ঢাকা ০৮:০০ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৩০ মে ২০২৫, ১৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

রংপুরের খামার গুলোতে ওজনদরে মিলছে গরু, সারা পড়ে‌নি হাটগুলোতে

কামরুল হাসান টিটু, রংপুর ব্যুরো
  • Update Time : ০৭:৩৫:৫৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৮ মে ২০২৫
  • / ১০০ Time View

হাতছা‌নি দি‌য়ে ডাকছে কোরবানির ঈদ। কোরবানির জন্য গরু-ছাগল কেনাবেচা শুরু হলেও রংপুরের পশুর হাটগুলোতে তেমন সারা পড়ে‌নি। বিগত সময়ে কোরবানির পশুর হাটগুলোতে ইজারাদারের লোকজন ও দালাল কর্তৃক নানাভাবে হয়রানির শিকার হওয়ায় ক্রেতা-বিক্রেতারা হাটবিমুখ হচ্ছেন। ঈদকে ঘিরে অবস্থাপন্নরা বিভিন্ন খামারে পছন্দের গরু বুকিং দিয়ে রেখেছেন। আর সাধারণ ক্রেতাসহ দূর থেকে আসা পাইকাররা হাটে ঝক্কি-ঝামেলা এড়াতে হাটকেন্দ্রিক বিভিন্ন রাস্তার মোড়ে হাটের উদ্দেশ্যে আসা গরু-ছাগল আটকিয়ে দরদাম করে কেনার চেষ্টা করছেন।

কোথাও কোথাও ওজন মেপে চলছে কোরবানির পশুর বেচাকেনা। হাটের ঝক্কি-ঝামেলা এড়াতে এবং স্টেরয়েডমুক্ত পশু কিনতে ক্রেতারা ভিড় করছেন ওজনদরে বিক্রি হচ্ছে এমন গরুর ফার্মে। রংপুর মহানগরীর মাহিগঞ্জের দেওয়ানটুলি এলাকায় জমজম ক্যাটল ফার্মে চার বছর ধরে এই পদ্ধতিতে গরু বিক্রি হচ্ছে। প্রতিদিনই ফার্মে আগ্রহী ক্রেতারা আসছেন এবং গরু দেখছেন। পছন্দ হলে ওজন স্কেলে উঠিয়ে পরিমাণ দেখে খামারেই গরু রেখে যাচ্ছেন। ঈদুল আজহার এক দিন বা দুই দিন আগে গরু নিয়ে যাবেন।

বর্তমানে ক্রেতারা ঝক্কি-ঝামেলামুক্ত এবং ফ্রেশ গরু কিনতে ছুটছেন এমন খামারে। তবে এভাবে গরু বিক্রি করে ক্রেতা-বিক্রেতা লাভবান হলেও রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। ক্রেতারা বলছেন, ওজন স্কেলে গরু বেচাকেনায় সুবিধা অনেক। ওজন স্কেলে গরু মেপে বেচাকেনার কারণে ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে ঠকে যাওয়ার চিন্তা নেই। বাজেট অনুযায়ী সুস্থ-সবল পশু কিনতে পারছেন তারা।

রংপুর জেলার পশুর হাটগুলোর মধ্যে অন্যতম গঙ্গাচড়ার বেতগাড়ি হাট। সপ্তাহে দু’দিন প্রতি শনি ও মঙ্গলবার এই হাট বসে। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে বেতগাড়ি হাট ঘুরে দেখা গেছে, অন্যান্য বছরের তুলনায় গরুর আমদানি কম, দামও বেশি চাওয়া হচ্ছে। বিগত বছরগুলোতে এই হাটে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা পাইকারদের পাশাপাশি স্থানীয় ক্রেতাদের ভিড় লক্ষ্য করা গেলেও এবারে তেমনটা চোখে পড়েনি। হাতেগোনা কিছু পাইকারের দেখা মিললেও কেনা-বেচা আগের মত নেই।

