সোহাগ হত্যা: নেপথ্যে ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব-দখল

- Update Time : ১১:৩৮:১৮ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৩ জুলাই ২০২৫
- / ৬২ Time View
রাজধানীর পুরান ঢাকায় ব্যবসায়ীকে পাথর মেরে নৃশংসভাবে হত্যার ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতার ও দ্রুত বিচার সম্পন্ন করার দাবি উঠেছে সর্বত্র। শুক্রবার রাতে ও শনিবার সারা দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ক্যাম্পাসসহ বিভিন্ন জায়গায় হত্যার প্রতিবাদ করছেন সাধারণ মানুষ। এরই মধ্যে এ হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত পাঁচজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ ও র্যাব।
এদের মধ্যে গ্রেফতারকৃত তারেক রহমান রবিন হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। পুলিশের দাবি, ভাঙ্গারি ব্যবসা দখল ও চাঁদাবাজি নিয়ে দ্বন্দ্ব চলছিল। হত্যাকান্ডের শিকার সোহাগ এবং হত্যাকান্ড যারা ঘটিয়েছে তাদের একসঙ্গে ব্যবসাও ছিল। সোহাগকে হত্যা করা হয়েছে দীর্ঘদিন ধরে চলা ব্যবসার দখল দ্বন্দ্ব ও চাঁদাবাজির জেরে।
গ্রেফতারকৃতরা হলো মাহমুদুল হাসান মহিন (৪১), তারেক রহমান রবিন (২২), মো. টিটন গাজী (৩২), আলমগীর (২৮) ও লম্বা মনির। তবে এজাহারভুক্ত অন্য আসামিরা এখনো পলাতক। তাদের ধরতে অভিযান চলছে। সোহাগকে নৃশংসভাবে হত্যার ঘটনায় জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী।
নিহতের স্ত্রী লাকি বেগম বলেন, আমার স্বামীর ব্যবসা সহ্য হচ্ছিল না ওদের। দীর্ঘদিন ধরেই আমার স্বামীর দোকান থেকে চাঁদা দাবি করে আসছিল হত্যাকারীরা। তারা প্রতি মাসে দুই লাখ করে টাকা চাইছিল। আমার স্বামী তা দিতে চায়নি। শেষমেশ আমার স্বামীকে মেরেই ফেলল। শুক্রবার ঢাকা থেকে নিহত লালচাঁদ ওরফে সোহাগের লাশ বরগুনায় নিয়ে যান স্বজনরা। পরে নানা বাড়ির পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। তার মৃত্যুতে এলাকায় নেমে এসেছে শোকের ছায়া, চলছে স্বজনদের আহাজারি।
স্থানীয় একাধিক ব্যবসায়ী জানান, মহিন-অপু সিন্ডিকেট দীর্ঘদিন ধরেই মিটফোর্ড এলাকায় চাঁদাবাজি ও ব্যবসা দখলের রাজত্ব কায়েম করে। কেউ প্রতিবাদ করলে তাদের ওপর নেমে আসে ভয়াবহ হামলা। প্রকাশ্যে অস্ত্র উঁচিয়ে ভয়-ভীতি দেখানো ছিল নিয়মিত ঘটনা। গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই চকবাজার ও মিটফোর্ড এলাকায় সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন মহিন ও অপু দাস। বিভিন্ন অবৈধ ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ, অস্ত্রবাজি, চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন ব্যবসায়ীরা। ফুটপাথ দখল করে দোকান থেকে এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে হুমকি দিয়ে চাঁদা তোলা ছিল তাদের নিত্যদিনের কাজ। যারাই চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানাতেন তাদেরই মারধর করা হতো এবং দোকান বন্ধ করে দেয়া হতো।