সম্পদের তথ্য গোপনেও ‘নাম্বার ওয়ান’ সাকিব

- Update Time : ০৮:৫৯:৫৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ৮ অক্টোবর ২০২৫
- / ৬৫ Time View
বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের অন্যতম উজ্জ্বল মুখ সাকিব আল হাসান। ‘ক্রিকেটের বাইবেল’খ্যাত ‘উইজডেন ক্রিকেটার্স অ্যালামনাক’ ২০০৯ সালে তাকে বর্ষসেরা টেস্ট ক্রিকেটার, একদিনের ক্রিকেট সংস্করণে দশকের (২০১০-২০) সেরা ক্রিকেটার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। নিঃসন্দেহে এ স্বীকৃতি শুধু ব্যক্তি সাকিবকে নয়, দেশের সাধারণ মানুষকেও আলোড়িত করেছে। কিন্তু ক্রীড়াব্যক্তিত্ব হিসেবে তার এ পরিচয় অনেক সময় আড়ালে রেখেছে মাঠের বাইরের নানা কর্মকাণ্ড।
অখেলোয়াড়সুলভ আচরণের জন্য ক্রীড়াঙ্গনে নিষিদ্ধও হয়েছিলেন সাকিব। আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকার একটা মোহ হয়তো তাকে তাড়া করে ফেরে! এ জন্য জড়িয়েছেন রাজনীতিতে। যুক্ত হয়েছেন শেয়ারবাজারের কারসাজিতেও। এ কারণে অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হয়েছেন। সুযোগ পেলে অর্থ উপার্জনের কোনো উপায় হাতছাড়া করেন না। লোভে পড়েই কক্ষচ্যুত হয়েছেন বলে মাঝেমধ্যেই তার সমালোচনা হয়। এবার জানা গেল কর ফাঁকিতেও পিছিয়ে নেই দেশের ‘নাম্বার ওয়ান’খ্যাত ক্রিকেটার সাকিব।
ব্যাংকের এফডিআর, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ, আমানতের সুদ থেকে আয় কিংবা দেশ-বিদেশে যেসব ক্রিকেট লিগে অংশ নিয়েছেন সেসব থেকে আয়ের তথ্যও গোপন করেছেন সাকিব। এখন পর্যন্ত ১০৬ কোটি টাকার বেশি জ্ঞাত আয়বহির্ভূত অর্থের সন্ধান পেয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আয়কর তদন্ত গোয়েন্দা ইউনিট। এর মধ্যে কর ফাঁকির পরিমাণ ৩০ কোটি টাকার বেশি।
আয়কর নথি অনুযায়ী সাকিবের আয়ের খাত বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) চুক্তিবদ্ধ খেলোয়াড় হিসেবে মাসিক বেতন, বিজ্ঞাপনী আয় আর ব্যাংকের কিছু স্থিতি। এছাড়া একমাত্র ইন্ডিয়ান ক্রিকেট লিগ (আইপিএল) থেকে আয় দেখানো হয় শুধু ২০১৭-১৮ করবর্ষে। যদিও তিনি ২০০৮ সালে আইপিএল শুরুর বছর থেকেই অংশ নিচ্ছেন।
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, আইপিএল ছাড়াও বিশ্বের প্রায় সব টি-২০ লিগে অংশ নিয়েছেন সাকিব। এর মধ্যে ২০১১ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত (২০১৩ সাল ব্যতীত) তিনি বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে (বিপিএল) খেলেছেন। পাকিস্তান সুপার লিগে (পিএসএল) ২০১৫-১৬, ২০১৬-১৭, ২০২২-২৩ ও ২০২৫ মৌসুমে খেলেন। এলপিএলে ২০২৩ সালে, ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লিগে (সিপিএল) ২০১৩, ২০১৬, ২০১৭, ২০১৯ ও ২০২২ মৌসুমে, বিগ ব্যাশ লিগে ২০১৩-১৪ ও ২০১৪-১৫ মৌসুমে, চ্যাম্পিয়ন লিগ টি-২০তে ২০১১-১২ ও ২০১২-১৩ মৌসুমে, মেজর লিগ ক্রিকেটে (এমএলসি) ২০২৪ সালে খেলেন। কিন্তু এসব লিগ থেকে উপার্জিত আয়ের কোনো তথ্যই আয়কর নথিতে দেখাননি তিনি। বিভিন্ন সময়ে ম্যান অব দ্য ম্যাচ কিংবা ম্যান অব দ্য সিরিজ হিসেবে পুরস্কারের অর্থও গোপন করেছেন সাকিব।
