ঢাকা ০১:৩৬ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৩ অক্টোবর ২০২৫, ৭ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
ব্রেকিং নিউজঃ
শরীয়তপুরের জেলা জজের অবাক কাণ্ড (পর্ব-১)

রায় ছিঁড়ে পছন্দের বিচারকের কাছে পুন: বিচারের জন্য পাঠালেন শরীয়তপুরের জেলা জজ

নওরোজ রিপোর্ট
  • Update Time : ০৯:০২:৪২ অপরাহ্ন, বুধবার, ২২ অক্টোবর ২০২৫
  • / ৫৮৩ Time View

শরীয়তপুরের জেলা জজ মো. সোলায়মান

মোটা অংকের ঘুষ হালাল করার জন্য নিষ্পত্তি করা রায় ছিঁড়ে ফেলে এন্টিডেটেড (প্রকৃত তারিখের পূর্ববর্তী তারিখ) কাগজপত্র তৈরি করে পুনরায় বিচারের জন্য অন্য আদালতে পাঠিয়ে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের নজিরবিহীন এক কাণ্ড ঘটিয়েছেন শরীয়তপুরের জেলা জজ মো. সোলায়মান।

শুধু তাই নয়, এই জাল-জালিয়াতির ঘটনায় অনুপ কুমার নামে অপর এক জেলা জজের সম্পৃক্ততাও পাওয়া গেছে, যিনি বর্তমানে জয়পুরহাটের জেলা জজ।

শরীয়তপুরের সাবেক সিনিয়র সহকারী জজ মো. আরিফুল ইসলাম গত বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর একটি মামলার রায় ঘোষণা করেন, যা ডায়েরি ও কজলিস্টে উল্লেখ আছে। ওই রায়ের ফটোকপিও নওরোজের কাছে হস্তগত হয়েছে। এমনকি তার দেওয়া রায়ের দেওয়ানী ১৬৭/২১ মোকদ্দমার শেষ আদেশটিও লেখার সুযোগ দেওয়া হয়নি। নথিটি সহকারী জজ সাদ্দাম হোসেনের কোর্টে বদলি করে ওই রাতেই মামলার রেকর্ড জেলা জজ নিজ হেফাজতে নিয়ে রায়টি ছিঁড়ে ফেলেন। সংশ্লিষ্ট কোর্টের বেঞ্চ সহকারী সূত্রে বিষয়টি জানা গেছে।

ওই সময় জেলা জজ হিসেবে কর্মরত ছিলেন মো. সোলায়মান। তিনি গত বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর অর্থাৎ রায় ঘোষণার সাত দিন আগে শরীয়তপুরে যোগ দেন। তিনি পূর্বে একই জেলায় যুগ্ম জেলা জজের দায়িত্ব পালন করেন। সেই সময় তার সাথে অনেক বিতর্কিত লোকজনের মেলামেশা ছিল বলে জনশ্রুতি আছে। জেলা জজ হিসেবে বদলি হয়ে শরীয়তপুরে এসেই পূর্বের পছন্দের লোকদের সাথে আবারও সখ্য গড়ে তোলেন তিনি। এরই মধ্যে তার নজরে পড়ে ভেদরগঞ্জ সিনিয়র সহকারী জজ আদালতের নিষ্পত্তিকৃত দেওয়ানী মোকদ্দমা ১৬৭/২১ নম্বর মামলার প্রতি।

বিভিন্ন সূত্র জানায়, ওই মামলায় মোটা অংকের অর্থ হাতিয়ে নেন মো. সোলায়মান। কিন্তু এরই মধ্যে মামলার রায় ঘোষিত হলে তিনি পড়েন বিপাকে।
পরে ভুয়া কাগজপত্র যেমন পূর্বের জেলা জজ অনুপ কুমারের নাম ব্যবহার করে নথি তলব করেন। কিন্তু বিষয়টি জানাজানি হওয়ায় তিনি তড়িঘড়ি করে একই দিনের তারিখ দেখিয়ে একটি মিস কেস যার নম্বর ৮৯/২৪ সৃজন করেন, যা রেজিস্ট্রারে ভিন্ন কালিতে লেখা আছে।
অনুপ কুমারের নামে সৃজিত তলবপত্রের বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার জন্য পরবর্তীতে যোগসাজসে মিস কেস সৃজন করেন, যার মধ্য দিয়ে তার অপকর্মটি প্রমাণিত হয়। শুধু তাই নয়, এই জালিয়াতির বিষয়টি যাতে ধরা না পড়ে সেজন্য সোলায়মান পরবর্তীতে তার সংশ্লিষ্ট কোর্টের বিচারককে ওই বছরের ২৬ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার রাতে তাড়াহুড়ো করে অপেক্ষাকৃত জুনিয়র আদালতে বদলি করেন এবং রোববার পূর্বাহ্নে কার্যকর বলে আদেশ দেন। অর্থাৎ তাকে পেন্ডিং কাজ সম্পন্ন বা চার্জ হ্যান্ডওভার-টেকওভারের সুযোগ দেওয়া হয়নি। এরপর ২৯ সেপ্টেম্বর ওই সিনিয়র সহকারী জজকে নিজ কক্ষে ডেকে এনে বিষয়টি নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে পরিণাম ভয়াবহ হবে এবং এসিআর খারাপ দেবে বলে হুমকি দেন।

