পঞ্চম ডাকের সেই তরুণ: রাসেদের গল্প
এক স্ট্যাটাস, এক তরুণ, আর এক অসমাপ্ত জীবন

- Update Time : ০৯:৩৭:৪৬ অপরাহ্ন, রবিবার, ৫ অক্টোবর ২০২৫
- / ৪৭৯ Time View
কখনও কখনও একটি বাক্য জীবনের আগাম সংবাদ হয়ে আসে। তিন বছর আগে নিজের ফেসবুকে লিখেছিলেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী রাসেদুল ইসলাম—
“কে জানে, পঞ্চম ডাকটা কার আসে…”
তখন সেটি ছিল এক তরুণের নিঃশব্দ অনুভব, বন্ধুহারা মন থেকে উঠে আসা এক বিষণ্ণ চিন্তা। কিন্তু সময়ের নির্মম পরিহাসে, সেটিই হয়ে উঠল তার জীবনের শেষ সত্য।
রবিবার (৫ অক্টোবর) বিকেল পৌনে ৩টার দিকে কুমিল্লার হোমনা উপজেলার ভবানীপুর ঘাটে বজ্রপাতে মারা যান রাসেদ। নদী পার হওয়ার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। হঠাৎ ঝলসে ওঠে আকাশ, মেঘে গর্জে ওঠে বজ্রধ্বনি— মুহূর্তের মধ্যে স্তব্ধ হয়ে যায় চারপাশ। কয়েক সেকেন্ডেই নিভে যায় এক তরুণ জীবনের দীপ্ত আলো।
রাসেদ ছিলেন ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। বয়স কম, কিন্তু চিন্তায় গভীর। সিনেমা ছিল তার জীবনের ভাষা— লেন্সের ওপারে তাকিয়ে পৃথিবীকে পড়তে চাইতেন তিনি। বন্ধুদের চোখে রাসেদ ছিল ‘চুপচাপ কিন্তু উজ্জ্বল’— এমন একজন, যার উপস্থিতি সবসময় একটা উষ্ণতা এনে দিত। হাসির আড়ালে লুকিয়ে থাকত গভীর ভাবনা, আবার ভাবনার ভেতরও থাকত অদ্ভুত রকমের আশাবাদ।
তবে সেই হাসির অন্তরালে ছিল এক গোপন শোক। কয়েক বছরের ব্যবধানে হারিয়েছিলেন তার চার প্রিয় বন্ধু— জিসান, মহিন, রাজু আর কাকন। একে একে তাদের চলে যাওয়া তাকে নীরবে ভেঙে দিয়েছিল। সেই সময়েই লিখেছিলেন এক দীর্ঘ স্ট্যাটাস, যা আজ পাঠ করলে মনে হয় তিনি যেন নিজের ভবিষ্যৎই লিখে গেছেন—
“মৃত্যু তো একটা অনিবার্য সত্য। কিন্তু ইদানিং কেন জানি নিজের মৃত্যুর কথা হঠাৎ হঠাৎ মনে পড়ে যায়। হয়তো কারণ, আমার বন্ধুদের ভেতর এক অদ্ভুত ট্রেন্ড শুরু হয়েছে। একে একে চারজন চলে গেল। কে জানে, পঞ্চম ডাকটা কার জন্য আসবে?”
পোস্টের শেষে তিনি আরও লিখেছিলেন—
“জিসানের মৃত্যুর দিনটায় আমি অনেকক্ষণ স্থির হয়ে বসে ছিলাম। তখনই প্রথম বুঝলাম— মৃত্যু শুধু বয়সের বিষয় নয়, সে আসতে পারে যে কোনো বয়সে, যে কোনো সময়।”
সেই লেখার তিন বছর পর, তারই নাম এখন সেই তালিকার পঞ্চম স্থানে। যেন ভবিষ্যতের একটা আভাস তিনি নিজেই লিখে রেখে গিয়েছিলেন।
রাসেদের মৃত্যুর খবর পৌঁছাতেই শোকের ছায়া নেমে আসে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। বন্ধুরা কেউ বিশ্বাসই করতে পারছিল না, এতটা হঠাৎ করে চলে যাওয়া সম্ভব! ক্লাসরুম, করিডোর, ক্যাফেটেরিয়া— সবখানেই তার স্মৃতির ছায়া। কেউ ফেসবুকে তার ছবি পোস্ট করছে, কেউ তার পুরোনো লেখা শেয়ার করছে। আবার কেউ নীরবে বসে আছে, কোনো কথাই খুঁজে পাচ্ছে না।
সহপাঠী নাফিজ বলেন, “রাসেদ শুধু বন্ধু না, একটা চিন্তা ছিল। ওর চোখে একটা অন্যরকম পৃথিবী দেখা যেত। খুব শান্ত, কিন্তু খুব গভীর।”
ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া বিভাগের শিক্ষকরা বলছেন, রাসেদ ছিলেন অত্যন্ত সম্ভাবনাময় শিক্ষার্থী। সিনেমা নিয়ে তার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল পরিণত ও মানবিক। কিছুদিন আগে বিভাগের এক প্রজেক্টে কাজ করছিলেন তিনি— জীবন ও সময় নিয়ে ছোট একটি প্রামাণ্যচিত্র বানানোর পরিকল্পনা ছিল তার।
রাসেদের সামাজিক মাধ্যমের পুরোনো পোস্টগুলো এখন পড়লে এক ধরনের বিষণ্ণতা ছড়িয়ে যায়। যেন প্রতিটি বাক্যের ভেতর মৃত্যুচেতনা লুকিয়ে ছিল, কিন্তু সেই চেতনা ছিল জীবনের প্রতি গভীর ভালোবাসা থেকেও। এক জায়গায় তিনি লিখেছিলেন—
“যে গোপনে আসিয়াছিল, তাহাকে গোপনেই যাইতে দিলাম। কিন্তু সে যে তাহার কতখানি আমার কাছে ফেলিয়া রাখিয়া গেল, তাহা কিছুই সে জানতে পারিল না।”
আজ তার এই লাইনগুলো বন্ধুদের মনে বারবার বাজছে।
চার বন্ধুর পর এবার সত্যিই এল ‘পঞ্চম ডাক’।
এবার সেই সারিতে যুক্ত হলো নতুন এক নাম
রাসেদুল ইসলাম।
চলে গেলেন, কিন্তু রেখে গেলেন এক অসমাপ্ত গল্প।
এক তরুণ, যে জীবনের অর্থ খুঁজতে চেয়েছিল সিনেমার আলো-অন্ধকারে,
এবার নিজেই হয়ে গেল সেই গল্পের সবচেয়ে নিঃশব্দ দৃশ্য।
Please Share This Post in Your Social Media
-
সর্বশেষ
-
জনপ্রিয়