রেলে লুটপাটের কাহিনী-২ : তাবাসসুমের দুই সহযোগী সাদরুল ও সালাহউদ্দিন

- Update Time : ০৯:২১:৩৯ অপরাহ্ন, বুধবার, ২১ মে ২০২৫
- / ১০৩ Time View
রেলওয়ে লুটপাটের নেত্রী তাবাসসুমের দুই সহযোগী সাদরুল ও ছাত্রলীগ ক্যাডার সালাহউদ্দিন। এই দু’জন ঘুরেফিরে গত ২১ বছর সদর দফতরেই চাকরি করছেন। এদের সহযোগিতায়ই তাবাসসুম গং রেলে লুটপাট চালিয়েছে নির্বিঘ্নে। তাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে এখনো রেল ভবন।
মসনদের মোহে মোহাবিষ্ট সাদরুল :
মোঃ সাদরুল হক, যুগ্ম-মহাপরিচালক (উন্নয়ন)। ২২ বছর চাকুরী জীবনের ২১ বছরই রেলভবনে চাকুরী করছেন। তিনি নামে ইঞ্জিনিয়ার কামে একজন অফিস বেয়ারার। কারণ তার পুরো চাকুরী জীবন কেরানীর চাকুরী ছাড়া কিছু করেন নাই।। মাঠপর্যায়ে একবার পদায়ন পেয়েছিলেন, কিন্তু ছয় মাসের মাথায় কুকীর্তির জন্য তাকে ফিরিয়ে আনতে বাধ্য হয়েছিল প্রশাসন। এরপর থেকে সাদরুল ফ্যাসিস্ট সরকারের আনুকূল্য নিয়ে রেল প্রশাসন চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নিয়েছেন। ডিজির পিএস এবং ডাইরেক্টরের মতো পদে তিনি পতিত সরকারের পুরো সময় কর্মরত ছিলেন। একজন আপাদমস্তক ‘বেয়াদব কর্মকর্তা’ বলে তার বিরুদ্ধে বিশাল অভিযোগ করেছেন কোন এক রেল কর্মী।
তার নেতৃত্বে রেলের বিতর্কিত নিয়োগ বিধি প্রণীত হয়। এই নিয়োগ বিধি রেলের জন্য এখন বিরাট বিষফোড়াঁ। নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য সাদরুল গং যে বিধি প্রনয়ণ করেছে, রেলকে পঙ্গু করার জন্য তা যথেষ্ট। শ্রমিক কর্মচারীদের জন্য এই বিধি একটি অভিশাপ। মাঠপর্যায়ে নিয়োগবিধি বিষয়ে ব্যাপক ক্ষোভ বিরাজ করছে। নতুন নিয়োগ এবং পদোন্নতি এই নিয়োগবিধির কারণে মুখ থুবড়ে পড়েছে। শ্রমিকবান্ধব নিয়োগবিধি প্রণিত না হলেও সাদরুল তার নিজের জন্য গ্রেড-৩. গ্রেড-২ পদ সৃষ্টি করেছেন এবং গ্রেড-৪ কর্মকর্তা হয়ে তদবিরবাজি রেলের সংস্থাপন প্রধান হিসেবে পদায়িত হয়েছেন।
লোভনীয় পদ আর সংস্থাপনের মতো কর্তৃত্ববাদী পদ ছাড়া তার চলেই না। রেলের অন্যান্য কর্মকর্তারা যেখানে মাঠ প্রশাসনে বছরের পর বছর কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছেন, সাদরুল গং সেখানে ব্যস্ত প্রাসাদ লীলায়। আওয়ামী আমলে রেলভবনে পদায়ন সাদরুল গংদের আর্শীবাদ ছাড়া সম্ভব ছিল না। পটপরিবর্তনের পরে শ্রমিকরা তার বদলীর দাবী জানান। অজ্ঞাত কারণে তাকে রেলভবনেই অন্য পদে বদলী করা হয়। বদলীর সময় তিনি নিয়ম কানুনের কোন তোয়াক্কা না করে নিজেই আগের পদের গাড়ি বদলীকৃত পদে নিয়ে যান। আগের পদের জ্বালানী মজুরীর বিপরীতে অদ্যাবধি গাড়ি ব্যবহার করছেন। রেলের উভয় জোনের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো শূন্য থাকা স্বত্বেও এই সাদরুল গংদের রেলভবনে কেন সুরক্ষা দেয়া হচ্ছে সেটি রেল কর্মীদের নিকট একটি বড় প্রশ্ন।
ছাত্রলীগের ক্যাডার এম এম সালাহউদ্দিন :
