : ০৩:০৫:২১ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৫
  • / ২৪৩ Time View

মোসাহিদ আহমেদ

অভাব, দায়িত্ব, ব্যর্থতা আর অনিশ্চয়তা অনেক সময় মানুষকে ভেঙে দেয়। আবার কাউকে তৈরি করে আরও শক্ত করে, করে তুলে আরও উদ্যমী। এক তরুণ; যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পর যে সময়টাতে আনন্দ উল্লাসে মেতে থাকার কথা, তখনই হারান বটবৃক্ষ বাবাকে। আর্থিক সংকট, পরিবারের দায়িত্ব, নিজের পড়ালেখার খরচ সব মিলিয়ে দায়িত্বের ভার কাঁধে। কিন্তু তিনি হার মানেননি। টিউশন করে সংসার  চালিয়েছেন, রাতের পর রাত পড়েছেন, নিজের দুর্বলতাকে পরিণত করেছেন শক্তিতে।

বলছিলাম সদ্য ৪৯তম স্পেশাল বিসিএস (শিক্ষা) ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী মোসাহিদ আহমেদের কথা। শত প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে যিনি নিজের স্বপ্নকে আঁকড়ে ধরে এগিয়ে গেছেন, সংকটকে পরিণত করেছেন শক্তিতে। আজ বলবো তার বিসিএস জয়ের গল্প। 

শুরুতেই বটবৃক্ষ হারানোর আঘাত

প্রতিটি শিক্ষার্থীর বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরুটা হয় আনন্দের। সারাদিন নতুন বন্ধুদের সাথে আড্ডা, পার্টি। আনন্দে উল্লাসে মেতে থাকার সময় বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরুটা। তবে, মোসাহিদের বেলায় ছিল একটু ব্যতিক্রম ও কঠিন। অনার্সের প্রথম সেমিস্টারেই বটবৃক্ষ বাবাকে হারান তিনি। বাবার চলে যাওয়া শুধু শোকই ছিল না, সেই সঙ্গে ভেঙে পড়ে পরিবার। সংসারের হাল ধরার কেউ নেই। আর্থিক টানাপড়েন, ভবিষ্যতের শঙ্কা, নিজের পড়ালেখা এবং পরিবারের বড় সন্তান হিসেবে সব দায়িত্ব একসাথে কাঁধে এসে পড়ে মোসাহিদের।

কিন্তু, এত প্রতিবন্ধকতা নিয়েও সে হার মানেনি। বারবার ভেঙে পড়লেও ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। টিউশন করে চালিয়েছেন নিজের পড়াশোনার খরচ, দিয়েছেন পরিবারের ভরণপোষণ। তবে, ভালো কিছু করার স্বপ্ন নিয়েই করে গেছেন সব প্রতিবন্ধকতার সাথে লড়াই। সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ‘থামলে চলবে না। আমাকে টিকে থাকতেই হবে।’

টিউশন করে সংসার চালানোর দিনগুলো

একদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা, অন্যদিকে সংসারের ভরনপোষণের ভার। সব কাঁধে নিয়ে এগিয়ে গেছেন নিজের স্বপ্নের দিকে। দিনে ক্লাস শেষে বিকেল থেকে রাত অবধি টিউশন করাতেন। ক্লান্ত শরীর নিয়ে বাসায় ফিরলেও থামতেন না। বাসায় ফিরে রাতে আবার বইয়ে দিতেন ডুব। কারণ তাঁর কাছে পড়াশোনা শুধু নিজের ভবিষ্যৎ নয়, পরিবারকে বাঁচিয়ে রাখার অস্ত্র ছিল। সে সময়টাকে মনে করে তিনি বলেন, ‘অনেক কষ্টের ও কঠিন সময় ছিলো, কিন্তু আমাকে মজবুত ও পরিশ্রমী করেছে।’

