মার্কিন হামলার আশঙ্কায় ভেনেজুয়েলাজুড়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা
- Update Time : ১১:৫৯:০২ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৫ ডিসেম্বর ২০২৫
- / ৭ Time View
ভেনেজুয়েলার রাজধানী কারাকাসের ব্যস্ত প্লাজাগুলো দৈনন্দিন জীবনের চেনা ছন্দেই চলছে। হাতে চকোলেট কিংবা বরফজমানো ফল বিক্রি করছেন ফেরিওয়ালারা।
দোকানিরা বিকেলের ভিড়ের মধ্যে তাক সাজাতে ব্যস্ত। তবুও এই চিরচেনা দৈনন্দিন জীবন-যাপনের মধ্যেও বিরাজ করছে নতুন এক উদ্বেগ, উত্তেজনার আবহ।
ভেনেজুয়েলা উপকূলে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধি, আর দুই দেশের উত্তপ্ত বাকযুদ্ধ দুশ্চিন্তা বাড়াচ্ছে। শঙ্কা, সংশয় আর আশার মিশ্রণে ভেনেজুয়েলাবাসী এখন বিভক্ত।
কেউ বিদেশি শক্তির আগমনকে সম্ভাব্য মুক্তি হিসেবে দেখছেন, কেউ দেখছেন সার্বভৌম একটি রাষ্ট্রের ওপর আঘাত হিসেবে। মাতৃভূমিকে রক্ষায় কেউ আবার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
৫২ বছর বয়সী কৃষক ও ব্যবসায়ী ডেভিড ওরোপেজা বলেন, “মাতৃভূমি তো মাতৃভূমিই, আর আমাদের সেনাবাহিনী আমাদেরই বাহিনী।”
ওরোপেজা নিজেই ফল সংগ্রহ করে ফ্রোজেন স্ট্রবেরি ও ব্ল্যাকবেরি বিক্রি করেন। স্বাস্থ্য সমস্যার কারণে তাকে সপ্তাহে তিনবার চিকিৎসা নিতে হয়। তবুও যুক্তরাষ্ট্র ভেনেজুয়েলায় হামলা করলে তিনি লড়াইয়ে যেতে প্রস্তুত বলে জানিয়েছেন।
“ওদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ ময়দানে নামতে আমি প্রস্তুত। আগ্রাসনকারীদের মুখোমুখি হব ভেনেজুয়েলার সেনাদের সঙ্গে দাঁড়িয়েই,” আল-জাজিরাকে বলেন ওরোপেজা।
ডাউনটাউন কারাকাসে বাসের অপেক্ষায় আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা ৫২ বছর বয়সী এই কৃষক-ব্যবসায়ী বলেন, “যেভাবে পারি দেশের জন্য সাহায্য করব।”
‘ইতিবাচক পরিবর্তন’
সেপ্টেম্বর থেকে ক্যারিবিয়ান ও প্রশান্ত মহাসাগর এলাকায় যুক্তরাষ্ট্র প্রায় দুই ডজন হামলা চালিয়েছে, যাতে ৮০ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার সর্বশেষ হামলায় চারজন নিহত হন।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন দাবি করেছে, লক্ষ্যবস্তু নৌকাগুলোতে মাদক বা চোরাচালানকারী ছিল। কিন্তু এই দাবির সপক্ষে তারা কোনও প্রমাণ তুলে ধরেনি। নৌযানগুলো যুক্তরাষ্ট্রের দিকে যাচ্ছিল এমন কোনও প্রমাণও ট্রাম্প প্রশাসন দেয়নি।
যুক্তরাষ্ট্র নৌযানগুলোতে হামলা চালানোর কোনও আইনি যৌক্তিকতাও তুলে ধরেনি। যদিও অনেক বিশেষজ্ঞই বলছেন, এইসব হামলা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন।
এর মধ্যেই ট্রাম্প আবার একথাও বলেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র স্থলভাগে মাদক চোরাচালানকারীদের ওপর হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এর মানে ভেনেজুয়েলার মাটিতে যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি সামরিক অভিযান খুব শিগগিরই চলতে পারে এমন আভাসই মেলে।
