সরকার পতনের পরও থামেনি পঞ্চগড়ের যুবলীগ নেতা আকবর আলীর ত্রাসের রাজত্ব

- Update Time : ০৬:৩৬:২৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ৩ মে ২০২৫
- / ১৪ Time View
সরকার পরিবর্তনের পর দেশের নানা প্রান্তে যখন রাজনৈতিক চাপ কমতে শুরু করেছে, তখনও পঞ্চগড় সদর উপজেলার সাতমেড়া ইউনিয়নের সাধারণ মানুষ রয়ে গেছে এক ভিন্ন বাস্তবতায়। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের পতন ঘটে ৫ আগস্ট, কিন্তু সেই পরিবর্তনের কোনো প্রভাব পড়েনি এই অঞ্চলের আলোচিত যুবলীগ নেতা আকবর আলীর দাপটে। বরং অভিযোগ উঠেছে, এখনো তার ভয়ংকর দখলবাজি, চাঁদাবাজি, হুমকি ও নির্যাতন অব্যাহত রয়েছে।
সাকিমুল হকের ছেলে আকবর আলি, সদর উপজেলা যুবলীগের সহ-সম্পাদক হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, তিনি ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রভাব ব্যবহার করে সাতমেড়া ও আশপাশের এলাকায় গড়ে তুলেছেন একপ্রকার ত্রাসের সাম্রাজ্য। তার বিরুদ্ধে একাধিকবার অভিযোগ উঠেছে ভূমিদখল, সাধারণ মানুষকে ভয়ভীতি প্রদর্শন, ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা আদায়, এমনকি প্রকাশ্যে দেশিয় অস্ত্র প্রদর্শনের মতো গুরুতর অপরাধে জড়িত থাকার।
স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, এই মানুষটি একাধারে নেতা, ব্যবসায়ী ও দখলদার। কথায় কথায় মানুষ পেটানো, জমি দখল, দোকান থেকে চাঁদা আদায় সবই তার নিত্যদিনের কাজ। কেউ প্রতিবাদ করলে, তার ওপর নেমে আসে অমানুষিক নির্যাতন ।
অনেকেই জানান, আকবর আলী সরকার পতনের আগেই নিজের প্রভাব খাটিয়ে পঞ্চগড়ের প্রশাসনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা গড়ে তোলেন। এরপর থেকেই তিনি সরকারি ডিলারশিপ—যেমন সারের ডিলার, চালের ডিলার, এমনকি টিসিবির পণ্য সরবরাহের দায়িত্ব নিজের কব্জায় নিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নেন।
অভিযোগ রয়েছে, এসব সুযোগ-সুবিধা গ্রহণের সময় তিনি নিজের পরিচয় উপর মহলের লোক হিসেবে তুলে ধরতেন এবং সরকারি কর্মকর্তাদের ‘চাপে’ রাখতেন। এছাড়া প্রতিটি ডিলারশিপ থেকে নিয়মিত হারে অবৈধ অর্থ আদায়েরও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এলাকাবাসীরা বলছেন, ক্ষমতার অপব্যবহার করে আলি আকবর শুধু নিজের পকেট ভারী করেননি, বরং সাধারণ মানুষের জীবনকে করেছেন অতিষ্ঠ।
ভূমিদখলের অভিযোগও তার বিরুদ্ধে নতুন নয়। অনুসন্ধানে জানা যায়, তিনি বিভিন্ন সময় জমির প্রকৃত মালিকদের ভয় দেখিয়ে বা মারধর করে জবরদখল করেছেন অনেক সম্পত্তি। এর পেছনে ছিল তার অনুসারী সন্ত্রাসীদের একটি সংঘবদ্ধ চক্র।
সম্প্রতি, আলী আকবরের দখলের শিকার হওয়া কয়েকজন ভুক্তভোগী একত্রিত হয়ে গণমাধ্যমের কাছে তাদের দুর্দশার কথা তুলে ধরেন। তারা জানান, তাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে এবং তারা তাদের হারানো জমি ফিরে পেতে চান।
