অগ্নিঝুঁকি নিয়ে বারবার সতর্ক করা হলেও ব্যবস্থা নেয়নি বেবিচক

- Update Time : ১২:২৬:১১ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২১ অক্টোবর ২০২৫
- / ৩০১ Time View
বারবার সতর্ক করার পরও কার্যত কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। উল্টো গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়ে গা ছাড়া ভাব ছিল। যার সর্বশেষ পরিণতি ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো বা হ্যাঙ্গার অগ্নিকাণ্ডের বিষয়ে পূর্ব থেকে ছিল সতর্ক বার্তা। একাধিকবার বেবিচক সদর দফতরকে লিখিতভাবে অবহিত করা হয়। কিন্তু দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের এ বিষয়ে গা ছাড়া ভাবের কারণে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।
খোদ বেবিচকের কর্মকর্তা ও কার্গো সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
তবে বেবিচক সদস্য (অপারেশন) এয়ার কমোডর আবু সাঈদ মেহবুব খান সাংবাদিকদের বলেন, ‘যে প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য আমাদের কাছে পাঠানো হয়েছে, সেগুলোয় রক্ষণাবেক্ষণ ও কেনাকাটায় অত্যধিক ব্যয় ধরা হয়েছে। আমরা যাচাই-বাছাই করছি। কোনটির প্রয়োজনীয়তা আছে, আর কোনটির নেই; সেটাও আমরা খতিয়ে দেখছি। এ ব্যাপারে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’
জানা গেছে, বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক বিমানবন্দরে ব্যবহৃত উদ্ধার ও অগ্নিনির্বাপক যানবাহনের অধিকাংশই দীর্ঘদিন ধরে অচল বা ত্রুটিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। গত ৩১ জুলাই বেবিচকের সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট, ইঞ্জিনিয়ারিং ও স্টোর ইউনিটের নির্বাহী পরিচালক মো. রেজাউল ইসলাম সই করা চিঠিতে বলা হয়, সংশ্লিষ্ট বিমানবন্দরের পক্ষ থেকে ২০২৪ সালের এপ্রিল হতে ২০২৫ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত মোট ১৯টি আলাদা তারিখে প্রশাসনিক অনুমোদনের জন্য চিঠিপত্র পাঠানো হলেও সদর দফতর থেকে কার্যকর কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।
প্রতিটি চিঠির বার্তা অভিন্ন। এতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তাদের যানবাহনের ত্রুটি, যান্ত্রিক সমস্যা ও জরুরি মেরামতের প্রয়োজনীয়তার বিবরণ পাঠায়। কেন্দ্রীয় ইউনিটের পাঠানো মূল নথিপত্রে উল্লিখিত আরও বিভিন্ন সূত্র ও নথি কপি হিসেবে চিঠিতে সংযুক্ত করা হয়।
চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়, বর্তমানে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে চারটি যানবাহন (একটি প্রোটেক্টর, একটি রোজেনবাওয়ার ও দুইটি মরিতা) শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তিনটি (একটি নাফকো ও দুইটি টাইটান), ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ৪টি (একটি নাফকো, একটি রোজেনবাওয়ার ও দুইটি টাইটান), কক্সবাজার বিমানবন্দরে দুটি, সৈয়দপুরে দুটি (একটি প্রোটেক্টর ও একটি রোজেনবাওয়ার), যশোরে একটি টাইটান, শাহ মখদুমে একটি টাইটান এবং বরিশালে দুটি যানবাহনসহ মোট ১৯টি উদ্ধার ও অগ্নিনির্বাপক যানবাহন মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের আওতায় আনা প্রয়োজন।
