ঢাকা ০৮:০৯ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৪, ৩ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

নায়িকার গাড়ি চালক থেকে রাজনীতিতে: জাহাঙ্গীরের শত কোটি টাকার সম্পদ

নোয়াখালী প্রতিনিধি
  • Update Time : ১০:৪৬:০২ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৬ জুলাই ২০২৪
  • / ৪৫ Time View

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক ব্যক্তিগত সহকারী মো. জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে আয় বহির্ভূত ৪শত কোটি টাকার মালিক হওয়ার অভিযোগ করেছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী নিজেই। এরপর এনিয়ে নোয়াখালীসহ সারা দেশে আলোচনা সমালোচনার ঝড় তুলে।

১৯৮৪ সালে প্রথম ঢাকা যান জাহাঙ্গীর। এরপর কিছুদিন সেখানে নায়িকা দোয়েলের গাড়ি চালিয়েছেন।

এরপর গাড়ি চালকের চাকরি ছেড়ে দৈনিক দিনমজুরিতে জাতীয় সংসদে কাজ করেছেন। সেই থেকে তার ভাগ্যের চাকা ঘুরতে থাকে। ২০০৯ সাল থেকে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী পরিচয়ে তাকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।

চাটখিল-সোনাইমুড়ী উপজেলার উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে তার দাপট ছিল চোখে পড়ার মত। অনেক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীকে এখানে এনে উন্নয়নমূলক কাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছেন।

তবে তার পতন শুরু হয় দ্বদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নোয়াখালী-১ (চাটখিল-সোনাইমুড়ী) আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে হলফনামা দাখিল করে। ওই হলফনামার বিবরণীতে দেখা যায় তার নিজের নামে প্রায় ২১ কোটি টাকার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ রয়েছে। স্ত্রী কামরুন নাহারের নামে রয়েছে ৭ কোটি ৩০ লাখ টাকার সম্পদ। ওই সম্পদ বিবরণীর দেখে অনেকের মাথা ঘুরে উঠে।

পরবর্তীতে জাহাঙ্গীরের প্রতিপক্ষ একটি গ্রুপ তার বিরুদ্ধে নিয়োগ,তদবির বাণ্যিজসহ নানা অভিযোগ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের নজরে আনেন। তখন ২০২৩ সালের ৬ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, জাহাঙ্গীর নিজেকে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন অনৈতিক কাজ করে বেড়াচ্ছেন। তবে তার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী কিংবা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কোনো সম্পর্ক নেই।

জাহাঙ্গীরের গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর চাটখিল উপজেলার খিলপাড়া ইউনিয়নের নাহারখিল গ্রামে। তার বাবার নাম রহমত উল্যা ও মায়ের নাম অজিফা খাতুন।

স্থানীয়রা জানায়, নোয়াখালীর আওয়ামীরাজনীতিতেও প্রভাব ছিল জাহাঙ্গীরের। নিজে ছিলেন নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতির পদে। নিয়ন্ত্রণ করতেন জেলার অনেক উন্নয়ন কাজ। এ পরিচয়ে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করেছেন তার পরিবারের একাধিক সদস্যকেও। জাহাঙ্গীর আলমের ছোট ভাই আলমগীল হোসেন দুই মেয়াদে খিলপাড়া ইউপি চেয়ারম্যান। তার ভাগিনা মাকসুদুর রহমান শিপন জেলা পরিষদের সদস্য ও প্যানেল চেয়ারম্যান। দুটি পদই জাহাঙ্গীর আলমের ক্ষমতার প্রভাবে বাগিয়ে নেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বর্তমান সরকারের টানা চার মেয়াদের প্রথম দুই টার্মের পুরোটা এবং তৃতীয় টার্মের প্রথম কিছু দিন প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে কর্মরত ছিলেন জাহাঙ্গীর। দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় সরকারের তৃতীয় টার্মের প্রথম দিকে চাকরিচ্যুত হন তিনি। ওই সময় তার বিষয়ে সবাইকে সতর্ক থেকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সহায়তা নেওয়ার পরামর্শও দেওয়া হয়েছিল।

প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী’ হিসেবে এলাকায় এসে চলতেন পুলিশ প্রটোকলে। বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক বা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে নিজেকে প্রধানমন্ত্রীর অত্যন্ত বিশ্বস্ত হিসেবে তুলে ধরতেন। আর সাধারণ জনগণ তা বিশ্বাস করতেন। তিনি বিভিন্ন সময় দেওয়া তার বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কোথায় যেতেন, কী করতেন, প্রধানমন্ত্রী কোন সময় কী করতেন তা তুলে ধরতেন। দরিদ্র বাবার সন্তান জাহাঙ্গীর আলম জাতীয় সংসদ নির্বাচনও করতে চেয়েছিলেন। মসজিদ, মাদরাসা, স্কুল-কলেজ, বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনকে দান করতেন অকাতরে।

