কুবিতে বর্ণাঢ্য আয়োজনে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উদযাপন

- Update Time : ০৪:১৭:৫২ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৫ অগাস্ট ২০২৫
- / ৪১ Time View
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুবি) বর্ণাঢ্য আয়োজনে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের প্রথম বর্ষপূর্তি উদযাপিত হয়েছে। এসময় গণঅভ্যুত্থানে আহত শিক্ষার্থীদের সম্মাননা প্রদান করা হয়।
৫ আগস্ট (মঙ্গলবার) ইংরেজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক তারিন বিনতে এনাম এবং গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের প্রভাষক মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মামুন চৌধুরীর সঞ্চালনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তমঞ্চে এই অনুষ্ঠান হয়েছে। অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মাসুদা কামাল।
সকাল ১০ টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের গোল চত্ত্বর থেকে র্যালি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক প্রদক্ষিণ করে মুক্তমঞ্চে এসে শেষ হয়। এরপর ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে কেক কাটা হয়।
তারপর এগারোটার দিকে জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে শুরু হয় আলোচনা সভা। আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোঃ হায়দার আলী। এছাড়া, বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলের বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সোলায়মান, রেজিস্ট্রার (অতিরিক্ত দায়িত্ব) অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন এবং প্রক্টর অধ্যাপক ড. মোঃ আব্দুল হাকিম।
আলোচনা সভার শুরুতে জুলাই যোদ্ধাদের বক্তব্য প্রদান করেন। এসময় তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সংকট নিরসন এবং আওয়ামী লীগ ও নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের বিচারের দাবি জানান।
বিশেষ অতিথির বক্তবে প্রক্টর অধ্যাপক ড. মোঃ আব্দুল হাকিম বলেন, ‘৫ আগস্টের পরে যে পরিবর্তনের কথা বলা হচ্ছে পরিবর্তনটা আসলে কোথায়? এখনও পাসপোর্ট অফিস বা রেজিস্ট্রি অফিসে গেলে ঘুষ দিতে হয়। ৫ আগস্টের আন্দোলনের মূল প্রতিপাদ্য ছিল—সমাজ ও রাষ্ট্রে বৈষম্য থাকবে না। কিন্তু বাস্তবতায় কি বৈষম্য বিলীন হয়েছে? আসলে রাষ্ট্র থেকে বৈষম্য উঠে যায়নি, শুধু এর পদ্ধতি বদলেছে। চাঁদাবাজি এখনো শেষ হয়নি, শুধু ধরণটা পাল্টেছে।’
রেজিস্ট্রার (অতিরিক্ত দায়িত্ব) অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘আজকের জুলাই বিপ্লব একদিনে সংগঠিত হয়নি। এটি গত ১৭ বছরের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। যারা এই বিপ্লবে আত্মহুতি দিয়েছে তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি আর যারা আহত হয়েছে তাদের সুস্থতা কামনা করছি। তাদের কারণেই আজকের এই দিনটা আমরা পেয়েছি। তারা বৈষম্য ও দুর্নীতি দূর করার জন্য, ন্যায়ের পক্ষে থাকার জন্য তাদের জীবনের আত্মহুতি দিয়েছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমরা তাদের আত্মত্যাগ ভুলে গিয়েছি। আমাদের উচিত যার যার জায়গা থেকে আমাদের এই বাংলাদেশেকে দুর্নীতিমুক্ত ও বৈষম্যহীন করতে সোচ্চার হওয়া।’
কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সোলায়মান বলেন, ‘৫ আগস্টের আগে ও পরে মত প্রকাশের স্বাধীনতার যে পার্থক্য, তা রক্ত দিয়ে অর্জিত। তাই আমাদের ‘জুলাই’কে ধারণ করতে হবে। বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়তে নিজেকে পরিবর্তন করতে হবে এবং নিজের আদর্শ সমাজ ছড়িয়ে দিতে হবে, যেমনটি আবু সাঈদ করেছিলেন। যদি আমরা চেতনায় বিচ্যুত হই বা দলীয় প্রভাবে পরিচালিত হই, তবে সেই বিচ্যুতির জন্য আমরাই দায়ী থাকবো।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন ফ্যাসিবাদ আগে কখনও জন্ম নেয়নি। যদি সেই স্বৈরাচার পলায়ন করতে বাধ্য হয়, তবে আমরাই বা কতদিন টিকে থাকবো? আমি চাই, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় স্বগৌরবে এগিয়ে যাক। তবে আমাদের স্বাদ থাকলেও সাধ্যের সীমাবদ্ধতা রয়েছে, যা কেবল একটি বক্তৃতায় নয়–বরং ধারাবাহিক পরিবর্তনের মাধ্যমেই সম্ভব।’
প্রধান অতিথির বক্তব্যে উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোঃ হায়দার আলী বলেন, ‘স্বৈরাচারের মাথাটা পালিয়ে গেছে, বডিটা এখনো আছে। এই বডির যন্ত্রণা প্রতি পদে পদে ভোগ করতে হচ্ছে আমাদের। মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতি একটুও কমে নাই। প্রতি টেবিলে যে খরচ করতে হতো, সেই খরচ না করলে এখানো আটকে যেতে হচ্ছে। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ও এর ব্যতিক্রম নয়। এখানেও রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি আছে, গোপনে দুর্নীতি হচ্ছে। আমরা বুঝতে পারছি কিন্তু ধরতে পারছি না।’
তিনি আরও বলোন, ‘শিক্ষক একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের কালচারকে পরিবর্তন করতে পারে, শিক্ষক একটা বিশ্ববিদ্যালয়কে ভালো মানের বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করতে পারে। ০৫ আগস্টের পর কিছু অর্জন করতে না পারলেও এইটুকু তো অর্জন করতে পেরেছি যে দাঁড়িয়ে বুক উঁচু করে কথা বলতে পেরেছি। ৫ আগস্ট বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি ঐতিহাসিক দিন, যেদিন জনগণের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে স্বৈরশাসকের পতন ঘটে। ৫ আগস্টের চেতনা ধরে রেখে দুর্বলরাও যে পরিবর্তন আনতে পারে, তা প্রমাণ করবে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।’
অনুষ্ঠানের সভাপতি ও উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড.মাসুদা কামাল বলেন, ‘আজকের দিনটি ৩৬ই জুলাই বা ৫ই আগস্ট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই দিনে ১৬ বছর ধরে চলা একনায়কতান্ত্রিক শাসনের পতন ঘটে। যাঁরা এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে আত্মত্যাগ করেছেন তাদের প্রতি আমি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি এবং তাঁদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। যারা আহত হয়েছেন ও পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন তাঁদের প্রতিও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। এছাড়াও আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী সবাইকে জানাই সম্মান ও অভিনন্দন। বিশেষভাবে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের প্রতি, যাঁরা এই আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। জুলাই বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে বৈষম্যহীনতা প্রতিষ্ঠা, যার মাধ্যমে একটি শোষণমুক্ত সমাজ গড়ে তোলাই ছিল মূল উদ্দেশ্য। আমরা ছিলাম শোষণের জাতাকলে পিষ্ট।’
আলোচনা সভা শেষে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের জুলাই আহতদের সম্মাননা প্রদান করা হয়। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবাদী সংগঠন অভয়ারণ্যের উদ্যোগে এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সহযোগিতায় ৩৬টি বৃক্ষরোপণ কর্মসূচির উদ্ভোদন করা হয়। সর্বশেষ জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ৫৬টি আলোকচিত্র প্রদর্শনীর মাধ্যমে অনুষ্ঠান শেষ হয়।
উল্লেখ্য, বিকাল পাঁচটায় গণঅভ্যুত্থানের প্রথম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে প্রশাসন।