এম এম সালাহউদ্দিন, যুগ্ম-মহাপরিচালক (অপারেশন)। ছাত্রলীগ নেতা সালাহউদ্দিনের বাড়ি সন্দ্বীপ। চট্টগ্রামের কুখ্যাত সন্ত্রাসী আজম নাসিরের বিশ্বস্ত চেলা হিসেবে তিনি বেশি পরিচিত। ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের ক্যাডার হিসেবে বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে জড়িত ছিলেন। তার কুখ্যাত বিভিন্ন কর্মকান্ডের মধ্যে চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে সাইদি হজুরের তাফসীর মাহফিলে বোমা হামলা করা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। জানা যায় যে, তাফসীর মাহফিলে বোমা হামলা করে একবার এই সন্ত্রাসী সালাহউদ্দিন ধরাও খেয়েছিলেন। পাবলিক গণধোলাই শুরু করলে আজম নাসিরের কল্যাণে বেঁচে যান।
এই সন্ত্রাসী সালাহউদ্দিন তার ২২ বছর চাকুরী জীবনের ২১ বছরই রেলভবনে কাটিয়েছেন। ফ্যাসিস্ট সরকারের সহযোগী হিসেবে বিগত দুই বছর ধরে তিনি রেলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদ এডিজি অপারেশন হিসেবে কাজ করেন। তার চেয়ে সিনিয়র যোগ্য কর্মকর্তা থাকা সত্বেও সাদরুল গংদের সহায়তায় তিনি অন্যায়ভাবে এই পদটি আঁকড়ে থেকেছেন। অদক্ষ এবং দুর্নীতিবাজ হওয়া সত্বেও তিনি ‘মামা’র বদৌলতে লাভজনক পদে চাকুরী করেছেন। আওয়ামী সরকারের দিনের ভোট রাতে করার কুখ্যাত কারিগর সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার হাবিবুল আউয়ালের আপন ভাগিনা এই এম এম সালাহউদ্দিন। মামার দাপটে রেলভবনকে তিনি তার রাজনৈতিক অফিস বানিয়েছেন। ট্রেন অপারেশন বাদ দিয়ে অফিস কক্ষে বসে তিনি কর্মীসভা করেন।
তিনি সব সময় তার চেম্বারে আওয়ামী নেতাদের কাজ ভাগ বাটোয়ারায় ব্যস্ত থাকেন। সহজ ডট কম. অন বোর্ড সার্ভিসসহ সকল বেসরকারী ট্রেনের লীজ আউট বন্দোবস্ত তিনি করেন। এগুলো তিনি আগে করতেন এবং এখনো করেন। কারো কিছু বলার সাধ্য কোথায়? এখন যে তিনি রেল উপদেষ্টার এলাকার লোক এবং কাছের আত্মীয়। এমনটা তিনি সকলকে বলে বেড়ান। অবশ্য সন্দ্বীপের লোকজন এসে তার সাথে চেম্বারে দেখা করেন বা করতেই পারেন। ব্যাস এটাই তার এখনকার পুঁজি। আপাদমস্তক আওয়ামী প্রেতাত্মা, ভোল পাল্টে এখন জামায়াত এবং উপদেষ্টার কাছের লোক। দিন বদল হলেও সালাহউদ্দিন এখন নতুনরূপে পুরাতন ভূমিকায়। তার কর্মকালে মারাত্মক সিডিউল বিপর্যয়ের জন্য রেলওয়ের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে। রেল লোকসান করেছেন আগের যে কোন সময়ের চেয়ে বেশি। মাঠ পর্যায়ে কোন কাজের অভিজ্ঞতা না থাকায় তিনি ট্রেন অপারেশনের কিছুই জানেন না। পরিবহন বিভাগের সকলেই জানেন তিনি একজন অদক্ষ, ক্ষমতালোভী এবং দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা। কর্মচারীদের সাথে দুর্ব্যবহারের জন্য অনেকে তাকে একজন সাইকো পেশেন্ট হিসেবে জানেন।
সাবেক ডিজি সরদার সাহাদাত আলীর অনুকূল্যও ছিল তার জন্য আশীর্বাদ স্বরূপ। বর্তমান রেল উপদেষ্টা ফাওজুল কবিরের এলাকার লোক হিসেবে সালাহউদ্দিনের মাধ্যমে সরদার সাহাদত চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের আশা করেছিলেন। ষড়যন্ত্র স্বরূপ পরবর্তী ডিজি হবার ১নং তালিকার পার্থ সরকারকে সরিয়ে দিয়ে যান্ত্রিক বিভাগের আর একজন অদক্ষ কমকর্তা আহমেদ মাহবুব চৌধুরীকে এডিজি আরএম হিসেবে পদায়ন করেন। আহমেদ মাহবুবের অদক্ষতার কারণে যান্ত্রিক বিভাগ এখন প্রায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। রেলের উর্ধ্বতন লেভেলে এমন দুজন কর্মকর্তাকে পদায়ন করে সরদার সাহাদাত আলী রেলের যে ক্ষতি করে গেছেন, সেখান থেকে রেল কবে উদ্ধার পাবে তা আল্লাহ মালুম।
