কবজি কেটে উল্লাসের ভিডিও টিকটকে দিতো ‘কবজি কাটা গ্রুপ’

- Update Time : ০৬:০৩:৪১ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৮ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
- / ৪৪ Time View
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের আলোচিত সন্ত্রাসী কবজি কাটা গ্রুপের প্রধান মো. আনোয়ার ওরফে শুটার আনোয়ার ওরফে কবজি কাটা আনোয়ারকে (৩৬) গ্রেফতার করেছে র্যাব।
র্যাব বলছে, মোহাম্মদপুর, আদাবর ও রায়েরবাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় মাদক, ছিনতাই ও চাঁদাবাজির রাজত্ব গড়ে তোলে কবজি কাটা গ্রুপ। এই রাজত্ব গড়তে গিয়ে আনোয়ার সাতজনের কবজি কাটাসহ বহু মানুষকে কুপিয়ে আহত ও পঙ্গু করেছে। শুধু কবজি কেটেই ক্ষান্ত হয়নি আনোয়ার গ্রুপ, কবজি কেটে টিকটকে ভিডিও করে উল্লাস করতেন আনোয়ার ও তার গ্রুপের সদস্যরা।
মঙ্গলবার (১৮ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান র্যাব-২ এর অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি খালিদুল হক হাওলাদার।
তিনি বলেন, র্যাবের হাতে গ্রেফতারের পর আনোয়ার স্বীকার করেছে তিনজনের কবজি কেটেছে। কিন্তু র্যাবের তদন্তে বেরিয়ে আসে আনোয়ার সাতজনের কবজি কেটেছে। টার্গেট ব্যক্তির ওপর হামলা ও ছিনতাইয়ের সময়ে আনোয়ারের স্টাইল হলো, যে ব্যক্তির ওপর হামলা করা হবে তার আশপাশের রাস্তায় কৃত্রিম যানজট সৃষ্টি করে। এরপর তারা যানজট কমাতে সহযোগিতা করার নামে কৃত্রিম ব্লক সৃষ্টি করে। পরে আনোয়ার এসে টার্গেট ব্যক্তির ওপর হামলা করে। পাশাপাশি সে আসার আগে সামনে ও পেছনে একাধিক টিম থাকে।
এক প্রশ্নের জবাবে র্যাব-২ এর অধিনায়ক বলেন, গত ৫ আগস্টের পর যৌথবাহিনীর অভিযানে পাঁচ শতাধিক ছিনতাইকারী গ্রেফতার করেছি। মোহাম্মদপুরে অপরাধের সংখ্যা শূন্যে নামিয়ে আনা হবে।
মোহাম্মদপুরে আগে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় অপরাধ হতো। কিন্তু পরিবর্তিত সময়ে এসে কারা অপরাধীদের মদত দিচ্ছে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আপনারা জানেন ৫ আগস্টের পর একটি রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হয়। এই পরিবর্তনের জেরে সন্ত্রাসীরা তৎপর হয়ে ওঠে। ৫ আগস্টের পর মোহাম্মদপুরে যে পরিমাণ অপরাধ বেড়েছিল, যৌথভাবে অভিযান করে জেনেভা ক্যাম্পসহ মোহাম্মদপুরের এ অপরাধ নিয়ন্ত্রণে কাজ করছি। মোহাম্মদপুর ও আদাবরকেন্দ্রিক কোনো সন্ত্রাসী ও গডফাদারের স্থান হবে না।
আনোয়ারের মদতদাতাদের বিষয় জানতে চাইলে র্যাব-২ এর অধিনায়ক বলেন, আনোয়ারের পেছনে দীর্ঘদিন লেগে ছিলাম। আমাদের কাছে তথ্য আসে, মোহাম্মদপুরের এক্সেল বাবু নামে এক ব্যক্তি তাকে মদত দিচ্ছে। সে আড়ালে থেকে আনোয়ারকে ছত্রছায়া দেয়।
কবজি কাটা আনোয়ার ছাড়াও গ্রেফতার করা হয় তার দুই সহযোগী মো. ইমন (২০) এবং মো. ফরিদকে (২৭)। তাদের আদাবর থেকে গ্রেফতার করা হয়।
এ সময় তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়- দেশীয় অস্ত্র সামুরাই একটি, ছুরি দুটি, গাঁজা ৮ কেজি, একটি প্রাইভেটকার ও একটি হাতঘড়ি।
কে এই কবজি কাটা আনোয়ার
