শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদ গ্রেপ্তার

- Update Time : ০৫:২১:১২ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৭ মে ২০২৫
- / ১৯৭ Time View
ঢাকার অপরাধজগতের ত্রাস, শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইনকে আটক করেছে সেনাবাহিনী। কুষ্টিয়া শহরের কালীশংকরপুর এলাকায় তিন ঘণ্টার এক শ্বাসরুদ্ধকর অভিযানে সহযোগীসহ সুব্রত বাইনকে গ্রেপ্তার করেছে সেনাবাহিনী।
মঙ্গলবার দুপুরে তাদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়। অভিযানে মোল্লা মাসুদ নামে আরেকজন সন্ত্রাসী গ্রেপ্তার রয়েছে।
আজ মঙ্গলবার সকালে কুষ্টিয়া শহরের কালিশংকরপুর এলাকায় তিন ঘণ্টার এক শ্বাসরুদ্ধকর অভিযানে সহযোগীসহ তাঁকে আটক করা হয়।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি সূত্র এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে। সূত্রটি বলছে, আজ বিকেল ৫টার দিকে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানানো হবে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, সেনাবাহিনীর অভিযানে দুজন আটক হয়েছেন। এর মধ্যে একজন সুব্রত বাইন। যদিও কুষ্টিয়া ক্যাম্পের দায়িত্বশীল কোনো কর্মকর্তা বিষয়টি নিশ্চিত করেননি।
ঢাকা থেকে যাওয়া সেনাবাহিনীর একটি দল কুষ্টিয়া শহরের কালিশংকরপুর এলাকার একটি বাড়িতে অভিযান চালায়। আজ সকাল ১০টার দিকে পৌর ৫ নম্বর ওয়ার্ডের কালিশংকরপুর সোনার বাংলা মসজিদ সড়কে গিয়ে দেখা যায়, মীর মহিউদ্দিনের মালিকানাধীন তিনতলা ভবনের সামনে এলাকাবাসীর ভিড়। সবার মধ্যে চাপা গুঞ্জন চলছে। গণমাধ্যমকর্মীদের দেখে অনেকেই স্থান ত্যাগ করেন। যাঁরা দাঁড়িয়ে ছিলেন, তাঁরাও সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি।
সেখানে রবিউল ইসলাম নামের এক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, ফজরের নামাজের সময় তিনি রাস্তায় সেনাবাহিনীর চারটি গাড়ি দেখতে পান। মীর মহিউদ্দিনের বাড়ি ঘিরে সেনাবাহিনীর সদস্যরা দাঁড়িয়ে ছিলেন। জানতে চাইলে তাঁরা জানান, ছাত্রদের মেসে অভিযান চলছে। এরপর ওই বাড়ি থেকে দুজনকে নিয়ে যায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
কালিশংকরপুর এলাকার স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, প্রায় দেড় মাস আগে কালিশংকরপুর সোনার বাংলা সড়ক এলাকার মৃত মীর মহিউদ্দিনের তিনতলা বাড়ির নিচতলায় ভাড়া থাকতেন দুই ব্যক্তি। স্থানীয় এক যুবক তাঁদের বাড়ি ভাড়া নিতে সহযোগিতা করেন। নিচতলা ভাড়া নেওয়ার পর থেকে স্থানীয় বাসিন্দারা দরজা-জানালা খুলতে দেখেননি। ভবনের দ্বিতীয় তলায় ছাত্রাবাস। আজ ভোরের দিকে বাড়ির তালা ভাঙার শব্দ পেয়ে আশপাশের লোকজন ছুটে আসেন। তাঁরা দেখতে পান, সেনাবাহিনীর সদস্যরা বাড়িটি ঘিরে অভিযান চালাচ্ছেন। কিছুক্ষণ পর দুজনকে আটক করে সেনাবাহিনীর গাড়িতে তোলা হয়। পরে স্থানীয় বাসিন্দারা জানতে পারেন, এই বাড়িতেই ভাড়া থাকতেন শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন ও তাঁর সহযোগীরা। এরপর থেকে এলাকাবাসীর মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে।

ছাত্রাবাসে থাকা ইমন নামের এক শিক্ষার্থী জানান, ভোরের দিকে সেনাবাহিনীর সদস্যরা ছাত্রাবাসে এসে সবাইকে এক জায়গায় জড়ো করেন। একটি কক্ষের ভেতর ১৮ জনকে রেখে বলা হয়, অভিযান চলছে। এরপর নিচতলা থেকে দুজনকে নিয়ে যায়।
তবে এ বিষয়ে জানে না স্থানীয় থানা-পুলিশ। জানতে চাইলে কুষ্টিয়া মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘বিষয়টি আমিও শুনেছি। তবে গ্রেপ্তারের ব্যাপারে এখন পর্যন্ত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। সেনাবাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা এ ব্যাপারে কথা বলেননি।’
কুষ্টিয়া জেলা পুলিশের মুখপাত্র ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অর্থ) ফয়সাল মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেন, এখানে আমাদের কোনো অভিযান ছিল না। অন্য কোনো বাহিনী করেছে কি না, জানি না। জানার চেষ্টা করছি।
