সাপের কামড়ে চিকিৎসার অভাবে বাড়ছে প্রাণহানি; দেশে নেই নিজস্ব অ্যান্টিভেনম উৎপাদন

- Update Time : ০৪:৫৫:৩৪ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৮ জুলাই ২০২৫
- / ১৮ Time View
প্রতিদিন দেশের কোথাও না কোথাও সাপের কামড়ে কেউ না কেউ আহত হচ্ছেন, কেউ প্রাণ হারাচ্ছেন। অথচ এখনও বাংলাদেশে নেই নিজস্ব উৎপাদিত অ্যান্টিভেনম, নেই উপজেলা পর্যায়ে সাপে কাটা রোগীদের জন্য কার্যকর চিকিৎসা ব্যবস্থা। ফলে প্রকৃতির নিরীহ এই প্রাণীর সঙ্গে সহাবস্থানের চেয়ে মৃত্যু–আতঙ্কই হয়ে উঠছে মানুষের প্রাত্যহিক ভয়।
এ বাস্তবতায় সাপকে ‘শত্রু’ নয়, বরং বাসযোগ্য প্রাণী হিসেবে তুলে ধরতে এবং সর্পদংশন-সংক্রান্ত চিকিৎসা ও সচেতনতা বিষয়ে সোমবার (৭ জুলাই) দিনব্যাপী সচেতনতামূলক কর্মশালার আয়োজন করা হয় কারমাইকেল কলেজ ক্যাম্পাসে। আয়োজন করে দেশের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘ওয়াইল্ডলাইফ অ্যান্ড স্নেক রেসকিউ টিম ইন বাংলাদেশ’।
সংগঠনটি শুধু উদ্ধার কার্যক্রমেই সীমাবদ্ধ নয়; দেশব্যাপী সচেতনতামূলক কর্মসূচি, স্কুল-কলেজে ওয়ার্কশপ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারণা এবং চিকিৎসা ব্যবস্থা উন্নয়নে জনসচেতনতা তৈরির মাধ্যমে সাপ ও মানুষের সহাবস্থান নিশ্চিত করা, চিকিৎসার অধিকার বাস্তবায়নের দাবি তোলা এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করাই তাদের মূল লক্ষ্য। কর্মশালায় অংশ নিয়ে শিক্ষার্থীরা শুধু সাপকে নয়, বরং দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকেও নতুন চোখে দেখতে শুরু করেছেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৬ থেকে ৭ লাখ মানুষ সাপে কামড়ের শিকার হন, যার মধ্যে গড়ে ৬ থেকে ৭ হাজারেরও বেশি মানুষ মারা যান শুধুমাত্র সময়মতো চিকিৎসা না পাওয়ায়।
সংগঠনের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি লিজেন আহম্মেদ প্রান্ত বলেন, বাংলাদেশে স্নেক বাইট চিকিৎসার অবস্থা অত্যন্ত করুণ। যেখানে চিকিৎসা মৌলিক অধিকার, সেখানে সর্পদংশন বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উদাসীনতা হতাশাজনক। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কোথাও অ্যান্টিভেনম নেই, জেলা হাসপাতালেও রোগীরা ফিরিয়ে দেওয়া হয়। এমনকি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও চিকিৎসার মান কাঙ্ক্ষিত নয়।
তিনি আরও জানান, ২০১৮ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ‘ভেনম রিসার্চ সেন্টার’ প্রতিষ্ঠা করা হলেও আজও তা পরীক্ষামূলক ধাপে আটকে আছে। কার্যকর উৎপাদন হয়নি, নেই কোনো জাতীয় পরিকল্পনা। যদি উদ্যোগটি সফল হতো, তাহলে দেশীয় প্রজাতির বিষধর সাপের জন্য উপযোগী অ্যান্টিভেনম দেশের মাটিতেই তৈরি হতো।
বর্তমানে সরকার শুধুমাত্র একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ইনসেফটার ভারতীয় অ্যান্টিভেনম আমদানির উপর নির্ভর করছে। সংগঠনের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, বাংলাদেশে যেমন রাসেলস ভাইপার, মনোকল্ড কোবরা, ব্যান্ডেড ক্রেইট, গ্রীন পিট ভাইপারসহ ভিন্ন গঠনবিশিষ্ট বিষধর সাপ রয়েছে, তাদের বিষের গঠন ভারতের সাপের চেয়ে আলাদা হওয়ায় ভারতীয় অ্যান্টিভেনম অনেক সময় কার্যকর হয় না। এই বৈজ্ঞানিক অসামঞ্জস্যই বহু মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশের সরকারি হাসপাতালে যে পরিমাণ অ্যান্টিভেনম সরবরাহ করা হয়, তা চাহিদার মাত্র ২০ থেকে ২৫ শতাংশ। আবার সংরক্ষণের সঠিক অবকাঠামো না থাকায় অনেক ওষুধ নষ্ট হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। রাজশাহী, যশোর, মেহেরপুর, বরিশাল, কুষ্টিয়া ও সিলেট অঞ্চলে সাপের কামড়ের হার বেশি হলেও সেখানেও নেই পর্যাপ্ত চিকিৎসা বা রেফারেল ব্যবস্থা।
রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের এক চিকিৎসক জানান, আমরা অনেক সময়ই দেখেছি রোগী অ্যান্টিভেনম পেলেও সেটার কার্যকারিতা নিয়ে সন্দেহ থাকে। আবার সময়মতো প্রয়োগ না হলে সেটা প্রাণ বাঁচাতে পারে না। আরও উদ্বেগের বিষয় হলো, চিকিৎসা শিক্ষার পাঠ্যক্রমে সর্পদংশনের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ক্লিনিক্যাল প্রশিক্ষণ নেই।
গত বছর রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার একটি গ্রামে বিষধর সাপে কামড় দেয় এক যুবককে। আতঙ্কে পরিবার প্রথমে স্থানীয় ওঝার কাছে নিয়ে যায়। সময় নষ্ট হয় ঝাড়ফুঁক আর তাবিজ-কবজে। পরে রংপুর মেডিকেলে আনা হলে চিকিৎসকরা জানান রোগীর শরীরে ইতোমধ্যেই বিষ ছড়িয়ে গেছে। হাসপাতালে অ্যান্টিভেনম ছিল না, বিকল্প উৎস থেকেও সময়মতো সংগ্রহ সম্ভব হয়নি। চিকিৎসার অভাবে মারা যান তিনি।
সরকারি ব্যর্থতার মধ্যে আরও একটি দিক হলো সারা দেশে যারা সাপ উদ্ধার, সচেতনতা কার্যক্রম ও প্রাথমিক চিকিৎসা সহায়তায় যুক্ত রয়েছেন, সেই রেসকিউয়ারদের জন্য নেই কোনো প্রশিক্ষণ, স্বাস্থ্য নিরাপত্তা বা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। অথচ তারাই ঝুঁকি নিয়ে মাঠে কাজ করেন, অনেক সময় হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই রোগীকে সহায়তা করেন।
অন্যদিকে প্রতিবেশী ভারতের কেরালা, মহারাষ্ট্র ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে সরকারি হাসপাতালে রয়েছে সর্পদংশন ইউনিট, প্রশিক্ষিত কর্মী এবং নিজস্ব উৎপাদিত অ্যান্টিভেনম। ভারত সরকার ‘স্নেক বাইট ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রাম’ চালু করেছে বহু আগেই। বাংলাদেশে এমন কোনও রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা এখনও নেই।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, বিশ্বে প্রতি বছর সাপের কামড়ে ৮১ হাজার থেকে ১ লাখ ৩৮ হাজার মানুষ মারা যান এবং আরও প্রায় চার লাখ মানুষ স্থায়ীভাবে পঙ্গু হন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মৃত্যুহার সর্বাধিক। অথচ এই অঞ্চলেই একাধিক দেশ ইতোমধ্যে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছে, সেখানে বাংলাদেশ এখনও পিছিয়ে।
সংগঠনটির তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে স্থলভাগে পাওয়া যায় ৭৬ প্রজাতির সাপ, যার মধ্যে ১৬টি প্রজাতি বিষধর। বাকিগুলো নির্বিষ বা কম বিষধর। কিন্তু অজ্ঞতা, ভয় এবং চিকিৎসা সংকটের কারণে প্রতিদিন সাপ এবং মানুষ দুজনেই প্রাণ হারাচ্ছে।
কর্মশালায় কারমাইকেল কলেজের ইন্টারমিডিয়েট প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী মোরসালিন হায়াত বলেন, সাপ পরিবেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রাণী। তাই সাপকে যেমন রক্ষা করতে হবে, তেমনি সাপের কামড় হলে মানুষ যেন সঠিক ও সময়মতো চিকিৎসা পায়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। সরকার যদি দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে আমরা শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামতেও বাধ্য হব।
কর্মশালায় উপস্থিত ছিলেন সংগঠনের সদস্য নুর হাসান নাহিদ, মাহমুদুল হাসান সোহেল, মাসুদ রানা এবং শান্ত বাবু। তারা বলেন, এই কাজ শুধুসাপ বাঁচানোর জন্য নয়, মানুষ বাঁচানোর জন্যও। সরকার যদি এখনই কার্যকর উদ্যোগ না নেয়, তাহলে মৃত্যু অব্যাহত থাকবে অথচ এ মৃত্যুর বেশিরভাগই প্রতিরোধযোগ্য।