ঢাকা ০৫:০১ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সিলেটে বন্যার জন্য অলওয়েদার সড়ক কতটা দায়ী?

মো.মুহিবুর রহমান, সিলেট
  • Update Time : ০৬:০১:২৪ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৫ জুন ২০২৪
  • / ১০৮ Time View

কিশোরগঞ্জের হাওরে নির্মিত ইটনা-মিঠামইন সড়ক।

অতীতেও অতি ভারী বৃষ্টি হয়েছে, ভারতীয় ঢল নেমেছে। বন্যাও হয়েছে সিলেটে। কিন্তু অল্প সময়ে এমন বন্যা অতীতে কখনো হয়নি। সিলেট নগরও এমনভাবে ডুবে যায়নি। যেমনটা হয়েছে ২০২২ সালে এবং এবারও। এ প্রশ্নের জবাব খুঁজছেন বিশেষজ্ঞরা। এখন কেন বারবার ডুবছে সিলেট? এ জন্য কিশোরগঞ্জের হাওরের বুকে নির্মিত ইটনা-মিঠামইন সড়ককে দায়ী করছেন অনেকে। ২০২২ সালে প্রায় অর্ধকোটি মানুষ ছিলেন পানিবন্দী। আর এ সপ্তাহে সৃষ্ট বন্যায় সিলেটের চার জেলার ২২ লাখ মানুষ এখন পানিবন্দী। তবে ভোগান্তি ও দুর্ভোগ ২০২২ এর চেয়ে কোন অংশে কম নয়।

সিলেটে সাম্প্রতিক ঘন ঘন বন্যার জন্য কিশোরগঞ্জের হাওরের বুকে নির্মিত ইটনা-মিঠামইন সড়ককে দায়ী করছেন অনেকে। সড়কটি ‘অলওয়েদার সড়ক’ নামে পরিচিত। বিশেষত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই সিলেটের বন্যার জন্য এই সড়ককে দায়ী করছেন। তাদের দাবি,সিলেটে আগেও এরকম প্রচুর বৃষ্টি হতো। কিন্তু এমন বন্যা হতো না। এখন কিশোরগঞ্জের এই সড়কটির কারণে সিলেটের বৃষ্টি ও ঢলের পানি হাওর দিয়ে নদীতে নামতে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। ফলে পানি আটকে বন্যার সৃষ্টি হচ্ছে। হাওরের বিশাল জলরাশির বুক চিরে ৮৭৪.০৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ২৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার দীর্ঘ আলোচিত এই সড়কটি নির্মিত হয় ২০২০ সালে। হাওরের তিন উপজেলার যোগাযোগ সহজতর করার পাশাপাশি এই সড়কটি পর্যটকদের কাছেও আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। সিলেটে ২০২২ সালে বন্যার পরও আলোচনায় উঠে আসে এই সড়ক। সেই আলোচনা তখন মন্ত্রিসভা পর্যন্ত গড়ায়। হাওরাঞ্চলে বন্যায় এই সড়কের কোনো প্রভাব রয়েছে কী না তা খতিয়ে দেখতে বলা হয় মন্ত্রিসভার বৈঠকে। এরপর পানি বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাতের নেতৃত্বে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়। এ ব্যাপারে ড. আইনুন নিশাত বলেন, ‘কিশোরগঞ্জের এই সড়কটি সিলেটে বন্যা সৃষ্টির কারণ বলে মনে হয় না। এখনও সেই সড়কের প্রভাব তেমন পড়েনি। তবে হাওরে এ ধরনের সড়ক নির্মাণের ক্ষতিকর প্রভাব তো আছেই। ভবিষ্যতে এর প্রভাব পড়তে পারে।’ তিনি বলেন, ‘এই সড়কের কারণে কয়েক বছর পর ওই এলাকার হাওর ও বিল ভরাট হয়ে যেতে পারে। তখন সিলেট অঞ্চলে প্রভাব পড়বে। সিলেট শহর রক্ষার জন্য নদীর তীরে বাঁধ প্রয়োজন।’

