ঢাকা ০৭:০৬ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৫ মে ২০২৫, ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

শখের বশে দুম্বা পালন

কামরুল হাসান টিটু, রংপুর ব্যুরো
  • Update Time : ০৪:০৭:৪৬ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৫ মে ২০২৫
  • / ১২ Time View

ব্যবসায়িক মনোভাব পোষণ না করে সম্প্রসারণের বিষয়টি প্রধান্য দিচ্ছেন জাহিদ

সাত মাস আগে শখের বশে দুম্বা পালন শুরু করলেও বর্তমানে একেকটি দুম্বার দাম আড়াই থেকে চার লাখ টাকা। শুরুতে বিক্রির মাধ্যমে ব্যবসায়িক মনোভাব পোষণ না করে সম্প্রসারণের বিষয়টি প্রধান্য দিচ্ছেন খামারি উদ্যোক্তা জাহিরুল ইসলাম জাহিদ। ছোট পরিসরে শুরু করা খামারে দুম্বার সংখ্যা বাড়ানোর সঙ্গে তার স্বপ্ন তপ্ত মরুর দুম্বা প্রান্তিক পর্যায়ে ছড়িয়ে দেয়া।

জাহিরুল ইসলাম জাহিদের বাড়ি রংপুরের পীরগঞ্জে। তবে তিনি দুম্বার খামার গড়ে তুলেছেন গাইবান্ধার সাদুল্লাপুর উপজেলার দড়ি জামালপুর গ্রামে। মেঠোপথ, দুপাশে ধানখেত আর নয়নাভিরাম সবুজ শ্যামল নিভৃত এ গ্রামে রঙিন টিন সেডে বানানো দুম্বার খামারটি সবার চেনা। তাইতো জাহিদটা নাম বললেই সোজা তার দুম্বার খামারে নিয়ে যান ছোট-বড় যে কেউ।

তরুণ উদ্যোক্তা জাহিদ একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় যক্ষ্মা নিয়ে গবেষণা ও চিকিৎসাসেবা দিয়ে থাকেন। পেশাগত দিক থেকে ব্যস্ততা থাকলে সৌখিনতা থেকেই দুম্বা লালন-পালন শুরু করেন তিনি। ছোটভাই জিন্নাহ মণ্ডল তার খামারের দেখভাল করার পাশাপাশি দুম্বার পরিচর্যা করে থাকেন। দুই সহোদয়ের স্বপ্ন এখন জেলার ব্যতিক্রমী খামার হিসেবে এটিকে দাঁড় করানো। সাথে নতুন সংযোজন হিসেবে উন্নত প্রজাতির আরো দুম্বা ও ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের বাণিজ্যিক খামার গড়ার স্বপ্ন দেখছেন তারা।

এসব দুম্বার খাবার তালিকায় থাকে ঘাস, পাতা, খড়, ভূষি ও সরিষা খৈল। প্রতিদিন রুটিন করে খাওয়ানোসহ সবধরনের যত্ন নিতে কমতি রাখেন জাহিদ ও জিন্নাহ। মরুভূমির এ প্রাণি লালন-পালন করতে পেরে খুশি তারা। লোকজন প্রতিদিন দূর দূরান্ত থেকে খামারে আসছেন জাহিদের দুম্বা দেখতে।

জাহিদের ছোটভাই জিন্নাহ মণ্ডল বলেন, আমি প্রথমে এধরনের ফার্ম করতে বড়ভাইকে নিষেধ করেছিলাম। কারণ তখনো আমার কাছে মনে হয়েছে এমন নিভৃত গ্রামে দুম্বার ফার্ম করা সম্ভব না। এসব দুম্বা তো সহজে পাওয়া যায় না। তবে শেষ পর্যন্ত ভাইয়ের ইচ্ছাতেই ফার্মের যাত্রা শুরু হয়। এখন বেশ সাড়া পাচ্ছি আমরা। দুম্বা বাংলাদেশে বিরল প্রাণি হলেও এর চাহিদা অনেক।

