ঢাকা ০৪:২৫ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৮ জুন ২০২৪, ৩ আষাঢ় ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি!

স্বামীর ঋণের দায়ে দুই মাস ধরে ধর্ষিতা গৃহবধূর বিষপানে আত্মহত্যা!

স্টাফ রিপোর্টার
  • Update Time : ০৭:৩০:৩৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ১ জুন ২০২৪
  • / ৪৪ Time View

কুড়িগ্রামের রাজীবপুরে স্বামীর ২০ হাজার টাকা ঋণের দায়ে দুইমাস ধরে দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন এক গৃহবধূ। স্বামী টাঙ্গাইলে দিনমজুর হিসেবে কাজ করতেন। অভাবের কারণে এই ঋণ নিয়েছিলেন।

অভাবের সংসারে ৪০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন এই দম্পতি। ২০ হাজার টাকা শোধ করেছেন। বাকি ২০ হাজার টাকার ঋণ শোধ করতে না পারায় প্রায় দুই মাস ধরে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করা হয় গৃহবধূকে। এ ঘটনায় স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের কাছে অভিযোগ করে বিচার না পেয়ে লজ্জায়, ক্ষোভে, অপমানে বিষ পান করেন ওই দম্পতি।

মর্মান্তিক ঘটনাটি ঘটেছে কুড়িগ্রামের চর রাজিবপুর উপজেলায়। দুটি হাসপাতাল ঘুরে পাঁচ দিন পর গত বুধবার দুপুরে বাড়িতেই তাঁর মৃত্যু হয়।
ওই গৃহবধূর মৃত্যুর ৫১ ঘণ্টা পর গতকাল শুক্রবার চারজনকে অভিযুক্ত করে রাজিবপুর থানায় অভিযোগ করা হয়েছে।

শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত স্ত্রীকে নিয়ে স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের কাছে কোন বিচার না পেয়ে মামলা করতে চান। তখন তারা বিচারের কথা বলে ২০ হাজার টাকা দিয়ে মিটমাটের কথা বলেন। এই দম্পতি তা প্রত্যাখ্যান করেন এবং পরের দিন বিষপানে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। স্বামীকে বাঁচানো গেলেও গৃহবধূকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। ওই দম্পতির তিন বছরের একটি শিশুসন্তান রয়েছে।

এরকম লোমহর্ষক ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি প্রদান করেন সমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরামের সভাপতি প্রকৌশলী শম্পা বসু ও সাধারণ সম্পাদক অ্যাড. দিলরুবা নূরী।

বিবৃতিতে নেতৃবৃন্দ বলেন, যেকোন ঘটনার সবচেয়ে ভয়াবহ প্রভাব পড়ে নারীর উপর। এ ঘটনা তার আরেকটি প্রমাণ। বিষয় ছিল টাকা পরিশোধের কিন্তু দায় পড়ল গৃহবধূর উপর। সমাজে নারী সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গী কেমন তা এই ঘটনা থেকে বোঝা যায়। ঘটনার সাথে যারা যুক্ত, মামলা করতে না দেয়া ব্যক্তিরা এবং ২০ হাজার টাকায় মিটমাট করতে চাওয়া মানুষ, প্রত্যেকেই একই দৃষ্টিভঙ্গী দ্বারা পরিচালিত। দেশের কোথাও কি নারী নিরাপদ? দিনের পর দিন ঘরে ঢুকে ৩ জন ধর্ষক ধর্ষণ করে যেতে পারে! এখানে নারীর পোশাক, আচরণের কোন দায় আপনারা দিবেন? শাসকরা তাদের শাসন অব্যাহত রাখার জন্য সমাজে ভোগবাদ, নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা বহাল রেখেছে। এর শিকার প্রতিনিয়ত নারীরা হচ্ছে।