ভারতের মেঘালয় ও আসাম থেকে নেমে আসা ঢলের পানি সিলেট অঞ্চলের নদী ও হাওর হয়ে কিশোরগঞ্জে মেঘনা নদীতে গিয়ে মেশে। অলওয়েদার সড়কের অবস্থানও কিশোরগঞ্জে। এই সড়কের কারণে পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে কী না তা খতিয়ে দেখতে বড় ধরনের সমীক্ষার দাবি উঠেছে। কিশোরগঞ্জের সড়ক ও জনপথ বিভাগের তথ্যমতে, ২৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার দীর্ঘ এই অলওয়েদার সড়কে ৫৯০ দশমিক ৪৭ মিটার দীর্ঘ তিনটি পিসিগার্ডার, ১৯০ মিটার দীর্ঘ ৬২টি আরসিসি বক্স কালভার্ট, ২৬৯ দশমিক ৬৮ মিটার দীর্ঘ ১১টি আরসিসি গার্ডার ব্রিজ রয়েছে।

সওজের প্রকৌশলীরা জানান, সিলেটের পানি দুই-তিনটি নদী দিয়ে নামে। একটি প্রবাহ সুরমা ও পুরাতন সুরমা হয়ে নামে ধনু নদী দিয়ে। সুনামগঞ্জের পানিও এই নদী দিয়ে নামে। নদীটির অবস্থান অলওয়েদার সড়কের সমান্তরালে। সিলেট অঞ্চলের আরেক নদী কুশিয়ারা হাওরে এসে হয়েছে কালিনী নদী। এটি সড়কের আরেক পাশ দিয়ে নামে। ফলে অল ওয়েদার সড়ক পানি নামতে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে না।

সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর কিশোরগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী নিতেশ বড়ুয়া বলেন, ‘পানিপ্রবাহের জন্য সড়কে অনেক সেতু আছে। তাছাড়া এই সড়কের কারণে পানি আটকে থাকলে তো সড়কের আশপাশ এখন পানিতে টুইটম্বুর থাকতো। এমনটিও নেই।’

পরিবেশ বিজ্ঞানী ও পানিসম্পদ বিশেষজ্ঞ ড. মো. খালেকুজ্জামান যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভেনিয়া অঙ্গরাজ্যের লক হ্যাভেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত। কিশোরগঞ্জের এই সড়ক নিয়ে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সড়ক নির্মাণের আগে যথাযথ পরিবেশগত সমীক্ষা চালানো হয়নি। সড়কটি নির্মাণের আগেই আমি এর বিরোধিতা করেছিলাম।’

তিনি বলেন, ‘হাওরের বৈশিষ্ট্য হলো জলের অবাধ প্রবাহ। আমি প্রস্তাব করেছিলাম, সড়ক যদি নির্মাণ করতেই হয় তাহলে যেন ৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সড়কের অন্তত ৩০ ভাগ জায়গা উঁচু সেতু বা উড়াল সড়ক আকারে বানিয়ে পানিপ্রবাহের সুযোগ রাখা হয়। এ বিষয়ে তখন একটি লিখিত প্রস্তাবও দিয়েছিলাম।‘এছাড়া এই সড়কের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, এটি একা দাঁড়িয়ে থাকা এক সড়ক, এই সড়ক ব্যাপক অর্থে কোনো কানেক্টিভিটি তৈরি করছে না। তাই এই সড়ক নির্মাণের আবশ্যকতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।’ ২০২৩ সালে পরিকল্পনামন্ত্রী থাকাকালে এক অনুষ্ঠানে সুনামগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ সদস্য এমএ মান্নান হাওরের এসব সড়ক নর্মাণ ভুল ছিলো বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেছিলেন, ‘হাওরের মাঝখানে সড়ক নির্মাণ করা ঠিক হয়নি। এখন টের পাচ্ছি, হাওরে সড়ক নির্মাণ করে নিজেদের পায়ে কুড়াল মেরেছি। হাওরে সড়ক বানিয়ে উপকারের চেয়ে অপকারই হয়েছে।’ এ ব্যাপারে বৃহস্পতিবার এম এ মান্নান বলেন, ‘সিলেটে বন্যার জন্য এই সড়কই দায়ী- এমনটি বললে সরলীকরণ হয়ে যাবে। হাওরে এমন অসংখ্য স্থাপনা হয়েছে। তাছাড়া মিঠামইন সড়কের অবস্থান সিলেট ও সুনামগঞ্জ থেকে অনেক দূরে। ‘তবে এখন থেকে হাওরে আর কোনো সড়ক নির্মাণ করা হবে না। শুধু উড়াল সেতু নির্মাণ করা হবে।