গোয়েন্দারা সাকিবের আয়কর নথি পর্যালোচনা করে এসব তথ্য পেয়েছেন। তবে এ বিষয়ে অধিকতর তদন্তের প্রয়োজন হতে পারে বলে মনে করছেন তারা। বিশেষ করে ২০২১-২২ আয়কর বছর থেকে সাকিবের এফডিআরের পরিমাণ কমতে শুরু করে। গোয়েন্দারা ধারণা করছেন, সাকিব তার জমানো অর্থ উত্তোলন করে দেশের বাইরে নিয়ে গেছেন।
আমেরিকার নিউ ইয়র্কে তার বাড়ি থাকার তথ্য বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে। বাংলাদেশের ক্রিকেট খেলোয়াড়রা ২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে টি-২০ বিশ্বকাপ প্রস্তুতির জন্য দেশটিতে সফরে গেলে সাকিবের বাসায় আতিথ্য গ্রহণ করার খবর বহুলভাবে প্রচারিত হয়। তিনি নিজেও ইনস্ট্রাগ্রাম স্টোরিতে সেটির ছবি ও ভিডিও আপলোড করেন। এতে দেশের বাইরে সাকিবের আরো সম্পদের খোঁজ মিলতে পারে বলে আয়কর গোয়েন্দারা ধারণা করছেন।
সাকিবের অর্থ কেলেঙ্কারি নিয়ে তদন্ত এখনো চলমান আছে। বর্তমানে ‘সাকিব আল হাসান ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট’ ও ‘সাকিব আল হাসান ক্যানসার ফাউন্ডেশন’ নামে দুটি দাতব্য প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আয়কর ফাঁকির ঘটনা ঘটেছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
আয়কর গোয়েন্দা ও তদন্ত ইউনিটের কমিশনার আবদুর রকিব বলেন, সাকিবের কর ফাঁকির বিষয়ে তদন্ত চলমান আছে। ইতোমধ্যে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের খোঁজ মিলেছে। এসব সম্পদের বিপরীতে সরকারের রাজস্ব আদায়ে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর আয়কর গোয়েন্দা ও তদন্ত ইউনিটের কার্যক্রম শুরু হয়। মূলত ব্যক্তি পর্যায়ে আয়ের তথ্য গোপন করে রাজস্ব ফাঁকি উদঘাটন ও আদায়ে এই ইউনিট গঠন করা হয়। তদন্ত ইউনিট তাদের প্রথম ফাইলটি ওপেন করে সাকিবের নামেই। এখানেও তিনি ‘নাম্বার ওয়ান’।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০০৬-০৭ আয়করবর্ষ থেকে রিটার্ন দাখিল করেছেন সাকিব। তবে ২০২৪-২৫ করবর্ষের রিটার্ন জমা দেননি। দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ও শেখ হাসিনার ভারতে পলায়নের পর সাকিবও দেশে অবস্থান না করার কারণে তিনি রিটার্ন জমা দেননি বলে ধারণা করছেন আয়কর কর্মকর্তারা। তবে দাখিল করা রিটার্নের মধ্যে ২০১৮-১৯ থেকে ২০২২-২৩ আয়করবর্ষের রিটার্নের তথ্য যাচাই শুরু করেন আয়কর গোয়েন্দা কর্মকর্তারা।
বক্তব্য দেওয়ার অনুমতি না থাকায় নাম প্রকাশ না করে এক আয়কর গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, সাকিবের সম্পদের খোঁজ পেতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। অনেক কোম্পানির পরিচালক হিসেবে তার নাম পাওয়া যাচ্ছে। এ পর্যন্ত ২৩টি প্রতিষ্ঠানের নাম পাওয়া গেছে। কিন্তু ফাইলে দেখানো হয়েছে ৯টির নাম।