ট্রাম্প সম্প্রতি কয়েক সপ্তাহে ভেনেজুয়েলার কাছে ক্যারিবীয় অঞ্চলে বিশ্বে র সবচেয়ে বগ বিমানবাহী রণতরী ইউএএস গেরাল্ড আর ফোর্ড মোতায়েন করেছে। সঙ্গে মোতায়েন হয়ে হাজার হাজার সেনা এবং এফ-৩৫ জঙ্গিবিমানও।
কয়েক দশকের মধ্যে ওই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের এমন শক্তি প্রদর্শন আর দেখা যায়নি। ভেনেজুয়েলাবাসীদের কেউ কেউ মনে করেন, প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর ওপর যুক্তরাষ্ট্রের এই চাপ দেশের জন্য ভাল।
এক ভেনেজুয়েলাবাসীর কথায়, যুক্তরাষ্ট্রের এই চাপের কারণে “ভেনেজুয়েলা মুক্ত হবে। আমাদের মুক্তির দিন আসবে।” মাদুরো এখনই অনেক চাপ অনুভব করছেন- এমনটিই মনে করেন বলে জানান তিনি।
তার কথায় মাদুরোর শাসন ঘিরে ভেনেজুয়েলাবাসীর মধ্যে ব্যাপক হতাশারই প্রতিফলন ঘটেছে। জানুয়ারিতে তৃতীয় মেয়াদে ভেনেজুয়েলার ক্ষমতা নেওয়া মাদুরোর শাসনামলে অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সংকটই কেবল আরও গভীর হয়েছে।
‘মাতৃভূমি মাতৃভূমিই’
ভেনেজুয়েলা এবং এর অভিজাতদের নিয়ে এমনকি ট্রাম্পের অভিপ্রায় নিয়ে কঠোর মনোভাব পোষণ করেন কৃষক ও ব্যবসায়ী ডেভিড ওরোপেজা।
তারপরও তিনি মনে করেন, দেশে যত সমস্যাই থাকুক, যুদ্ধ এর কোনও জবাব হতে পারে না। তার কথায়, “কেউ যুদ্ধ চায় না। সবাই শান্তি চায়।”
তার মতে, “মার্কিন রাজনীতি অস্ত্রের ওপরই অনেকটা চলে, আর সেটা ক্ষমতায় থাকা মানুষকে আরও ধনী করে। ভেনেজুয়েলার পক্ষেও সেনা মোতায়েনে স্থানীয় অভিজাতরাই হয়ত লাভবান হবে।” তিনি বলেন, “কারা ধনী হচ্ছে? তারা, আর আমরা যাদেরকে চিনি না তারা।”
ওরোপেজা নিজেকে প্রয়াত প্রেসিডেন্ট হুগো শ্যাভেজের সমর্থক হিসেবে পরিচয় দেন। বর্তমান প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর সমর্থক তিনি নন। তবু দেশের সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে তার অবস্থান কঠোর। সরকারে অনাস্থা থাকলেও বিদেশি হামলাকে সমর্থন করেন না তিনি।
সাম্প্রতিক উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট মাদুরোও পাল্টা শক্তি প্রদর্শন করেছেন। সেনা ও মিলিশিয়াদের সমাবেশ ঘটেছে, ক্যারিবিয়ান উপকূল জুড়ে অ্যান্টি–এয়ার সিস্টেম পরীক্ষা করেছে সেনাবাহিনী।
নভেম্বর নাগাদ সরকার জানায়, সম্ভাব্য যে কোনও মার্কিন পদক্ষেপের মোকাবেলায় সেনা ও নাগরিকদের ব্যাপকমাত্রায় সমাবেশ করা হবে।
সন্দেহ ও সম্পদ:
তরুণ প্রজন্মের অনেকেই মনে করে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহের কারণ মূলত ভেনেজুয়েলার বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ। “আমার মনে হয় আমরা বিপদে আছি,” বলেন ২৪ বছর বয়সী সুপারশপ কর্মী দিয়েগো মেহিয়া।