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. গোলাম মো. মুন্না জানান, সিলেট অঞ্চলে ঘন ঘন বন্যার কারণ আসলে দুই ধরনের। প্রথমটি প্রাকৃতিক ও দ্বিতীয়টি কৃত্রিম। তিনি বলেন, প্রকৃতির বিরূপ আচরণ যেমন দায়ী তেমনি আমাদের ভূমিকাও নেহায়েত কম নয়। ভারতের মেঘালয়ে অতি বৃষ্টি থেকে যে পানি আসে, সেটি বেশির ভাগই সুরমা ও কুশিয়ারা বয়ে নিয়ে যায়। তবে বর্তমানে বেশি পরিমাণ পানি প্রবাহের সক্ষমতা আমাদের নদীগুলোর নেই। এর মূল কারণ নদীর নাব্যতা সংকট। এছাড়া কৃত্রিম কারণের মধ্যে রয়েছে- অপরকল্পিত নগরায়ন, দুর্বল ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনা। এর ফলে সম্প্রতি সিলেট অঞ্চল ঘন ঘন বন্যা পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছে।

বন্যা প্রসঙ্গে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান হাওলাদার জানান, সিলেট ও সুনামগঞ্জের ওপর দিয়ে প্রবহমান নদীগুলো দখলের কারণে সংকুচিত হয়ে পড়েছে। অপরিকল্পিত বালু ও পাথর উত্তোলনসহ নানা কারণে নদীগুলো ভরাট হয়ে গেছে। নদীর গতিপথ পাল্টেছে। উত্তর থেকে আসা পানি বহন করার ক্ষমতা হারিয়েছে নদীগুলো। এখনকার বন্যার এটাই প্রধান কারণ।

এ অবস্থায় গত শুক্রবার আশার কথা শুনালেন পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক। তিনি বললেন, সিলেটবাসীকে বন্যার কবল থেকে রক্ষা করতে সবধরনের পদক্ষেপ গ্রহনের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

সুরমা নদী পরিদর্শনকালে পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী বলেন, আগামীতে সিলেট-সুনামগঞ্জের বন্যা কবলিত এলাকা কিভাবে সহনীয় পর্যায় নিয়ে আসতে পারি সে লক্ষে আমরা আলোচনা করেছি। ইতিমধ্যে সুরমা নদীর ১৫ কিলোমিটারের মধ্যে ১২ কিলোমিটার খনন কাজ সম্পন্ন হয়েছে। বন্যার পানি কমে গেলে বাকিটুকু খনন করা হবে। এছাড়াও সামগ্রীক ভাবে সুরমা-কুশিয়ারা নদী খনন করবো। সুনামগেঞ্জর ছোট বড় ২০টি নদী আমরা খনন করবো।