তিনি আরও বলেন, দুম্বা লালন-পালনে তেমন কোনো বাড়তি ঝামেলা নেই। খুব বেশি কষ্ট করতেও হয় না। মরুভূমির প্রাণি হিসেবে খাবারের বৈচিত্র্য থাকার কথা থাকলেও বাংলাদেশ প্রচলিত খাবারই খাওয়ানো হয় দুম্বাকে। আমরা সকালে কাঁচা ঘাস (নেপিয়ার). দুপুরে খড়, ভুষি, গুড়া ও খুদভাটি, সন্ধ্যার আগে খড়কাটা এবং ভুষি খেতে দেই। এর বাইরে পাতাও খেয়ে থাকে।

জিন্নাহ বলেন, মরুভূমির প্রাণি হিসেবে দুম্বার রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক বেশি হওয়ায় অন্যান্য প্রাণির মতো চর্চার ব্যাপারে খুব বেশি কষ্ট করতে হয় না। অসুখ-বিসুখ হলে খুব একটা চিকিৎসার প্রয়োজন পড়ে না। তারপরও আমরা ইউটিউব দেখে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে থাকি। তিন মাস পর পর কৃমির প্রতিষেধক দেয়া হয়।

তরুণ এই উদ্যোক্তা বলেন, দুম্বা দলবদ্ধভাবে থাকতে বেশি পছন্দ করে। বেশ শান্ত প্রাণি, গরু-ছাগলের মতো নয়। প্রান্তিক পর্যায়ে আমরা এই ফার্ম করার পর থেকে সবার কাছ থেকে ভালো সাড়া পাচ্ছি। ইচ্ছে আছে ধীরে ধীরে এই ফার্মকে বড় পরিসরে গড়ে তোলা। এবং যেহেতু দুম্বার চাহিদা ও দাম বেশি, তাই লালন-পালনে কোনো লোকসানের সম্ভাবনা নেই।

স্থানীয় যুবক ফজলুল করিম চয়নের সাথে কথা হলে তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, আমাদের এলাকার আগে দুম্বা ছিল না। জাহিদ ভাই প্রথম দুম্বার খামার গড়ে লালন-পালন করছে। এটা লাভজনক ব্যবসা এবং এর চাহিদাও বাড়ছে। সফলতার দিক থেকে ভালো।

তিনি আরও বলেন, দুম্বার গোস্তের মধ্যে অনেক প্রোটিন ও ভিটামিন আছে। এটা ব্যয়বহুল হলেও জাহিদ ভাইয়ের মতো উদ্যোক্তারা সফল হবে। গরু-ছাগলের চেয়ে যদি একটু ব্যতিক্রম চিন্তা থেকে কেউ দুম্বার খামার গড়ে তুলতে চাইলে খুব বেশি পুঁজি লাগবে না। আর এখন কোরবানির হাটে যদি দুম্বা দেখতে পাওয়া যায়, এটা যে কারো ভালো লাগবে। যেই দুম্বা সৌদি আরব থেকে আনতে হতো সেই দুম্বা এখন আমরা হাতের নাগালে পাচ্ছি।

জাহিদের এই দুম্বার খামার দেখতে রংপুর শহর থেকে এসেছেন মোহাম্মদ শামীম। তারও ইচ্ছে আছে ছোট পরিসরে হলেও দুম্বা লালন-পালন শুরু করবেন। প্রতিবেদককে শামীম বলেন, এর আগে সরাসরি কখনো দুম্বা দেখেনি। একারণে দেখার আগ্রহ থেকে রংপুর থেকে এতো দূরে এসেছি। বেশ ভালো লাগছে।