নেতৃবৃন্দ আরো বলেন, এলাকাগুলোতে এরকম মর্মান্তিক ভয়াবহ ফৌজদারি ঘটনাগুলোকে স্থানীয় সালিশির মাধ্যমে ফয়সালা করা হয়, যা অপরাধ। এই অপরাধেরও যদি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা আইনগতভাবে না থাকে তাহলে গ্রামে-গঞ্জে এই সমস্ত অপরাধ বাড়তে থাকবে আর নারীরা তার বলি হতে থাকবে। অবিলম্বে এই ঘটনার সাথে যুক্ত ব্যক্তিদের গ্রেফতার ও বিচারের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করেন নেতৃবৃন্দ।

এদিকে, মৃত্যুর আগে ২২ মে স্থানীয় কয়েকজনের কাছে দেওয়া গৃহবধূর জবানবন্দির একটি অডিও রেকর্ড নওরোজের এ প্রতিবেদকের হাতে আসে।

ওই অডিও রেকর্ডে গৃহবধূ পাশবিক নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছেন।

অডিওতে পাওনা টাকার জন্য উপজেলা সদরের হলোপাড়া গ্রামের জয়নাল মিয়া, তাঁর সহযোগী শুক্কুর ও সোলেমানের বিরুদ্ধে দলবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ করেন ওই গৃহবধূ। ২০ মিনিট ২৬ সেকেন্ডের অডিওতে গৃহবধূ নির্যাতনের বিস্তারিত তুলে ধরেন। অভিযুক্ত ব্যক্তিরা পেশায় কসাইয়ের কাজ করেন। রাজীবপুর বাজারে তাঁদের মাংসের দোকান আছে।

অডিও রেকর্ডে পাশবিক নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে গৃহবধূ বলেছেন, ‘আমার বাবা নেই। মা গৃহকর্মীর কাজে বিদেশে থাকেন। স্বামী দিনমজুরির কাজের জন্য টাঙ্গাইলে থাকেন। কয়েক মাস আগে অভাবের কারণে তাঁর স্বামী অভিযুক্ত জয়নালের কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা ধার করেন। ওই টাকার জন্য জয়নাল তাঁকে (গৃহবধূ) চাপ দিয়ে আসছিলেন। টাকা পরিশোধ করতে না পারায় জয়নাল তাঁকে শারীরিক সম্পর্কের কুপ্রস্তাব দেন। গত রোজার মাস থেকে তাঁকে ধর্ষণ করতে শুরু করেন জয়নাল। একপর্যায়ে জয়নালের সহযোগী সোলেমান মুঠোফোনে জয়নালের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কের ভিডিও ধারণ করেন এবং তাঁর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক না করলে ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখান। এরপর জয়নাল, শুক্কুর ও সোলেমান দিনের পর দিন ওই গৃহবধূকে দলবদ্ধ ধর্ষণ করতে থাকেন। দুই মাসের বেশি সময় ধরে তাদের নির্যাতনে অসুস্থ হয়ে বাধ্য হয়ে স্বামীকে বিস্তারিত ঘটনা জানাই। পরে স্থানীয় মাতব্বরদের কাছে অভিযোগ দিয়েও কোনো বিচার পাইনি।’

এব্যাপারে গৃহবধূর স্বামী বলেন, টাঙ্গাইল থেকে বাড়িতে ফিরে তিনি দেখেন, স্ত্রীর শারীরিক অবস্থা খুবই খারাপ। জিজ্ঞাসা করলে জয়নাল, শুক্কুর ও সোলেমানের ধর্ষণের ঘটনা খুলে বলেন স্ত্রী। ধর্ষণের ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে দিনের পর দিন ধর্ষণ করেন তাঁরা। পরে স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি ও দূরসম্পর্কের এক মামাকে জানিয়ে স্ত্রীকে নিয়ে থানায় মামলা করতে যান। কিন্তু থানায় পৌঁছানোর আগেই রাজীবপুর ইসলামী ব্যাংকের সামনে পুলিশ কনস্টেবল রবিউল ইসলাম, আমেজ উদ্দিন ও জয়নাল পথরোধ করে বাসায় ফিরে যেতে বলেন এবং রাতে বাড়িতে গিয়ে বিচারের আশ্বাস দেন।