বিসিএসের অনুপ্রেরণা যেভাবে

বিসিএস জার্নিতে মোসাহিদের অনুপ্রেরণা ছিলেন তাঁর গ্রামের ইসমাইল মোর্শেদ। যিনি প্রথম তার গ্রাম থেকে ভালো রেজাল্ট করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং পরে বিসিএস দিয়ে ট্যাক্স কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন। নিজ গ্রামের এমন সাফল্য তাকে অনুপ্রাণিত করেছিল বলে জানান মোসাহিদ। সাহস, ইচ্ছা আর পরিশ্রম করলে সেও পারবে বলে বিশ্বাস ছিলো তার। সেই বিশ্বাস থেকেই স্বপ্ন দেখা এবং লড়াই শুরু।

স্বপ্নের বীজ: বিসিএস যাত্রার শুরু

অনার্সের তৃতীয় বর্ষে এসে ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয় নিজের লক্ষ্য। লক্ষ্য নির্ধারণ করেন শিক্ষা ক্যাডার হয়ে শিক্ষক হওয়ার। চতুর্থ বর্ষে এসে তিনি পুরোপুরি প্রস্তুতি শুরু করেন বিসিএসের জন্য। মোসাহিদ জানান, মানবিকের ছাত্র হওয়ায় গণিত, বিজ্ঞান, আইসিটি সহ এসব বিষয় কঠিন লাগতো। তবে, বাংলা, ইংরেজি, সাধারণ জ্ঞান যে বিষয়গুলোতে সে ভালো ছিল সেগুলোতেই দিয়েছেন সবচেয়ে বেশি সময়।

ক্ষ্যে পৌঁছানোর অনুভূতি

গত ১১ নভেম্বর ৪৯তম স্পেশাল বিসিএসের ফলাফল প্রকাশিত হয়। ফলাফল প্রকাশের মুহূর্তটি তিনি আজও ভুলতে পারেননি। মোসাহিদ বলেন, ‘রেজাল্ট শিটে নিজের রোল নম্বর দেখার সঙ্গে সঙ্গে পুরো শরীর কেঁপে উঠেছিল। সবার আগে ফোন করেছিলেন মাকে। আম্মার একমাত্র স্বপ্ন ছিল ছেলে একদিন ভালো কিছু করবে। সেই স্বপ্ন পূরণ করতে পেরে আবেগে ভাষা খুঁজে পাইনি।’

বর্তমান ও ভবিষ্যৎ স্বপ্ন

এখনো কোনো চাকরিতে যুক্ত হননি তিনি। কারণ তার ভয় ছিল চাকরির ব্যস্ততায় হয়তো বিসিএস প্রস্তুতিতে সময় দিতে পারবেন না। তাই টিউশন চালিয়ে গেছেন, স্বপ্নের জন্য অপেক্ষা করেছেন। সামনে ৪৬ ও ৪৭তম বিসিএসের ফলাফলের অপেক্ষায় আছেন বলে জানান মোসাহিদ । তাছাড়া সরকারি ব্যাংকের লিখিত পরীক্ষাও বাকি। তবে, শিক্ষা ক্যাডারেই থাকার ইচ্ছে তার। মোসাহিদ বলেন, ‘শিক্ষাক্ষেত্রে কাজ করতে পারলেই মনে হবে আমার জীবন অর্থ পেয়েছে।’

তরুণদের জন্য মোসাহিদের বার্তা

সঠিক পরিকল্পনা, ইতিবাচক মানসিকতা এবং ধারাবাহিক চেষ্টা এই তিনটাই বিসিএসের মূল শক্তি। শর্ট্‌কাট নেই। প্রতিটি সাবজেক্ট গভীরভাবে পড়ে এগোতে হবে। মোসাহিদের ভাষায়, ‘নিজের লক্ষ্যে অবিচল থাকো। জীবনে প্রতিকূলতা আসবেই। কিন্তু, যেদিন তুমি ঠিক করবে ‘হারবে না’ সেদিন থেকেই বদলে যাবে সব। পরিশ্রমের বিকল্প নেই। আর আল্লাহর ওপর ভরসা রাখো!’

