চেনা যায় না লাশ, পোড়া সামগ্রী দেখেই কান্নায় ভেঙে পড়ছেন স্বজনেরা
- Update Time : ১০:৫৩:৩২ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৫ অক্টোবর ২০২৫
- / ২৬৮ Time View
ঘড়ির কাটার হিসাবে তখন মঙ্গলবার পেরিয়ে বুধবার। গভীর রাতে চারপাশের কোলাহলও কমেছে। তবে তখনও কিছু মানুষের গরম নিঃশ্বাস ও মাঝেমধ্যে ডুকরে কান্নার শব্দে ভারী হয়ে আসছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল এলাকার বাতাস। জরুরি বিভাগের সামনে কেউ দাঁড়িয়ে, কেউ বসে। কারও হাতে ছবি, কারও চোখে শূন্যতা। বিকাল থেকেই একটার পর একটা স্ট্রেচার গড়িয়ে ভেতরে ঢুকছে পোড়া দেহ, যেগুলো চেনা অসম্ভব।
এরমধ্যেই মর্গে রাখা একটি মরদেহের দুই কানে দুটি কানের দুল দেখে চিৎকার করে ওঠেন কয়েকজন। তাদের দাবি, এই কানের দুল তাদের স্বজন সানজিদার। তবে তাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে রূপনগর থানা পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা জানান, সানজিদা নামে যাকে শনাক্তের দাবি করেছেন স্বজনেরা, তিনি মূলত মাহিয়া; এটাও আরেক পরিবার শনাক্ত করেছে। সে কারণে ডিএনএ নমুনার পরীক্ষা ছাড়া মরদেহ কাউকে হস্তান্তর করা যাবে না।
রাজধানী মিরপুরের শিয়ালবাড়ি এলাকার পোশাক কারখানা ও রাসায়নিক গোডাউনের আগুন কেড়ে নিয়েছে অন্তত ১৬টি প্রাণ। মঙ্গলবার বিকেলের সেই আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছে দেহগুলো। এখন সেগুলো রাখা আছে ঢামেক হাসপাতালের মর্গে।
মর্গের ভেতরে কাজ করছেন চিকিৎসক ও পুলিশ সদস্যরা। তাঁদের ভাষ্য, এই লাশগুলো দেখে কাউকে চেনার উপায় নাই। আগুনে পুড়ে কালো কঙ্কাল হয়ে গেছে। কারও মুখ নেই, কারও চুলটুকু অবশিষ্ট। তবু স্বজনেরা চেষ্টা ছাড়ছেন না। কেউ হাতে থাকা ঘড়ি দেখে কাঁদছেন, কেউ কানের দুল দেখে শনাক্তের দাবি করছেন।
মধ্যরাতেই পোড়া মরেদেহের হাতে ঘড়ি ও চামড়ার সঙ্গে লেগে থাকা পোড়া মানিব্যাগ দেখেই ইশরাত জাহান এমি নামে এক নারী দাবি করেন, এটা তাঁর স্বামী আল মামুনের দেহ। স্বজনদের জড়িয়ে বিলাপ করে বলছিলেন, ‘হায় আল্লাহ, আমার দুই ছেলের এখন কী হবে! বাবা ভক্ত দুই ছেলে এখন কোথায় যাবে? কার আদরে বড় হবে?’
