ঢাকা ০৩:৩৫ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৪ অগাস্ট ২০২৫, ২৯ শ্রাবণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

লাগামহীন লুটপাটে ‘পাথরহীন’ সিলেটের সাদাপাথর

মো.মুহিবুর রহমান, সিলেট
  • Update Time : ০৪:২২:৪৪ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৩ অগাস্ট ২০২৫
  • / ৭৮ Time View

একসময় রাতের আধাঁরে চুরি হলেও এখন দিনদুপুরে পাথর লুট হচ্ছে সিলেটের সাদাপাথরসহ জাফলং এলাকায়। এ কারণে বিলীনের পথে সিলেটের সাদাপাথর ও জাফলং এর পাথর। সাদাপাথর পর্যটনকেন্দ্রের কাছাকাছি তিনটি বিজিবি ক্যাম্প ও একটি থানা থাকলেও লুট ঠেকাতে কি ভূমিকা রাখতে পারছে না?

পরিবেশবাদীসহ সংশ্লিষ্ট অনেকের মন্তব্য, সাদাপাথর লুট ঠেকাতে প্রশাসন কি ব্যর্থ? লাগামহীন লুটপাটে প্রায় পাথরহীন হয়ে পড়েছে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার পর্যটন এলাকা সাদাপাথর। সম্প্রতি পাহাড়ি ঢলের সাথে ধলাই নদের উৎসমুখ সাদাপাথরে বিপুল পরিমাণ পাথর আসে। প্রকাশ্যেই সেই সব পাথর নৌকা করে নিয়ে লুট করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। প্রতিদিন শত শত নৌকা দিয়ে লুটের পাথর পরিবহন করা হচ্ছে। নদী তীরের বালিও মাটি খুঁড়েও চলছে লুট। ব্যাপক লুটপাটের কারণে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত এ এলাকাটি একেবারে বিরাণভূমিতে পরিণত হয়েছে। প্রশাসনের সামনেই দিনদুপুরে চলছে লুটপাট। সকাল থেকে সাদা পাথর এলাকায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) ফাঁড়ি এলাকা মাড়িয়ে জিরো পয়েন্ট দিয়ে পাথর লুট হচ্ছে।

জানা গেছে, গত দুই সপ্তাহে সাদা পাথর এলাকায় কয়েক দফা পাহাড়ি ঢল নামে। প্রতিবারই ঢলের তোড়ে স্তরে স্তরে পাথর ও বালু নামে। এবার দফায় দফায় ঢলের পর শুধু বালু দেখা গেছে। বালুর স্তর সরিয়ে পাথর লুটপাট হয়েছে।

স্থানীয় লোকজন বলছেন, দুই সপ্তাহে অন্তত শতকোটি টাকার পাথর লুট হয়েছে। সাদা পাথর প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট একটি পর্যটনকেন্দ্র। ২০১৭ সালে পাহাড়ি ঢলে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জ পাথর মহালের ধলাই নদের উৎসমুখে পাঁচ একর জায়গাজুড়ে জমা হয় পাথর। ঢলের তোড়ে সেখানে সর্বশেষ ১৯৯০ সালে একবার পাথর জমা হয়েছিল। সেসব পাথরকে ‘ধলাসোনা’ বলে অভিহিত করা হয়। তবে পাহাড়ি ঢলের পর লুটপাটে সেসব পাথর নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। ২৭ বছরের মাথায় ফের পাথর জমা হওয়ায় উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের পাহারায় সংরক্ষিত হয়। ওই বছর থেকে পুরো এলাকাটি প্রাকৃতিক পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি পায়। সাদা পাথর এলাকার ওপারে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পাহাড়ি অঞ্চল লুংলংপুঞ্জি ও শিলংয়ের চেরাপুঞ্জি। সেখানকার ঝরনা থেকে সারা বছর নদের পানি প্রবহমান থাকে। বৃষ্টিবহুল চেরাপুঞ্জির পাদদেশ থেকে বর্ষায় ঢলের পানির সঙ্গে পাহাড় থেকে পাথরাখা এপারে নেমে আসে। ভেসে আসা এই পাথর উত্তোলিত বা আমদানি করা পাথরের চেয়ে দামি। এটির কদরও বেশি। ব্যবহৃত হয় স্থাপত্য কাজে।