তার এই সকল যড়যন্ত্রের মূলে হলো স্বঘোষিত ছাত্রলীগ নেতা সালাহউদ্দিন। তিনি নিজেকে উপদেষ্টার আত্মীয় পরিচয় দিয়ে সবাইকে বদলী করে দেয়ার ভয় দেখান। এহেন প্রেক্ষাপটে তাকে ঢাকার বাইরে বদলী করার সাহস কে দেখাবেন? সে কারণে পটপরিবর্তনের পরেও সন্ত্রাসী ছাত্রলীগ নেতা আছেন বহাল তবিয়তে। চাকুরী জীবনের ৭/৮ মাস তিনি চট্টগ্রামে কাজ করেছেন। কিন্তু এই সময়ে তিনি অবৈধ রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে কর্মচারীদের কল্যাণ প্রতিষ্ঠান রেলওয়ে মেন্স স্টোরের চেয়ারম্যান হন। চেয়ারম্যান হয়ে তিনি মেন্স স্টোরের কুখ্যাত শামীমের সহায়তায় কোটি কোটি টাকা আত্মসাত করেন।
ঢাকার ডিআরএম থাকার সময় তার কল্যানে কমলাপুর রেল স্টেশন অপরাধীদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়। টিকেট কালোবাজারী, টেন্ডারবাজি, বাসাবাড়ি দখলসহ নানাবিধ অপরাধ কর্মকান্ড তার ছত্রছায়ায় সংগঠিত হয়। আওয়ামী সন্ত্রাসীদের সাথে গোপন বৈঠক এবং চাঁদাবাজির ভাগ বাটোয়ারার জন্য একটি বিশেষ কক্ষ তার জন্য সংরক্ষিত রাখতেন। জেডিজি অপারেশন হিসেবে তার অধীনে কয়েকটি নবনিয়োগ সম্পন্ন হয়েছে। সেই নিয়োগগুলো নিয়ে অনেক অভিযোগ আছে। সাবেক সচিব হুমায়ুন কবির এবং সাবেক ডিজি কামরুল আহছানের দেয়া তালিকা অনুযায়ী তিনি কর্মচারী নিয়োগ দিতেন। এসব নিয়োগ নিয়ে ব্যাপক আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে।
আওয়ামী প্রেতাত্মা সালাহউদ্দিনের কারণে বিএনপি নেতা মির্জা আব্বাস পরিবারের সাথে রেলওয়ের সম্পর্ক নষ্ট হয়। মির্জা পরিবারের অসংখ্য স্থাপনা ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিয়ে তিনি অনেক আওয়ামী নেতাদের দখলদারিত্বের সুযোগ করে দিয়েছেন। সরকারী চাকুরী করেও তার এই রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বা হেনস্তা করার বিষয়টি রেলকে বিব্রত করেছে। অথচ এটা নিয়ে প্রায়ই তিনি উল্লাস করতেন, এমনকি বিভিন্ন সভা সমাবেশে মির্জা পরিবারকে হেনস্থা করার গল্প শুনিয়ে নিজেকে হিরো দাবী করতেন।
অথচ সম্প্রতি তিনি রেলওয়ে অফিসার্স কলোনির মধ্যে তার বাসার পাশে অবৈধ আইটহাউস তৈরি করেছেন। এ বিষয়ে কমকর্তারা অভিযোগ জানালেও অজ্ঞাত কারণে প্রকৌশল বিভাগ সরকারী খরচে তার অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করে দেন। অনেক কর্মকর্তার বাসায় নূন্যতম মেরামতের অনুরোধ রাখা হয় না। অভিযোগ আছে, সালাহউদ্দিন রেল উপদেস্টার প্রভাব খাটিয়ে প্রকৌশল বিভাগের কর্মকর্তাদের হুমকি দিয়ে অসৎ উদ্দেশ্যে এই অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করেছেন। কলোনীর বাসিন্দারা আশংকা করছেন, তার এই অবৈধ আউটহাউস পতিত সরকারের পুনর্বাসনের সূতিকাগার কিনা। (চলবে)