ডিসি রমনা
ভবিষ্যতে কারও বাসায় গিয়ে মব সৃষ্টি করবে না, এই মুচলেকায় ছাড়া হয়েছে সমন্বয়কদের

- Update Time : ১০:৪১:৩৯ অপরাহ্ন, বুধবার, ২১ মে ২০২৫
- / ৫০ Time View
ভবিষ্যতে কারও বাসায় গিয়ে মব সৃষ্টির চেষ্টা করা হবে না- এই মর্মে মুচলেকা দিয়ে সমন্বয়কদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন ডিএমপির রমনা বিভাগের ডিসি মাসুদ আলম।
তিনি বলেন, রাজধানীতে যে কোনো ধরনের মব সৃষ্টির ব্যাপারে ডিএমপি জিরো টলারেন্স বলেও জানান ডিসি মাসুদ।
বুধবার (২১ মে) দুপুরে রাজধানীতে পৃথক দুটি চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলায় ১৪ জনকে গ্রেপ্তার বিষয়ে সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন তিনি।
এদিকে থানা থেকে সমন্বয়কদের ছাড়িয়ে নেওয়ার ঘটনায় জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসউদকে কারণ দর্শানো নোটিশ পাঠানো হয়েছে। তাকে আগামী তিন দিনের মধ্যে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে।
বুধবার (২১ মে) এনসিপির যুগ্ম সদস্যসচিব (দপ্তর) সালেহ উদ্দিন সিফাতের সই করা বিজ্ঞপ্তিতে এই নোটিশ পাঠানো হয়।
নোটিশে বলা হয়েছে, গত মঙ্গলবার ধানমন্ডি থানার আওতাভুক্ত একটি আবাসিক এলাকায় ‘সমন্বয়ক’ পরিচয়ে বিশৃঙ্খলা করার অভিযোগে তিন জনকে আটক করে ধানমন্ডি থানা পুলিশ। উল্লেখ্য, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, কেন্দ্রীয় কমিটি কর্তৃক ওই তিনজনের অন্যতম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, মোহাম্মদপুর থানার আহ্বায়ক সাইফুল ইসলাম রাব্বিকে নৈতিকতা স্খলনজনিত কারণে অব্যাহতি প্রদান করা হয়। এতদ্বসত্ত্বেও, আপনি সংশ্লিষ্ট থানায় উপস্থিত হয়ে আটক তিনজনের মুচলেকা প্রদান করে থানা থেকে তাদের জামিন করিয়েছেন।
এতে আরও বলা হয়েছে, ওই ঘটনার প্রেক্ষিতে আপনার ব্যাখ্যা এবং আপনার বিরুদ্ধে কেন সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না, তার লিখিত বিবরণ আগামী তিন দিনের মধ্যে শৃঙ্খলা কমিটির প্রধানের নিকট উপস্থাপন করার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হলো।
রাজধানীর ধানমন্ডির ৪ নম্বর সড়কে হাক্কানী পাবলিশার্সের চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফার বাসার সামনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে স্লোগান দিতে থাকেন কয়েকজন যুবক। গত সোমবার গভীর রাতে এমন খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে যায় পুলিশ। সেখানে পুলিশের সঙ্গে বাগবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তিন সমন্বয়ককে আটক করা হয়। তার প্রায় ১৫ ঘণ্টা পর বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতা ও পরিবারের জিম্মায় তাদের ছেড়ে দেয় পুলিশ। গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসউদ ও আটকদের পরিবারের সদস্যরা থানায় গিয়ে মুচলেকা দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে যান।
পুলিশের সঙ্গে খারাপ ব্যবহারের ঘটনায় আটক হয়েছিলেন মোহাম্মদপুর থানা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক সাইফুল ইসলাম রাব্বি, ঢাকা মহানগর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের যুগ্ম সদস্য সচিব ফারহান সরকার ডিনার ও মোহাম্মদপুর কেন্দ্রীয় কলেজের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা ও ট্রাফিক সহায়ক মোহাম্মদ জিসান উল্লাহ। হান্নান মাসউদের সই করা মুচলেকায় বলা হয়েছে, ভবিষ্যতে তারা আর এ ধরনের কাজে জড়িত হবেন না। যদি তারা জড়িত হন, তাহলে পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেবে।
