চীন থেকে ২০টি যুদ্ধবিমান কিনছে অন্তর্বর্তী সরকার, কী সুবিধা এই বিমানের

- Update Time : ১২:৪১:০৮ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৯ অক্টোবর ২০২৫
- / ৫৬ Time View
বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর জন্য চীন থেকে ২০টি জে-১০সিই যুদ্ধবিমান কেনা হচ্ছে। মাল্টিরোল কমব্যাট এয়ারক্রাফট (এমআরসিএ) বা নানামুখী ভূমিকা পালনে সক্ষম এসব যুদ্ধবিমান কেনা, প্রশিক্ষণ, অন্যান্য খরচসহ মোট ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ২২০ কোটি ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ২৭ হাজার ৬০ কোটি টাকা। জাতীয় আকাশ প্রতিরক্ষাকে শক্তিশালী করার উদ্যোগের অংশ হিসেবে এসব যুদ্ধবিমান কেনা হচ্ছে। চলতি ২০২৫-২৬ এবং আগামী ২০২৬-২৭ অর্থবছরে যুদ্ধবিমান কেনার চুক্তি বাস্তবায়নের আশা করছে সরকার। জিটুজি (সরকার টু সরকার) পদ্ধতিতে চীন সরকার বা সে দেশের সরকার মনোনীত কোনো সংস্থার কাছ থেকে এসব বিমান কেনা হবে। এসব বিমানের মূল্য ২০৩৫-৩৬ অর্থবছর পর্যন্ত ১০ বছরে পরিশোধ করতে হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় এবং যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে তাঁর ভেরিফায়েড অ্যাকাউন্টে গতকাল বুধবার এ নিয়ে একটি স্ট্যাটাস দেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর আধুনিকায়ন এবং জাতীয় আকাশ প্রতিরক্ষাকে শক্তিশালী করতে চীনের তৈরি ২০টি জে-১০সিই মাল্টিরোল যুদ্ধবিমান কেনার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। চলতি ২০২৫-২৬ এবং ২০২৬-২৭ অর্থবছরে সরাসরি ক্রয় অথবা জিটুজি পদ্ধতিতে চীন সরকারের সঙ্গে চুক্তিটি বাস্তবায়নের আশা করা হচ্ছে।
এর আগে মঙ্গলবার সচিবালয়ে সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির বৈঠক শেষে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদকে সাংবাদিকরা চীন থেকে যুদ্ধবিমান কেনা হচ্ছে কিনা– জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। একটি গণমাধ্যমে প্রকাশিত এ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের পরিপ্রেক্ষিত অর্থ উপদেষ্টাকে ওই প্রশ্ন করা হয়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিমানবাহিনীর ২১ নম্বর স্কোয়াড্রনের এ-৫ আইআইআইএ বিমানের অনুকূলে ১০টি জে-১০সিই মাল্টিরোল কমবেট যুদ্ধবিমান কেনার উদ্যোগ রয়েছে সরকারের। বাকি ১০টি যুদ্ধবিমান দিয়ে ‘ফোর্সেস গোল-২০৩০’-এর আলোকে নুতন স্কোয়াড্রন গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে।
চীনের কাছ থেকে ২০টি যুদ্ধবিমান কিনতে সম্ভাব্য খরচের একটি হিসাব তৈরি করেছে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়। এতে প্রতিটি মাল্টিরোল কমবেট এয়ারক্রাফটের মূল্য প্রাক্কলন করা হয়েছে ৬ কোটি ডলার। এ হিসাবে ২০টি বিমানের মূল্য ১২০ কোটি ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১৪ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। স্থানীয় ও বৈদেশিক প্রশিক্ষণ, যন্ত্রপাতি কেনা, পরিবহন খরচ যোগ হবে আরও ৮২ কোটি ডলার বা ১০ হাজার ৮৬ কোটি টাকা। এর সঙ্গে বীমা ও ভ্যাট, এজেন্সি কমিশন, পূর্ত কাজসহ অন্যান্য খরচ যোগ করলে মোট ব্যয় দাঁড়াবে ২২০ কোটি ডলার বা ২৭ হাজার ৬০ কোটি টাকা। এসব যুদ্ধবিমানের মূল্য পরিশোধের জন্য ২০৩৫-২০৩৬ অর্থবছর পর্যন্ত ১০ বছরে থোক বরাদ্দ দিতে হবে অর্থ মন্ত্রণালয়কে।