মবের শিকার সেই রূপলালের ছেলে জয় আবার ফিরেছে ক্লাসে
- Update Time : ০৭:২৯:৫৬ অপরাহ্ন, বুধবার, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫
- / ৬০০৮ Time View
মব সন্ত্রাসে বাবা রূপলাল রবিদাসের মৃত্যুর পর স্কুল ছেড়ে বাবার পেশায় বসতে হয়েছিল ছেলে জয় রবিদাসকে। জুতা সেলাই করে পরিবারের আয়ের সংস্থানে নামতে বাধ্য হয় ১৪ বছরের এই কিশোর। তবে মানুষের সহমর্মিতা আর সহযোগিতার হাত জয়কে আবার স্কুলে ফেরার স্বপ্ন দেখিয়েছে। বাবাহীন সংসারের বোঝা ঝেড়ে কাঁধে উঠেছে স্কুল ব্যাগ। এখন তার স্বপ্ন—বড় হয়ে একজন আইনজীবী হওয়ার।
চৌদ্দ বছর বয়সী জয় রবিদাস রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার কুর্শা ইউনিয়নের ঘনিরামপুর গ্রামের রূপলাল রবিদাসের ছেলে। সে তারাগঞ্জ সরকারি মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্র। তার বড় বোন নুপুর দাস এইচএসসি পাস করেছেন। আর ছোট বোন রুপা দাস পড়ছে ষষ্ঠ শ্রেণিতে।
গত ৯ আগস্ট চোর সন্দেহে মব সৃষ্টি করে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয় রূপলাল রবিদাস ও তার ভাগ্নিজামাই প্রদীপ লাল রবিদাসকে। উপার্জনক্ষম বাবাকে হারিয়ে দিশেহারা পরিবারের হাল ধরতে স্কুল ছেড়ে ফুটপাতে ছোট্ট কাঠের চৌকিতে বসে জুতা সেলাইয়ের কাজ শুরু করেছিল জয় রবিদাস। যেখানে এক যুগেরও বেশি সময় ধরে বসতেন তার বাবা রূপলাল।
স্কুল ছেড়ে পৈতৃক পেশার মাধ্যমে সংসারের হাল ধরার চেষ্টা করা জয় রবিদাসকে নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়। এরপর অনেকেই জয়ের পরিবারের পাশে দাঁড়ায়। প্রশাসনের আশ্বাসে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সেই জয় আবার ফিরেছে স্কুলে। গত রোববার থেকে সে নিয়মিত ক্লাসও করছে।
বাড়ি থেকে জয়ের বিদ্যালয়ের দূরত্ব প্রায় তিন কিলোমিটার। বুধবার দুপুরে বিদ্যালয় থেকে বাড়ি ফেরার পথে কথা বলে এই প্রতিবেদকের সাথে। জয় দাস বলে, আমি নিয়মিত স্কুলে যাচ্ছি। শিক্ষক-সহপাঠী সবাই উৎসাহ দিচ্ছে, সাহায্য করছে। আমাকে এখন আর জুতা সেলাইয়ের কাজ করতে হচ্ছে না। এখন বাবার স্বপ্ন পূরণে পড়ালেখা করে আমি আইনজীবী হতে চাই।
তারাগঞ্জ বাজারে নতুন চৌপথী বাসস্ট্যান্ড থেকে অগ্রণী ব্যাংক মোড়ের মধ্যবর্তী স্থানে জুতাপট্টির সামনে রাস্তার পাশে জলচৌকিতে বসে জুতা তৈরি ও সেলাইয়ের কাজ করতেন জয়ের বাবা রূপলাল রবিদাস। তার মৃত্যুর পর সংসারের হাল ধরতে একই পেশা বেছে নেয় একমাত্র ছেলে জয়।
সেই মূহুর্তের কথা জানতে চাইলে জয় রবিদাস বলে, যেদিন বাবার আসনে বসে কাজ করার সময় বুক ফেঁটে কান্না এসেছিল। কিন্তু কাঁদতে পারিনি। বাবাকে হারানোর কষ্ট ভুলতে পারছি না। বাবাকে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে মেরে ফেলায় আমরা এতিম হয়ে গেছি। বাড়িতে আমার দাদি, মা ও দুই বোন রয়েছে। বিভিন্ন মিডিয়াতে আমাদের পরিবারকে নিয়ে সংবাদ প্রকাশ হয়েছে। এরপর উপজেলা প্রশাসন এক লাখ টাকা দিয়েছে। বিএনপি-জামায়াতসহ অনেকেই আর্থিক সহায়তার মাধ্যমে পাশে দাঁড়িয়েছেন। সবার প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ।