হাটে আসা পাইকার ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত বছর যে গরু ৬৫ থেকে ৭০ হাজার টাকায় কেনা যেত, এবারে সেই গরু কিনতে হচ্ছে ৭৫ থেকে ৮০ হাজার টাকায়। গরু কিনতে ঢাকা থেকে আসা পাইকার ফয়েজ উদ্দিন ব্যাপারী ও জুনায়েদ আহম্মেদ জানান, অন্যান্য বছরে কোরবানির ঈদের ১৫ থেকে ২০ দিন আগে ঢাকা, চট্রগ্রামসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে পাইকাররা এসে রংপুরের হাটগুলো থেকে গরু কিনে নিয়ে যেতো। এবারে সেই সংখ্যা একেবারেই কম।

এর কারণ হিসেবে তারা বলেন, হাট ইজারাদারের লোকজন কর্তৃক হাসিল বা খাজনার নামে জোর করে বেশি টাকা আদায়, দালালদের উৎপাত ছাড়াও পরিবহন খরচ আগে চেয়ে বেশি হওয়ায় পাইকাররা আগ্রহ হারিয়েছেন। এ বছর এখনো বেশি হাসিল আদায় না হলেও দালালদের অসহনীয় উৎপাত আছে। তবে বিক্রেতারা আগেভাগে কিনতে আসায় বিক্রেতারা গরুর দাম ছাড়তে রাজি হচ্ছেন না বলেও জানান তারা।

গঙ্গাচড়া উপজেলার পাশ্ববর্তী ধনতোলা গ্রাম থেকে বিক্রির জন্য গরু নিয়ে বেতগাড়ি হাটে আসা হাসেম আলী বলেন, লোকজন খালি দাম পুছ (জিজ্ঞেস) করে আর যায়, কায়ও সাহস করি দাম করেনা বা গরু কেনেনা। এক লাখ ১০ হাজার টাকায় একটি মাঝারি সাইজের দেশীয় ষাড় গরু কেনেন খলেয়া গঞ্জিপুর এলাকার আব্দুস সোবহান। তিনি বলেন, ঈদ ঘনিয়ে আসলে হাটের ভিরে গরু কেনা দুষ্কর হয়ে পড়বে। তাই আগেভাগেই কিনলাম, যদিও গোখাদ্যের দামের অজুহাতে এবারে গরুর দামও কিছুটা বেশি।

গরু দেখতে আসা আনিছুর রহমান বলেন, কিনতে নয়, দাম যাচাই করতে হাটে এসেছি। ঝক্কি-ঝামেলা এড়াতে কোরবানির জন্য একটি খামারে আগেই গরু বুকিং দিয়ে রেখেছি। ঈদের আগের দিন সেখান থেকে তারা গরু নিয়ে যাবেন বলে জানান।

হাটে গরু কিনতে আসা কলেজশিক্ষক শাহীন ইসলাম বলেন, বহু কষ্টে উপার্জিত অর্থ দিয়ে একটি গরু কেনার জন্য হাটে এসেছি। কিন্তু দালালকে ডিঙ্গিয়ে হাটে গরু কেনার কোনো সুযোগ নেই। নিজেরা দরদাম করে গরু বের করলেও নানা কায়দায় দালালরা টাকা আদায় করেন।

হাট থেকে বেরিয়ে বিভিন্ন রাস্তার মোড়ে গিয়ে দেখা যায়, হাটে ঢোকার আগেই দামাদামি করে গরু কিনছেন ক্রেতারা। হাটের এক কিলোমিটার দক্ষিণে ধনতোলা সড়কে ৮০ হাজার টাকায় গরু কেনেন পাগলাপীর থেকে আসা ইব্রাহিম ও একরামুল। রাস্তায় গরু কিনতে পেরে তিনি বলেন, হয়তো দামে কিছুটা ঠকেছি। কিন্তু হাটে দালালের খপ্পরে পড়তে হয়নি।

উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, এর আগে বেতগাড়ি হাটের ইজারায় সরকারি দর ৩ কোটি ৭০ লাখ ৯৮ হাজার ৭২৯ টাকা হলেও এবারে ২ কোটি ৭৭ লাখ টাকায় ইজারা দেওয়া হয়েছে।

