বছরে দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৫০-৬০ লাখ মানুষ

- Update Time : ১০:৩০:৩০ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৯ অক্টোবর ২০২৫
- / ৩৭৭ Time View
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, নদীভাঙন ও ভূমিধসের মাত্রা বাড়ছে। বাংলাদেশে প্রতি বছর ৫০-৬০ লাখ মানুষ বিভিন্ন দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এসব ঘটনায় নারী, শিশু, বৃদ্ধ ও প্রতিবন্ধীদের ওপর দীর্ঘমেয়াদি মানসিক প্রভাব ফেলছে। আবার দেশে প্রতি এক লাখ মানুষের জন্য মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আছেন একজনেরও কম।
‘দুর্যোগ ও সংকটকালে মানসিক স্বাস্থ্য’ নিয়ে বৃহস্পতিবার (৯ অক্টোবর) এডাব আয়োজিত এক সেমিনারে এসব তথ্য জানানো হয়।
সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন এডাব’র সভাপতি কাজী বেবী। আর মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের শিক্ষক ও উৎস’র নির্বাহী পরিচালক মোস্তফা কামাল যাত্রা।
অনুষ্ঠানে জানানো হয়, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, ভূমিধস, অগ্নিকাণ্ড, মহামারি, বাস্তুচ্যুতি ও সংঘাত-এসব দুর্যোগ মানুষের শারীরিক জীবনের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর গভীর প্রভাব ফেলছে।
বাংলাদেশের মতো একটি দুর্যোগপ্রবণ দেশে প্রতি বছরই হাজার হাজার মানুষ তাদের ঘরবাড়ি, জীবিকা, প্রিয়জন হারান। এই ক্ষতি শুধু বস্তুগত নয়, মানসিকভাবে বিধ্বংসী।
দুর্যোগ-পরবর্তী সময়ের শোক, ট্রমা, উদ্বেগ, হতাশা ও ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা অনেককে মানসিকভাবে ভেঙে ফেলে। তবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার জাতীয় কাঠামোতে মানসিক স্বাস্থ্য সেবা ও মনোসামাজিক সহায়তা এখনো পর্যাপ্তভাবে অন্তর্ভুক্ত নয়। দুর্যোগে আক্রান্ত মানুষের জন্য চিকিৎসা, খাদ্য, আশ্রয় ইত্যাদি জরুরি সেবা যতটা অগ্রাধিকার পায়, মানসিক পুনরুদ্ধার সেবা ততটা গুরুত্ব পায় না- বলে উল্লেখ করেন বক্তারা।
মূল প্রবন্ধে মোস্তফা কামাল যাত্রা বলেন, বাংলাদেশ একটি দুর্যোগপ্রবণ ও ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। প্রায় প্রতি বছর ৫০-৬০ লাখ মানুষ বিভিন্ন দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, নদীভাঙন ও ভূমিধসের মাত্রা বাড়ছে। এসব ঘটনার মানসিক প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি; বিশেষ করে নারী, শিশু, বৃদ্ধ ও প্রতিবন্ধীদের ওপর।
উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, ২০২২ সালের সিলেটের ভয়াবহ বন্যার পর অনেক পরিবার উদ্বেগ, নিদ্রাহীনতা ও হতাশায় ভুগেছে। ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা আগমনের সময় হাজারো মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে মানসিক অস্থিতিশীলতার শিকার হন। কোভিড-১৯ মহামারির সময় সমাজের সব শ্রেণির মানুষ মানসিক চাপে আক্রান্ত হয় ভয়, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, কর্মহীনতা ও শোকের কারণে। এসব প্রমাণ করে, দুর্যোগ ও সংকট শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতি নয়, মানসিক স্বাস্থ্যও একটি বড় মানবিক সংকট।