এলাকার অনেকে জানান, একসময় তাদের পরিবার ছিল খুবই দরিদ্র। বর্তমানে জাহাঙ্গীর আলম অঢেল সম্পদ ও টাকার মালিক। এসবই হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী পরিচয়ে। তার বাবা রহমত উল্যাহ ইউনিয়ন পরিষদে কেরানী হিসেবে চাকরি করতেন। সংসারে ছিল টানাপোড়ন। দল ক্ষমতায় আসার পর জাহাঙ্গীর আলমের উত্থান অনেকের কাছে আলাদীনের চেরাগের মতো। চাটখিলে পৈতৃক ভিটায় করেছেন চারতলা বাড়ি। বাড়ির পাশে রয়েছে ৭০০ শতক জমি। উপজেলার খিলপাড়া পূর্ব বাজারে রয়েছে প্রায় কোটি টাকা মূল্যের সম্পদ। জেলা শহরের মাইজদীতে রয়েছে আটতলা বিলাসবহুল ভবন। সদর উপজেলার খলিলপুরে ১০ একর জায়গাজুড়ে রয়েছে বিশাল খামার বাড়ি। যা নামমাত্র মূল্যে কিনা। সোনাপুর পৌর সুপার মার্কেটে রয়েছে দুটি দোকান। এছাড়া, চাটখিল ও রাজধানী ঢাকায় রয়েছে নামে-বেনামে কোটি কোটি টাকার সম্পদ।

জাহাঙ্গীরের বড় ভাই খিলপাড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মীর হোসেন বলেন, জাহাঙ্গীর দু্ই বিয়ে করেছিল। তার দুই সংসারে চার ছেলে। সে প্রথম ঢাকা গিয়ে নায়িকা দোয়েল ও তার স্বামী সুব্রতয়ের সাথে ছিল। তাদের সাথে হোটেল ব্যবসায় জড়িত ছিল। এর আগে সে ঢাকায় গাড়ি চালানো শিখে। তবে তার ছোট ভাই নায়িকার গাড়ি চালক ছিলনা বলে তিনি দাবি করেন।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে জাহাঙ্গীর আলমের ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বরে কল দেওয়া হলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। পরে হোয়াটসঅ্যাপে কল দেওয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি। তবে তার একাধিক নিকট আত্মীয় জানান, জাহাঙ্গীর আলম বর্তমানে আমেরিকায় আছেন। তিনি কিছু দিনের মধ্যে দেশে ফিরবেন।

Please Share This Post in Your Social Media

নায়িকার গাড়ি চালক থেকে রাজনীতিতে: জাহাঙ্গীরের শত কোটি টাকার সম্পদ

নোয়াখালী প্রতিনিধি
Update Time : ১০:৪৬:০২ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৬ জুলাই ২০২৪

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক ব্যক্তিগত সহকারী মো. জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে আয় বহির্ভূত ৪শত কোটি টাকার মালিক হওয়ার অভিযোগ করেছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী নিজেই। এরপর এনিয়ে নোয়াখালীসহ সারা দেশে আলোচনা সমালোচনার ঝড় তুলে।

১৯৮৪ সালে প্রথম ঢাকা যান জাহাঙ্গীর। এরপর কিছুদিন সেখানে নায়িকা দোয়েলের গাড়ি চালিয়েছেন।

এরপর গাড়ি চালকের চাকরি ছেড়ে দৈনিক দিনমজুরিতে জাতীয় সংসদে কাজ করেছেন। সেই থেকে তার ভাগ্যের চাকা ঘুরতে থাকে। ২০০৯ সাল থেকে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী পরিচয়ে তাকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।

চাটখিল-সোনাইমুড়ী উপজেলার উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে তার দাপট ছিল চোখে পড়ার মত। অনেক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীকে এখানে এনে উন্নয়নমূলক কাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছেন।

তবে তার পতন শুরু হয় দ্বদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নোয়াখালী-১ (চাটখিল-সোনাইমুড়ী) আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে হলফনামা দাখিল করে। ওই হলফনামার বিবরণীতে দেখা যায় তার নিজের নামে প্রায় ২১ কোটি টাকার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ রয়েছে। স্ত্রী কামরুন নাহারের নামে রয়েছে ৭ কোটি ৩০ লাখ টাকার সম্পদ। ওই সম্পদ বিবরণীর দেখে অনেকের মাথা ঘুরে উঠে।

পরবর্তীতে জাহাঙ্গীরের প্রতিপক্ষ একটি গ্রুপ তার বিরুদ্ধে নিয়োগ,তদবির বাণ্যিজসহ নানা অভিযোগ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের নজরে আনেন। তখন ২০২৩ সালের ৬ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, জাহাঙ্গীর নিজেকে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন অনৈতিক কাজ করে বেড়াচ্ছেন। তবে তার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী কিংবা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কোনো সম্পর্ক নেই।