গৃহবধূর স্বামী বলেন, ‘আমরা বাসায় ফিরে এলে গত বৃহস্পতিবার (২৩ মে) রাতে কনস্টেবল রবিউল, (পুলিশের) গাড়িচালক মোজাহারুল ইসলাম, জয়নাল, সোলেমান ও শুক্কুর আমার বাড়িতে আসেন। তাঁরা আমাকে ২০ হাজার টাকা দিতে চান এবং বিষয়টি নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেন। আমি টাকা নিতে অস্বীকৃতি জানাই। পরে তাঁরা কোনো সমাধান না দিয়ে চলে যান। সুষ্ঠু বিচার না পাওয়ায় শুক্রবার (২৪ মে) বিকেলে আমরা স্বামী-স্ত্রী আত্মহত্যার জন্য বিষ খাই।’

গৃহবধূর স্বামী অভিযোগ করেন, গত বুধবার স্ত্রীর মৃত্যুর পর স্থানীয় ইউপি সদস্য আনোয়ার হোসেন ও আমেজ উদ্দিন তাঁর বাড়িতে আসেন। তখন শারীরিক অবস্থা ভালো ছিল না। তাঁরা তাঁর কাছ থেকে চিকিৎসার খরচের জন্য এক লাখ টাকা দাবি করেন এবং একটি ফাঁকা স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর করিয়ে নেন। পরে তাঁর পরিবারের পক্ষে কেউ টাকা দিয়েছেন কি না,তিনি জানেন না।

ফাঁকা স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন ইউপি সদস্য আনোয়ার। তিনি বলেন, ওই গৃহবধূ ও তাঁর স্বামীর চিকিৎসার জন্য অনেক টাকা খরচ হয়েছিল। সেই খরচ বাবদ এক লাখ টাকা চাওয়া হয়েছিল। কেন স্ট্যাম্পে চিকিৎসার খরচের বিষয়টি লেখা ছিল না জানতে চাইলে ওই ইউপি সদস্য চুপ করে থাকেন।

আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘ঘটনাটি গোপন ছিল। আমরা জানতাম না। গৃহবধূর স্বামী একেকবার একেক কথা কয়। বিষ খাওয়ার পর চিকিৎসার জন্য জয়নাল ২০ হাজার টাহা দিছে। হের স্বামী নেয় নাই।’

ধর্ষণের ঘটনা পুলিশকে নিয়ে কিভাবে টাকা দিয়ে মীমাংসার সিদ্ধান্ত দিয়েছেন—এমন প্রশ্নের জবাবে এই ওয়ার্ড মেম্বার বলেন, ‘অভিযুক্তরাই মীমাংসার কথা বলেছিল। এখন জয়নাল ও শুক্কুর কই আছে আমার জানা নাই।’

ভুক্তভোগী পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ওই দম্পতি সম্পর্কে খালাতো ভাই-বোন। অভিযোগ রয়েছে, তাঁদের চাচাতো মামা আমেশ অভিযুক্তদের সঙ্গে মিলে আইনি পদক্ষেপ নিতে বাধা দিয়েছিলেন। স্থানীয়ভাবে মীমাংসার আশ্বাস দিয়েছিলেন। এতে সহযোগিতা করেন স্থানীয় ইউপি সদস্য আনোয়ার ও দুই পুলিশ সদস্য।

এ বিষয়ে গৃহবধূর মামা আকবর আলী বলেন, ‘উপজেলার সদর ইউনিয়নের হলপাড়া গ্রামের আবুসামার ছেলে জয়নাল মিয়া এবং তাঁর সহযোগী কারিগরপাড়ার শুক্কুর কসাই, ডাকাতপাড়ার আলম কসাই ও টাঙ্গাইলপাড়ার সোলেমানের নামে থানায় অভিযোগ দিয়েছি। আমরা ন্যায়বিচার চাই।’

অনুসন্ধানে জানা গেছে, জয়নাল ও শুক্কুরকে সহযোগিতা করেছেন ভুক্তভোগী দম্পতির মামা আমেশ ও স্থানীয় মেম্বার আনোয়ার। তাঁরা থানা পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে ধর্ষণের ঘটনাটি মামলা পর্যন্ত গড়াতে দেননি। তাঁদের সহযোগিতা করেছেন পুলিশ কনস্টেবল রবিউল ও থানার ড্রাইভার মাজহারুল।