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ২৬ মার্চ চার দিনের সফরে চীন যান। সফরের সময় প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছিল, দুই নেতার বৈঠকে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে তিস্তা নদীর প্রকল্পে চীনের সহায়তা, মাল্টিপল রোল কমবেট এয়ারক্র্যাফট (বহুমাত্রিক যুদ্ধবিমান) কেনা, বাংলাদেশের বন্দরগুলোর সঙ্গে চীনের কুনমিংয়ের বহুমাত্রিক সংযুক্তি ইত্যাদি। চীন থেকে যুদ্ধবিমান কেনার জন্য আলোচনার মাধ্যমে চুক্তির খসড়া চূড়ান্ত করতে গত এপ্রিলে বিমানবাহিনীর প্রধানকে সভাপতি করে ১১ সদস্যের একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিতে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, অর্থ বিভাগ, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ, আইন মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সংস্থার প্রতিনিধিরা রয়েছেন। কমিটি চীনা প্রতিনিধিদের সঙ্গে দরকষাকষির মাধ্যমে এসব যুদ্ধবিমানের চূড়ান্ত মূল্য নির্ধারণ, অর্থ পরিশোধে শর্ত নির্ধারণ এবং খসড়া চুক্তি প্রস্তুত করাসহ চীনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে চুক্তিপত্র চূড়ান্ত করে চুক্তি স্বাক্ষর সম্পর্কিত বিষয় সম্পন্ন করবে।
জে-১০সি যুদ্ধবিমানে কী সুবিধা
চীনের সংবাদমাধ্যম গ্লোবাল টাইমস এবং প্রতিরক্ষাবিষয়ক সংবাদ ও বিশ্লেষণভিত্তিক ওয়েবসাইট দ্য ওয়্যার জোনের তথ্য অনুযায়ী, চীনের তৈরি জঙ্গি বিমান জে-১০সি ‘ভিগোরাস ড্রাগন’ নামেও পরিচিত। এটি মাল্টিরোল কমবেট এয়ারক্র্যাফট (এমআরসিএ)। চতুর্থ প্রজন্মের জঙ্গি বিমানের বহুমাত্রিক অভিযানের সামর্থ্য রয়েছে। সুপারসনিক গতিতে (শব্দের চেয়ে বেশি গতি) উড্ডয়ন সক্ষম জে–১০সি শত্রুপক্ষের জঙ্গি বিমান শনাক্তকরণে অত্যন্ত দক্ষ। আকাশ থেকে আকাশে ও আকাশ থেকে ভূমিতে হামলার সক্ষমতা রয়েছে। এটি ২০০ কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে। এটি অন্যান্য জঙ্গি বিমান এবং ড্রোনের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে অভিযানে যুক্ত হতে পারে। যুদ্ধবিমানটি প্রযুক্তি, গতি এবং শত্রুর নজর এড়িয়ে আক্রমণ পরিচালনা এবং নজরদারিতে সক্ষম। গত মে মাসে কাশ্মীরে সন্ত্রাসী হামলার পর চীনের তৈরি জে-১০সির প্রযুক্তিগত এবং সামরিক সামর্থ্য প্রমাণিত হয়েছে বলে দাবি পাকিস্তানের। ইসলামাবাদ দাবি করে, তখন প্রথমবারের মতো কোনো সম্মুখ লড়াইয়ে যুক্ত হয়েছিল জে-১০সি। এর মাধ্যমে ফ্রান্সে তৈরি জঙ্গি বিমান দাসল্ট রাফালে ভূপাতিত করা হয়। যদিও এই ঘটনা স্বতন্ত্রভাবে যাচাই করা এখনও সম্ভব হয়নি।