ব্যাংক লুটেরা রতনের বিরুদ্ধে মামলার প্রস্তুতি, পাসপোর্টও জব্দ করার প্রচেষ্টা চলছে

- Update Time : ০৯:৪২:৫৪ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৪
- / ১০১ Time View
স্বৈরাচারি ফ্যাসিবাদি হাসিনা সরকারে সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ও সাবেক কেবিনেট সচিব কবির বিন আনোয়ারের দোসর ব্যাংক লুটেরা সাবেক ছাত্রলীগ নেতা হায়দার আলী রতনের বিরুদ্ধে মামলার প্রস্তুতির পাশাপাশি পাসপোর্টও জব্দ করার প্রস্তুতি চলছে দুদকের। এই রতন ইনফ্রাটেক কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেডের মালিক হলেও ঢাকার ধানমন্ডি বনানী ও বাংলাদেশ ব্যাংকসহ গোটা মতিঝিল এলাকায় সবাই তাকে মূলত: একজন দালাল ও প্রতারক হিসেবেই চিনি ও জানে।
হাসিনা সরকারের শাসনামলে ২০২২ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা মেনে ব্যাংকগুলোর লেনদেনের সময়সূচি নির্ধারণ করা হয় , সকাল ১০টা থেকে বিকেল সাড়ে ৩টা পর্যন্ত। ওই সময়ের মধ্যে সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে টাকা জমা উত্তোলনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কোনো কারণে ওই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটানো যাবে না। এমন নির্দেশনা না মানা গুরুতর অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়।
অথচ কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে দেশের প্রথম সারির ব্যাংক ন্যাশনাল ব্যাংকের গুলশান কর্পোরেট শাখায় রাত ৮টার পর এক গ্রাহককে নগদ ২২ কোটি ৬০ লাখ টাকা প্রদান করা হয়। সেই গ্রাহকের নাম আলী হায়দার রতন। তিনি ইনফ্রাটেক কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেডের মালিক। ২০২২ সালের ২৮ ডিসেম্বর নিয়ম ভেঙে পাঁচ দফায় ওই অর্থ প্রদান করা হয়। বিষয়টি নিশ্চিত করে দুদকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, মেসার্স ইনফ্রাটেক কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেডের মালিক আলী হায়দার রতনের বিরুদ্ধে ন্যাশনাল ব্যাংকের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ বাংলাদেশ ব্যাংকের বিএফআইইউ’র তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে। তাদের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে কমিশন থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর অভিযোগটি অনুসন্ধানের জন্য দুদকের মানিলন্ডারিং বিভাগকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি এখন অনুসন্ধান শেষ পর্যায়ে রয়েছে।
অন্যদিকে, দুদকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বলেন, ‘যে কোনো অভিযোগ যাচাই-বাছাই শেষে কমিশন থেকে অনুমোদন নেওয়ার পর অনুসন্ধানও প্রায় শেষ। দুদক আইন ও বিধি অনুসরণ করেই আইনি ব্যবস্থা নেবে। যদিও বিএফআইইউর তদন্তের আগেই নির্ধারিত সময়ের পর নগদ লেনদেন করে ব্যাংকের কর্মকর্তারা শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন বলে জানায় বাংলাদেশ ব্যাংক।
সম্প্রতি ন্যাশনাল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) বরাবর পাঠানো এক চিঠির সূত্রে বিষয়টি জানা যায়। গণমাধ্যমের হাত ধরে বিষয়টি শেষ পর্যন্ত দেশের সর্বোচ্চ আদালত হাইকোর্টে গড়ায়। এমন অনিয়মের পেছনের কারিগরসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আদালতের নির্দেশনা অনুসরণ করে গত মাসে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) অনুসন্ধানের অনুরোধ করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ২০২২ সালের ২৮ ডিসেম্বর ন্যাশনাল ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদের ৪৭৫তম সভায় ইনফ্রাটেক কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেডের নবায়নের প্রস্তাবে বলা হয়, সীমাতিরিক্ত ৪৭ কোটি ৮৫ লাখ টাকার ঋণপত্র খোলা হয়েছে। অন্য ব্যাংকে এ গ্রাহকের ঋণ খেলাপি অবস্থায় রয়েছে এবং ঋণ নবায়ন হলে গ্রাহক ২২ কোটি ৬০ লাখ টাকা উত্তোলনের সুযোগ পাবে। পর্যদের আলোচ্যসূচি দেখে সেই সময় ব্যাংকটিতে নিযুক্ত সমন্বয়ক ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক সাইফুল ইসলাম আপত্তি জানিয়ে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান মনোয়ারা সিরুলার, নিরীক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান নাইমুজ্জামান ভূঁইয়াসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে ই-মেইলে ইনস্ট্রাকশন কোম্পানির নামের বিষয়ে আপত্তি জানান। এরপরও ঋণ অনুমোদন হয়। তবে, সাইফুল ইসলামের আপত্তির বিষয়টি সচেতনভাবে ব্যাংকটির কার্যবিবরণীতে উল্লেখ করা হয়নি।