স্থানীয়রা বলছে, গত ২৫ মে ওই দম্পতি প্রকাশ্যে বিষ পান করার পর তাঁদের রাজিবপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়। সেখানে তাঁদের পাকস্থলী পরিষ্কার করেন চিকিৎসক। পরে সেখান থেকে জামালপুর হাসপাতালে নেওয়া হয়। গৃহবধূর অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় চিকিৎসক ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রেফার করেন। কিন্তু হাতে টাকা না থাকায় এই দম্পতি বাড়ি চলে আসেন। গত বুধবার বাড়িতেই মৃত্যু হয় গৃহবধূর। পরে লাশ উদ্ধার করে থানায় নেয় পুলিশ।

এ বিষয়ে রাজিবপুর থানার ওসি আশিকুর রহমান বলেন, ‘ধর্ষণের ঘটনায় আজই (গতকাল) একটি অভিযোগ পেয়েছি। এর আগে বিষপানের ঘটনায় একটি অপমৃত্যুর মামলা হয়। প্রাথমিক তদন্তে অভিযোগটির সত্যতা পেলে মামলা হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হবে।’

ঘটনার ব্যাপারে গতকাল শুক্রবার রাজীবপুরের ওই ইউনিয়নে গিয়ে এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা হয়। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, গত শুক্রবার বিকেলে ওই গৃহবধূ ও তাঁর স্বামী বিচার না পেয়ে বিষপান করেন। গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় তাঁদের প্রথমে রাজীবপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ও পরে জামালপুর হাসপাতালে নেওয়া হয়। অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় চিকিৎসকেরা তাঁদের ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করার পরামর্শ দেন। কিন্তু হাসপাতালের খরচের টাকা না থাকায় অসুস্থ অবস্থায় ওই দম্পতি বাড়িতে ফিরে আসেন। এরপর গত বুধবার ওই গৃহবধূ মারা যান।

অভিযুক্ত জয়নাল, সোলেমান ও শুক্কুর ঘটনার পর থেকে গা ঢাকা দিয়েছেন। তাঁদের বাড়ি বা মাংসের দোকানে গিয়েও তাঁদের পাওয়া যায়নি। অভিযোগের বিষয়ে জয়নাল ও সোলেমানের মুঠোফোন নম্বরে একাধিকবার কল করলেও বন্ধ পাওয়া যায়।

অভিযুক্ত আমেজ উদ্দিন ধর্ষণের ঘটনা ধামাচাপা দিতে মীমাংসার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তাঁর বাড়িতে গিয়ে স্বজনদের পাওয়া গেলেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। স্বজনদের কাছে তাঁর মুঠোফোন নম্বর চাইলে তাঁরা দিতে অস্বীকৃতি জানান।

রাজীবপুর থানায় গিয়ে কনস্টেবল রবিউল ইসলামের সঙ্গে কথা হয়। অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, অভিযুক্ত জয়নালের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল। জয়নাল একজনের কাছে টাকা পাবেন বলে তাঁকে ডেকে নিয়ে ওই গৃহবধূর বাড়িতে যান। তিনি ওই বাড়িতে গিয়ে ঘটনা জানতে পারেন। পরে তিনি সেখান থেকে চলে আসেন।

রাজীবপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আশিকুর রহমান বলেন, এখন পর্যন্ত ধর্ষণের কোনো অভিযোগ পাননি। স্বামী-স্ত্রী বিষপান করেছিলেন। এর মধ্যে স্ত্রীর মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা হয়েছে।

কনস্টেবল ও গাড়িচালকের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের বিষয়ে ওসি বলেন, ‘জয়নাল একজনের কাছে টাকা পান, সেটি তুলতে যাওয়ার কথা বলে মোজাহারুলকে ওই বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন বলে শুনেছি। কোনো পুলিশ সদস্যের ব্যক্তিগত অপরাধের দায় পুরো পুলিশ প্রশাসন নেবে না। যদি কোনো পুলিশ সদস্য ওই গৃহবধূর বাড়িতে কোনো অপরাধে জড়িত থাকেন, তার দায় সেই সদস্যের।’

Please Share This Post in Your Social Media

দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি!