আরও বলা হয়, ইন্টারন্যাশনাল সিভিল অ্যাভিয়েশন অর্গানাইজেশনের (আইকাও) নীতিমালা অনুযায়ী প্রতিটি বিমানবন্দরকে নির্দিষ্ট মান বজায় রাখতে হলে কার্যকর অগ্নিনির্বাপক যানবাহন সার্ভিসেবল রাখা অত্যাবশ্যক। কিন্তু এসব যানবাহন দীর্ঘ সময় অচল থাকায় বিমানবন্দরের অপারেশন ঝুঁকির মধ্যে পড়ে এবং ভবিষ্যতে বিমানবন্দরগুলোর শ্রেণি বা ক্যাটাগরি কমে যাওয়ারও আশঙ্কা রয়েছে। দীর্ঘদিন কোনও সংশোধনাত্মক কার্যক্রম না নেওয়ার ফলে ক্ষুদ্র ত্রুটিগুলো বড় ত্রুটিতে পরিণত হতে পারে এবং একেবারে মারাত্মক ত্রুটির কারণে বিমানবন্দরকে সাময়িকভাবে বন্ধ করে মেরামত করতে হতে পারে। এতে অপারেশন ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অডিট আপত্তি হতে পারে বা বিমানবন্দরের ক্যাটাগরি ডাউন হয়ে যেতে পারে। চিঠিতে জরুরি প্রশাসনিক অনুমোদন প্রদান এবং দ্রুত প্রাক্কলন অনুলিপি পর্যালোচনার জন্য সদর দফতরের প্রতি শক্তিশালী অনুরোধ জানানো হয়। কিন্তু এত কিছুর পরও কোনও ব্যবস্থা নেয়নি কর্তৃপক্ষ।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেবিচকের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘একটি বিমান দুর্ঘটনা ঘটলে প্রথম প্রতিরক্ষা হলো ওই অগ্নিনির্বাপক যানবাহনগুলো। যদি এসব যানবাহন কাজে না আসে, তাহলে দুর্ভাগ্যজনক কোনও ঘটনার ত্বরিত প্রতিকারের সম্ভাবনা সীমিত থাকবে।’
তিনি জানান, ‘আন্তর্জাতিক পরিদর্শন বা অডিটে যদি এই তথ্য ওঠে আসে তাহলে দেশের বিমানবন্দরগুলোকে অনুকূলভাবে বিবেচনা করা নাও হতে পারে এবং আন্তর্জাতিক ফ্লাইটসহ নানা ব্যবস্থায় এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।’
এদিকে কার্গো সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যেভাবে আগুন লাগলো আর ছড়িয়ে পড়লো তাতে করে আমরা বুঝতে পারলাম আমাদের কত গাফিলতি ছিল।
তারা বলেন, ঘটনায় গঠন করা তদন্ত কমিটিকে অবশ্যই যাদের অবহেলায় অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা সুসংহত হয়নি তাদের আইনের অভিযোগের আনতে হবে। পাশাপাশি আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নির্বাহী পরিচালকের চিঠির চাহিদানুযায়ী অবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া না হলে যেকোনও সময় দেশের বিমানবন্দরগুলোতে যাত্রী এবং বিমান উভয়েরই নিরাপত্তা বড় ধরনের ঝুঁকিতে পড়তে পারে। কর্তৃপক্ষের দায়িত্বশীল ও দ্রুত পদক্ষেপই এখন এর একমাত্র সমাধান।’
প্রসঙ্গত, গত ১৮ অক্টোবর দুপুর সোয়া ২টার দিকে ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে আগুন লাগে। আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করে ফায়ার সার্ভিসের ৩৭টি ইউনিট। একইসঙ্গে কাজ করেন নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, সিভিল অ্যাভিয়েশন, বিজিবি, পুলিশ ও আনসার সদস্যরা। আগুনের কারণে বিমানবন্দরে সব ধরনের উড়োজাহাজ ওঠানামা সাময়িকভাবে বন্ধ রাখে কর্তৃপক্ষ। একইসঙ্গে ঢাকার বদলে সব বিমান চট্টগ্রাম ও সিলেটে অবতরণের নির্দেশনা দেওয়া হয়। ছয় ঘণ্টায় ১৩টি আন্তর্জাতিক ফ্লাইট অন্য বিমানবন্দরে অবতরণ করে। এর মধ্যে আটটি ফ্লাইট চট্টগ্রামে, তিনটি সিলেটে এবং চেন্নাই ও দিল্লি থেকে দুটি ফ্লাইট কলকাতায় অবতরণ করে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় রাত ৯টার পর উড়োজাহাজ ওঠানামা শুরু হয়।
আগুন নেভাতে গিয়ে ফায়ার ফাইটার, সিভিল এভিয়েশন, আনসার সদস্যসহ মোট ৩৫ জন আহত হন। এর মধ্যে আনসার সদস্যই ২৫ জন। তাদের সিএমএইচ ও কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
Please Share This Post in Your Social Media
-
সর্বশেষ
-
জনপ্রিয়