২০২২ সালের ২৮ ডিসেম্বরের সভায় চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন ব্যাংকটির পরিচালক রিক হক সিকদার। সভায় ব্যাংকটির কর্মকর্তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সমন্বয়কের আপত্তির কথা জানালেও ঋণ নবায়নের প্রস্তাব অনুমোদন হয়ে যায়। ওই দিনই গ্রাহক গুলশান কর্পোরেট শাখা থেকে ২২ কোটি ৬০ লাখ টাকা তুলে নেন। গ্রাহকের হিসাব বিবরণী পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২৮ ডিসেম্বর চার দফায় পাঁচ কোটি টাকা করে এবং এক দফায় দুই কোটি ৬০ লাখ টাকা তোলা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের চিঠিতে যা বলা হয়: ১৩ ফেব্রুয়ারি ন্যাশনাল ব্যাংকের এমডি বরাবর একটি চিঠি পাঠায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যেখানে বলা হয়, “আপনাদের ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের ৪৭৫তম সভা শেষে গ্রাহক ইনফ্লাটেক কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেডের প্রস্তাব অনুমোদনের চূড়ান্ত কার্যবিবরণী ব্যাংকের বোর্ড বিভাগ বিকেল ৪টা ৪৫ মিনিটে ই- মেইলের মাধ্যমে ব্যাংকের সিআরএম-১ বিভাগে প্রেরণ করে। সিআরএম-১ বিভাগ গ্রাহকের ঋণ নবায়নসংক্রান্ত অনুমোদনপত্র সন্ধ্যা ৬টা ৫০ মিনিটে ই-মেইলের মাধ্যমে ব্যাংকের গুলশান কর্পোরেট শাখার প্রেরণ করে। গ্রাহকের ঋণ হিসাব থেকে অর্থ উত্তোলনসংক্রান্ত লেনদেনের বিস্তারিত তথ্য হতে দেখা যায়, ২৮ ডিসেম্বর রাত ৮টা ২৩ মিনিট থেকে ৯টা ৪ মিনিটের মধ্যে পাঁচটি লেনদেনের মাধ্যমে ২২ কোটি ৬০ কোটি টাকা উত্তোলন করা হয়। রাত ৮টান পর নগদ লেনদেন সম্পন্ন করে ব্যাংকের কর্মকর্তারা গুরুতর অনিয়ম করেছেন, যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে মনে করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পর্ষদের আলোচ্যসূচি দেশে ২৭ ডিসেম্বর ব্যাংকটিতে নিযুক্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক সাইফুল ইসলাম আপত্তি জানিয়ে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান মনোয়ারা সিকদার, নিরীক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান নাইমুজ্জামান ভূঁইয়াসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে ই-মেইলে ইনফ্রাটেক কনস্ট্রাকশন কোম্পানির যান নবায়নের বিষয়ে আপত্তি জানান। এরপর ঋণ অনুমোদন হয়।
চিঠিতে ইনফ্রাটেক কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেডের সীমাতিরিক্ত ঋণপত্র খোলার বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া অফিস সময়সূচির বাইরে রাত ৮টার পর হিসাব থেকে ২২ কোটি ৬০ লাখ টাকা উত্তোলনের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কেন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না- সে বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে।
আদালতে ন্যাশনাল ব্যাংকের অনিয়ম: ন্যাশনাল ব্যাংকের গুলশান কর্পোরেট শাখায় কর্মঘণ্টার বাইরে অর্থাৎ রাত ৮টার পর ২২ কোটি ৬০ লাখ টাকা লেনদেনের ঘটনায় গত ২০ ফেব্রুয়ারি ব্যাখ্যা দিতে ব্যাংকটির গুলশান কর্পোরেট শাখার ব্যবস্থাপককে তলব করেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে ওই লেনদেনের ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংক কী ব্যবস্থা নিয়েছে তাও জানতে চেয়েছেন আদালত। এ সংক্রান্ত তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করতে বলা হয়েছে। ২০২২ সালের ২৮ ডিসেম্বরের সভার চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন ব্যাংকটির পরিচালক রিক হক সিকদার। সভায় ব্যাংকটির কর্মকর্তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সমন্বয়কের আপত্তির কথা জানালেও ঋণ নবায়নের প্রস্তাব অনুমোদন হয়ে যায়। এই দিনই গ্রাহক গুলশান কর্পোরেট শাখা থেকে ২২ কোটি ৬০ লাখ টাকা তুলে নেন। গ্রাহকের হিসাব বিবরণী
পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২৮ ডিসেম্বর চার পাঁচ কোটি টাকা করে দায় দুই কোটি ৬০ লাখ টাকা তোলা হয়। এছাড়া কর্মঘণ্টার বাইরে অর্থাৎ রাত ৮টার পর ২২ কোটি ৬০ লাখ টাকা লেনদেন কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন আদালত। এছাড়া কর্মঘণ্টার বাইরে অর্থাৎ রাত ৮টার পর ২২ কোটি ৬০ লাখ টাকা লেনদেন কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন আদালত।
এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন আদালতে উপস্থাপন করেন দুদকের আইনজীবী। এই সময় রাষ্ট্রপক্ষের তৎকালীন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম আমিন উদ্দিন মানিক ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল আন্না খানম উপস্থিত ছিলেন। দুদক অভিযোগ যাচাই-শেষে কমিশন থেকে অনুমোদন অনুসন্ধান শেষ করা হয়। তিনি আরও বলেন, সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা হয়েছে বলে জেনেছি। তবে এ বিষয়ে না জেনে মন্তব্য করা যাবে না।
অন্যদিকে, আদালতে জমা দেওয়া প্রতিবেদন এবং ন্যাশনাল ব্যাংকের অনিয়মে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে জানতে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্রের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
Please Share This Post in Your Social Media
-
সর্বশেষ
-
জনপ্রিয়