স্বামীর ঋণের দায়ে দুই মাস ধরে ধর্ষিতা গৃহবধূর বিষপানে আত্মহত্যা!

Update Time : ০৭:৩০:৩৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ১ জুন ২০২৪

কুড়িগ্রামের রাজীবপুরে স্বামীর ২০ হাজার টাকা ঋণের দায়ে দুইমাস ধরে দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন এক গৃহবধূ। স্বামী টাঙ্গাইলে দিনমজুর হিসেবে কাজ করতেন। অভাবের কারণে এই ঋণ নিয়েছিলেন।

অভাবের সংসারে ৪০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন এই দম্পতি। ২০ হাজার টাকা শোধ করেছেন। বাকি ২০ হাজার টাকার ঋণ শোধ করতে না পারায় প্রায় দুই মাস ধরে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করা হয় গৃহবধূকে। এ ঘটনায় স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের কাছে অভিযোগ করে বিচার না পেয়ে লজ্জায়, ক্ষোভে, অপমানে বিষ পান করেন ওই দম্পতি।

মর্মান্তিক ঘটনাটি ঘটেছে কুড়িগ্রামের চর রাজিবপুর উপজেলায়। দুটি হাসপাতাল ঘুরে পাঁচ দিন পর গত বুধবার দুপুরে বাড়িতেই তাঁর মৃত্যু হয়।
ওই গৃহবধূর মৃত্যুর ৫১ ঘণ্টা পর গতকাল শুক্রবার চারজনকে অভিযুক্ত করে রাজিবপুর থানায় অভিযোগ করা হয়েছে।

শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত স্ত্রীকে নিয়ে স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের কাছে কোন বিচার না পেয়ে মামলা করতে চান। তখন তারা বিচারের কথা বলে ২০ হাজার টাকা দিয়ে মিটমাটের কথা বলেন। এই দম্পতি তা প্রত্যাখ্যান করেন এবং পরের দিন বিষপানে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। স্বামীকে বাঁচানো গেলেও গৃহবধূকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। ওই দম্পতির তিন বছরের একটি শিশুসন্তান রয়েছে।

এরকম লোমহর্ষক ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি প্রদান করেন সমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরামের সভাপতি প্রকৌশলী শম্পা বসু ও সাধারণ সম্পাদক অ্যাড. দিলরুবা নূরী।

বিবৃতিতে নেতৃবৃন্দ বলেন, যেকোন ঘটনার সবচেয়ে ভয়াবহ প্রভাব পড়ে নারীর উপর। এ ঘটনা তার আরেকটি প্রমাণ। বিষয় ছিল টাকা পরিশোধের কিন্তু দায় পড়ল গৃহবধূর উপর। সমাজে নারী সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গী কেমন তা এই ঘটনা থেকে বোঝা যায়। ঘটনার সাথে যারা যুক্ত, মামলা করতে না দেয়া ব্যক্তিরা এবং ২০ হাজার টাকায় মিটমাট করতে চাওয়া মানুষ, প্রত্যেকেই একই দৃষ্টিভঙ্গী দ্বারা পরিচালিত। দেশের কোথাও কি নারী নিরাপদ? দিনের পর দিন ঘরে ঢুকে ৩ জন ধর্ষক ধর্ষণ করে যেতে পারে! এখানে নারীর পোশাক, আচরণের কোন দায় আপনারা দিবেন? শাসকরা তাদের শাসন অব্যাহত রাখার জন্য সমাজে ভোগবাদ, নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা বহাল রেখেছে। এর শিকার প্রতিনিয়ত নারীরা হচ্ছে।

নেতৃবৃন্দ আরো বলেন, এলাকাগুলোতে এরকম মর্মান্তিক ভয়াবহ ফৌজদারি ঘটনাগুলোকে স্থানীয় সালিশির মাধ্যমে ফয়সালা করা হয়, যা অপরাধ। এই অপরাধেরও যদি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা আইনগতভাবে না থাকে তাহলে গ্রামে-গঞ্জে এই সমস্ত অপরাধ বাড়তে থাকবে আর নারীরা তার বলি হতে থাকবে। অবিলম্বে এই ঘটনার সাথে যুক্ত ব্যক্তিদের গ্রেফতার ও বিচারের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করেন নেতৃবৃন্দ।