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুরান ঢাকার এক ব্যবসায়ী বলেন, এখন ভাবি, আমরা যদি সেদিন চুপ না থাকতাম, একসঙ্গে প্রতিবাদ করতাম, তাহলে হয়তো সোহাগ বেঁচে থাকতেন। কিন্তু আমরা ভয়ের কারণে আগাতে পারিনি। এ কথা মনে পড়লে অনুশোচনা হয়। আমরা চাই এমন নৃশংসতার পুনরাবৃত্তি না ঘটুক। চাঁদাবাজ আর সন্ত্রাসীদের যেন কঠোর থেকে কঠোরতম শাস্তি হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুরান ঢাকার অপর এক ব্যবসায়ী বলেন, সোহাগ কয়েক মাস আগে ওই এলাকায় দোকান ভাড়া নেন। প্রায় চার মাস ধরে মাহমুদুল হাসান (মহিন), ছোট মনির, আলমগীরসহ কয়েকজন সোহাগের কাছে প্রতি মাসে তিন লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন। পরে বিএনপির এক নেতার মধ্যস্থতায় মাসে দুই লাখ টাকায় রফা হয়। গত বুধবার বিকেলে সোহাগের কাছে তারা চাঁদা নিতে আসে। চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালে তাকে দোকান থেকে তুলে নিয়ে যায়। পরে তাকে হত্যা করা হয়।
সূত্রে জানা গেছে, সোহাগ একসময় মহিনের সঙ্গে চলাফেরা করলেও এলাকায় বিদ্যুতের তামার তার ও সাদা তারের অবৈধ ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে শুরু হয় দ্বন্দ্ব। তামার তার ও সাদা তারের ব্যবসার সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণ ছিল সোহাগের কাছে। সেটির নিয়ন্ত্রণ নিতে মরিয়া ছিল মহিন, অপু, সারোয়ার হোসেন টিটু ও রজ্জব আলী পিন্টুসহ মিটফোর্ড হাসপাতালের একটি চক্র। তারা ওই অবৈধ বাণিজ্যের ৫০ শতাংশের নিয়ন্ত্রণ চেয়েছিল। তা নাহলে নিয়মিত চাঁদা দেয়ার দাবি জানিয়েছিল। এর জেরেই দ্বন্দ্ব এবং নৃশংস হত্যাকা- বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যবসায়ী জানান, সোহাগকে হত্যার কয়েক দিন আগেও এক অ্যাম্বুলেন্স ব্যবসায়ীকে চাঁদার জন্য সবার সামনে বেধড়ক মারধর করেন মহিন ও অপু দাস। এছাড়াও গত মার্চ মাসে রজ্জব আলী পিন্টু, রবিন এবং আরো বেশ কয়েকজন স্থানীয় বিএনপি নেতা ইসহাক আলী সরকারের নেতৃত্বে গোলাগুলি ও ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ব্যবসায়ীদের ওপর চাঁদার জন্য হামলা করে। এই ঘটনায় চকবাজার থানায় তাদের বিরুদ্ধে বিস্ফোরকদ্রব্য আইনে মামলাও হয়। গ্রেফতারদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বরাতে লালবাগ বিভাগের ডিসি মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন বলেন, ভাঙ্গারি ব্যবসা এবং দোকানে কারা ব্যবসা করবে সেটি নিয়ে দ্বন্দ্ব চলছিল। হত্যাকান্ডের শিকার সোহাগ এবং যারা হত্যাকান্ডটি ঘটিয়েছে তারা একসঙ্গে কিছুদিন ব্যবসা করেছে। যখন ব্যবসা লেনদেন নিয়ে দ্বন্দ্ব তৈরি হয় তখনই তারা বিবাদে লিপ্ত হয়। এর ফলে হত্যাকান্ডটি সংঘটিত হয়।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে মোহাম্মদ জসীম বলেন, গত বুধবার বিকেল ৬টার দিকে রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের তিন নম্বর গেটের সামনে একদল লোক লালচাঁদ ওরফে সোহাগ নামের এক ব্যক্তিকে এলোপাতাড়ি আঘাত করে ও কুপিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে। ঘটনার সংবাদ পাওয়ার পর কোতোয়ালি থানা পুলিশ দ্রুত ঘটনাস্থলে যায় এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। পরে ১০ জুলাই এ ঘটনায় নিহতের বড় বোন বাদী হয়ে কোতোয়ালি থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। পুলিশ নিহতের সুরতহাল প্রতিবেদন প্রস্তুত করে এবং ময়নাতদন্তের জন্য হাসপাতালের মর্গে পাঠায়। পুলিশ ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে এবং রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে অভিযান পরিচালনা করে এজাহারভুক্ত আসামি মাহমুদুল হাসান মহিন ও তারেক রহমান রবিনকে গ্রেফতার করে। এ সময় গ্রেফতার তারেক রহমান রবিনের কাছ থেকে একটি বিদেশি পিস্তল উদ্ধার করা হয়। এই ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে র্যাব আলমগীর ও মনির ওরফে ছোট মনির নামের আরো দুজনকে গ্রেফতার করেছে।
