অরুণাচলের কাছে চীনের ৩৬ বিমান বাংকার, উদ্বেগে ভারত
- Update Time : ১২:১৩:৩১ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৮ অক্টোবর ২০২৫
- / ৫১১ Time View
ভারতের অরুণাচল প্রদেশের সীমান্তঘেষা তিব্বতের লুনজে বিমানঘাঁটিতে ৩৬টি শক্তিশালী বিমান বাংকার, নতুন প্রশাসনিক ভবন ও অ্যাপ্রন এলাকা নির্মাণ করেছে চীন। ম্যাকমোহন রেখা থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত এই ঘাঁটি ভারতের তাওয়াং শহর থেকে মাত্র ১০৭ কিলোমিটার দূরে।
ভারতীয় সামরিক বিশ্লেষকদের মতে, লুনজেতে এই উন্নয়ন কার্যক্রম চীনকে তার যুদ্ধবিমান ও ড্রোনগুলো সীমান্তের আরো কাছাকাছি মোতায়েনের সুযোগ দেবে। এতে ভারতের বিমানবাহিনীর প্রতিক্রিয়া জানানোর সময় কমে আসবে ও সীমান্তে হঠাৎ যেকোনো আকাশ হুমকির ঝুঁকি বাড়বে।
ভারতের সাবেক বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল (অব.) বি. এস. ধনোয়া এনডিটিভিকে বলেন, লুনজেতে ৩৬টি শক্তিশালী বিমান আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ প্রমাণ করে যে পরবর্তী সংঘাতের সময় তাদের যুদ্ধবিমান ও আক্রমণ হেলিকপ্টারগুলো এখানেই মোতায়েন থাকবে। তিনি আরও জানান, এলাকাটির ভূগর্ভস্থ টানেলে গোলাবারুদ ও জ্বালানি এরই মধ্যে মজুত করা থাকতে পারে।
ধনোয়া বলেন, আমি ২০১৭ সালের দোকলাম সংঘাতের সময়ই বলেছিলাম- তিব্বতে চীনা বিমানবাহিনীর দুর্বলতা হলো মোতায়েন সক্ষমতা। এখন তারা সেখানে বাংকার তৈরি করছে। তখনই বলেছিলাম, যেদিন তারা তিব্বতে এসব আশ্রয়কেন্দ্র বানানো শুরু করবে, সেদিনই বুঝতে হবে তারা আমাদের সঙ্গে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
ভারতীয় বিমানবাহিনীর সাবেক উপ-প্রধান এয়ার মার্শাল অনিল খোঁসলা বলেন, লুনজে ঘাঁটির এই উন্নয়ন ভবিষ্যতে চীনের যুদ্ধ পরিকল্পনাকে সহায়তা করতে পারে। এটি ভারতের জন্য গুরুতর কৌশলগত হুমকি, বিশেষ করে গালওয়ান সংঘর্ষের পরবর্তী ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে।
তিনি আরও বলেন, এই ৩৬টি বাংকার চীনা বিমানবাহিনীকে আকাশ সম্পদ ছড়িয়ে রাখতে সাহায্য করবে, তাদের ওপর আক্রমণের ঝুঁকি কমাবে ও উচ্চ পার্বত্য অঞ্চলে টানা সামরিক অভিযান চালানোর সক্ষমতা বাড়াবে।
খোঁসলা সতর্ক করে বলেন, এসব আশ্রয়কেন্দ্র ভারতের নির্ভুল আক্রমণ বা ক্ষেপণাস্ত্র হামলা থেকে চীনের ঘাঁটিকে রক্ষা করবে, ফলে সংঘাতের শুরুতেই তাদের বিমানঘাঁটি অকেজো করা কঠিন হবে।
তিনি জানান, তিংরি, লুনজে ও বুরাং ঘাঁটিগুলো প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা (এলএসি) থেকে মাত্র ৫০ থেকে ১৫০ কিলোমিটারের মধ্যে। এতে চীনা বিমানবাহিনী সীমান্তে দ্রুত মোতায়েন ও আক্রমণের প্রতিক্রিয়া জানাতে পারবে এবং অরুণাচল, সিকিম, উত্তরাখণ্ড ও লাদাখে ভারতীয় অবস্থানগুলোকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করতে পারবে।
স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা গেছে, লুনজে ঘাঁটির রানওয়েতে কয়েকটি সিএইচ-৪ ড্রোন মোতায়েন রয়েছে। এই উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন মানববিহীন ড্রোনগুলো ১৬ হাজার ফুট উঁচু থেকে আকাশে উড়ে মাটির লক্ষ্যবস্তুতে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করতে পারে।