এদিকে, মৃত্যুর আগে ২২ মে স্থানীয় কয়েকজনের কাছে দেওয়া গৃহবধূর জবানবন্দির একটি অডিও রেকর্ড নওরোজের এ প্রতিবেদকের হাতে আসে।

ওই অডিও রেকর্ডে গৃহবধূ পাশবিক নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছেন।

অডিওতে পাওনা টাকার জন্য উপজেলা সদরের হলোপাড়া গ্রামের জয়নাল মিয়া, তাঁর সহযোগী শুক্কুর ও সোলেমানের বিরুদ্ধে দলবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ করেন ওই গৃহবধূ। ২০ মিনিট ২৬ সেকেন্ডের অডিওতে গৃহবধূ নির্যাতনের বিস্তারিত তুলে ধরেন। অভিযুক্ত ব্যক্তিরা পেশায় কসাইয়ের কাজ করেন। রাজীবপুর বাজারে তাঁদের মাংসের দোকান আছে।

অডিও রেকর্ডে পাশবিক নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে গৃহবধূ বলেছেন, ‘আমার বাবা নেই। মা গৃহকর্মীর কাজে বিদেশে থাকেন। স্বামী দিনমজুরির কাজের জন্য টাঙ্গাইলে থাকেন। কয়েক মাস আগে অভাবের কারণে তাঁর স্বামী অভিযুক্ত জয়নালের কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা ধার করেন। ওই টাকার জন্য জয়নাল তাঁকে (গৃহবধূ) চাপ দিয়ে আসছিলেন। টাকা পরিশোধ করতে না পারায় জয়নাল তাঁকে শারীরিক সম্পর্কের কুপ্রস্তাব দেন। গত রোজার মাস থেকে তাঁকে ধর্ষণ করতে শুরু করেন জয়নাল। একপর্যায়ে জয়নালের সহযোগী সোলেমান মুঠোফোনে জয়নালের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কের ভিডিও ধারণ করেন এবং তাঁর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক না করলে ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখান। এরপর জয়নাল, শুক্কুর ও সোলেমান দিনের পর দিন ওই গৃহবধূকে দলবদ্ধ ধর্ষণ করতে থাকেন। দুই মাসের বেশি সময় ধরে তাদের নির্যাতনে অসুস্থ হয়ে বাধ্য হয়ে স্বামীকে বিস্তারিত ঘটনা জানাই। পরে স্থানীয় মাতব্বরদের কাছে অভিযোগ দিয়েও কোনো বিচার পাইনি।’

এব্যাপারে গৃহবধূর স্বামী বলেন, টাঙ্গাইল থেকে বাড়িতে ফিরে তিনি দেখেন, স্ত্রীর শারীরিক অবস্থা খুবই খারাপ। জিজ্ঞাসা করলে জয়নাল, শুক্কুর ও সোলেমানের ধর্ষণের ঘটনা খুলে বলেন স্ত্রী। ধর্ষণের ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে দিনের পর দিন ধর্ষণ করেন তাঁরা। পরে স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি ও দূরসম্পর্কের এক মামাকে জানিয়ে স্ত্রীকে নিয়ে থানায় মামলা করতে যান। কিন্তু থানায় পৌঁছানোর আগেই রাজীবপুর ইসলামী ব্যাংকের সামনে পুলিশ কনস্টেবল রবিউল ইসলাম, আমেজ উদ্দিন ও জয়নাল পথরোধ করে বাসায় ফিরে যেতে বলেন এবং রাতে বাড়িতে গিয়ে বিচারের আশ্বাস দেন।