তপ্ত মরুর দুম্বা নিয়ে খামার গড়ে তোলা প্রসঙ্গে জাহিরুল ইসলাম জাহিদ বলেন, সবাইতো গরু-ছাগল-ভেড়া লালন পালন করে থাকে। কিন্ত আমার শুরু থেকেই একটু ব্যতিক্রম চিন্তা ছিল। আমি আনকমন কিছু দিয়ে শুরু করব, যেটা আমাদের দেশে সহজলভ্য নয়। এবং আমার মাধ্যমে প্রান্তিক পর্যায়ের খামারিরা সেটা পাবেন। প্রথমে আমি হরিণ নিয়েও ভেবেছি। পরে বিভিন্ন খামার পরির্দশন ও অনেক কিছু জেনে শুনে দুম্বা নিয়ে আগ্রহ তৈরি হয়। এরপর ভারত এবং পাকিস্তানী টার্কিজ প্রজাতির দুম্বা দিয়ে খামার গড়ে তোলার কাজ শুরু করি।

জাহিদের স্বপ্ন প্রান্তিক পর্যায়ে বেকার সমস্যা দূরীকরণে দুম্বার লালন-পালনে উদ্যোক্তা তৈরি করা। এজন্য তিনি প্রান্তিক পর্যায়ে দুম্বা সরবরাহ করতে চান। যাতে একটা সময় রংপুর অঞ্চলের পাশাপাশি সারা দেশে দুম্বা সহজলভ্য হয়ে উঠে। শুধু তাই নয়, কোরবানির হাটগুলোতে যাতে দুম্বার সরবরাহ থাকে, সেটি নিশ্চিত করতে বড় পরিসরে খামার গড়ার স্বপ্ন বুনছেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, আমাদের দেশে কোরবানির ঈদে অনেকেই গরু, ছাগল, ভেড়া, মহিষ ও উট কিনে থাকেন। কিন্তু দুম্বা খুব একটা কিনতে দেখা যায় না। এর চাহিদা থাকলেও হাটগুলোতে এর আমদানি দেখা যায় না। আমার ইচ্ছে আছে, বাংলাদেশের প্রত্যেক প্রান্তে এই প্রাণিকে ছড়িয়ে দেয়া। আমার আগে অনেক খামারি ভাই দুম্বার খামার গড়েছেন। আমি এখন ছোট পরিসরে শুরু করলেও স্বপ্নটা অনেক বড়। আমি বিশ্বাস করি, প্রান্তিক পর্যায়ে দুম্বা ছড়িয়ে দিতে পারলে একটা সময় দুম্বার চাহিদা সবখানেই বাড়বে।

জাহিদ বলেন, মরুভূমির প্রাণি হলেও বাংলাদেশের আবহাওয়া ও পরিবেশ দুম্বা লালন-পালনের জন্য সহনীয়। একারণে দেশের অনেকেই দিন দিন দুম্বার খামার গড়ে তুলছেন। আমি নিজেও বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসব দুম্বা ক্রয় করে খামার ধীরে ধীরে বড় করার চেষ্টা করছি। যেকেউ দুই-তিনটা দুম্বা দিয়ে ছোট পরিসরে খামারের শুরুটা করতে পারবে। এক্ষেত্রে ছয় মাস বয়সের বাচ্চা দুম্বা কিনতে গেলে ৮০ হাজার থেকে এক লাখ ২০ হাজার টাকা দাম পড়বে। বয়স্ক প্রতিটা দুম্বা পড়বে দেড় লাখ থেকে দুই লাখ টাকা। বাংলাদেশে দুম্বার ভবিষ্যত উজ্জ্বল তাই খামার গড়তে পারলে সফল উদ্যোক্তা হতে বেশি কষ্ট পোহাতে হবে না।

তিনি আরও জানান, তার খামারে থাকা একেকটি দুম্বার ওজন কমপক্ষে ৭৫ থেকে ১২০ কেজি পর্যন্ত হবে। ভবিষ্যতে দুবাইয়ের আউয়াসি প্রজাতির দুম্বার পাশাপাশি দেশীয় ব্লাক বেঙ্গল ছাগল লালন-পালন এবং বাণিজ্যিকভাবে সরবরাহ করতে খামার বিস্তৃত করার পরিকল্পনা রয়েছে তার।