তিনি আরও বলেন, সাম্প্রতিক ‘জুলাই আন্দোলন’ ও এর পরবর্তী সহিংসতা, প্রাণহানি ও সামাজিক অস্থিরতা বাংলাদেশের প্রায় সব স্তরের মানুষের মনে গভীর মানসিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। তরুণ প্রজন্ম বিশেষভাবে এই পরিস্থিতিতে আঘাত, ভীতি ও হতাশার অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছে। অনেক পরিবার তাদের সন্তান বা প্রিয়জন হারানোর শোকের মধ্যে রয়েছে, অন্যদিকে অনেকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দমন, ভয়, ও অনিরাপত্তা বোধে ভুগছে।
এই ধরনের সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা একটি মানসিক দুর্যোগ তৈরি করে-যার কোনো ঘূর্ণিঝড় নেই, বন্যা নেই, কিন্তু মানুষের মনের ভেতর ভেঙে যায় নিরাপত্তা ও ভবিষ্যতের আশা। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, মানসিক স্বাস্থ্য কেবল প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা ব্যক্তিগত ট্রমার বিষয় নয়; বরং রাষ্ট্রীয়, রাজনৈতিক ও সামাজিক সংকটও সমানভাবে মানসিক বিপর্যয়ের উৎস- বলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক।
তিনি বলেন, নারীরা দুর্যোগকালে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠীর একটি। দুর্যোগের সময় ও পরবর্তী পুনর্বাসন পর্বে তারা একাধিক ঝুঁকির মুখে পড়ে, যেমন- লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা, যৌন হয়রানি ও শোষণ বৃদ্ধি পায় আশ্রয়কেন্দ্র, ত্রাণ বিতরণ এলাকা বা বাস্তুচ্যুত অবস্থায়। গর্ভবতী, স্তন্যদানকারী মা ও কিশোরীরা পর্যাপ্ত স্বাস্থ্য সেবা না পাওয়ায় শারীরিক ও মানসিক চাপের মধ্যে থাকে। মানসিকভাবে তারা ভয়, অনিশ্চয়তা, নিরাপত্তাহীনতা, ও হতাশা অনুভব করে।
তিনি আরও বলেন, শিশুরা দুর্যোগে সবচেয়ে বেশি মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। কারণ তাদের মানসিক সহনশক্তি ও বোধবুদ্ধি সীমিত। পরিবারের সদস্য হারানো, ঘরবাড়ি ভেঙে যাওয়া, স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়া ইত্যাদি ঘটনায় তারা শোক, ভয়, দুঃস্বপ্ন, ঘুমের সমস্যা ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতার মতো উপসর্গে ভোগে। কিশোর বয়সীদের ক্ষেত্রে দেখা যায় আচরণগত পরিবর্তন, একাগ্রতার অভাব, আত্মগোপন, বা কখনো আগ্রাসী আচরণ। দীর্ঘমেয়াদি সহায়তা না পেলে এসব শিশু পরিণত বয়সে মানসিক অসুস্থতায় ভোগার আশঙ্কা থাকে।
মোস্তফা কামাল যাত্রা জানান, দেশে মানসিক স্বাস্থ্যসেবার কাঠামো এখনো সীমিত। প্রতি ১ লাখে মাত্র ১ জনেরও কম মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। সরকারি হাসপাতালগুলোতে দুর্যোগ-পরবর্তী মানসিক সেবা কার্যত অনুপস্থিত। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নীতিমালায় ‘মনোসামাজিক সহায়তা’ বিষয়টি এখনো প্রান্তিক অবস্থানে। অন্যদিকে, সামাজিক কলঙ্ক, অজ্ঞতা ও প্রশিক্ষিত মানবসম্পদের অভাব মানুষকে মানসিক সহায়তা চাইতে নিরুৎসাহিত করে।
কাজী বেবী বলেন, দুর্যোগের সময় সম্পদের ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়। সম্পদের ক্ষতি হলে মানুষিক ট্রমা দেখা যায়। সম্পদ হারিয়ে কেউ কেউ ভিক্ষাবৃত্তিতেও নামেন। এমন পরিস্থিতিতে পড়লে তাদের যে ধরনের সহায়তার প্রয়োজন তা সরকারিভাবে দেওয়া হয় না, বেসরকারিভাবেও দেওয়া হয় না।
Please Share This Post in Your Social Media
-
সর্বশেষ
-
জনপ্রিয়