Please Share This Post in Your Social Media

দারিদ্র্যকে জয় করে মোসাহিদের বিসিএস সাফল্য

সাজিদুর রহমান, কুবি
Update Time : ০৩:০৫:২১ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৫

অভাব, দায়িত্ব, ব্যর্থতা আর অনিশ্চয়তা অনেক সময় মানুষকে ভেঙে দেয়। আবার কাউকে তৈরি করে আরও শক্ত করে, করে তুলে আরও উদ্যমী। এক তরুণ; যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পর যে সময়টাতে আনন্দ উল্লাসে মেতে থাকার কথা, তখনই হারান বটবৃক্ষ বাবাকে। আর্থিক সংকট, পরিবারের দায়িত্ব, নিজের পড়ালেখার খরচ সব মিলিয়ে দায়িত্বের ভার কাঁধে। কিন্তু তিনি হার মানেননি। টিউশন করে সংসার  চালিয়েছেন, রাতের পর রাত পড়েছেন, নিজের দুর্বলতাকে পরিণত করেছেন শক্তিতে।

বলছিলাম সদ্য ৪৯তম স্পেশাল বিসিএস (শিক্ষা) ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী মোসাহিদ আহমেদের কথা। শত প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে যিনি নিজের স্বপ্নকে আঁকড়ে ধরে এগিয়ে গেছেন, সংকটকে পরিণত করেছেন শক্তিতে। আজ বলবো তার বিসিএস জয়ের গল্প। 

শুরুতেই বটবৃক্ষ হারানোর আঘাত

প্রতিটি শিক্ষার্থীর বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরুটা হয় আনন্দের। সারাদিন নতুন বন্ধুদের সাথে আড্ডা, পার্টি। আনন্দে উল্লাসে মেতে থাকার সময় বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরুটা। তবে, মোসাহিদের বেলায় ছিল একটু ব্যতিক্রম ও কঠিন। অনার্সের প্রথম সেমিস্টারেই বটবৃক্ষ বাবাকে হারান তিনি। বাবার চলে যাওয়া শুধু শোকই ছিল না, সেই সঙ্গে ভেঙে পড়ে পরিবার। সংসারের হাল ধরার কেউ নেই। আর্থিক টানাপড়েন, ভবিষ্যতের শঙ্কা, নিজের পড়ালেখা এবং পরিবারের বড় সন্তান হিসেবে সব দায়িত্ব একসাথে কাঁধে এসে পড়ে মোসাহিদের।

কিন্তু, এত প্রতিবন্ধকতা নিয়েও সে হার মানেনি। বারবার ভেঙে পড়লেও ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। টিউশন করে চালিয়েছেন নিজের পড়াশোনার খরচ, দিয়েছেন পরিবারের ভরণপোষণ। তবে, ভালো কিছু করার স্বপ্ন নিয়েই করে গেছেন সব প্রতিবন্ধকতার সাথে লড়াই। সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ‘থামলে চলবে না। আমাকে টিকে থাকতেই হবে।’

টিউশন করে সংসার চালানোর দিনগুলো

একদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা, অন্যদিকে সংসারের ভরনপোষণের ভার। সব কাঁধে নিয়ে এগিয়ে গেছেন নিজের স্বপ্নের দিকে। দিনে ক্লাস শেষে বিকেল থেকে রাত অবধি টিউশন করাতেন। ক্লান্ত শরীর নিয়ে বাসায় ফিরলেও থামতেন না। বাসায় ফিরে রাতে আবার বইয়ে দিতেন ডুব। কারণ তাঁর কাছে পড়াশোনা শুধু নিজের ভবিষ্যৎ নয়, পরিবারকে বাঁচিয়ে রাখার অস্ত্র ছিল। সে সময়টাকে মনে করে তিনি বলেন, ‘অনেক কষ্টের ও কঠিন সময় ছিলো, কিন্তু আমাকে মজবুত ও পরিশ্রমী করেছে।’