সাদা পাথর পর্যটন সৃষ্টি ও তদারকি সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সালের মার্চ মাস থেকে মধ্য জুলাই পযন্ত মোট ১৩ দফা পাহাড়ি ঢল নেমেছিল। তখন উপজেলা প্রশাসন প্রাথমিকভাবে হিসাব করেছে ঢলের তোড়ে ওপার থেকে পাথরের অন্তত ১৩টি আস্তরণ পড়ে। পাঁচ একর জায়গার ওপরে অন্তত ২০ ফুট পুরু পাথরের স্তর জমে। তখন উপজেলা প্রশাসন লুটপাট ঠেকিয়ে পাথরগুলো সংরক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করে। ২০১৭ সাল থেকে এটি সাদা পাথর পর্যটন এলাকা হিসেবে পরিচিতি পায়।

সাদা পাথর এলাকাটির অবস্থান কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার সীমান্তবর্তী পশ্চিম ইসলামপুর ইউনিয়নে।

২০১৭ সালে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন শাহ মোহাম্মদ জামাল উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘উপজেলা প্রশাসনের চেষ্টায় সেসব পাথর সংরক্ষিত হয়েছিল। তখনকার জেলা প্রশাসক রাহাত আনোয়ার ও ইউএনও আবুল লাইছ নিজ উদ্যোগে পাহারার ব্যবস্থা করেছিলেন। এরপর উপজেলা প্রশাসন সংরক্ষণের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে। সর্বশেষ সুমন আচার্য ইউএনও থাকাকালে সাদা পাথর নিয়ে একটি মহাপরিকল্পনা তৈরি করেন। সেটি বাস্তবায়ন না হওয়ায় এলাকাটি ঝুঁকির মুখে পড়ে। সাদা পাথর যাওয়ার ঘাট হিসেবে পরিচিত ধলাই নদতীরের ভোলাগঞ্জের ১০ নম্বর এলাকা।

সেখানকার স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, পাহাড়ি ঢল নেমে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় পর্যটকরা সাদা পাথরে যাচ্ছেন না। এই সুযোগে চলছে লুটপাট। গত এক সপ্তাহে দিন ও রাতে হাজার খানেক বারকি নৌকা ব্যবহার করে পাথর লুট হয়েছে। অনেকটা মব স্টাইলে হওয়ায় ভয়ে পুলিশ প্রশাসনও ছিল সাক্ষী-গোপালের ভূমিকায়।

সার্বিক পরিস্থিতিতে সমন্বিত পদক্ষেপ ছাড়া পুলিশের পক্ষে একা কিছু করা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন কোম্পানীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) উজায়ের মাহমুদ আদনান।

তিনি বলেন, ‘সাদা পাথর লুটের ঘটনার খবর পেলেই ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে স্পেশাল টাস্কফোর্সের টিম অভিযান চালায়। আমরা পুলিশ দিয়ে সহযোগিতা করছি। এর বাইরে কী আর করার আছে।’

সোমবার বিকেলে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আজিজুন্নাহার বলেন, ‘আমরা ডিসি অফিসে কথা বলছি, আমরা খুব দ্রুত হয়তো বা এই সপ্তাহের মধ্যে আশা করছি আবার ক্রাশারগুলোতে অভিযান চালাব। আগের বার আমরা অনেকটা শক্ত অভিযানে ছিলাম। পরবর্তীতে পরিবহন শ্রমিকরা সড়ক অবরোধ করে একটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। এরপর থেকেই এই লুটপাট হচ্ছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘সোমবারও তারা সাদাপাথরে সাড়ে ৪ ঘণ্টা অভিযান চালিয়েছেন। গত মঙ্গলবার থেকে সোমবার পর্যন্ত মোট ৪ দফা অভিযান চালানো হয়েছে। লুটপাট কেন বন্ধ হচ্ছে না এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মোবাইল কোর্ট তো ২৪ ঘণ্টা চালানো যায় না। তাই বন্ধ করা যাচ্ছে না পাথর চুরি। তবে, তারা এ ব্যাপারে সতর্ক আছেন।’