আদালত সূত্রে জানা যায়, এ নিয়ে কর্মচারীরা ভীতসন্ত্রস্ত ও বিব্রতকর অবস্থায় আছেন। কখন জেলা জজের খড়গ তাদের উপর নেমে আসে এই আশঙ্কায় আছেন কর্মচারীরা। তার অপকর্মকে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য এরই মধ্যে কয়েকজন কর্মচারীকে অন্যত্র বদলিও করেছেন।

জেলা জজ সোলায়মান সিনিয়র সহকারী জজ আরিফুল ইসলামকে (যিনি বর্তমানে ঢাকার সিএমএম কোর্টে এম এম হিসেবে কর্মরত) টেলিফোনে শরীয়তপুরে দেখা করার জন্য ডাকলে আরিফুল ১৫ অক্টোবর সেখানে যান। জেলা জজের খাস কামরায় আরিফুল ইসলামের সাথে অমানবিক ও অপেশাদার আচরণ এবং বিশ্রি ভাষায় তুই-তোকারি করে কথা বলে চেঁচামেচি করেন।

জেলা জজ উত্তেজিত হয়ে বলেন, ‘তুই কেন এই রায় ছেঁড়ার বিষয় মানুষজনকে জানিয়েছিস। তোকে ফৌজদারি কেস করে সোজা জেলে পাঠিয়ে দেব। তোমার বিরুদ্ধে প্রসিডিং দাঁড় করিয়ে দেব। তুমি সোলায়মানকে চেন না। আমি উপদেষ্টা, আইন সচিব, প্রধান বিচারপতি সবার কাছে তোমার বিরুদ্ধে নালিশ দিয়ে ক্যারিয়ার শেষ করে দেব।’

জেলা জজের চিৎকার শুনে আশেপাশের স্টাফরা জড়ো হন।

জেলা জজের এমন মারমুখী আচরণ, দুর্ব্যবহার ও কথোপকথনের অডিও রেকর্ড নওরোজের কাছে হস্তগত হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে এই প্রতিবেদক সুপ্রিম কোর্টের কয়েকজন বিচারপতি ও আইনজীবীর সাথে কথা বললে তারা বিস্মিত হয়ে বলেন, ‘এমন উন্মাদ ব্যক্তি কীভাবে জেলা জজ হলো।’

Please Share This Post in Your Social Media

শরীয়তপুরের জেলা জজের অবাক কাণ্ড (পর্ব-১)

রায় ছিঁড়ে পছন্দের বিচারকের কাছে পুন: বিচারের জন্য পাঠালেন শরীয়তপুরের জেলা জজ

নওরোজ রিপোর্ট
Update Time : ০৯:০২:৪২ অপরাহ্ন, বুধবার, ২২ অক্টোবর ২০২৫

মোটা অংকের ঘুষ হালাল করার জন্য নিষ্পত্তি করা রায় ছিঁড়ে ফেলে এন্টিডেটেড (প্রকৃত তারিখের পূর্ববর্তী তারিখ) কাগজপত্র তৈরি করে পুনরায় বিচারের জন্য অন্য আদালতে পাঠিয়ে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের নজিরবিহীন এক কাণ্ড ঘটিয়েছেন শরীয়তপুরের জেলা জজ মো. সোলায়মান।

শুধু তাই নয়, এই জাল-জালিয়াতির ঘটনায় অনুপ কুমার নামে অপর এক জেলা জজের সম্পৃক্ততাও পাওয়া গেছে, যিনি বর্তমানে জয়পুরহাটের জেলা জজ।

শরীয়তপুরের সাবেক সিনিয়র সহকারী জজ মো. আরিফুল ইসলাম গত বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর একটি মামলার রায় ঘোষণা করেন, যা ডায়েরি ও কজলিস্টে উল্লেখ আছে। ওই রায়ের ফটোকপিও নওরোজের কাছে হস্তগত হয়েছে। এমনকি তার দেওয়া রায়ের দেওয়ানী ১৬৭/২১ মোকদ্দমার শেষ আদেশটিও লেখার সুযোগ দেওয়া হয়নি। নথিটি সহকারী জজ সাদ্দাম হোসেনের কোর্টে বদলি করে ওই রাতেই মামলার রেকর্ড জেলা জজ নিজ হেফাজতে নিয়ে রায়টি ছিঁড়ে ফেলেন। সংশ্লিষ্ট কোর্টের বেঞ্চ সহকারী সূত্রে বিষয়টি জানা গেছে।