এদিকে পবিত্র ঈদুল আজহা সামনে রেখে রংপুর জেলায় প্রায় তিন লাখ ৬৩ হাজার গবাদিপ্রাণি প্রস্তুত করেছেন খামারি ও গৃহস্থরা। এসব প্রাণির বিপরীতে জেলায় কোরবানির চাহিদা রয়েছে প্রায় দুই লাখ ২৪ হাজারের কিছু বেশি। ফলে এক লাখ ৩৯ হাজার কোরবানির প্রাণি উদ্বৃত্ত থাকবে।

রংপুর জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. আবু ছাঈদ বলেন, জেলার আট উপজেলায় প্রায় ২৫ হাজার খামারির ঘরে এক লাখ ৫৪ হাজার ৩২৩টি গরু এবং দুই লাখ আট হাজার ৭০০ ছাগল, ভেড়া, দুম্বা বাজারে বিক্রির জন্য প্রস্তুত রয়েছে। খামারিদের সবরকমের সহযোগিতা করা হচ্ছে বলেও জানান এই কর্মকর্তা।

তিনি আরও বলেন, ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দুম্বা একটি সেনসিটিভ প্রাণি। রংপুর জেলার পীরগঞ্জ, পীরগাছা ও সদর উপজেলার বেশ কয়েকজন খামারি দুম্বা লালন-পালন করছেন। শুধু দুম্বা নয় দুম্বার একটি জাত হচ্ছে গাড়ল। আবার ভেড়া ও গাড়ল প্রায়ই একই প্রাণি। তবে ধর্মীয় কারণে দুম্বা কোরবানির জন্য অনেকের কাছে পছন্দীয় এবং এর চাহিদাও রয়েছে।

ডা. মো. আবু ছাঈদ বলেন, আগে দুম্বার খামার না থাকলেও এখন দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। দুম্বা লালন-পালনে আলাদা কোনো প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হয় না। ভেড়া ও গাড়ল যে পদ্ধতিতে পালন করা হয়, দুম্বার ক্ষেত্রেও একই পদ্ধতি। তবে ভেড়া আমরা সবাই চিনি, গাড়ল চেনার ক্ষেত্রে গরুর বাছুরের মতো লম্বা লেজ আর দুম্বার পাছায় অনেক মাংস থাকবে।

Please Share This Post in Your Social Media

শখের বশে দুম্বা পালন

কামরুল হাসান টিটু, রংপুর ব্যুরো
Update Time : ০৪:০৭:৪৬ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৫ মে ২০২৫

ব্যবসায়িক মনোভাব পোষণ না করে সম্প্রসারণের বিষয়টি প্রধান্য দিচ্ছেন জাহিদ

সাত মাস আগে শখের বশে দুম্বা পালন শুরু করলেও বর্তমানে একেকটি দুম্বার দাম আড়াই থেকে চার লাখ টাকা। শুরুতে বিক্রির মাধ্যমে ব্যবসায়িক মনোভাব পোষণ না করে সম্প্রসারণের বিষয়টি প্রধান্য দিচ্ছেন খামারি উদ্যোক্তা জাহিরুল ইসলাম জাহিদ। ছোট পরিসরে শুরু করা খামারে দুম্বার সংখ্যা বাড়ানোর সঙ্গে তার স্বপ্ন তপ্ত মরুর দুম্বা প্রান্তিক পর্যায়ে ছড়িয়ে দেয়া।

জাহিরুল ইসলাম জাহিদের বাড়ি রংপুরের পীরগঞ্জে। তবে তিনি দুম্বার খামার গড়ে তুলেছেন গাইবান্ধার সাদুল্লাপুর উপজেলার দড়ি জামালপুর গ্রামে। মেঠোপথ, দুপাশে ধানখেত আর নয়নাভিরাম সবুজ শ্যামল নিভৃত এ গ্রামে রঙিন টিন সেডে বানানো দুম্বার খামারটি সবার চেনা। তাইতো জাহিদটা নাম বললেই সোজা তার দুম্বার খামারে নিয়ে যান ছোট-বড় যে কেউ।