গৃহবধূর স্বামী বলেন, ‘আমরা বাসায় ফিরে এলে গত বৃহস্পতিবার (২৩ মে) রাতে কনস্টেবল রবিউল, (পুলিশের) গাড়িচালক মোজাহারুল ইসলাম, জয়নাল, সোলেমান ও শুক্কুর আমার বাড়িতে আসেন। তাঁরা আমাকে ২০ হাজার টাকা দিতে চান এবং বিষয়টি নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেন। আমি টাকা নিতে অস্বীকৃতি জানাই। পরে তাঁরা কোনো সমাধান না দিয়ে চলে যান। সুষ্ঠু বিচার না পাওয়ায় শুক্রবার (২৪ মে) বিকেলে আমরা স্বামী-স্ত্রী আত্মহত্যার জন্য বিষ খাই।’

গৃহবধূর স্বামী অভিযোগ করেন, গত বুধবার স্ত্রীর মৃত্যুর পর স্থানীয় ইউপি সদস্য আনোয়ার হোসেন ও আমেজ উদ্দিন তাঁর বাড়িতে আসেন। তখন শারীরিক অবস্থা ভালো ছিল না। তাঁরা তাঁর কাছ থেকে চিকিৎসার খরচের জন্য এক লাখ টাকা দাবি করেন এবং একটি ফাঁকা স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর করিয়ে নেন। পরে তাঁর পরিবারের পক্ষে কেউ টাকা দিয়েছেন কি না,তিনি জানেন না।

ফাঁকা স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন ইউপি সদস্য আনোয়ার। তিনি বলেন, ওই গৃহবধূ ও তাঁর স্বামীর চিকিৎসার জন্য অনেক টাকা খরচ হয়েছিল। সেই খরচ বাবদ এক লাখ টাকা চাওয়া হয়েছিল। কেন স্ট্যাম্পে চিকিৎসার খরচের বিষয়টি লেখা ছিল না জানতে চাইলে ওই ইউপি সদস্য চুপ করে থাকেন।

আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘ঘটনাটি গোপন ছিল। আমরা জানতাম না। গৃহবধূর স্বামী একেকবার একেক কথা কয়। বিষ খাওয়ার পর চিকিৎসার জন্য জয়নাল ২০ হাজার টাহা দিছে। হের স্বামী নেয় নাই।’

ধর্ষণের ঘটনা পুলিশকে নিয়ে কিভাবে টাকা দিয়ে মীমাংসার সিদ্ধান্ত দিয়েছেন—এমন প্রশ্নের জবাবে এই ওয়ার্ড মেম্বার বলেন, ‘অভিযুক্তরাই মীমাংসার কথা বলেছিল। এখন জয়নাল ও শুক্কুর কই আছে আমার জানা নাই।’

ভুক্তভোগী পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ওই দম্পতি সম্পর্কে খালাতো ভাই-বোন। অভিযোগ রয়েছে, তাঁদের চাচাতো মামা আমেশ অভিযুক্তদের সঙ্গে মিলে আইনি পদক্ষেপ নিতে বাধা দিয়েছিলেন। স্থানীয়ভাবে মীমাংসার আশ্বাস দিয়েছিলেন। এতে সহযোগিতা করেন স্থানীয় ইউপি সদস্য আনোয়ার ও দুই পুলিশ সদস্য।

এ বিষয়ে গৃহবধূর মামা আকবর আলী বলেন, ‘উপজেলার সদর ইউনিয়নের হলপাড়া গ্রামের আবুসামার ছেলে জয়নাল মিয়া এবং তাঁর সহযোগী কারিগরপাড়ার শুক্কুর কসাই, ডাকাতপাড়ার আলম কসাই ও টাঙ্গাইলপাড়ার সোলেমানের নামে থানায় অভিযোগ দিয়েছি। আমরা ন্যায়বিচার চাই।’

অনুসন্ধানে জানা গেছে, জয়নাল ও শুক্কুরকে সহযোগিতা করেছেন ভুক্তভোগী দম্পতির মামা আমেশ ও স্থানীয় মেম্বার আনোয়ার। তাঁরা থানা পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে ধর্ষণের ঘটনাটি মামলা পর্যন্ত গড়াতে দেননি। তাঁদের সহযোগিতা করেছেন পুলিশ কনস্টেবল রবিউল ও থানার ড্রাইভার মাজহারুল।