লালবাগ বিভাগের ডিসি আরো বলেন, এ ঘটনায় পুলিশ অত্যন্ত তৎপর রয়েছে। এই চাঞ্চল্যকর ঘটনায় মূল রহস্য উৎঘাটন, সংশ্লিষ্ট সব অপরাধী গ্রেফতার এবং সোহাগ কেন এই ঘটনার শিকার হলো তা উদঘাটনের জন্য একটি চৌকস টিম গঠন করা হয়েছে। ঘটনার প্রকৃত কারণ অনুসন্ধানে এবং ঘটনার সঙ্গে জড়িত অন্যান্যদের গ্রেফতারে পুলিশি অভিযান অব্যাহত রয়েছে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, এ হত্যার ঘটনাটা বড়ই দুঃখজনক। একটা সভ্য দেশে এমন একটি ঘটনা কখনোই আশা করা যায় না। এটার জন্য যারা দায়ী, তাদের পাঁচজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ঘটনার সঙ্গে জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে। আমরা খুব অসহিষ্ণু হয়ে গেছি। এই অসহিষ্ণুতা আমাদের কমিয়ে আনতে হবে। সমাজের নীতি-নির্ধারক, অভিভাবক, শিক্ষক, চিকিৎসক সবার চেষ্টায় এই সহিংসতা কমিয়ে আনতে হবে।
তিনি বলেন, আমরা সবাইকে অনুরোধ করছি, কেউ যেন আইন নিজের হাতে তুলে না নেয়। কোনো ঘটনা ঘটলে সেটি যেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে জানানো হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সেটার যথাযথ ব্যবস্থা নেবে।
র্যাব ডিজি এ কে এম শহিদুর রহমান বলেন, গত ৯ জুলাই মিটফোর্ড হাসপাতালের তিন নম্বর গেটের সামনে ভাঙ্গারি ব্যবসায়ী মো. সোহাগ হত্যার ঘটনা ঘটে। হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটন ও জড়িতদের আইনের আওতায় নিয়ে আসতে র্যাব গোয়েন্দা নজদারি বৃদ্ধি করে। এরই ধারাবাহিকতায় শুক্রবার কেরানীগঞ্জ এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত ৪ নং এজাহানামীয় আসামি আলমগীর (২৮) ও ৫ নং এজাহারনামীয় আসামি মনির ওরফে লম্বা মনিরকে (৩২) গ্রেফতার করা হয়।
এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চাইলে তিনি বলেন, মিটফোর্ডে যে ঘটনাটি সংগঠিত হয়েছে, এর মূল তদন্ত ডিএমপি করছে। তারাই তদন্ত করে এর সঙ্গে জড়িত, কিভাবে সম্পন্ন বিষয়টি বের করবে। আমরা (র্যাব) ছায়া তদন্তের মাধ্যমে আমরা ডিএমপিকে সহায়তা করছি। আমরা আমাদের ছায়া তদন্ত গোপনে চালিয়ে যাচ্ছি। প্রাথমিকভাবে জানা গেছে, ঘটনাটি স্থানীয় ব্যবসা বাণিজ্য ও চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে ঘটেছে।
পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, মাত্র সাত মাস বয়সে বজ্রপাতে সোহাগের বাবা আইউব আলী মারা যান। এরপর তার মা আলেয়া বেগম জীবিকার তাগিদে সন্তানদের নিয়ে ঢাকায় চলে যান। ঢাকায় থেকেই সোহাগ বড় হয়েছেন এবং মেসার্স সোহানা মেটাল নামের একটি দোকান পরিচালনা করতেন পুরান ঢাকার মিটফোর্ড এলাকায়। দীর্ঘদিন ধরে দোকান থেকে প্রতি মাসে দুই লাখ টাকা চাঁদা দাবি করছিল একটি সন্ত্রাসী চক্র। চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানানোয় বুধবার বিকেলে সোহাগকে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে গিয়ে আটকে রাখে তারা। এতেও চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালে সোহাগকে নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে পাথর মেরে হত্যা করা হয় বলে জানান স্বজনরা।