তরুণ উদ্যোক্তা জাহিদ একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় যক্ষ্মা নিয়ে গবেষণা ও চিকিৎসাসেবা দিয়ে থাকেন। পেশাগত দিক থেকে ব্যস্ততা থাকলে সৌখিনতা থেকেই দুম্বা লালন-পালন শুরু করেন তিনি। ছোটভাই জিন্নাহ মণ্ডল তার খামারের দেখভাল করার পাশাপাশি দুম্বার পরিচর্যা করে থাকেন। দুই সহোদয়ের স্বপ্ন এখন জেলার ব্যতিক্রমী খামার হিসেবে এটিকে দাঁড় করানো। সাথে নতুন সংযোজন হিসেবে উন্নত প্রজাতির আরো দুম্বা ও ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের বাণিজ্যিক খামার গড়ার স্বপ্ন দেখছেন তারা।

এসব দুম্বার খাবার তালিকায় থাকে ঘাস, পাতা, খড়, ভূষি ও সরিষা খৈল। প্রতিদিন রুটিন করে খাওয়ানোসহ সবধরনের যত্ন নিতে কমতি রাখেন জাহিদ ও জিন্নাহ। মরুভূমির এ প্রাণি লালন-পালন করতে পেরে খুশি তারা। লোকজন প্রতিদিন দূর দূরান্ত থেকে খামারে আসছেন জাহিদের দুম্বা দেখতে।

জাহিদের ছোটভাই জিন্নাহ মণ্ডল বলেন, আমি প্রথমে এধরনের ফার্ম করতে বড়ভাইকে নিষেধ করেছিলাম। কারণ তখনো আমার কাছে মনে হয়েছে এমন নিভৃত গ্রামে দুম্বার ফার্ম করা সম্ভব না। এসব দুম্বা তো সহজে পাওয়া যায় না। তবে শেষ পর্যন্ত ভাইয়ের ইচ্ছাতেই ফার্মের যাত্রা শুরু হয়। এখন বেশ সাড়া পাচ্ছি আমরা। দুম্বা বাংলাদেশে বিরল প্রাণি হলেও এর চাহিদা অনেক।

তিনি আরও বলেন, দুম্বা লালন-পালনে তেমন কোনো বাড়তি ঝামেলা নেই। খুব বেশি কষ্ট করতেও হয় না। মরুভূমির প্রাণি হিসেবে খাবারের বৈচিত্র্য থাকার কথা থাকলেও বাংলাদেশ প্রচলিত খাবারই খাওয়ানো হয় দুম্বাকে। আমরা সকালে কাঁচা ঘাস (নেপিয়ার). দুপুরে খড়, ভুষি, গুড়া ও খুদভাটি, সন্ধ্যার আগে খড়কাটা এবং ভুষি খেতে দেই। এর বাইরে পাতাও খেয়ে থাকে।

জিন্নাহ বলেন, মরুভূমির প্রাণি হিসেবে দুম্বার রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক বেশি হওয়ায় অন্যান্য প্রাণির মতো চর্চার ব্যাপারে খুব বেশি কষ্ট করতে হয় না। অসুখ-বিসুখ হলে খুব একটা চিকিৎসার প্রয়োজন পড়ে না। তারপরও আমরা ইউটিউব দেখে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে থাকি। তিন মাস পর পর কৃমির প্রতিষেধক দেয়া হয়।

তরুণ এই উদ্যোক্তা বলেন, দুম্বা দলবদ্ধভাবে থাকতে বেশি পছন্দ করে। বেশ শান্ত প্রাণি, গরু-ছাগলের মতো নয়। প্রান্তিক পর্যায়ে আমরা এই ফার্ম করার পর থেকে সবার কাছ থেকে ভালো সাড়া পাচ্ছি। ইচ্ছে আছে ধীরে ধীরে এই ফার্মকে বড় পরিসরে গড়ে তোলা। এবং যেহেতু দুম্বার চাহিদা ও দাম বেশি, তাই লালন-পালনে কোনো লোকসানের সম্ভাবনা নেই।

স্থানীয় যুবক ফজলুল করিম চয়নের সাথে কথা হলে তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, আমাদের এলাকার আগে দুম্বা ছিল না। জাহিদ ভাই প্রথম দুম্বার খামার গড়ে লালন-পালন করছে। এটা লাভজনক ব্যবসা এবং এর চাহিদাও বাড়ছে। সফলতার দিক থেকে ভালো।