পুলিশ সূত্রে জানা যায়, তিন সমন্বয়ককে আটক করার পর থেকে বিভিন্নভাবে থানা ঘেরাও করার হুমকি দিয়ে আসছিলেন তাদের অনুসারীরা। তাদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের যুগ্ম আহ্বায়ক ও কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক সাকিবুল ইসলাম এবং কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক রকিবুল ইসলাম বর্ণ কয়েক দফা থানায় এসে তাদের ছাড়ানোর চেষ্টা করেন। ব্যর্থ হয়ে ছাত্র আন্দোলনের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসউদ থানায় আটক তিনজনকে নিজ জিম্মায় ছাড়িয়ে নেন। সোমবার রাত ১১টার পর একদল লোক ধানমন্ডির ৪ নম্বর সড়কের ৩৬/১-এর হাক্কানী পাবলিশার্সের চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফার বাসার সামনে অবস্থান নিয়ে ‘আওয়ামী দোসরদের এ বাংলায় ঠাঁই নাই’ বলে নানা সেøাগান দেন। এরপর তারা বাসায় প্রবেশের চেষ্টা করলে ৯৯৯-এর মাধ্যমে খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যায় পুলিশ। পরে ঘটনাস্থলে উপস্থিত বৈষম্যবিরোধী নেতারা সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়াই মোস্তফাকে গ্রেপ্তার করতে বলেন। অভিযোগ ছাড়া তাকে গ্রেপ্তার করতে না চাইলে পুলিশের সঙ্গে তর্কে জড়ান তারা। একপর্যায়ে নেতারা পুলিশের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন। এতে ঘটনাস্থল থেকে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তিন নেতাকে আটক করে পুলিশ।
বিশৃঙ্খলায় জড়িত তিনজনকে ছাড়িয়ে নিয়ে থানা থেকে বের হওয়ার সময় এনসিপি নেতা হান্নান মাসউদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘একটু ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। সেই ভুল বোঝাবুঝিটা নিরসন করতে আসছি। বাইরের বিভিন্ন গোষ্ঠী এটার সঙ্গে জড়িত আছে, আমরা যেটা দেখছি।’ যাদের ছাড়িয়ে নিতে এসেছেন, তাদের বিরুদ্ধে আগেও অভিযোগ ছিল সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি আমাদের বৈষম্যবিরোধী (ছাত্র আন্দোলন) আহ্বায়কের মেসেজটা পেয়ে দেখতে আসছি। বিষয়টি সাংগঠনিকভাবে তদন্ত করা হবে। আর যাদের কথা বলছেন, তাদের বিরুদ্ধে অ্যাকশন নেওয়া হবে।’
আপনি তো তাদের ছাড়িয়ে নিতে আসছেন এমন প্রশ্নের জবাবে হান্নান মাসউদ বলেন, ‘এরা আসলে ব্যবহৃত হয়েছে। এদের যারা ব্যবহার করেছে, তাদের বিরুদ্ধেও অ্যাকশন নেওয়া হবে।’
ভুক্তভোগী হাক্কানী পাবলিশার্সের চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘আমি আওয়ামী লীগের কেউ না। আমার বিরুদ্ধে কোনো মামলাও নেই। একজন পাবলিশার হিসেবে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বা মতাদর্শের বই প্রকাশ করেছি। এটা তো আমার ব্যবসা। এজন্য আমাকে আওয়ামী লীগের দোসর বানিয়ে মধ্যরাতে বাসায় এসে দরজা ভাঙার চেষ্টা, দারোয়ানকে মারধর কিংবা মব সৃষ্টির চেষ্টা কেউ করতে পারে না।’
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ধানমন্ডি জোনের সহকারী কমিশনার (এসি) শাহ মোস্তফা তারিকুজ্জামান বলেন, ‘একজন প্রকাশকের বাসার নিচে গিয়ে তাকে ফ্যাসিবাদের দোসর আখ্যা দিয়ে বাসায় ঢোকার চেষ্টা করে একদল লোক। খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাস্থলে পৌঁছায় পুলিশ। পরে ওই ব্যক্তিরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা পরিচয় দিয়ে ওই প্রকাশককে গ্রেপ্তার করতে বলেন। কিন্তু ওই প্রকাশকের বিরুদ্ধে কোনো মামলা বা অভিযোগ না থাকায় গ্রেপ্তারে অপারগতা প্রকাশ করে পুলিশ। আবাসিক এলাকায় বিশৃঙ্খলা হতে পারে এমন আশঙ্কায় তিনজনকে হেফাজতে নেওয়া হয়।’