‘যুক্তরাষ্ট্রের হামলা আসন্ন’ এটা নিয়ে সন্দেহ আছে দিয়েগোর। তার কথায়, “যুক্তরাষ্ট্র চাইলে আগেই হামলা করতে পারত।” কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র কি চায় সে বিষয়ে তার ধারণা পরিষ্কার। তিনি বলেন,
“ভেনেজুয়েলা অনেক বেশি সম্পদশালী। ভেনেজুয়েলার তেল এবং ইউরেনিয়াম আছে উল্লেখ করে দিয়েগো বলেন, “তারা (যুক্তরাষ্ট্র) ভেনেজুয়েলা নিয়ে আগ্রহী। কারণ তাদের এই দেশটির সম্পদ প্রয়োজন।”
বিশ্বের বৃহত্তম প্রমাণিত তেল মজুত রয়েছে ভেনেজুয়েলায়। যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় পাঁচ গুণেরও বেশি। এছাড়া আছে বৃহৎ প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুত।
তেল–গ্যাস ছাড়াও দেশটিতে গ্যাস, স্বর্ণ, হীরা, বক্সাইট, লোহার আকরিক, এবং ইলেকট্রনিকস–অ্যারোস্পেস শিল্পের জন্য জরুরি কোলটানের মতো বিরল খনিজ আছে।
তবুও যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য হামলার উদ্বেগ সামলাতে মেহিয়া ভরসা করেন বিশ্বাসে; তার কথায়, “ঈশ্বর এখানে কিছু হতে দেবেন না।”
ভেনেজুয়েলার রাস্তায় এখনও মানুষের স্বাভাবিক আনাগোনা দেখে এবং খাদ্য মজুতে ব্যস্ত হতে না দেখে অনেকেই ধরে নিচ্ছেন, যুক্তরাষ্ট্রের হামলা আসন্ন নয়।
অজানার ভয়ে ভেনেজুয়েলা:
অন্যান্য ভেনেজুয়েলাবাসী আবার এতটা নিশ্চিত নন।
সন্তানকে নিয়ে পার্কে এসে ৩৪ বছর বয়সী গৃহিণী দালিবেথ ব্রেয়া বললেন, এই পরিস্থিতি তার মনে আশা ও শঙ্কা- দু’য়েরই উদ্রেক করে। এই উদ্বেগ, উত্তেজনা তার পারিপার্শ্বিক সামাজিক পরিমন্ডলেও বাস্তব।
তার এক বন্ধু সরকারি চাকরিতে আছেন। চাকরি বিরূপ প্রভাব পড়ার ভয়ে তিনি এ বিষয়ে সাক্ষাৎকার দিতে রাজি হননি।
ব্রেয়া মনে করেন, ভেনেজুয়েলা যে চাপের মুখে পড়েছে তা দেশের জন্য ভাল কিছুও বয়ে আনতে পারে। তার কথায়, “বাইরের দেশগুলোতে যে উন্নয়ন দেখি, সেটা এখানে হলে ভালো লাগবে।”
তবে সহিংসতার সম্ভাবনা ব্রেয়াকে আতঙ্কিতও করেছে। কৃষক ও ব্যবসায়ী ওরোপেজার মতো শত্রুবাহিনীকে রুখে দাঁড়ানোর মনোভাব তার নেই; বরং লুকিয়ে থাকারই প্রবণতা।
“ভয়ে আমি আশ্রয় নিতাম,” স্বীকার করেন তিনি। তার প্রস্তুতি খুব সাধারণ: “বাড়িতে খাবার জমা রাখা, আর সবাইকে এক জায়গায় রাখা।”
ভূরাজনৈতিক উত্তেজনার কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে থাকা শহরটিতে সূর্য ডবিতে থাকার সঙ্গে সঙ্গে ব্রেয়ার মুখে শোনা যায় অন্য লাখো মানুষের মতোই অনিশ্চয়তার সুর।
“আমি জানি না কিছু ঘটবে কি না,” বলেন তিনি। “কিছু কিছু ক্ষেত্রে মনে হয় হবে—আবার কিছু ক্ষেত্রে মনে হয় হবে না।”
Please Share This Post in Your Social Media
-
সর্বশেষ
-
জনপ্রিয়













































































































































