তিনি আরও বলেন, দুম্বার গোস্তের মধ্যে অনেক প্রোটিন ও ভিটামিন আছে। এটা ব্যয়বহুল হলেও জাহিদ ভাইয়ের মতো উদ্যোক্তারা সফল হবে। গরু-ছাগলের চেয়ে যদি একটু ব্যতিক্রম চিন্তা থেকে কেউ দুম্বার খামার গড়ে তুলতে চাইলে খুব বেশি পুঁজি লাগবে না। আর এখন কোরবানির হাটে যদি দুম্বা দেখতে পাওয়া যায়, এটা যে কারো ভালো লাগবে। যেই দুম্বা সৌদি আরব থেকে আনতে হতো সেই দুম্বা এখন আমরা হাতের নাগালে পাচ্ছি।

জাহিদের এই দুম্বার খামার দেখতে রংপুর শহর থেকে এসেছেন মোহাম্মদ শামীম। তারও ইচ্ছে আছে ছোট পরিসরে হলেও দুম্বা লালন-পালন শুরু করবেন। প্রতিবেদককে শামীম বলেন, এর আগে সরাসরি কখনো দুম্বা দেখেনি। একারণে দেখার আগ্রহ থেকে রংপুর থেকে এতো দূরে এসেছি। বেশ ভালো লাগছে।

তপ্ত মরুর দুম্বা নিয়ে খামার গড়ে তোলা প্রসঙ্গে জাহিরুল ইসলাম জাহিদ বলেন, সবাইতো গরু-ছাগল-ভেড়া লালন পালন করে থাকে। কিন্ত আমার শুরু থেকেই একটু ব্যতিক্রম চিন্তা ছিল। আমি আনকমন কিছু দিয়ে শুরু করব, যেটা আমাদের দেশে সহজলভ্য নয়। এবং আমার মাধ্যমে প্রান্তিক পর্যায়ের খামারিরা সেটা পাবেন। প্রথমে আমি হরিণ নিয়েও ভেবেছি। পরে বিভিন্ন খামার পরির্দশন ও অনেক কিছু জেনে শুনে দুম্বা নিয়ে আগ্রহ তৈরি হয়। এরপর ভারত এবং পাকিস্তানী টার্কিজ প্রজাতির দুম্বা দিয়ে খামার গড়ে তোলার কাজ শুরু করি।

জাহিদের স্বপ্ন প্রান্তিক পর্যায়ে বেকার সমস্যা দূরীকরণে দুম্বার লালন-পালনে উদ্যোক্তা তৈরি করা। এজন্য তিনি প্রান্তিক পর্যায়ে দুম্বা সরবরাহ করতে চান। যাতে একটা সময় রংপুর অঞ্চলের পাশাপাশি সারা দেশে দুম্বা সহজলভ্য হয়ে উঠে। শুধু তাই নয়, কোরবানির হাটগুলোতে যাতে দুম্বার সরবরাহ থাকে, সেটি নিশ্চিত করতে বড় পরিসরে খামার গড়ার স্বপ্ন বুনছেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, আমাদের দেশে কোরবানির ঈদে অনেকেই গরু, ছাগল, ভেড়া, মহিষ ও উট কিনে থাকেন। কিন্তু দুম্বা খুব একটা কিনতে দেখা যায় না। এর চাহিদা থাকলেও হাটগুলোতে এর আমদানি দেখা যায় না। আমার ইচ্ছে আছে, বাংলাদেশের প্রত্যেক প্রান্তে এই প্রাণিকে ছড়িয়ে দেয়া। আমার আগে অনেক খামারি ভাই দুম্বার খামার গড়েছেন। আমি এখন ছোট পরিসরে শুরু করলেও স্বপ্নটা অনেক বড়। আমি বিশ্বাস করি, প্রান্তিক পর্যায়ে দুম্বা ছড়িয়ে দিতে পারলে একটা সময় দুম্বার চাহিদা সবখানেই বাড়বে।