এদিকে, পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক গত বৃহস্পতিবার নগরের টুকেরবাজার এলাকার শাদীখাল পরিদর্শন করেছেন। পরিদর্শনকালে তিনি জানান, সিলেট বিভাগে ভয়াবহ বন্যার কারণ হিসেবে অনেকে কিশোরগঞ্জের ইটনা-অষ্টগ্রাম-মিঠামইনের অল-ওয়েদার সড়ককে দায়ী করছেন। ওই সড়কের কারণে পানি আটকে গেলে তা নামানোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি আরো বলেন, ‘মিঠামইনে যেটা হয়েছে, সেটার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, “নদীর পানি যাতে পাস করে সে ব্যবস্থা আমরা করব। এবারের বর্ষার সময় আমরা দেখব, পানি আটকে যায় কি না? যদি আটকে যায়, সেটার জন্য আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করব।” সিলেট নগরকে আগাম বন্যার কবল থেকে রক্ষা করতে সুরমা নদী ড্রেজিং করা হবে। তিনি বলেন, দেশের ৯টি স্থানে ড্রেজিং স্টেশন তৈরি করা হচ্ছে। নদী ভাঙন, পলিমাটি অপসারণে নিয়মিত নদী খনন করা হবে। নদীতে পলিথিন থাকার ফলে এর আগেও ড্রেজিং কাজ ব্যাহত হয়েছিল। এ জন্য পলিথিন ব্যবহারের বিষয়ে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। পরিদর্শনকালে সিটি মেয়র মোহাম্মদ আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন ওয়ার্ডের কাউন্সিলররা উপস্থিত ছিলেন।

বন্যায় এবার অনেকটা ফিকে হয়ে গেলো ঈদের আনন্দ। মানুষজন স্বাচ্ছন্দে দিতে পারেননি কোরবানী, যেতে পারেননি ঈদগাহে। ঈদের আনন্দকে রেখে মানুষকে লড়াই করতে হয় পানির সাথে।জেলা প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, সিলেট নগরের ২৮টি ওয়ার্ডের ১ লাখ মানুষ বন্যাকবলিত। এছাড়া সিলেট জেলার ১৩ উপজেলায় বন্যা আক্রান্ত সাড়ে ১০ লাখ, সুনামগঞ্জ জেলার ১১ উপজেলায় ৮ লাখ, মৌলভীবাজার জেলায় ৩ লাখ ও হবিগঞ্জ জেলায় ১ লাখ মানুষ পানিবন্দী।

Please Share This Post in Your Social Media

সিলেটে বন্যার জন্য অলওয়েদার সড়ক কতটা দায়ী?

মো.মুহিবুর রহমান, সিলেট
Update Time : ০৬:০১:২৪ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৫ জুন ২০২৪

অতীতেও অতি ভারী বৃষ্টি হয়েছে, ভারতীয় ঢল নেমেছে। বন্যাও হয়েছে সিলেটে। কিন্তু অল্প সময়ে এমন বন্যা অতীতে কখনো হয়নি। সিলেট নগরও এমনভাবে ডুবে যায়নি। যেমনটা হয়েছে ২০২২ সালে এবং এবারও। এ প্রশ্নের জবাব খুঁজছেন বিশেষজ্ঞরা। এখন কেন বারবার ডুবছে সিলেট? এ জন্য কিশোরগঞ্জের হাওরের বুকে নির্মিত ইটনা-মিঠামইন সড়ককে দায়ী করছেন অনেকে। ২০২২ সালে প্রায় অর্ধকোটি মানুষ ছিলেন পানিবন্দী। আর এ সপ্তাহে সৃষ্ট বন্যায় সিলেটের চার জেলার ২২ লাখ মানুষ এখন পানিবন্দী। তবে ভোগান্তি ও দুর্ভোগ ২০২২ এর চেয়ে কোন অংশে কম নয়।