ডিএমপির রমনা বিভাগের উপকমিশনার ডিসি মাসুদ আলম বলেন, ‘সমন্বয়ক পরিচয় দিয়ে মব সৃষ্টির চেষ্টা করে একদল লোক। অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি ঘটানোর আগেই পুলিশ পৌঁছে যায়। এ ঘটনায় কেউ অভিযোগ না করায় আটক তিন সমন্বয়ককে মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। ভবিষ্যতে যদি তারা কখনো এ ধরনের কাজে জড়িত হন, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
ভিডিও ফুটেজে যা দেখা গেল : সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, ধানমন্ডি থানার ওসিকে উদ্দেশ্য করে এক যুবক বলছেন, ‘আপনি কেন এখানে কথা বলছেন এভাবে। আপনি ওসি, আপনি গ্রেপ্তার করলেন না কেন। আমি বলছি আপনি তাকে গ্রেপ্তার করেন। তখন ওসিকে বলতে শোনা যায়, ওনার (গোলাম মোস্তফ) নামে কোনো মামলা নেই। তখন ওই যুবক বলেন, মামলা আমি করব, আপনি গ্রেপ্তার করেন। ওসি বলেন, আমার সিনিয়র বলছেন, মামলা না থাকলে গ্রেপ্তার করা যাবে না। ওসি তখন তরুণদের উদ্দেশ্য করে “সিনক্রিয়েট” না করার অনুরোধ জানান। তারপরও যুবকরা কোনো কথা না শুনে তাকে গ্রেপ্তার করার জন্য চাপ দিচ্ছিলেন। কোনো কিছুতে কাজ না হওয়ায় তারা ওসি টাকা খেয়েছেন বলে স্লোগান দিতে থাকেন।’
এক সমন্বয়ককে অব্যাহতি : এদিকে গতকাল নৈতিক স্খলনের দায়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মোহাম্মদপুর থানার আহ্বায়ক সাইফুল ইসলাম রাব্বিকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্য (দপ্তর সেল) মারজিউর রহমানের পাঠানো এক জরুরি বার্তায় এ তথ্য জানানো হয়। নোটিসে বলা হয়, নৈতিক স্খলনের দায়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মোহাম্মদপুর থানার আহ্বায়ক সাইফুল ইসলাম রাব্বিকে অব্যাহতি দেওয়া হলো।
ডিএমপির কঠোর বার্তা : গতকাল এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ডিএমপি জানিয়েছে, আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার চেষ্টা করলে তা কোনোভাবেই বরদাশত করা হবে না। আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া থেকে বিরত থাকার জন্য এবং আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে পুলিশকে দায়িত্ব পালনে সহযোগিতা করতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে অনুরোধ করা হলো। এ ছাড়া কোনো ব্যক্তি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কাউকে অহেতুক হয়রানি করলে বা আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার চেষ্টা করলে বিষয়টি তাৎক্ষণিক জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ অথবা নিকটস্থ থানায় অবহিত করার জন্য অনুরোধ করা হলো।
হান্নান মাসউদের ফেসবুক পোস্ট : তিনজনকে থানা থেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার পর এ বিষয়ে নিজের বক্তব্য তুলে ধরে ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়েছেন এনসিপি নেতা হান্নান মাসউদ। তাতে তিনি বলেছেন, ‘মোহাম্মদপুর থানা আহ্বায়কসহ তিনজনকে আটক করা হয় মব সৃষ্টির চেষ্টাকালে, যার ফলে বৈষম্যবিরোধী পরিচয়ে ছাত্ররা ধানমন্ডি থানায় গিয়ে ঝামেলা সৃষ্টি করছিল। এ বিষয়ে ডিএমপি কমিশনারের অনুরোধে আমি সেখানে যাই। সেখানে গেলে প্রশাসনের অনুরোধে বিষয়টির মধ্যস্থতা করি, যেহেতু প্রশাসন ওদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ রুজু করেনি এবং করতেও চাচ্ছিল না। তা ছাড়া ফ্যাসিবাদবিরোধী একটা মঞ্চের ব্যানারে নিয়মিত মব সৃষ্টি করা ব্যক্তিদের মধ্যেও একজন সেখানে ছিল, যেটা পরবর্তী সময়ে আমি জানতে পারি। এই বিষয়ে প্রশাসনকে পরিপূর্ণ সহযোগিতা করা হচ্ছে, মব সৃষ্টির মূল হোতারা দ্রুত অ্যারেস্ট হবে। ডিএমপিকে ওদের ব্যাপারে ইনফর্ম করা হয়েছে।’