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) সিলেটের সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট শাহ সাহেদা আখতার জানান, ‘প্রশাসনকে আমি সাদাপাথর রক্ষার্থে ব্যর্থ বলবো না। ব্যর্থ তারা তখনই হতো, যখন চেষ্টা করতো। সাদাপাথর রক্ষার্থে তো তারা কখনো কোনো চেষ্টাই করেনি। প্রশাসনের উদাসীনতাই সাদাপাথরের জন্য কাল হয়েছে। অথচ একবছর আগেও সাদাপাথরে কেউ হাত দেওয়ার সাহস পায়নি।’

পরিবেশ অধিদপ্তর সিলেটের পরিচালক মো. ফেরদৌস আনোয়ার জানান, ‘আসলে সাদাপাথর ইসিএ-ভুক্ত এলাকা না হওয়ায় আমরা সেখানে গিয়ে কোনো আইনি পদক্ষেপ নিতে পারছি না। তবুও আমরা স্থানীয় প্রশাসনকে অভিযানে সহযোগিতা করছি।’

সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ জানান, ‘সাদাপাথর রক্ষার্থে আমরাতো নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছি। কিন্তু কোনোভাবেই বন্ধ হচ্ছে না।’আগে এটি রক্ষা করতে পারলেও এখন কেন পারছেন না প্রশ্ন করলে একই উত্তর দেন যে, ‘আমরা নিয়মিত অভিযান দিচ্ছি।’

সাদাপাথরে গতকাল জেলা প্রশাসনের ম্যাজিস্ট্রেট অভিযান চালিয়েছেন বলে জানান তিনি।

বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (পর্যটন) ফাতেমা রহিম বীনার সাথে যোগাযোগ করলে তিনি তথ্য অধিকারে আবেদন করে তার বক্তব্য নিতে বলেন।

এদিকে,সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপি’র সভাপতি সাহাব উদ্দিনের সকল পদ স্থগিত করা হয়েছে। তার স্থলে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপি’র সহ-সভাপতি হাজী আব্দুল মান্নানকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে মনোনীত করা হয়েছে। সোমবার (১১ আগস্ট) বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভীর স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে পদ স্থগিতের এ তথ্য জানানো হয়।

লুট ঠেকাতে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার খান মো. রেজা-উন-নবী। তিনি বলেন, ‘সাদা পাথর পর্যটন স্পট খুঁড়ে পাথর উত্তোলনের ভিডিওটি আমি দেখেছি। পর্যটন স্পটে এ ধরনের কাজ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। একটি টিম সেখানে পাঠিয়েছি পরিদর্শনের জন্য। অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন বন্ধে আমরা পুলিশ, বিজিবির সমন্বয়ে অভিযান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’

এদিকে,সাদা পাথরে ব্যাপক লুটপাটের ঘটনায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। একজন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে প্রধান করে এই কমিটি গঠন করা হয়।

বুধবার এই তথ্য নিশ্চিত করে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ জানানম মঙ্গলবার এ কমিটি গঠন করা হয়।

জেলা প্রশাসক বলেন, ‘লুটপাটের ঘটনাটি অত্যন্ত দুঃখজনক। সাদা পাথরে কী হচ্ছে, কেন হচ্ছে এটি তদন্তের জন্যে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে কমিটিকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।‘

জেলা প্রশাসক আরও বলেন, বিষয়টি পর্যালোচনার জন্য আজ একটা সভা আয়োজন করা হয়। সভায় বিস্তারিত আলোচনা করা হয়। এছাড়া আমাদের অভিযান তো চলমান আছে। আগামীতেও চলবে।