বিসিএসের অনুপ্রেরণা যেভাবে

বিসিএস জার্নিতে মোসাহিদের অনুপ্রেরণা ছিলেন তাঁর গ্রামের ইসমাইল মোর্শেদ। যিনি প্রথম তার গ্রাম থেকে ভালো রেজাল্ট করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং পরে বিসিএস দিয়ে ট্যাক্স কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন। নিজ গ্রামের এমন সাফল্য তাকে অনুপ্রাণিত করেছিল বলে জানান মোসাহিদ। সাহস, ইচ্ছা আর পরিশ্রম করলে সেও পারবে বলে বিশ্বাস ছিলো তার। সেই বিশ্বাস থেকেই স্বপ্ন দেখা এবং লড়াই শুরু।

স্বপ্নের বীজ: বিসিএস যাত্রার শুরু

অনার্সের তৃতীয় বর্ষে এসে ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয় নিজের লক্ষ্য। লক্ষ্য নির্ধারণ করেন শিক্ষা ক্যাডার হয়ে শিক্ষক হওয়ার। চতুর্থ বর্ষে এসে তিনি পুরোপুরি প্রস্তুতি শুরু করেন বিসিএসের জন্য। মোসাহিদ জানান, মানবিকের ছাত্র হওয়ায় গণিত, বিজ্ঞান, আইসিটি সহ এসব বিষয় কঠিন লাগতো। তবে, বাংলা, ইংরেজি, সাধারণ জ্ঞান যে বিষয়গুলোতে সে ভালো ছিল সেগুলোতেই দিয়েছেন সবচেয়ে বেশি সময়।

ক্ষ্যে পৌঁছানোর অনুভূতি

গত ১১ নভেম্বর ৪৯তম স্পেশাল বিসিএসের ফলাফল প্রকাশিত হয়। ফলাফল প্রকাশের মুহূর্তটি তিনি আজও ভুলতে পারেননি। মোসাহিদ বলেন, ‘রেজাল্ট শিটে নিজের রোল নম্বর দেখার সঙ্গে সঙ্গে পুরো শরীর কেঁপে উঠেছিল। সবার আগে ফোন করেছিলেন মাকে। আম্মার একমাত্র স্বপ্ন ছিল ছেলে একদিন ভালো কিছু করবে। সেই স্বপ্ন পূরণ করতে পেরে আবেগে ভাষা খুঁজে পাইনি।’

বর্তমান ও ভবিষ্যৎ স্বপ্ন

এখনো কোনো চাকরিতে যুক্ত হননি তিনি। কারণ তার ভয় ছিল চাকরির ব্যস্ততায় হয়তো বিসিএস প্রস্তুতিতে সময় দিতে পারবেন না। তাই টিউশন চালিয়ে গেছেন, স্বপ্নের জন্য অপেক্ষা করেছেন। সামনে ৪৬ ও ৪৭তম বিসিএসের ফলাফলের অপেক্ষায় আছেন বলে জানান মোসাহিদ । তাছাড়া সরকারি ব্যাংকের লিখিত পরীক্ষাও বাকি। তবে, শিক্ষা ক্যাডারেই থাকার ইচ্ছে তার। মোসাহিদ বলেন, ‘শিক্ষাক্ষেত্রে কাজ করতে পারলেই মনে হবে আমার জীবন অর্থ পেয়েছে।’

তরুণদের জন্য মোসাহিদের বার্তা

সঠিক পরিকল্পনা, ইতিবাচক মানসিকতা এবং ধারাবাহিক চেষ্টা এই তিনটাই বিসিএসের মূল শক্তি। শর্ট্‌কাট নেই। প্রতিটি সাবজেক্ট গভীরভাবে পড়ে এগোতে হবে। মোসাহিদের ভাষায়, ‘নিজের লক্ষ্যে অবিচল থাকো। জীবনে প্রতিকূলতা আসবেই। কিন্তু, যেদিন তুমি ঠিক করবে ‘হারবে না’ সেদিন থেকেই বদলে যাবে সব। পরিশ্রমের বিকল্প নেই। আর আল্লাহর ওপর ভরসা রাখো!’