জয়ের বড় বোন নুপুর দাস জানান, তার বাবা জয়কে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখতেন। যেদিন জয় বাবার পেশায় যোগ দিয়েছিল, পুরো পরিবার সেদিন খুব কেঁদেছিল। কিন্তু জয়কে নিয়ে সংবাদ প্রকাশ হলে প্রশাসনসহ অনেকের সহায়তায় পরিবারে স্বস্তি ফিরেছে। এখন জয়ের স্বপ্ন পূরণ হলে সবার সহযোগিতা স্বার্থক হবে।
মা ভারতী রানী বলেন, আমার স্বামী ফুটপাতে জুতা সেলাই করলেও সন্তানদের শিক্ষিত করার স্বপ্ন দেখতেন। ছেলেটা আবার স্কুলে ফিরেছে– এটাই আমার কাছে সবচেয়ে স্বস্তির।
তারাগঞ্জ সরকারি মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবু মুসা বলেন, জয় মেধাবী ছাত্র। বাবাকে হারানোর পর সে স্কুলে আসা বন্ধ করেছিল। হঠাৎ জয়কে রাস্তায় জুতা সেলাই করতে দেখে মনটা খুব খারাপ হয়েছিল। কিন্তু ওকে তো ফেরানোর পথ ছিল না আমাদের। এখন সে আবার বিদ্যালয়ে আসছে, ওকে দেখে ভালো লাগছে। তাকে মানসিকসহ সব ধরনের সহায়তা দিচ্ছি। সে পড়াশোনা করে মানুষের মতো মানুষ হোক, এটাই চাই।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুবেল রানা বলেন, সরকারি-বেসরকারি সহায়তা পেয়েছে পরিবারটি। রুপলালের বড় মেয়ে নুপুরের জন্য একটি চাকরি ও বাজারে দোকানঘর করে দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনা যাতে ব্যাঘাত না ঘটে, তা নিশ্চিত করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, গত ৯ আগস্ট রাত সাড়ে ৮টার দিকে মিঠাপুকুরের ছড়ান বালুয়া এলাকা থেকে ভাগ্নিজামাই প্রদীপ লাল রবিদাসকে নিয়ে ভ্যানে করে বাড়ি ফেরার পথে সয়ার ইউনিয়নের বুড়িরহাট বটতলা মোড়ে স্থানীয় কয়েকজন ব্যক্তি তাদের পথরোধ করে চোর সন্দেহে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। এরই একপর্যায়ে সন্দেহভাজনরা প্রদীপ লালের কালো ব্যাগ তল্লাশি করে ‘স্পিড ক্যানের’ বোতলে দুর্গন্ধযুক্ত পানীয় এবং কিছু ওষুধ পান। বোতলের ঢাকনা খোলার পর দুর্গন্ধে বুড়িরহাট এলাকার মেহেদী হাসানসহ কয়েকজন অসুস্থ হয়ে পড়েন। এতে উত্তেজিত হয়ে রূপলাল ও প্রদীপ লালকে বুড়িরহাট উচ্চ বিদ্যালয়ে মাঠে নিয়ে যান।
এর পরই মব গড়ে উঠলে সেখানে লাঠিসোঁটা ও লোহার রড দিয়ে তাদের দুজনকে বেধড়ক মারধর করা হয়। একপর্যায়ে গুরুত্বর আহত অবস্থায় তাদের উদ্ধার করে তারাগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হলে চিকিৎসক রূপলাল রবিদাসকে মৃত ঘোষণা করেন। পরে সেখান থেকে প্রদীপ লাল রবিদাসকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তির জন্য পাঠানো হয়। পরদিন রোরবার ভোরে প্রদীপ লালেরও মৃত্যু হয়।
এ ঘটনার পরদিন ১০ আগস্ট রূপলাল রবিদাসের স্ত্রী ভারতী রানী বাদী হয়ে তারাগঞ্জ থানায় ৫০০-৭০০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে হত্যা মামলা করেন। এখন পর্যন্ত এ মামলায় ছয়জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।













































































































































































