হাটের ইজারাদার শহিদুল ইসলাম জানান, ঈদ আসন্ন হলেও হাটে এবারে এখন পর্যন্ত গরুর আমদানির পাশাপাশি ক্রেতাও কম। মঙ্গলবার হাটে গরু উঠেছিল ৫ থেকে ৭ হাজার। ছোট (৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা), বড় (এক থেকে দেড় লাখ টাকা) ও মাঝারি (৮০ থেকে ৯০ হাজার টাকা) মিলে ৭০০টি গরু বিক্রি হয়েছে।

হাট ইজারায় তিনি প্রথমবার জানিয়ে বলেন, বিগত সময়ের তথ্য বলছে ঈদের ১৫ থেকে ২০ দিন আগে প্রতি হাটে সহস্রাধিক গরু বিক্রি হয়েছে। এখান থেকে হাটে ৫০টির বেশি ট্রাক দেশের বিভিন্ন স্থানে গরু পরিবহন করলেও মঙ্গলবার মাত্র দুটি ট্রাকে গরু গেছে। আগে কিনে রাখা-খাওয়ানোসহ ঝামেলা এড়াতে স্থানীয় ক্রেতারা ঈদের আগের হাটে গরু কেনেন। তাছাড়া বিশেষ করে অবস্থাপন্ন ক্রেতারা এখন হাটের চেয়ে খামারে গরু কিনতে স্বাচ্ছন্দবোধ করেন বলেও জানান তিনি।

এদিকে রংপুর মহানগরীর অন্যতম লালবাগ হাটে গত রোববারের মতো আজ বুধবার বিকেলে গিয়ে দেখা যায়, সাধারণ হাটবারের চেয়েও গরু কম। হাত গুটিয়ে বসে আছেন ইজারাদারের লোকজন। হাতেগোনা কিছু গরু উঠলেও ক্রেতা নেই।

গরু বিক্রেতা পাশ্ববর্তী ধর্মদাস এলাকার হারুন অর রশিদ জানান, তার গরু বাজারে দেড় লাখ টাকা হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কেউ দাম করেনি। গরু কিনতে আসা নগরীর এরশাদ মোড় সেনপাড়া এলাকার রাজীব ও নয়ন বলেন, আসলে শহরকেন্দ্রিক লোকজন কোরবানির গরু কিনতে এখন খামারনির্ভর হয়ে পড়েছে। আমরা হাটে এসেছি গরু দেখার জন্য। আজকে দাম শুনে যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত নিবো।

সিটি করপোরেশনের আওতায় এই হাটের ইজারার দায়িত্বে থাকা আব্দুল্লাহেল কাফি জানান, হাটে গরুর আমদানি একেবারেই কম। এছাড়া ক্রেতারাও বেশিরভাগ খামারনির্ভর এবং সাধারণ মানুষের হাতে টাকা নেই। তবে সামনের হাট থেকে ক্রেতা-বিক্রেতার সমাগম ঘটবে।

তিনি আরও জানান, বিগত বছরগুলোতে কোরবানি ঈদের ১৫ থেকে ২০ দিন আগে রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলের প্রায় দেড় হাজার গরুর হাটে ২৫ লাখেরও বেশি গরু বিক্রি হতো। এই গরুর ৮০ ভাগ ক্রেতা ছিলেন উত্তরাঞ্চলের বাইরে থেকে আসা বৃহত্তর ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, বরিশাল এলাকার গরু ব্যবসায়ী। ট্রাকে করে এগুলো নিয়ে যাওয়া হতো বাইরে। আর স্থানীয় পর্যায়ে গরু বিক্রি শুরু হতো ঈদের ঠিক সপ্তাহখানেক আগে থেকে।

অন্যদিকে, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ঈদুল আজহা উপলক্ষ্যে রংপুর বিভাগে পশুর চাহিদা রয়েছে ১৩ লাখ ১৮ হাজার ১১৭টি। তবে কোরবানির জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে ২১ লাখ ৫২ হাজার ৩১৯টি পশু। চাহিদা মিটিয়ে উদ্বৃত্ত থাকবে আরও আট লাখের বেশি পশু। বিভাগের আট জেলার দেড় লক্ষাধিক খামারির মাধ্যমে পশুগুলো পাওয়া যাবে। তবে খামারিরা বলছেন, পশুখাদ্যের দাম বাড়ায় গত বছরের তুলনায় এবার বাড়তি দামে কোরবানির পশু কিনতে হবে ক্রেতাকে।