জাহিদ বলেন, মরুভূমির প্রাণি হলেও বাংলাদেশের আবহাওয়া ও পরিবেশ দুম্বা লালন-পালনের জন্য সহনীয়। একারণে দেশের অনেকেই দিন দিন দুম্বার খামার গড়ে তুলছেন। আমি নিজেও বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসব দুম্বা ক্রয় করে খামার ধীরে ধীরে বড় করার চেষ্টা করছি। যেকেউ দুই-তিনটা দুম্বা দিয়ে ছোট পরিসরে খামারের শুরুটা করতে পারবে। এক্ষেত্রে ছয় মাস বয়সের বাচ্চা দুম্বা কিনতে গেলে ৮০ হাজার থেকে এক লাখ ২০ হাজার টাকা দাম পড়বে। বয়স্ক প্রতিটা দুম্বা পড়বে দেড় লাখ থেকে দুই লাখ টাকা। বাংলাদেশে দুম্বার ভবিষ্যত উজ্জ্বল তাই খামার গড়তে পারলে সফল উদ্যোক্তা হতে বেশি কষ্ট পোহাতে হবে না।

তিনি আরও জানান, তার খামারে থাকা একেকটি দুম্বার ওজন কমপক্ষে ৭৫ থেকে ১২০ কেজি পর্যন্ত হবে। ভবিষ্যতে দুবাইয়ের আউয়াসি প্রজাতির দুম্বার পাশাপাশি দেশীয় ব্লাক বেঙ্গল ছাগল লালন-পালন এবং বাণিজ্যিকভাবে সরবরাহ করতে খামার বিস্তৃত করার পরিকল্পনা রয়েছে তার।

এদিকে পবিত্র ঈদুল আজহা সামনে রেখে রংপুর জেলায় প্রায় তিন লাখ ৬৩ হাজার গবাদিপ্রাণি প্রস্তুত করেছেন খামারি ও গৃহস্থরা। এসব প্রাণির বিপরীতে জেলায় কোরবানির চাহিদা রয়েছে প্রায় দুই লাখ ২৪ হাজারের কিছু বেশি। ফলে এক লাখ ৩৯ হাজার কোরবানির প্রাণি উদ্বৃত্ত থাকবে।

রংপুর জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. আবু ছাঈদ বলেন, জেলার আট উপজেলায় প্রায় ২৫ হাজার খামারির ঘরে এক লাখ ৫৪ হাজার ৩২৩টি গরু এবং দুই লাখ আট হাজার ৭০০ ছাগল, ভেড়া, দুম্বা বাজারে বিক্রির জন্য প্রস্তুত রয়েছে। খামারিদের সবরকমের সহযোগিতা করা হচ্ছে বলেও জানান এই কর্মকর্তা।

তিনি আরও বলেন, ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দুম্বা একটি সেনসিটিভ প্রাণি। রংপুর জেলার পীরগঞ্জ, পীরগাছা ও সদর উপজেলার বেশ কয়েকজন খামারি দুম্বা লালন-পালন করছেন। শুধু দুম্বা নয় দুম্বার একটি জাত হচ্ছে গাড়ল। আবার ভেড়া ও গাড়ল প্রায়ই একই প্রাণি। তবে ধর্মীয় কারণে দুম্বা কোরবানির জন্য অনেকের কাছে পছন্দীয় এবং এর চাহিদাও রয়েছে।

ডা. মো. আবু ছাঈদ বলেন, আগে দুম্বার খামার না থাকলেও এখন দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। দুম্বা লালন-পালনে আলাদা কোনো প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হয় না। ভেড়া ও গাড়ল যে পদ্ধতিতে পালন করা হয়, দুম্বার ক্ষেত্রেও একই পদ্ধতি। তবে ভেড়া আমরা সবাই চিনি, গাড়ল চেনার ক্ষেত্রে গরুর বাছুরের মতো লম্বা লেজ আর দুম্বার পাছায় অনেক মাংস থাকবে।