সেনা কর্মকর্তা তরিকুল ইসলামের ভাষ্য অনুযায়ী, আকবর আলী দীর্ঘ দিন ধরে তার নয় বিঘা জমি অবৈধভাবে দখল করে রেখেছে। তরিকুল ইসলাম যখন তার জমিতে যান, তখন আকবর আলী সন্ত্রাসী কায়দায় তার ওপর হামলা করে এবং তাকে প্রায় মেরেই ফেলেছিল। মাথায় পনেরোটি সেলাই নিয়ে তিনি কোনোমতে প্রাণে বেঁচেছেন। এর আগেও আকবর আলী তাকে হত্যার চেষ্টা করেছিল বলে তিনি জানান। তরিকুল ইসলাম এই ঘটনায় মামলা দায়ের করলেও, অভিযোগ করেন যে পুলিশ এখনও পর্যন্ত আকবর আলীকে গ্রেফতার করেনি।
তরিকুল ইসলামের মতে, আকবর আলী এতটাই প্রভাবশালী সন্ত্রাসী যে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা ছেড়ে দিলেও তার ক্ষমতার কোনো পরিবর্তন হয়নি।
একই এলাকার বাসিন্দা রুস্তম আলী জানান, আকবর আলী জোর করে তার বাবার এক একর ত্রিশ শতাংশ জমি দখল করে রেখেছে। যদিও খতিয়ান অনুযায়ী তারা জমির মালিক, তবুও আলী আকবরের ভয়ে তারা জমিতে যেতে সাহস পান না।
জহিরুল ইসলামের অভিযোগ, ১৫ বছর যাবত আকবর আলী ও তার দল ভূমি দস্যু হিসেবে পরিচিত। তিনি জানান, ইতোমধ্যে তাদের দ্বারা তার সাড়ে তিন বিঘা জমি বেদখল হয়ে গেছে। তাদের কোনো নৈতিকতা নেই এবং একটি বিশেষ শক্তির ছত্রছায়ায় তারা এসব কাজ করে আসছে, যার কারণে ভুক্তভোগীরা তাদের নিজেদের জমি ফেরত নিতে পারছেন না।
মৃত হবিবর রহমানের ছেলে আব্দুস সোবহান জানান, তার বাবার কেনা চল্লিশ শতাংশ জমি আকবর আলী জবরদখল করে রেখেছে।
ঐ এলাকার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বাসিন্দা জানান, যখন তিনি গর্ভবতী ছিলেন, তখন যুবলীগ নেতা আকবর আলী তাকে মাতৃভাতার কার্ড করে দেবেন বলে আশ্বাস দেন এবং এজন্য তার কাছ থেকে ৪০০০ টাকা নেন। তবে দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও তিনি সেই কার্ড পাননি। তিনি আরও জানান, বহুবার আকবর আলীর সঙ্গে যোগাযোগ করে টাকা ফেরত চেয়েছেন, কিন্তু তিনি টাকা ফেরত দেননি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ব্যক্তি জানান, আকবর আলী একটি ঘর, একটি খামার ও একটি নলকূপ দেওয়ার কথা বলে তার কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়েছে। শুধু তার কাছ থেকেই নয়, এলাকার আরও অনেকের কাছ থেকে একইভাবে টাকা নিয়ে প্রতারণা করেছেন বলে তিনি অভিযোগ করেন।
তিনি আরো বলেন আকবর খুব ভয়ংকর ছেলে ,তার ভয়ে এলাকায় কেউ মুখ খুলার সাহস পাবেনা। আমার নাম দিয়েন না আমার ক্ষতি করিয়েন না।
সাতমেড়া ইউনিয়নের এক প্রবীণ ব্যক্তি বলেন, সরকার বদলেছে, কিন্তু এলাকায় কিছুই বদলায়নি। আকবর আলী আজও সেই আগের মতোই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছেন। আমরা আর নিরাপদ নই।
অঞ্চলের সাধারণ জনগণের একটাই দাবি—অবিলম্বে আকবর আলীর বিরুদ্ধে কঠোর তদন্ত ও প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক, যাতে এলাকায় শান্তি ফিরে আসে এবং কেউ আর রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করতে না পারে।
এব্যাপারে আকবর আলী দাবি করেছেন যে, তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। তিনি আওয়ামী লীগের কোনো পদে নেই। তাদের জমিজমা সংক্রান্ত কিছু ঝামেলা চলছে, যার জেরে তাকে বিভিন্নভাবে ফাঁসানো হচ্ছে।
পঞ্চগড় সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আব্দুল হিল জামান জানান, আকবর আলীর বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে এবং আসামি গ্রেপ্তারের অভিযান চলছে।