রংপুর ডেইরি ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি লতিফুর রহমান মিলন বলেন, পশুখাদ্যসহ অন্যান্য উপকরণের দাম বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় রংপুর বিভাগে অনেক খামার বন্ধ হয়ে গেছে। আবার অনেক খামার বন্ধের পথে। যারা আছেন তাদের অনেক সংগ্রাম করতে হচ্ছে। এবার গরুর মাংসের কেজি ৭০০ থেকে ৭৫০ টাকার কমে বিক্রি করলে খামারিদের লোকসান হবে।

তিনি আরও বলেন, প্রতি বছরই সীমান্ত এলাকার বিভিন্ন হাটে ভারতীয় গরু আসার আশঙ্কা থাকে। এবারো যদি ব্যাপক হারে ভারতীয় গরু আসে তাহলে খামারিরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তবে গৃহস্তদের পালিতসহ বিভাগে আসন্ন ঈদুল আজহা ঘিরে কোরবানির জন্য পর্যাপ্ত পশু রয়েছে। এবারে কোরবানির জন্য খামারগুলোতে ক্রেতারা বিভিন্ন দামের গরু আগাম বুকিং দিয়ে রাখছেন বলেও জানান তিনি।

রংপুর বিভাগীয় প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পরিচালক নজরুল ইসলাম বলেন, কোরবানির ঈদে চাহিদা পূরণ করেও উদ্বৃত্ত পশু থাকবে আট লাখেরও বেশি। ঈদে রংপুর, রাজশাহী ও খুলনা বিভাগ থেকে সাধারণত উদ্বৃত্ত পশু বিভিন্ন স্থানে যায়। এর মধ্যে রংপুর অন্যতম। হাটগুলোয় যাতে অসুস্থ গরু বিক্রি করতে না পারে, সেজন্য বিভাগের বিভিন্ন হাটে মেডিকেল টিম কাজ করছে। পাশাপাশি হাটে আসা কোনো গরু অসুস্থ হলে মেডিকেল টিম চিকিৎসা দেবে।

Please Share This Post in Your Social Media

রংপুরের খামার গুলোতে ওজনদরে মিলছে গরু, সারা পড়ে‌নি হাটগুলোতে

কামরুল হাসান টিটু, রংপুর ব্যুরো
Update Time : ০৭:৩৫:৫৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৮ মে ২০২৫

হাতছা‌নি দি‌য়ে ডাকছে কোরবানির ঈদ। কোরবানির জন্য গরু-ছাগল কেনাবেচা শুরু হলেও রংপুরের পশুর হাটগুলোতে তেমন সারা পড়ে‌নি। বিগত সময়ে কোরবানির পশুর হাটগুলোতে ইজারাদারের লোকজন ও দালাল কর্তৃক নানাভাবে হয়রানির শিকার হওয়ায় ক্রেতা-বিক্রেতারা হাটবিমুখ হচ্ছেন। ঈদকে ঘিরে অবস্থাপন্নরা বিভিন্ন খামারে পছন্দের গরু বুকিং দিয়ে রেখেছেন। আর সাধারণ ক্রেতাসহ দূর থেকে আসা পাইকাররা হাটে ঝক্কি-ঝামেলা এড়াতে হাটকেন্দ্রিক বিভিন্ন রাস্তার মোড়ে হাটের উদ্দেশ্যে আসা গরু-ছাগল আটকিয়ে দরদাম করে কেনার চেষ্টা করছেন।

কোথাও কোথাও ওজন মেপে চলছে কোরবানির পশুর বেচাকেনা। হাটের ঝক্কি-ঝামেলা এড়াতে এবং স্টেরয়েডমুক্ত পশু কিনতে ক্রেতারা ভিড় করছেন ওজনদরে বিক্রি হচ্ছে এমন গরুর ফার্মে। রংপুর মহানগরীর মাহিগঞ্জের দেওয়ানটুলি এলাকায় জমজম ক্যাটল ফার্মে চার বছর ধরে এই পদ্ধতিতে গরু বিক্রি হচ্ছে। প্রতিদিনই ফার্মে আগ্রহী ক্রেতারা আসছেন এবং গরু দেখছেন। পছন্দ হলে ওজন স্কেলে উঠিয়ে পরিমাণ দেখে খামারেই গরু রেখে যাচ্ছেন। ঈদুল আজহার এক দিন বা দুই দিন আগে গরু নিয়ে যাবেন।