স্থানীয়রা বলছে, গত ২৫ মে ওই দম্পতি প্রকাশ্যে বিষ পান করার পর তাঁদের রাজিবপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়। সেখানে তাঁদের পাকস্থলী পরিষ্কার করেন চিকিৎসক। পরে সেখান থেকে জামালপুর হাসপাতালে নেওয়া হয়। গৃহবধূর অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় চিকিৎসক ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রেফার করেন। কিন্তু হাতে টাকা না থাকায় এই দম্পতি বাড়ি চলে আসেন। গত বুধবার বাড়িতেই মৃত্যু হয় গৃহবধূর। পরে লাশ উদ্ধার করে থানায় নেয় পুলিশ।

এ বিষয়ে রাজিবপুর থানার ওসি আশিকুর রহমান বলেন, ‘ধর্ষণের ঘটনায় আজই (গতকাল) একটি অভিযোগ পেয়েছি। এর আগে বিষপানের ঘটনায় একটি অপমৃত্যুর মামলা হয়। প্রাথমিক তদন্তে অভিযোগটির সত্যতা পেলে মামলা হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হবে।’

ঘটনার ব্যাপারে গতকাল শুক্রবার রাজীবপুরের ওই ইউনিয়নে গিয়ে এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা হয়। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, গত শুক্রবার বিকেলে ওই গৃহবধূ ও তাঁর স্বামী বিচার না পেয়ে বিষপান করেন। গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় তাঁদের প্রথমে রাজীবপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ও পরে জামালপুর হাসপাতালে নেওয়া হয়। অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় চিকিৎসকেরা তাঁদের ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করার পরামর্শ দেন। কিন্তু হাসপাতালের খরচের টাকা না থাকায় অসুস্থ অবস্থায় ওই দম্পতি বাড়িতে ফিরে আসেন। এরপর গত বুধবার ওই গৃহবধূ মারা যান।

অভিযুক্ত জয়নাল, সোলেমান ও শুক্কুর ঘটনার পর থেকে গা ঢাকা দিয়েছেন। তাঁদের বাড়ি বা মাংসের দোকানে গিয়েও তাঁদের পাওয়া যায়নি। অভিযোগের বিষয়ে জয়নাল ও সোলেমানের মুঠোফোন নম্বরে একাধিকবার কল করলেও বন্ধ পাওয়া যায়।

অভিযুক্ত আমেজ উদ্দিন ধর্ষণের ঘটনা ধামাচাপা দিতে মীমাংসার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তাঁর বাড়িতে গিয়ে স্বজনদের পাওয়া গেলেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। স্বজনদের কাছে তাঁর মুঠোফোন নম্বর চাইলে তাঁরা দিতে অস্বীকৃতি জানান।

রাজীবপুর থানায় গিয়ে কনস্টেবল রবিউল ইসলামের সঙ্গে কথা হয়। অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, অভিযুক্ত জয়নালের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল। জয়নাল একজনের কাছে টাকা পাবেন বলে তাঁকে ডেকে নিয়ে ওই গৃহবধূর বাড়িতে যান। তিনি ওই বাড়িতে গিয়ে ঘটনা জানতে পারেন। পরে তিনি সেখান থেকে চলে আসেন।

রাজীবপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আশিকুর রহমান বলেন, এখন পর্যন্ত ধর্ষণের কোনো অভিযোগ পাননি। স্বামী-স্ত্রী বিষপান করেছিলেন। এর মধ্যে স্ত্রীর মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা হয়েছে।

কনস্টেবল ও গাড়িচালকের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের বিষয়ে ওসি বলেন, ‘জয়নাল একজনের কাছে টাকা পান, সেটি তুলতে যাওয়ার কথা বলে মোজাহারুলকে ওই বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন বলে শুনেছি। কোনো পুলিশ সদস্যের ব্যক্তিগত অপরাধের দায় পুরো পুলিশ প্রশাসন নেবে না। যদি কোনো পুলিশ সদস্য ওই গৃহবধূর বাড়িতে কোনো অপরাধে জড়িত থাকেন, তার দায় সেই সদস্যের।’