দিন দিন বাড়ছে কথিত সাংবাদিকদের সংখ্যা
হুমকির মুখে সাংবাদিকতা পেশার সম্মান ও মর্যাদা!

- Update Time : ০৯:৪৪:৫৩ অপরাহ্ন, শনিবার, ২ অগাস্ট ২০২৫
- / ৩৪ Time View
বাংলাদেশে সাংবাদিকতার অঙ্গনে অদ্ভুত এক বৈপরীত্য তৈরি হয়েছে। একদিকে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে সাংবাদিক পরিচয়ে থাকা ব্যক্তিদের সংখ্যা, অন্যদিকে কমছে পেশাগত মান, নৈতিকতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা। এতে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়ছেন অভিজ্ঞ ও সিনিয়র সাংবাদিকরা। বহু বছরের অভিজ্ঞতা ও পেশাদারিত্ব নিয়েও তারা এখন বিপাকে ওই সাংবাদিক নামধারী সাংঘাতিকদের কারণে।
সাংবাদিক বাড়ছে, মানের সংকট প্রকট হচ্ছে:
২০২৫ সালের মার্চ মাসে চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের প্রকাশিত সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে নিবন্ধিত দৈনিক পত্রিকার সংখ্যা ১,৩৬৯টি, যার মধ্যে ঢাকা মহানগর থেকে প্রকাশিত পত্রিকা ৫৬১টি। তবে বাস্তব চিত্র ভিন্ন—শুধু রাজধানী ঢাকাতেই প্রতিদিন ‘প্রেস’ লেখা স্টিকারধারী ও আইডি কার্ড ব্যবহারকারী লোকের সংখ্যা প্রায় ২০ হাজারের বেশি। অনেকেই নিজেরাই ফেসবুক পেজ খুলে সেটিকে “নিউজ পোর্টাল” বানিয়ে সাংবাদিকতার পরিচয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাইকের সামনে সাংবাদিক স্টিকার লাগিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন পুরো ঢাকা শহর।
বিশ্লেষকদের মতে, দেশে এখন প্রতি ১০০ জন তরুণের মধ্যে অন্তত ৫ জন নিজেকে সাংবাদিক বলে দাবি করেন—যার বড় অংশই কোনো প্রতিষ্ঠানভিত্তিক দায়িত্বে নেইl
সিনিয়র সাংবাদিকরা কেন বিপাকে?
১. কথিত ও ভুয়া সাংবাদিকদের বন্যা
বর্তমানে ফেসবুক পেজ, ইউটিউব চ্যানেল, এবং নামসর্বস্ব অনলাইন পোর্টালের মাধ্যমে হাজার হাজার মানুষ নিজেকে “সাংবাদিক” পরিচয় দিচ্ছে। এদের অনেকেই সাংবাদিকতার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বা অভিজ্ঞতা ছাড়াই মাঠে নামছেন। এতে সাধারণ মানুষের মধ্যে সাংবাদিকতার প্রতি অবমূল্যায়ন তৈরি হচ্ছে এবং মূলধারার সাংবাদিকদের বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
২. মূলধারার সাংবাদিকদের সুযোগ কমে যাচ্ছে
ভুয়া সাংবাদিকরা রাজনৈতিক প্রভাব, ভয়ভীতি বা সুবিধাবাদী আচরণের মাধ্যমে প্রশাসন ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ব্যক্তিগত সুবিধা আদায়ে ব্যস্ত। এতে প্রকৃত সাংবাদিকরা মাঠে তথ্য সংগ্রহ বা প্রতিবেদন করার ক্ষেত্রে বাধার সম্মুখীন হন। অনেক ক্ষেত্রে তাদেরকেই সন্দেহের চোখে দেখা হয়।
৩.পাঠকের আস্থার সংকট
এক শ্রেণির কথিত সাংবাদিক মিথ্যা, কুৎসা, গুজব এবং পেইড কনটেন্ট ছড়ানোর কারণে গণমাধ্যমের ওপর মানুষের আস্থা কমছে। এতে সব সাংবাদিকই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, বিশেষ করে যারা দীর্ঘদিন ধরে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন।
কিছু তথ্য যা চিন্তার উদ্রেক করে:
২০২৫ সালের তথ্য অনুযায়ী, দেশে নিবন্ধিত মিডিয়ার বাইরে প্রায় ৭ হাজারের বেশি অননুমোদিত অনলাইন পোর্টাল রয়েছেএবং কিছু কিছু টিভি চ্যানেল ও পত্রিকা বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় প্রতিনিধি বাণিজ্য করছে। তারা একটি জেলায় জেলা দক্ষিণ প্রতিনিধি, উত্তর প্রতিনিধি, পশ্চিম, পূর্ব করে একটি জেলায় ৪-৫ জন প্রতিনিধি দিচ্ছে। ইদানিং কিছু কিছু জায়গায় ইউনিয়ন প্রতিনিধি ও দেখা যাচ্ছে। যাতে বাড়ছে হাজার হাজার সাংবাদিকদের সংখ্যা আর বিপাকে পড়ছেন সিনিয়র ও অভিজ্ঞ সাংবাদিকরা
সমাধান ও করণীয়:
জাতীয় সাংবাদিক রেজিস্ট্রি চালু করা:
প্রতিটি সাংবাদিকের সরকারি স্বীকৃতি ও নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করতে হবে।
সনদ ছাড়া সাংবাদিকতা নিষিদ্ধ করা:
কোনো স্বীকৃত প্রশিক্ষণ ছাড়া সাংবাদিকতা করা যাবে না—এমন আইন চালু জরুরি।
আইডি কার্ড যাচাইয়ের কেন্দ্রীয় ব্যবস্থা:
প্রেস কার্ডে QR কোড ও কেন্দ্রীয় যাচাই ব্যবস্থা চালু করলে ভুয়া পরিচয় কমানো যাবে।
পেশাগত প্রশিক্ষণ ও মানোন্নয়ন:
বিশেষ করে জেলা-উপজেলায় নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে—যাতে নতুনরা সঠিকভাবে পেশায় প্রবেশ করেন।
শেষ কথা:
সাংবাদিকতা একটি জাতির বিবেক। এই পেশায় যেমন দায়িত্ব রয়েছে, তেমনি রয়েছে ত্যাগ ও সততার প্রয়োজন। যদি এই পেশায় অভিজ্ঞদের অবমূল্যায়ন আর অপেশাদারদের আধিপত্য চলতেই থাকে, তাহলে গণমাধ্যম হারাবে তার সবচেয়ে বড় শক্তি—জনগণের আস্থা। এখনই সময় সাংবাদিকতার পরিচয়কে বিশুদ্ধ করা, নয়তো সাংবাদিক নামটাই হয়ে যাবে বিতর্কিত।