বর্তমানে ক্রেতারা ঝক্কি-ঝামেলামুক্ত এবং ফ্রেশ গরু কিনতে ছুটছেন এমন খামারে। তবে এভাবে গরু বিক্রি করে ক্রেতা-বিক্রেতা লাভবান হলেও রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। ক্রেতারা বলছেন, ওজন স্কেলে গরু বেচাকেনায় সুবিধা অনেক। ওজন স্কেলে গরু মেপে বেচাকেনার কারণে ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে ঠকে যাওয়ার চিন্তা নেই। বাজেট অনুযায়ী সুস্থ-সবল পশু কিনতে পারছেন তারা।

রংপুর জেলার পশুর হাটগুলোর মধ্যে অন্যতম গঙ্গাচড়ার বেতগাড়ি হাট। সপ্তাহে দু’দিন প্রতি শনি ও মঙ্গলবার এই হাট বসে। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে বেতগাড়ি হাট ঘুরে দেখা গেছে, অন্যান্য বছরের তুলনায় গরুর আমদানি কম, দামও বেশি চাওয়া হচ্ছে। বিগত বছরগুলোতে এই হাটে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা পাইকারদের পাশাপাশি স্থানীয় ক্রেতাদের ভিড় লক্ষ্য করা গেলেও এবারে তেমনটা চোখে পড়েনি। হাতেগোনা কিছু পাইকারের দেখা মিললেও কেনা-বেচা আগের মত নেই।

হাটে আসা পাইকার ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত বছর যে গরু ৬৫ থেকে ৭০ হাজার টাকায় কেনা যেত, এবারে সেই গরু কিনতে হচ্ছে ৭৫ থেকে ৮০ হাজার টাকায়। গরু কিনতে ঢাকা থেকে আসা পাইকার ফয়েজ উদ্দিন ব্যাপারী ও জুনায়েদ আহম্মেদ জানান, অন্যান্য বছরে কোরবানির ঈদের ১৫ থেকে ২০ দিন আগে ঢাকা, চট্রগ্রামসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে পাইকাররা এসে রংপুরের হাটগুলো থেকে গরু কিনে নিয়ে যেতো। এবারে সেই সংখ্যা একেবারেই কম।

এর কারণ হিসেবে তারা বলেন, হাট ইজারাদারের লোকজন কর্তৃক হাসিল বা খাজনার নামে জোর করে বেশি টাকা আদায়, দালালদের উৎপাত ছাড়াও পরিবহন খরচ আগে চেয়ে বেশি হওয়ায় পাইকাররা আগ্রহ হারিয়েছেন। এ বছর এখনো বেশি হাসিল আদায় না হলেও দালালদের অসহনীয় উৎপাত আছে। তবে বিক্রেতারা আগেভাগে কিনতে আসায় বিক্রেতারা গরুর দাম ছাড়তে রাজি হচ্ছেন না বলেও জানান তারা।

গঙ্গাচড়া উপজেলার পাশ্ববর্তী ধনতোলা গ্রাম থেকে বিক্রির জন্য গরু নিয়ে বেতগাড়ি হাটে আসা হাসেম আলী বলেন, লোকজন খালি দাম পুছ (জিজ্ঞেস) করে আর যায়, কায়ও সাহস করি দাম করেনা বা গরু কেনেনা। এক লাখ ১০ হাজার টাকায় একটি মাঝারি সাইজের দেশীয় ষাড় গরু কেনেন খলেয়া গঞ্জিপুর এলাকার আব্দুস সোবহান। তিনি বলেন, ঈদ ঘনিয়ে আসলে হাটের ভিরে গরু কেনা দুষ্কর হয়ে পড়বে। তাই আগেভাগেই কিনলাম, যদিও গোখাদ্যের দামের অজুহাতে এবারে গরুর দামও কিছুটা বেশি।