Please Share This Post in Your Social Media

লাগামহীন লুটপাটে ‘পাথরহীন’ সিলেটের সাদাপাথর

মো.মুহিবুর রহমান, সিলেট
Update Time : ০৪:২২:৪৪ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৩ অগাস্ট ২০২৫

একসময় রাতের আধাঁরে চুরি হলেও এখন দিনদুপুরে পাথর লুট হচ্ছে সিলেটের সাদাপাথরসহ জাফলং এলাকায়। এ কারণে বিলীনের পথে সিলেটের সাদাপাথর ও জাফলং এর পাথর। সাদাপাথর পর্যটনকেন্দ্রের কাছাকাছি তিনটি বিজিবি ক্যাম্প ও একটি থানা থাকলেও লুট ঠেকাতে কি ভূমিকা রাখতে পারছে না?

পরিবেশবাদীসহ সংশ্লিষ্ট অনেকের মন্তব্য, সাদাপাথর লুট ঠেকাতে প্রশাসন কি ব্যর্থ? লাগামহীন লুটপাটে প্রায় পাথরহীন হয়ে পড়েছে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার পর্যটন এলাকা সাদাপাথর। সম্প্রতি পাহাড়ি ঢলের সাথে ধলাই নদের উৎসমুখ সাদাপাথরে বিপুল পরিমাণ পাথর আসে। প্রকাশ্যেই সেই সব পাথর নৌকা করে নিয়ে লুট করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। প্রতিদিন শত শত নৌকা দিয়ে লুটের পাথর পরিবহন করা হচ্ছে। নদী তীরের বালিও মাটি খুঁড়েও চলছে লুট। ব্যাপক লুটপাটের কারণে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত এ এলাকাটি একেবারে বিরাণভূমিতে পরিণত হয়েছে। প্রশাসনের সামনেই দিনদুপুরে চলছে লুটপাট। সকাল থেকে সাদা পাথর এলাকায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) ফাঁড়ি এলাকা মাড়িয়ে জিরো পয়েন্ট দিয়ে পাথর লুট হচ্ছে।

জানা গেছে, গত দুই সপ্তাহে সাদা পাথর এলাকায় কয়েক দফা পাহাড়ি ঢল নামে। প্রতিবারই ঢলের তোড়ে স্তরে স্তরে পাথর ও বালু নামে। এবার দফায় দফায় ঢলের পর শুধু বালু দেখা গেছে। বালুর স্তর সরিয়ে পাথর লুটপাট হয়েছে।

স্থানীয় লোকজন বলছেন, দুই সপ্তাহে অন্তত শতকোটি টাকার পাথর লুট হয়েছে। সাদা পাথর প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট একটি পর্যটনকেন্দ্র। ২০১৭ সালে পাহাড়ি ঢলে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জ পাথর মহালের ধলাই নদের উৎসমুখে পাঁচ একর জায়গাজুড়ে জমা হয় পাথর। ঢলের তোড়ে সেখানে সর্বশেষ ১৯৯০ সালে একবার পাথর জমা হয়েছিল। সেসব পাথরকে ‘ধলাসোনা’ বলে অভিহিত করা হয়। তবে পাহাড়ি ঢলের পর লুটপাটে সেসব পাথর নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। ২৭ বছরের মাথায় ফের পাথর জমা হওয়ায় উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের পাহারায় সংরক্ষিত হয়। ওই বছর থেকে পুরো এলাকাটি প্রাকৃতিক পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি পায়। সাদা পাথর এলাকার ওপারে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পাহাড়ি অঞ্চল লুংলংপুঞ্জি ও শিলংয়ের চেরাপুঞ্জি। সেখানকার ঝরনা থেকে সারা বছর নদের পানি প্রবহমান থাকে। বৃষ্টিবহুল চেরাপুঞ্জির পাদদেশ থেকে বর্ষায় ঢলের পানির সঙ্গে পাহাড় থেকে পাথরাখা এপারে নেমে আসে। ভেসে আসা এই পাথর উত্তোলিত বা আমদানি করা পাথরের চেয়ে দামি। এটির কদরও বেশি। ব্যবহৃত হয় স্থাপত্য কাজে।