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, একটি দেশের প্রতিরক্ষা খাতের দুই ধরনের কাজে মূলত যুদ্ধবিমান ব্যবহৃত হয়ে থাকে। একটি হলো ডিফেনসিভ বা প্রতিরক্ষামূলক, আর অপরটি অফেনসিভ বা আক্রমণাত্মক। শত্রুপক্ষ হামলা করলে সেটি মোকাবিলা করায় কাজে লাগে ডিফেনসিভ। আর শত্রুর ওপর হামলা করায় লাগে অফেনসিভ। ডিফেনসিভ যুদ্ধবিমানগুলো সাধারণত দুই কাজেই, যেমন–– প্রতিরক্ষা ও হামলা দুই কাজেই ব্যবহৃত করা যায়। সামরিক খাত সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা জানান, বাংলাদেশের অধিকাংশ যুদ্ধবিমানই ছিল ডিফেনসিভ বা প্রতিরক্ষামূলক, যার কারণ বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি। তারা জানান, চীনের ‘জে-১০’ সিরিজের যুদ্ধবিমান মূলত ব্যবহার করে তাদের অ্যারোবেটিক টিম। গত মে মাসে ভারত-পাকিস্তান সংঘাতের সময়ও চীনের এই যুদ্ধবিমান নিয়ে আলোচনা হয়েছিল।
ওই সময় মার্কিন কর্মকর্তার বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছিলো, পাকিস্তান চীনের তৈরি জে-১০ বিমান ব্যবহার করে ভারতীয় যুদ্ধবিমানে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে – যার ফলে কমপক্ষে দুটি ভূপাতিত হয়। চীন ২০০৯ সালে তাদের প্রদর্শনীতে আনা বিমানের তালিকায় ‘জে-১০এ’ ও ‘জে-১০এস’ যুক্ত করে। এরপর ২০২৩ সালে উন্নত সংস্করণ ‘জে-১০সি’তে আপগ্রেড করে দেশটি। নিরাপত্তা খাত সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে জে-১০সিই যুদ্ধবিমানের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো এটি অনেক কম জায়গায় ‘টেক অফ’ করতে পারে। অর্থাৎ শত্রুপক্ষ হামলা করলে জে-১০সিই যুদ্ধবিমান অনেক কম সময়ে (রিঅ্যাকশন টাইম) স্বল্প স্থানে ‘টেক অফ’ করতে পারে। রানওয়ের একটি অংশে শত্রুপক্ষ বোমা হামলা করলেও এই যুদ্ধবিমান অন্য অংশ থেকেই টেক অফ করতে পারবে। এছাড়া, এই যুদ্ধবিমান সিঙ্গেল ইঞ্চিন ফাইটার। এর সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো ম্যানুভারিং, অর্থাৎ ‘টপ ফাইট’ বা উঁচুতে যুদ্ধ করা যায়।
সামরিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টপ ফাইটের সময় দ্রুতগতিতে প্রচুর টার্নিং নিতে হয়। দ্রুত আকাশে ওঠার ক্ষমতা এই টপ ফাইটে প্রয়োজন। এই যুদ্ধ বিমান এমনভাবে ডিজাইন করা যাতে বিশ্বের প্রায় অধিকাংশ ম্যানুভারিং করা সম্ভব। অর্থাৎ শত্রুপক্ষের বিমানকে সহজে ফাঁকি দেওয়া যায় এই বিমানে। আকাশ থেকে আকাশে ছোঁড়া ক্ষেপণাস্ত্র এবং ভূমি থেকে আকাশে ছোঁড়া উভয় ধরনের ক্ষেপণাস্ত্রকেই এই জে-১০সিই যুদ্ধবিমানের অ্যারো ডায়নামিকস ডিজাইনের কারণেই সহজে ফাঁকি দেওয়া সক্ষম বলে জানান সামরিক বিশেষজ্ঞরা। এই যুদ্ধবিমান ‘মাল্টিরোল’ ভূমিকাও পালন করে, অর্থাৎ ডিফেনসিভ এবং অফেনসিভ দুই ধরনের কাজই এই যুদ্ধবিমানের মাধ্যমে করা যাবে।
এছাড়া এই যুদ্ধবিমানের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো শব্দের চেয়ে দ্বিগুণ এর গতিবেগ। অর্থাৎ এই বিমানটির সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় প্রায় দুই হাজার ৪১৫ কিলোমিটার। রাফাল এবং জে-১০সি দুটোই চার দশমিক পাঁচ প্রজন্মের যুদ্ধবিমান, কিন্তু রাডারের ক্ষেত্রে জে-১০সি বিমান রাফালের চেয়ে শক্তিশালী বলে ধারণা করা হয়। এটি বিমানবাহী রণতরী এবং ভূমিতে থাকা ঘাঁটি থেকে পরিচালনা করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে বলেও জানান নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা।
Please Share This Post in Your Social Media
-
সর্বশেষ
-
জনপ্রিয়