গরু দেখতে আসা আনিছুর রহমান বলেন, কিনতে নয়, দাম যাচাই করতে হাটে এসেছি। ঝক্কি-ঝামেলা এড়াতে কোরবানির জন্য একটি খামারে আগেই গরু বুকিং দিয়ে রেখেছি। ঈদের আগের দিন সেখান থেকে তারা গরু নিয়ে যাবেন বলে জানান।

হাটে গরু কিনতে আসা কলেজশিক্ষক শাহীন ইসলাম বলেন, বহু কষ্টে উপার্জিত অর্থ দিয়ে একটি গরু কেনার জন্য হাটে এসেছি। কিন্তু দালালকে ডিঙ্গিয়ে হাটে গরু কেনার কোনো সুযোগ নেই। নিজেরা দরদাম করে গরু বের করলেও নানা কায়দায় দালালরা টাকা আদায় করেন।

হাট থেকে বেরিয়ে বিভিন্ন রাস্তার মোড়ে গিয়ে দেখা যায়, হাটে ঢোকার আগেই দামাদামি করে গরু কিনছেন ক্রেতারা। হাটের এক কিলোমিটার দক্ষিণে ধনতোলা সড়কে ৮০ হাজার টাকায় গরু কেনেন পাগলাপীর থেকে আসা ইব্রাহিম ও একরামুল। রাস্তায় গরু কিনতে পেরে তিনি বলেন, হয়তো দামে কিছুটা ঠকেছি। কিন্তু হাটে দালালের খপ্পরে পড়তে হয়নি।

উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, এর আগে বেতগাড়ি হাটের ইজারায় সরকারি দর ৩ কোটি ৭০ লাখ ৯৮ হাজার ৭২৯ টাকা হলেও এবারে ২ কোটি ৭৭ লাখ টাকায় ইজারা দেওয়া হয়েছে।

হাটের ইজারাদার শহিদুল ইসলাম জানান, ঈদ আসন্ন হলেও হাটে এবারে এখন পর্যন্ত গরুর আমদানির পাশাপাশি ক্রেতাও কম। মঙ্গলবার হাটে গরু উঠেছিল ৫ থেকে ৭ হাজার। ছোট (৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা), বড় (এক থেকে দেড় লাখ টাকা) ও মাঝারি (৮০ থেকে ৯০ হাজার টাকা) মিলে ৭০০টি গরু বিক্রি হয়েছে।

হাট ইজারায় তিনি প্রথমবার জানিয়ে বলেন, বিগত সময়ের তথ্য বলছে ঈদের ১৫ থেকে ২০ দিন আগে প্রতি হাটে সহস্রাধিক গরু বিক্রি হয়েছে। এখান থেকে হাটে ৫০টির বেশি ট্রাক দেশের বিভিন্ন স্থানে গরু পরিবহন করলেও মঙ্গলবার মাত্র দুটি ট্রাকে গরু গেছে। আগে কিনে রাখা-খাওয়ানোসহ ঝামেলা এড়াতে স্থানীয় ক্রেতারা ঈদের আগের হাটে গরু কেনেন। তাছাড়া বিশেষ করে অবস্থাপন্ন ক্রেতারা এখন হাটের চেয়ে খামারে গরু কিনতে স্বাচ্ছন্দবোধ করেন বলেও জানান তিনি।

এদিকে রংপুর মহানগরীর অন্যতম লালবাগ হাটে গত রোববারের মতো আজ বুধবার বিকেলে গিয়ে দেখা যায়, সাধারণ হাটবারের চেয়েও গরু কম। হাত গুটিয়ে বসে আছেন ইজারাদারের লোকজন। হাতেগোনা কিছু গরু উঠলেও ক্রেতা নেই।

গরু বিক্রেতা পাশ্ববর্তী ধর্মদাস এলাকার হারুন অর রশিদ জানান, তার গরু বাজারে দেড় লাখ টাকা হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কেউ দাম করেনি। গরু কিনতে আসা নগরীর এরশাদ মোড় সেনপাড়া এলাকার রাজীব ও নয়ন বলেন, আসলে শহরকেন্দ্রিক লোকজন কোরবানির গরু কিনতে এখন খামারনির্ভর হয়ে পড়েছে। আমরা হাটে এসেছি গরু দেখার জন্য। আজকে দাম শুনে যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত নিবো।