সিলেটে সাম্প্রতিক ঘন ঘন বন্যার জন্য কিশোরগঞ্জের হাওরের বুকে নির্মিত ইটনা-মিঠামইন সড়ককে দায়ী করছেন অনেকে। সড়কটি ‘অলওয়েদার সড়ক’ নামে পরিচিত। বিশেষত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই সিলেটের বন্যার জন্য এই সড়ককে দায়ী করছেন। তাদের দাবি,সিলেটে আগেও এরকম প্রচুর বৃষ্টি হতো। কিন্তু এমন বন্যা হতো না। এখন কিশোরগঞ্জের এই সড়কটির কারণে সিলেটের বৃষ্টি ও ঢলের পানি হাওর দিয়ে নদীতে নামতে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। ফলে পানি আটকে বন্যার সৃষ্টি হচ্ছে। হাওরের বিশাল জলরাশির বুক চিরে ৮৭৪.০৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ২৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার দীর্ঘ আলোচিত এই সড়কটি নির্মিত হয় ২০২০ সালে। হাওরের তিন উপজেলার যোগাযোগ সহজতর করার পাশাপাশি এই সড়কটি পর্যটকদের কাছেও আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। সিলেটে ২০২২ সালে বন্যার পরও আলোচনায় উঠে আসে এই সড়ক। সেই আলোচনা তখন মন্ত্রিসভা পর্যন্ত গড়ায়। হাওরাঞ্চলে বন্যায় এই সড়কের কোনো প্রভাব রয়েছে কী না তা খতিয়ে দেখতে বলা হয় মন্ত্রিসভার বৈঠকে। এরপর পানি বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাতের নেতৃত্বে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়। এ ব্যাপারে ড. আইনুন নিশাত বলেন, ‘কিশোরগঞ্জের এই সড়কটি সিলেটে বন্যা সৃষ্টির কারণ বলে মনে হয় না। এখনও সেই সড়কের প্রভাব তেমন পড়েনি। তবে হাওরে এ ধরনের সড়ক নির্মাণের ক্ষতিকর প্রভাব তো আছেই। ভবিষ্যতে এর প্রভাব পড়তে পারে।’ তিনি বলেন, ‘এই সড়কের কারণে কয়েক বছর পর ওই এলাকার হাওর ও বিল ভরাট হয়ে যেতে পারে। তখন সিলেট অঞ্চলে প্রভাব পড়বে। সিলেট শহর রক্ষার জন্য নদীর তীরে বাঁধ প্রয়োজন।’

ভারতের মেঘালয় ও আসাম থেকে নেমে আসা ঢলের পানি সিলেট অঞ্চলের নদী ও হাওর হয়ে কিশোরগঞ্জে মেঘনা নদীতে গিয়ে মেশে। অলওয়েদার সড়কের অবস্থানও কিশোরগঞ্জে। এই সড়কের কারণে পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে কী না তা খতিয়ে দেখতে বড় ধরনের সমীক্ষার দাবি উঠেছে। কিশোরগঞ্জের সড়ক ও জনপথ বিভাগের তথ্যমতে, ২৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার দীর্ঘ এই অলওয়েদার সড়কে ৫৯০ দশমিক ৪৭ মিটার দীর্ঘ তিনটি পিসিগার্ডার, ১৯০ মিটার দীর্ঘ ৬২টি আরসিসি বক্স কালভার্ট, ২৬৯ দশমিক ৬৮ মিটার দীর্ঘ ১১টি আরসিসি গার্ডার ব্রিজ রয়েছে।

সওজের প্রকৌশলীরা জানান, সিলেটের পানি দুই-তিনটি নদী দিয়ে নামে। একটি প্রবাহ সুরমা ও পুরাতন সুরমা হয়ে নামে ধনু নদী দিয়ে। সুনামগঞ্জের পানিও এই নদী দিয়ে নামে। নদীটির অবস্থান অলওয়েদার সড়কের সমান্তরালে। সিলেট অঞ্চলের আরেক নদী কুশিয়ারা হাওরে এসে হয়েছে কালিনী নদী। এটি সড়কের আরেক পাশ দিয়ে নামে। ফলে অল ওয়েদার সড়ক পানি নামতে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে না।

সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর কিশোরগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী নিতেশ বড়ুয়া বলেন, ‘পানিপ্রবাহের জন্য সড়কে অনেক সেতু আছে। তাছাড়া এই সড়কের কারণে পানি আটকে থাকলে তো সড়কের আশপাশ এখন পানিতে টুইটম্বুর থাকতো। এমনটিও নেই।’