সাদা পাথর পর্যটন সৃষ্টি ও তদারকি সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সালের মার্চ মাস থেকে মধ্য জুলাই পযন্ত মোট ১৩ দফা পাহাড়ি ঢল নেমেছিল। তখন উপজেলা প্রশাসন প্রাথমিকভাবে হিসাব করেছে ঢলের তোড়ে ওপার থেকে পাথরের অন্তত ১৩টি আস্তরণ পড়ে। পাঁচ একর জায়গার ওপরে অন্তত ২০ ফুট পুরু পাথরের স্তর জমে। তখন উপজেলা প্রশাসন লুটপাট ঠেকিয়ে পাথরগুলো সংরক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করে। ২০১৭ সাল থেকে এটি সাদা পাথর পর্যটন এলাকা হিসেবে পরিচিতি পায়।

সাদা পাথর এলাকাটির অবস্থান কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার সীমান্তবর্তী পশ্চিম ইসলামপুর ইউনিয়নে।

২০১৭ সালে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন শাহ মোহাম্মদ জামাল উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘উপজেলা প্রশাসনের চেষ্টায় সেসব পাথর সংরক্ষিত হয়েছিল। তখনকার জেলা প্রশাসক রাহাত আনোয়ার ও ইউএনও আবুল লাইছ নিজ উদ্যোগে পাহারার ব্যবস্থা করেছিলেন। এরপর উপজেলা প্রশাসন সংরক্ষণের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে। সর্বশেষ সুমন আচার্য ইউএনও থাকাকালে সাদা পাথর নিয়ে একটি মহাপরিকল্পনা তৈরি করেন। সেটি বাস্তবায়ন না হওয়ায় এলাকাটি ঝুঁকির মুখে পড়ে। সাদা পাথর যাওয়ার ঘাট হিসেবে পরিচিত ধলাই নদতীরের ভোলাগঞ্জের ১০ নম্বর এলাকা।

সেখানকার স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, পাহাড়ি ঢল নেমে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় পর্যটকরা সাদা পাথরে যাচ্ছেন না। এই সুযোগে চলছে লুটপাট। গত এক সপ্তাহে দিন ও রাতে হাজার খানেক বারকি নৌকা ব্যবহার করে পাথর লুট হয়েছে। অনেকটা মব স্টাইলে হওয়ায় ভয়ে পুলিশ প্রশাসনও ছিল সাক্ষী-গোপালের ভূমিকায়।

সার্বিক পরিস্থিতিতে সমন্বিত পদক্ষেপ ছাড়া পুলিশের পক্ষে একা কিছু করা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন কোম্পানীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) উজায়ের মাহমুদ আদনান।

তিনি বলেন, ‘সাদা পাথর লুটের ঘটনার খবর পেলেই ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে স্পেশাল টাস্কফোর্সের টিম অভিযান চালায়। আমরা পুলিশ দিয়ে সহযোগিতা করছি। এর বাইরে কী আর করার আছে।’

সোমবার বিকেলে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আজিজুন্নাহার বলেন, ‘আমরা ডিসি অফিসে কথা বলছি, আমরা খুব দ্রুত হয়তো বা এই সপ্তাহের মধ্যে আশা করছি আবার ক্রাশারগুলোতে অভিযান চালাব। আগের বার আমরা অনেকটা শক্ত অভিযানে ছিলাম। পরবর্তীতে পরিবহন শ্রমিকরা সড়ক অবরোধ করে একটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। এরপর থেকেই এই লুটপাট হচ্ছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘সোমবারও তারা সাদাপাথরে সাড়ে ৪ ঘণ্টা অভিযান চালিয়েছেন। গত মঙ্গলবার থেকে সোমবার পর্যন্ত মোট ৪ দফা অভিযান চালানো হয়েছে। লুটপাট কেন বন্ধ হচ্ছে না এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মোবাইল কোর্ট তো ২৪ ঘণ্টা চালানো যায় না। তাই বন্ধ করা যাচ্ছে না পাথর চুরি। তবে, তারা এ ব্যাপারে সতর্ক আছেন।’