ওই সময় জেলা জজ হিসেবে কর্মরত ছিলেন মো. সোলায়মান। তিনি গত বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর অর্থাৎ রায় ঘোষণার সাত দিন আগে শরীয়তপুরে যোগ দেন। তিনি পূর্বে একই জেলায় যুগ্ম জেলা জজের দায়িত্ব পালন করেন। সেই সময় তার সাথে অনেক বিতর্কিত লোকজনের মেলামেশা ছিল বলে জনশ্রুতি আছে। জেলা জজ হিসেবে বদলি হয়ে শরীয়তপুরে এসেই পূর্বের পছন্দের লোকদের সাথে আবারও সখ্য গড়ে তোলেন তিনি। এরই মধ্যে তার নজরে পড়ে ভেদরগঞ্জ সিনিয়র সহকারী জজ আদালতের নিষ্পত্তিকৃত দেওয়ানী মোকদ্দমা ১৬৭/২১ নম্বর মামলার প্রতি।

বিভিন্ন সূত্র জানায়, ওই মামলায় মোটা অংকের অর্থ হাতিয়ে নেন মো. সোলায়মান। কিন্তু এরই মধ্যে মামলার রায় ঘোষিত হলে তিনি পড়েন বিপাকে।
পরে ভুয়া কাগজপত্র যেমন পূর্বের জেলা জজ অনুপ কুমারের নাম ব্যবহার করে নথি তলব করেন। কিন্তু বিষয়টি জানাজানি হওয়ায় তিনি তড়িঘড়ি করে একই দিনের তারিখ দেখিয়ে একটি মিস কেস যার নম্বর ৮৯/২৪ সৃজন করেন, যা রেজিস্ট্রারে ভিন্ন কালিতে লেখা আছে।
অনুপ কুমারের নামে সৃজিত তলবপত্রের বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার জন্য পরবর্তীতে যোগসাজসে মিস কেস সৃজন করেন, যার মধ্য দিয়ে তার অপকর্মটি প্রমাণিত হয়। শুধু তাই নয়, এই জালিয়াতির বিষয়টি যাতে ধরা না পড়ে সেজন্য সোলায়মান পরবর্তীতে তার সংশ্লিষ্ট কোর্টের বিচারককে ওই বছরের ২৬ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার রাতে তাড়াহুড়ো করে অপেক্ষাকৃত জুনিয়র আদালতে বদলি করেন এবং রোববার পূর্বাহ্নে কার্যকর বলে আদেশ দেন। অর্থাৎ তাকে পেন্ডিং কাজ সম্পন্ন বা চার্জ হ্যান্ডওভার-টেকওভারের সুযোগ দেওয়া হয়নি। এরপর ২৯ সেপ্টেম্বর ওই সিনিয়র সহকারী জজকে নিজ কক্ষে ডেকে এনে বিষয়টি নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে পরিণাম ভয়াবহ হবে এবং এসিআর খারাপ দেবে বলে হুমকি দেন।

আদালত সূত্রে জানা যায়, এ নিয়ে কর্মচারীরা ভীতসন্ত্রস্ত ও বিব্রতকর অবস্থায় আছেন। কখন জেলা জজের খড়গ তাদের উপর নেমে আসে এই আশঙ্কায় আছেন কর্মচারীরা। তার অপকর্মকে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য এরই মধ্যে কয়েকজন কর্মচারীকে অন্যত্র বদলিও করেছেন।

জেলা জজ সোলায়মান সিনিয়র সহকারী জজ আরিফুল ইসলামকে (যিনি বর্তমানে ঢাকার সিএমএম কোর্টে এম এম হিসেবে কর্মরত) টেলিফোনে শরীয়তপুরে দেখা করার জন্য ডাকলে আরিফুল ১৫ অক্টোবর সেখানে যান। জেলা জজের খাস কামরায় আরিফুল ইসলামের সাথে অমানবিক ও অপেশাদার আচরণ এবং বিশ্রি ভাষায় তুই-তোকারি করে কথা বলে চেঁচামেচি করেন।

জেলা জজ উত্তেজিত হয়ে বলেন, ‘তুই কেন এই রায় ছেঁড়ার বিষয় মানুষজনকে জানিয়েছিস। তোকে ফৌজদারি কেস করে সোজা জেলে পাঠিয়ে দেব। তোমার বিরুদ্ধে প্রসিডিং দাঁড় করিয়ে দেব। তুমি সোলায়মানকে চেন না। আমি উপদেষ্টা, আইন সচিব, প্রধান বিচারপতি সবার কাছে তোমার বিরুদ্ধে নালিশ দিয়ে ক্যারিয়ার শেষ করে দেব।’

জেলা জজের চিৎকার শুনে আশেপাশের স্টাফরা জড়ো হন।

জেলা জজের এমন মারমুখী আচরণ, দুর্ব্যবহার ও কথোপকথনের অডিও রেকর্ড নওরোজের কাছে হস্তগত হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে এই প্রতিবেদক সুপ্রিম কোর্টের কয়েকজন বিচারপতি ও আইনজীবীর সাথে কথা বললে তারা বিস্মিত হয়ে বলেন, ‘এমন উন্মাদ ব্যক্তি কীভাবে জেলা জজ হলো।’