পরিবেশ বিজ্ঞানী ও পানিসম্পদ বিশেষজ্ঞ ড. মো. খালেকুজ্জামান যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভেনিয়া অঙ্গরাজ্যের লক হ্যাভেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত। কিশোরগঞ্জের এই সড়ক নিয়ে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সড়ক নির্মাণের আগে যথাযথ পরিবেশগত সমীক্ষা চালানো হয়নি। সড়কটি নির্মাণের আগেই আমি এর বিরোধিতা করেছিলাম।’

তিনি বলেন, ‘হাওরের বৈশিষ্ট্য হলো জলের অবাধ প্রবাহ। আমি প্রস্তাব করেছিলাম, সড়ক যদি নির্মাণ করতেই হয় তাহলে যেন ৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সড়কের অন্তত ৩০ ভাগ জায়গা উঁচু সেতু বা উড়াল সড়ক আকারে বানিয়ে পানিপ্রবাহের সুযোগ রাখা হয়। এ বিষয়ে তখন একটি লিখিত প্রস্তাবও দিয়েছিলাম।‘এছাড়া এই সড়কের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, এটি একা দাঁড়িয়ে থাকা এক সড়ক, এই সড়ক ব্যাপক অর্থে কোনো কানেক্টিভিটি তৈরি করছে না। তাই এই সড়ক নির্মাণের আবশ্যকতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।’ ২০২৩ সালে পরিকল্পনামন্ত্রী থাকাকালে এক অনুষ্ঠানে সুনামগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ সদস্য এমএ মান্নান হাওরের এসব সড়ক নর্মাণ ভুল ছিলো বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেছিলেন, ‘হাওরের মাঝখানে সড়ক নির্মাণ করা ঠিক হয়নি। এখন টের পাচ্ছি, হাওরে সড়ক নির্মাণ করে নিজেদের পায়ে কুড়াল মেরেছি। হাওরে সড়ক বানিয়ে উপকারের চেয়ে অপকারই হয়েছে।’ এ ব্যাপারে বৃহস্পতিবার এম এ মান্নান বলেন, ‘সিলেটে বন্যার জন্য এই সড়কই দায়ী- এমনটি বললে সরলীকরণ হয়ে যাবে। হাওরে এমন অসংখ্য স্থাপনা হয়েছে। তাছাড়া মিঠামইন সড়কের অবস্থান সিলেট ও সুনামগঞ্জ থেকে অনেক দূরে। ‘তবে এখন থেকে হাওরে আর কোনো সড়ক নির্মাণ করা হবে না। শুধু উড়াল সেতু নির্মাণ করা হবে।

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. গোলাম মো. মুন্না জানান, সিলেট অঞ্চলে ঘন ঘন বন্যার কারণ আসলে দুই ধরনের। প্রথমটি প্রাকৃতিক ও দ্বিতীয়টি কৃত্রিম। তিনি বলেন, প্রকৃতির বিরূপ আচরণ যেমন দায়ী তেমনি আমাদের ভূমিকাও নেহায়েত কম নয়। ভারতের মেঘালয়ে অতি বৃষ্টি থেকে যে পানি আসে, সেটি বেশির ভাগই সুরমা ও কুশিয়ারা বয়ে নিয়ে যায়। তবে বর্তমানে বেশি পরিমাণ পানি প্রবাহের সক্ষমতা আমাদের নদীগুলোর নেই। এর মূল কারণ নদীর নাব্যতা সংকট। এছাড়া কৃত্রিম কারণের মধ্যে রয়েছে- অপরকল্পিত নগরায়ন, দুর্বল ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনা। এর ফলে সম্প্রতি সিলেট অঞ্চল ঘন ঘন বন্যা পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছে।