দুই ছেলেকে নিয়ে এমন নানা অনিশ্চয়তার কথা বলতে বলতেই হঠাৎ নিশ্চুপ, নিথর হয়ে মেঝেতে বসে পড়েন তিনি। সম্বিত ফিরে পেয়ে আবার বলতে থাকেন, ‘আমার দুই পোলার ছোটটাই বাবার ভক্ত ছিল বেশি। ওরে আমি কি কমু? কারে এখন বাপ ডাকবো? ও আল্লাহ তুমি কী করলা! প্যান্টটা পর্যন্ত পুড়ে গেছে। কিছুই নাই। ঘড়ি, মানিব্যাগ ও লাল শার্ট দেখেই চিনেছি। ওই আমার স্বামী। ওই আমার আল মামুন।‘
নিখোঁজ আল মামুনের শ্বশুর আব্দুস সালাম জানান, মামুনের বাবার নাম মজিবুর রহমান। তাদের বাড়ি বরগুনার আমতলীতে।
এদিকে আরেক পোড়া দেহের চকচকে দাঁত দেখেই আঁতকে ওঠেন আরেক স্বজন। বলে ওঠেন এ লাশ তার ভাই সাব্বিরের। একইভাবে পোড়া লাশের সঙ্গে থাকা মানিব্যাগ, আবার কেউ আগুনে গলে শক্ত হয়ে যাওয়া বাটন মোবাইল ফোন দেখে তাদের স্বজনদের শনাক্তের দাবি করে আহাজারি করছিলেন হাসপাতাল মর্গের সামনে। এভাবেই মঙ্গলবার বিকাল থেকে বুধবার ভোর পর্যন্ত লাশের দাবিদার ও নিখোঁজ ব্যক্তির স্বজনদের বিলাপ ও আহাজারি করতে দেখা গেছে।
রাত সোয়া ১টার দিকে পোশাক কারখানার স্টোর ইনচার্জ খালিদ হাসান সাব্বিরের খোঁজে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের মর্গে এসেছিলেন তার ফুপাতো ভাই শাকিল। তিনি
বলেন, আগুন লাগার পর থেকেই সাব্বিরকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তাই তিনি স্বজনদের নিয়ে ঢামেক হাসপাতাল মর্গে এসেছেন।
মর্গে দায়িত্ব পালনকারী হাসপাতালের কর্মচারীরা জানান, লাশগুলো ভাজা ভাজা হয়ে গেছে। আগুনে পুড়ে শুকিয়ে গেছে। দেখতে কালো কঙ্কালের মতো মনে হচ্ছে। কাজেই কেউ কাউকে চিনতেই পারছেন না। কারও মুখমন্ডল পুড়ে গেছে, শুধু দাতগুলো চকচক করছে। কোনো নারীর পুরো শরীর ঝলসে গেলেও কিছু বড় চুল অবশিষ্ট রয়েছে, তাই দেখেই প্রাথমিকভাবে মেয়ে বলে শনাক্ত করা হয়েছে। আবার কেউ পুড়ে একেবারে শুকিয়ে গেছে।
যে মরদেহটি সানজিদার বলে দাবি করছিলেন কয়েকজন, কথা হয় তাঁদের সঙ্গে। শফিকুল ইসলাম, নিখোঁজ সানজিদার মামা। তিনি বলেন, সানজিদা মাত্র একমাস আগে এই পোশাক কারখানায় চাকরি নিয়েছিল। কাজ করছিল দ্বিতীয় তলায় হেলপার পদে। তার বাবার নাম ফারুক, বেঁচে নাই। দুইবোনের মধ্যে ১৪ বছর বয়সী সানজিদা ছিল ছোট। তাদের বাড়ি বরগুনার বাবনা থানার আমতলী গ্রামে। থাকতো রূপনগরে ভাড়া বাসায়।
তিনি বলেন, পোশাক কারখানার পাশেই তাদের বাসা। আগুন লাগার খবর পেয়েই ছুটে যান কারখানার সামনে। এসময় তাদের সামনেই তিনজনকে বের করে আনা হয়। কিন্তু সানজিদা বের হতে পারেনি। তখন ফায়ার সার্ভিসের লোকজন মাইকিং করে ঢামেক হাসপাতালে যেতে বলেন স্বজনদের খোঁজ করতে। তারপর বিকাল থেকেই তারা সানজিদার খোঁজে ঢামেক হাসপাতালে অবস্থান করছেন।
হাসপাতাল মর্গের অফিস কর্মকর্তারা জানান, আজ বুধবার সকালে ঢামেকের মর্গে ময়নাতদন্ত ও ফরেনসিক বিভাগে ডিএনএ’র নমুনা নেওয়া হবে। সেগুলো পরীক্ষার পরই মরদেহগুলো দাবিদার স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হবে।
প্রাথমিকভাবে পুলিশ সাতজনের মরদেহ শনাক্ত করতে পেরেছে বলেও জানান তারা। তবে ময়নাতদন্ত ও ডিএনএ নমুনা পরীক্ষার পরই প্রকৃত স্বজনদের কাছে তাদের হস্তান্তর করা হবে।
Please Share This Post in Your Social Media
-
সর্বশেষ
-
জনপ্রিয়


























































































































