সিটি করপোরেশনের আওতায় এই হাটের ইজারার দায়িত্বে থাকা আব্দুল্লাহেল কাফি জানান, হাটে গরুর আমদানি একেবারেই কম। এছাড়া ক্রেতারাও বেশিরভাগ খামারনির্ভর এবং সাধারণ মানুষের হাতে টাকা নেই। তবে সামনের হাট থেকে ক্রেতা-বিক্রেতার সমাগম ঘটবে।

তিনি আরও জানান, বিগত বছরগুলোতে কোরবানি ঈদের ১৫ থেকে ২০ দিন আগে রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলের প্রায় দেড় হাজার গরুর হাটে ২৫ লাখেরও বেশি গরু বিক্রি হতো। এই গরুর ৮০ ভাগ ক্রেতা ছিলেন উত্তরাঞ্চলের বাইরে থেকে আসা বৃহত্তর ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, বরিশাল এলাকার গরু ব্যবসায়ী। ট্রাকে করে এগুলো নিয়ে যাওয়া হতো বাইরে। আর স্থানীয় পর্যায়ে গরু বিক্রি শুরু হতো ঈদের ঠিক সপ্তাহখানেক আগে থেকে।

অন্যদিকে, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ঈদুল আজহা উপলক্ষ্যে রংপুর বিভাগে পশুর চাহিদা রয়েছে ১৩ লাখ ১৮ হাজার ১১৭টি। তবে কোরবানির জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে ২১ লাখ ৫২ হাজার ৩১৯টি পশু। চাহিদা মিটিয়ে উদ্বৃত্ত থাকবে আরও আট লাখের বেশি পশু। বিভাগের আট জেলার দেড় লক্ষাধিক খামারির মাধ্যমে পশুগুলো পাওয়া যাবে। তবে খামারিরা বলছেন, পশুখাদ্যের দাম বাড়ায় গত বছরের তুলনায় এবার বাড়তি দামে কোরবানির পশু কিনতে হবে ক্রেতাকে।

রংপুর ডেইরি ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি লতিফুর রহমান মিলন বলেন, পশুখাদ্যসহ অন্যান্য উপকরণের দাম বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় রংপুর বিভাগে অনেক খামার বন্ধ হয়ে গেছে। আবার অনেক খামার বন্ধের পথে। যারা আছেন তাদের অনেক সংগ্রাম করতে হচ্ছে। এবার গরুর মাংসের কেজি ৭০০ থেকে ৭৫০ টাকার কমে বিক্রি করলে খামারিদের লোকসান হবে।

তিনি আরও বলেন, প্রতি বছরই সীমান্ত এলাকার বিভিন্ন হাটে ভারতীয় গরু আসার আশঙ্কা থাকে। এবারো যদি ব্যাপক হারে ভারতীয় গরু আসে তাহলে খামারিরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তবে গৃহস্তদের পালিতসহ বিভাগে আসন্ন ঈদুল আজহা ঘিরে কোরবানির জন্য পর্যাপ্ত পশু রয়েছে। এবারে কোরবানির জন্য খামারগুলোতে ক্রেতারা বিভিন্ন দামের গরু আগাম বুকিং দিয়ে রাখছেন বলেও জানান তিনি।

রংপুর বিভাগীয় প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পরিচালক নজরুল ইসলাম বলেন, কোরবানির ঈদে চাহিদা পূরণ করেও উদ্বৃত্ত পশু থাকবে আট লাখেরও বেশি। ঈদে রংপুর, রাজশাহী ও খুলনা বিভাগ থেকে সাধারণত উদ্বৃত্ত পশু বিভিন্ন স্থানে যায়। এর মধ্যে রংপুর অন্যতম। হাটগুলোয় যাতে অসুস্থ গরু বিক্রি করতে না পারে, সেজন্য বিভাগের বিভিন্ন হাটে মেডিকেল টিম কাজ করছে। পাশাপাশি হাটে আসা কোনো গরু অসুস্থ হলে মেডিকেল টিম চিকিৎসা দেবে।