বন্যা প্রসঙ্গে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান হাওলাদার জানান, সিলেট ও সুনামগঞ্জের ওপর দিয়ে প্রবহমান নদীগুলো দখলের কারণে সংকুচিত হয়ে পড়েছে। অপরিকল্পিত বালু ও পাথর উত্তোলনসহ নানা কারণে নদীগুলো ভরাট হয়ে গেছে। নদীর গতিপথ পাল্টেছে। উত্তর থেকে আসা পানি বহন করার ক্ষমতা হারিয়েছে নদীগুলো। এখনকার বন্যার এটাই প্রধান কারণ।

এ অবস্থায় গত শুক্রবার আশার কথা শুনালেন পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক। তিনি বললেন, সিলেটবাসীকে বন্যার কবল থেকে রক্ষা করতে সবধরনের পদক্ষেপ গ্রহনের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

সুরমা নদী পরিদর্শনকালে পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী বলেন, আগামীতে সিলেট-সুনামগঞ্জের বন্যা কবলিত এলাকা কিভাবে সহনীয় পর্যায় নিয়ে আসতে পারি সে লক্ষে আমরা আলোচনা করেছি। ইতিমধ্যে সুরমা নদীর ১৫ কিলোমিটারের মধ্যে ১২ কিলোমিটার খনন কাজ সম্পন্ন হয়েছে। বন্যার পানি কমে গেলে বাকিটুকু খনন করা হবে। এছাড়াও সামগ্রীক ভাবে সুরমা-কুশিয়ারা নদী খনন করবো। সুনামগেঞ্জর ছোট বড় ২০টি নদী আমরা খনন করবো।

এদিকে, পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক গত বৃহস্পতিবার নগরের টুকেরবাজার এলাকার শাদীখাল পরিদর্শন করেছেন। পরিদর্শনকালে তিনি জানান, সিলেট বিভাগে ভয়াবহ বন্যার কারণ হিসেবে অনেকে কিশোরগঞ্জের ইটনা-অষ্টগ্রাম-মিঠামইনের অল-ওয়েদার সড়ককে দায়ী করছেন। ওই সড়কের কারণে পানি আটকে গেলে তা নামানোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি আরো বলেন, ‘মিঠামইনে যেটা হয়েছে, সেটার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, “নদীর পানি যাতে পাস করে সে ব্যবস্থা আমরা করব। এবারের বর্ষার সময় আমরা দেখব, পানি আটকে যায় কি না? যদি আটকে যায়, সেটার জন্য আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করব।” সিলেট নগরকে আগাম বন্যার কবল থেকে রক্ষা করতে সুরমা নদী ড্রেজিং করা হবে। তিনি বলেন, দেশের ৯টি স্থানে ড্রেজিং স্টেশন তৈরি করা হচ্ছে। নদী ভাঙন, পলিমাটি অপসারণে নিয়মিত নদী খনন করা হবে। নদীতে পলিথিন থাকার ফলে এর আগেও ড্রেজিং কাজ ব্যাহত হয়েছিল। এ জন্য পলিথিন ব্যবহারের বিষয়ে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। পরিদর্শনকালে সিটি মেয়র মোহাম্মদ আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন ওয়ার্ডের কাউন্সিলররা উপস্থিত ছিলেন।

বন্যায় এবার অনেকটা ফিকে হয়ে গেলো ঈদের আনন্দ। মানুষজন স্বাচ্ছন্দে দিতে পারেননি কোরবানী, যেতে পারেননি ঈদগাহে। ঈদের আনন্দকে রেখে মানুষকে লড়াই করতে হয় পানির সাথে।জেলা প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, সিলেট নগরের ২৮টি ওয়ার্ডের ১ লাখ মানুষ বন্যাকবলিত। এছাড়া সিলেট জেলার ১৩ উপজেলায় বন্যা আক্রান্ত সাড়ে ১০ লাখ, সুনামগঞ্জ জেলার ১১ উপজেলায় ৮ লাখ, মৌলভীবাজার জেলায় ৩ লাখ ও হবিগঞ্জ জেলায় ১ লাখ মানুষ পানিবন্দী।