অবশ্য এর মধ্যে ১১টির পরিচালকের পদ ছেড়ে দিয়েছেন তিনি। এর মধ্যে ৯টি কোম্পানির জন্য একই ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে। এই ঠিকানা হচ্ছে ১০/২ গাউসিয়া কাশেম সেন্টার। ৫০০ বর্গফুটেরও কম পরিসরের একটি কক্ষে এতগুলো কোম্পানির নিবন্ধন শুধু শেয়ার ব্যবসার জন্য নেওয়া হয়েছে বলে ধারণা করছেন তিনি। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে অন্য কেউ ফায়দা লুটতে সাকিবের নাম ব্যবহার করতে পারেন বলেও মন্তব্য করেন তিনি। শেয়ারবাজারের আলোচিত ব্যবসায়ী হিরোর স্ত্রী কাজি সাদিয়া হাসানের মোনার্ক হোল্ডিংস লিমিটেড নামে একটি ব্রোকারেজ হাউসের মালিকানাও রয়েছে সাকিবের।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮-১৯ করবর্ষে ২৭ কোটি ৮৫ লাখ টাকা আয়কর দেখানো হয়। ওই বছরে ছয় কোটি ৫৭ লাখ টাকা এফডিআর এবং সুদ বাবদ এক কোটি ৯২ লাখ টাকা আয় গোপনের তথ্য মিলেছে। শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের তথ্যও দেখানো হয়নি। ২০২১-২২ করবর্ষে শেয়ার ব্যবসায় বিনিয়োগ দেখানো হয়েছে ছয় কোটি ৫৭ লাখ টাকা।
এসবিএল ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট নামে একটি সিকিউরিটিজ হাউস থেকে যে তথ্য পাওয়া গেছে, তাতে দেখা যায় সাকিবের বিনিয়োগের পরিমাণ ২১ লাখ ৮৮ লাখ টাকা। র্যাংকন থেকে ২০ কোটি ৫০ লাখ টাকা দামের একটি ফ্ল্যাট কেনেন, যা ২০২৩ সালে তার নামে হস্তান্তর করা হয়েছে সেটিও আয়কর নথিতে নেই। এভাবে ২০১৮-১৯ থেকে ২০২২-২৩ করবর্ষ পর্যন্ত সাকিবের আয়বহির্ভূত ব্যাংক হিসাবে পাওয়া গেছে ১০৬ কোটি টাকা।
সূত্র আরো জানায়, সাকিবের নামে কোনো গাড়ি নেই। একসময় দুটি গাড়ি দেখানো হলেও পরে সেগুলো বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। তবে তিনি যেসব গাড়ি ব্যবহার করেন, সেগুলো তার প্রতিষ্ঠানের নামে নিবন্ধিত।
কয়েকটি সূত্র জানায়, সাকিব ২০১৮ সালের নভেম্বরে রাজনীতিতে নাম লেখান। ওই সময় ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে মাগুরা-১ আসন থেকে একই দলের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেন। ‘রাতের ভোট’ নামে খ্যাত ওই নির্বাচনে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিতও হন।
তবে ২০২৩ সালে সংসদ সদস্যপদ থেকে ইস্তফা দেন। খেলার মাঠে পুরোপুরি মনোনিবেশ করতে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে জানিয়েছিলেন তিনি। তবে সম্প্রতি ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানিয়ে ফের আলোচনায় আসে তার নাম। ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ বরাবরই সাকিবের জাতীয় দলে ফেরার বিরোধিতা করে আসছেন। সে হিসেবে সাকিব আগামীতে দেশের হয়ে খেলতে পারবেন তা নিশ্চিত নয়।
বর্তমানে দেশের বাইরে অবস্থান করা এই ক্রীড়াবিদ সবশেষ গত বছরের নভেম্বরে দেশে ফিরেছিলেন, বিসিবির সঙ্গে চুক্তির বিষয়ে আলোচনা করতে। কিন্তু সে আলোচনা ভেস্তে যায় এবং সাকিব দেশ ছেড়ে চলে যান। বর্তমানে তিনি আমেরিকায় অবস্থান করছেন।
সাকিবের সম্পদের তথ্য গোপন ও আয়কর ফাঁকির বিষয়ে কথা বলতে তার আইনজীবী আবদুস সবুরের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি। এমনকি মেসেজ পাঠালেও কোনো জবাব মেলেনি।
Please Share This Post in Your Social Media
-
সর্বশেষ
-
জনপ্রিয়