শহরের বাসিন্দারা জানান, আজ ভোর ৫টা থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত কালীশংকরপুর এলাকার সোনার বাংলা মসজিদের পাশের একটি তিনতলা বাড়ি ঘিরেন রাখে সেনাবাহিনীর সদস্যরা। সেনাবাহিনীর কমপক্ষে পাঁচটি গাড়ি অভিযানে অংশ নেয় এবং বাড়ির নিচতলা ও আশপাশের এলাকায় দীর্ঘ সময় ধরে তল্লাশি চালানো হয়। অভিযান চালানো বাড়িটি স্থানীয় মীর মহিউদ্দিনের মালিকানাধীন। বাড়ির দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা মেস হিসেবে থাকেন।
সেই মেসের কয়েকজন শিক্ষার্থী বলেন, কয়েক দিন ধরে নিচতলায় এক দাড়িওয়ালা অপরিচিত ব্যক্তিকে থাকতে দেখা যাচ্ছিল। তিনি দিনে একবার শুধু খাওয়ার সময় বাইরে বের হতেন। অভিযানের সময় সেনাসদস্যরা শিক্ষার্থীদের নির্দিষ্ট দুটি কক্ষে বসিয়ে রাখেন এবং বারবার বলেন, ‘তোমাদের কোনো ভয় নেই।’
এক শিক্ষার্থী বলেন, সকাল ৮টার দিকে একটি কালো মাইক্রোবাস আসে। তখন সেনাসদস্যরা একজন দাড়িওয়ালা ব্যক্তিকে হাতকড়া পরিয়ে এবং অন্য এক যুবককে হাত বেঁধে গাড়িতে তোলেন।
অভিযান শেষে একজন সেনা কর্মকর্তা শিক্ষার্থীদের বলেন, এখন বললে ভয় পাবে। পরে মিডিয়ার মাধ্যমে সব জানতে পারবে।
ঘটনাস্থলের পাশের বাসিন্দা রবিউল আলম বলেন, সকালবেলা দেখি সেনাবাহিনীর গাড়ি। পরে দেখি দুজনকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। আরেকজন জানান, জানালা দিয়ে দেখতে পান ভেতরে তল্লাশি চলছে এবং কিছুক্ষণ পর সেনাবাহিনীর সদস্যরা দুজনকে নিয়ে চলে যান। এদের একজনের মুখে দাড়ি আছে।
সরকারি একটি দায়িত্বশীল সূত্র বলেছে, সুব্রত বাইনকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের পর ঢাকায় নেওয়া হবে। এরপর সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে বিস্তারিত জানানো হবে।
সুব্রত বাইনকে আটকের বিষয়টি প্রশাসনে ব্যাপক গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের ধারণা, রাজধানীতে সাম্প্রতিক যেসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটেছে, তার পেছনে পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসীদের হাত রয়েছে।
একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ভারতে আশ্রয় দেওয়া কয়েকজন বাংলাদেশি সন্ত্রাসীকে ছেড়ে দেয়। তারা এখন দেশে ফিরে এসে জোটবদ্ধ হয়ে রাজধানীসহ বিভিন্ন জায়গায় নৈরাজ্য চালাচ্ছে। এদের অনুগত চক্র রাজধানীতে চাঁদাবাজি, ছিনতাইসহ নানা অপরাধে যুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার করা হলে এসব অপরাধ কমে আসবে, বলেন ওই কর্মকর্তা।
পুলিশের তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইনের পরিবার আগে থাকত রাজধানীর মগবাজারে। পরে তারা গাজীপুরের পুবাইল হারবাইদ নয়াপাড়ায় পাঁচ কাঠা জমি কিনে বাড়ি করেন। এখন সেখানেই থাকেন সুব্রত বাইনের বাবা বিপুল বাইন ও মা কুমুলিনি বাইন। এক ভাই তিন বোনের মধ্যে সুব্রত সবার বড়। তিন বোন মেরি বাইন, চেরি সুপর্ণা বাইন ও সুপ্রভা পরির বিয়ে হয়েছে। চেরি ঢাকার এক হাসপাতালে আর পরি একটি ক্রিশ্চিয়ান সংস্থায় কাজ করেন।
কলকাতায় আত্মগোপনে থাকার সময় ২০১৪ সালে চিকিৎসার জন্য সুব্রত বাইনের মা ও বাবা কলকাতায় গিয়েছিলেন। সে সময় সুব্রত বাইনের সঙ্গে তাঁদের দেখা হয়। তখন সুব্রত তাঁদের জানিয়েছিলেন তিনি ভারতের নাগরিক সনদ পেয়েছেন। সুব্রত বাইন তিনটি বিয়ে করেন। তাঁর চারটি সন্তান আছে।
পরিবারের সদস্যরা তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগও রাখেন। সুব্রতর প্রথম স্ত্রী লুসির দুই সন্তান রিতু (২৮) ও রিপন (২৬) ঢাকায় থাকে। দ্বিতীয় স্ত্রী বিউটির সন্তান ছোটন মায়ের সঙ্গে থাকে। কলকাতায় তাঁর তৃতীয় স্ত্রী জমিলার সঙ্গে থাকে একমাত্র মেয়ে। তাঁরা স্বীকার করেছেন, ঢাকার মতো গাজীপুরেও সুব্রত বাইনের একটি সন্ত্রাসী বাহিনী ছিল। তারা বিভিন্ন কারখানা ও মার্কেট থেকে চাঁদা আদায় করত। তারা প্রয়োজনমতো সুব্রত বাইনের মাকেও ব্যবহার করত। একবার একটি চাঁদাবাজির ঘটনায় তাঁকে নিয়ে যান সন্ত্রাসীরা। সুব্রত বাইন সেটা জানার পর মাকে বারণ করে দেন।
উল্লেখ্য, শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইনকে ধরতে ইন্টারপোলের রেড নোটিশ জারি রয়েছে। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে তাঁকে ধরিয়ে দিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পুরস্কার ঘোষণা করেছিল। পুরস্কার ঘোষিত ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর অন্যতম ছিলেন সুব্রত বাইন।