র্যাব-২ এর অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি খালিদুল হক হাওলাদার বলেন, গ্রেফতার আনোয়ার ওরফে কবজি কাটা আনোয়ার ২০০৫ সালে জীবিকার সন্ধানে বাগেরহাট জেলা থেকে ঢাকায় তার বাবার কাছে চলে আসে। ঢাকায় এসে বিশুদ্ধ খাবার পানি পরিবহন করতো সে। প্রথম পর্যায়ে আনোয়ার অপরাধ জগতে ছিনতাই ও বাসস্ট্যান্ডে চাঁদাবাজি শুরু করলেও ২০২৪ সালে মানুষের কবজি কেটে ভিডিও করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়ে নিজেকে কবজি কাটা গ্রুপের প্রধান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে এবং কবজি কাটার ভিডিওটি টিকটক ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে।
আত্মগোপনে থেকে কবজি কাটা গ্রুপ নামে দুর্ধর্ষ বাহিনী গড়ে তোলে আনোয়ার
কবজি কাটা ভিডিও টিকটকে ছড়িয়ে পড়লে আনোয়ার ও তার সহযোগীদের কুখ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। পরে বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরে এলে ধারাবাহিক অভিযানের মুখে বাহিনীর অন্যতম সদস্য ভাগনে বিল্লালসহ আরও অনেকে গ্রেফতার হয়। এরপর আনোয়ার নিজের আগের লেবাস পরিবর্তন করে আত্মগোপনে থেকে কবজি কাটা গ্রুপের নামে দুর্ধর্ষ এক বাহিনী গড়ে তোলে।
যেসব এলাকায় কবজি কাটা গ্রুপের আধিপত্য
মোহাম্মদপুরের ঢাকা উদ্যান, চাঁদ উদ্যান, নবীনগর হাউজিং, চন্দ্রিমা হাউজিং ও আদাবরের শ্যামলী হাউজিং, শেখেরটেক, নবোদয় হাউজিং এলাকায় হত্যা, অস্ত্র-গুলি, মাদক কেনাবেচা, চাঁদাবাজি ও ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ে কবজি কাটা আনোয়ার গ্রুপ বাহিনী।
ছিনতাই-চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্মে জড়িত তারা
র্যাব-২ এর অধিনায়ক আরও বলেন, কবজি কাটা আনোয়ার গ্রুপ নিজের শক্তি বৃদ্ধি এবং আধিপত্য বজায় রাখার জন্য এলাকার কিশোরদের মাদক, অস্ত্র ও অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে ছিনতাই, চাঁদাবাজিসহ নানান অপকর্মে তাদের ব্যবহার করে। অপরাধ জগৎ থেকে উপার্জিত অর্থের মাধ্যমে সে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদের মালিক হয়ে ওঠে।
অত্যন্ত সুকৌশলে বারবার সে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজর এড়িয়ে অপরাধমূলক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছিল এবং এলাকায় তার বিরুদ্ধে কেউ মুখ খোলার সাহস করেনি। কবজি কাটা আনোয়ার বাহিনী প্রথমে যাকে টার্গেট করে তাকে যে কোনোভাবে হামলা করে।
কৃত্রিম যানজট ও সিসি ক্যামেরা ভাঙচুর করে কবজি কাটা গ্রুপ
গ্রুপ সদস্যরা রাস্তায় কৃত্রিম যানজট তৈরি করে, সিসি ক্যামেরা থাকলে সেগুলো ভাঙচুর করে ও নজরে রাখে, রাস্তার মোড়ে ট্রাফিক পুলিশের আদলে যানজট নিয়ন্ত্রণের নাটক সাজিয়ে রাস্তা ব্লক করে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা সাধারণ জনগণ বাধা দিচ্ছে কি না তা খেয়াল রাখে। এরপর তারা ফিল্মি স্টাইলে ভুক্তভোগীকে কুপিয়ে গুরুতর জখম করে।
পরে হাতের কবজি কেটে সবার সামনে দিয়ে হেঁটে চলে যায়। গ্রেফতার আনোয়ারের হাতেই গত কয়েক মাসে সাত-আট জন হামলার শিকার হয়েছেন। কেউ হারিয়েছেন পা, কেউ হাত আবার কেউবা পঙ্গু হয়ে বিছানায় কাতরাচ্ছেন। তার হামলার শিকার ব্যক্তিদের বেশিরভাগই এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন। তার ভয়ে মামলাও করেন না অনেকে। আবার কেউ মামলা করলে তাকে ভয়ভীতি দেখায় আনোয়ারের কবজি কাটা গ্রুপের সদস্যরা।