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) সিলেটের সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট শাহ সাহেদা আখতার জানান, ‘প্রশাসনকে আমি সাদাপাথর রক্ষার্থে ব্যর্থ বলবো না। ব্যর্থ তারা তখনই হতো, যখন চেষ্টা করতো। সাদাপাথর রক্ষার্থে তো তারা কখনো কোনো চেষ্টাই করেনি। প্রশাসনের উদাসীনতাই সাদাপাথরের জন্য কাল হয়েছে। অথচ একবছর আগেও সাদাপাথরে কেউ হাত দেওয়ার সাহস পায়নি।’

পরিবেশ অধিদপ্তর সিলেটের পরিচালক মো. ফেরদৌস আনোয়ার জানান, ‘আসলে সাদাপাথর ইসিএ-ভুক্ত এলাকা না হওয়ায় আমরা সেখানে গিয়ে কোনো আইনি পদক্ষেপ নিতে পারছি না। তবুও আমরা স্থানীয় প্রশাসনকে অভিযানে সহযোগিতা করছি।’

সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ জানান, ‘সাদাপাথর রক্ষার্থে আমরাতো নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছি। কিন্তু কোনোভাবেই বন্ধ হচ্ছে না।’আগে এটি রক্ষা করতে পারলেও এখন কেন পারছেন না প্রশ্ন করলে একই উত্তর দেন যে, ‘আমরা নিয়মিত অভিযান দিচ্ছি।’

সাদাপাথরে গতকাল জেলা প্রশাসনের ম্যাজিস্ট্রেট অভিযান চালিয়েছেন বলে জানান তিনি।

বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (পর্যটন) ফাতেমা রহিম বীনার সাথে যোগাযোগ করলে তিনি তথ্য অধিকারে আবেদন করে তার বক্তব্য নিতে বলেন।

এদিকে,সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপি’র সভাপতি সাহাব উদ্দিনের সকল পদ স্থগিত করা হয়েছে। তার স্থলে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপি’র সহ-সভাপতি হাজী আব্দুল মান্নানকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে মনোনীত করা হয়েছে। সোমবার (১১ আগস্ট) বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভীর স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে পদ স্থগিতের এ তথ্য জানানো হয়।

লুট ঠেকাতে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার খান মো. রেজা-উন-নবী। তিনি বলেন, ‘সাদা পাথর পর্যটন স্পট খুঁড়ে পাথর উত্তোলনের ভিডিওটি আমি দেখেছি। পর্যটন স্পটে এ ধরনের কাজ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। একটি টিম সেখানে পাঠিয়েছি পরিদর্শনের জন্য। অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন বন্ধে আমরা পুলিশ, বিজিবির সমন্বয়ে অভিযান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’

এদিকে,সাদা পাথরে ব্যাপক লুটপাটের ঘটনায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। একজন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে প্রধান করে এই কমিটি গঠন করা হয়।

বুধবার এই তথ্য নিশ্চিত করে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ জানানম মঙ্গলবার এ কমিটি গঠন করা হয়।

জেলা প্রশাসক বলেন, ‘লুটপাটের ঘটনাটি অত্যন্ত দুঃখজনক। সাদা পাথরে কী হচ্ছে, কেন হচ্ছে এটি তদন্তের জন্যে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে কমিটিকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।‘

জেলা প্রশাসক আরও বলেন, বিষয়টি পর্যালোচনার জন্য আজ একটা সভা আয়োজন করা হয়। সভায় বিস্তারিত আলোচনা করা হয়। এছাড়া আমাদের অভিযান তো চলমান আছে। আগামীতেও চলবে।