জাহাঙ্গীরের গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর চাটখিল উপজেলার খিলপাড়া ইউনিয়নের নাহারখিল গ্রামে। তার বাবার নাম রহমত উল্যা ও মায়ের নাম অজিফা খাতুন।

স্থানীয়রা জানায়, নোয়াখালীর আওয়ামীরাজনীতিতেও প্রভাব ছিল জাহাঙ্গীরের। নিজে ছিলেন নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতির পদে। নিয়ন্ত্রণ করতেন জেলার অনেক উন্নয়ন কাজ। এ পরিচয়ে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করেছেন তার পরিবারের একাধিক সদস্যকেও। জাহাঙ্গীর আলমের ছোট ভাই আলমগীল হোসেন দুই মেয়াদে খিলপাড়া ইউপি চেয়ারম্যান। তার ভাগিনা মাকসুদুর রহমান শিপন জেলা পরিষদের সদস্য ও প্যানেল চেয়ারম্যান। দুটি পদই জাহাঙ্গীর আলমের ক্ষমতার প্রভাবে বাগিয়ে নেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বর্তমান সরকারের টানা চার মেয়াদের প্রথম দুই টার্মের পুরোটা এবং তৃতীয় টার্মের প্রথম কিছু দিন প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে কর্মরত ছিলেন জাহাঙ্গীর। দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় সরকারের তৃতীয় টার্মের প্রথম দিকে চাকরিচ্যুত হন তিনি। ওই সময় তার বিষয়ে সবাইকে সতর্ক থেকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সহায়তা নেওয়ার পরামর্শও দেওয়া হয়েছিল।

প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী’ হিসেবে এলাকায় এসে চলতেন পুলিশ প্রটোকলে। বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক বা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে নিজেকে প্রধানমন্ত্রীর অত্যন্ত বিশ্বস্ত হিসেবে তুলে ধরতেন। আর সাধারণ জনগণ তা বিশ্বাস করতেন। তিনি বিভিন্ন সময় দেওয়া তার বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কোথায় যেতেন, কী করতেন, প্রধানমন্ত্রী কোন সময় কী করতেন তা তুলে ধরতেন। দরিদ্র বাবার সন্তান জাহাঙ্গীর আলম জাতীয় সংসদ নির্বাচনও করতে চেয়েছিলেন। মসজিদ, মাদরাসা, স্কুল-কলেজ, বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনকে দান করতেন অকাতরে।

এলাকার অনেকে জানান, একসময় তাদের পরিবার ছিল খুবই দরিদ্র। বর্তমানে জাহাঙ্গীর আলম অঢেল সম্পদ ও টাকার মালিক। এসবই হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী পরিচয়ে। তার বাবা রহমত উল্যাহ ইউনিয়ন পরিষদে কেরানী হিসেবে চাকরি করতেন। সংসারে ছিল টানাপোড়ন। দল ক্ষমতায় আসার পর জাহাঙ্গীর আলমের উত্থান অনেকের কাছে আলাদীনের চেরাগের মতো। চাটখিলে পৈতৃক ভিটায় করেছেন চারতলা বাড়ি। বাড়ির পাশে রয়েছে ৭০০ শতক জমি। উপজেলার খিলপাড়া পূর্ব বাজারে রয়েছে প্রায় কোটি টাকা মূল্যের সম্পদ। জেলা শহরের মাইজদীতে রয়েছে আটতলা বিলাসবহুল ভবন। সদর উপজেলার খলিলপুরে ১০ একর জায়গাজুড়ে রয়েছে বিশাল খামার বাড়ি। যা নামমাত্র মূল্যে কিনা। সোনাপুর পৌর সুপার মার্কেটে রয়েছে দুটি দোকান। এছাড়া, চাটখিল ও রাজধানী ঢাকায় রয়েছে নামে-বেনামে কোটি কোটি টাকার সম্পদ।

জাহাঙ্গীরের বড় ভাই খিলপাড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মীর হোসেন বলেন, জাহাঙ্গীর দু্ই বিয়ে করেছিল। তার দুই সংসারে চার ছেলে। সে প্রথম ঢাকা গিয়ে নায়িকা দোয়েল ও তার স্বামী সুব্রতয়ের সাথে ছিল। তাদের সাথে হোটেল ব্যবসায় জড়িত ছিল। এর আগে সে ঢাকায় গাড়ি চালানো শিখে। তবে তার ছোট ভাই নায়িকার গাড়ি চালক ছিলনা বলে তিনি দাবি করেন।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে জাহাঙ্গীর আলমের ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বরে কল দেওয়া হলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। পরে হোয়াটসঅ্যাপে কল দেওয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি। তবে তার একাধিক নিকট আত্মীয় জানান, জাহাঙ্গীর আলম বর্তমানে আমেরিকায় আছেন। তিনি কিছু দিনের মধ্যে দেশে ফিরবেন।