ভারত ২০২৯ সাল থেকে মার্কিন তৈরি ‘স্কাই গার্ডিয়ান’ ড্রোন পেতে শুরু করবে, যা এই হুমকির জবাব হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ভারতীয় বিমানবাহিনী ও সেনাবাহিনী প্রত্যেকে আটটি করে ড্রোন পাবে। ৩৫০ কোটি ডলারের এই চুক্তির আওতায় নৌবাহিনীও ১৫টি ‘সি গার্ডিয়ান’ ড্রোন পাচ্ছে।
এই মার্কিন ড্রোনগুলো ভারতের গোয়েন্দা নজরদারি ও হামলা সক্ষমতা বহুগুণ বাড়াবে, বিশেষ করে হিমালয় অঞ্চলে। বর্তমানে ভারতীয় বাহিনী তুলনামূলকভাবে কম সক্ষম ইসরায়েলি তৈরি ‘হেরন’ ও ‘সার্চার’ ড্রোন ব্যবহার করছে।
ভারতের সাবেক বিমানবাহিনী উপপ্রধান এয়ার মার্শাল এস.পি. ধারকর বলেন, তিব্বতে এসব শক্তিশালী আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ ভারতের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। ভৌগোলিক সুবিধা ও উচ্চতার কারণে এতদিন আমরা কিছুটা স্বস্তিতে ছিলাম। কিন্তু এখন চীনের নতুন অবকাঠামো সেই সুবিধা ক্রমে কমিয়ে দিচ্ছে।
ভূ-গোয়েন্দা বিশেষজ্ঞ ডেমিয়েন সাইমন বলেন, তাওয়াং সেক্টরের বিপরীতে এত দ্রুত বিমান আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের মধ্য দিয়ে বেইজিং স্পষ্টতই তার আকাশসামরিক শক্তি বাড়াতে চাইছে। লুনজের এই সামরিকীকরণ ভারতের সঙ্গে ক্ষমতার ভারসাম্য কমানোর প্রচেষ্টা।
তিনি আরও বলেন, এখনো নিশ্চিত নয়, এসব আশ্রয়কেন্দ্র ঘূর্ণনক্ষম (হেলিকপ্টার) নাকি স্থির ডানার বিমান রাখার জন্য নির্মিত। তবে যেকোনোভাবেই হোক, এগুলো চীনের প্রতিক্রিয়া জানানোর সময় ও আকাশ শক্তি মোতায়েনের ক্ষমতা বহুগুণ বাড়াবে।
এই লুনজে ঘাঁটির উন্নয়ন এমন সময় হচ্ছে, যখন চীন হিমালয় সীমান্ত বরাবর অন্তত ছয়টি নতুন বিমানঘাঁটি আধুনিকীকরণ করছে- তিংরি, লুনজে, বুরাং, ইউতিয়ান ও ইয়ারকান্তসহ। এসব ঘাঁটিতে নতুন রানওয়ে, ইঞ্জিন টেস্ট প্যাড, হ্যাঙ্গার ও সহায়ক অবকাঠামো যোগ করা হচ্ছে।
ভারতীয় বিমানবাহিনী এনডিটিভিকে জানিয়েছে, তারা এসব কার্যক্রম গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে এবং প্রতিক্রিয়া জানানোর যথাযথ ব্যবস্থা রয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, হিমালয় সীমান্তে চীনের এসব কার্যক্রম ভারতের দীর্ঘদিনের আকাশ-প্রাধান্যকে চ্যালেঞ্জ করছে। দুই দেশই এখন বিমানঘাঁটি উন্নয়নের মাধ্যমে এক নতুন কৌশলগত বাস্তবতায় প্রবেশ করেছে।
উল্লেখ্য, ২০২০ সালের ১৫–১৬ জুন গালওয়ান সংঘর্ষের পর সম্পর্কের পুনর্গঠনের চেষ্টা সত্ত্বেও দুই দেশই সীমান্তে সামরিক প্রস্তুতি বাড়িয়ে চলেছে।
চলতি বছরের আগস্টে চীনের তিয়ানজিন শহরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বৈঠকে দুই দেশের মধ্যে নতুন বাণিজ্য, বিরল খনিজ ও সরাসরি ফ্লাইট পুনরায় চালুর বিষয়ে অগ্রগতি হলেও সীমান্তে উত্তেজনা এখনো বিদ্যমান।











































































































































































































