রংপুরের ডিসির সহযোগিতায় মেট্রো চেম্বারের নামে বাপ্পী এন্টারপ্রাইজের বাণিজ্য মেলা
বীর শহীদ আবু সাঈদের রংপুরে স্বৈরাচারের পুনর্বাসন

- Update Time : ১০:২৬:৩৯ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২২ এপ্রিল ২০২৫
- / ৯ Time View
রংপুরের মেট্রোপলিটন চেম্বার তাদের পুরোনো মিত্র গোপালগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা লুৎফর রহমানের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ‘বাপ্পী এন্টারপ্রাইজ’কে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের নামে মেলার মালিকানা তুলে দিয়ে বীর শহীদ আবু সাঈদের রংপুরে স্বৈরাচার পুনর্বাসনের ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করেছে। আর জেলা প্রশাসক ‘স্বৈরাচারের দোসরদের আওয়ামী চেম্বারে জামাই আদর’ দেয়া হচ্ছে জেনেও সবকিছু ক্ষতিয়ে না দেখে মেট্রো চেম্বারকে মেলার অনুমতি দিয়ে প্রকারন্তরে সহায়তা করছেন।
বিস্ময়করভাবে ৭ মাস আগের জালিয়াতিপূর্ণ আবেদনকে আমলে নিয়ে তিনি কোন নির্দিষ্ট দিন তারিখ না দিয়ে ‘উদ্বোধনের দিন থেকে উল্লেখ করে ঐ প্রতিষ্ঠানকে ইচ্ছে মতো যেকোন সময় মেলা করার সুযোগ অবারিত রেখেছেন। অথচ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ পরিপত্রে নির্ধারিত তারিখ দিয়ে মেলার অনুমতি দেয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। যা তিনি তাঁর ২৬ ফেব্রæয়ারি প্রদত্ত অনুমতিপত্রেও উল্লেখ করেছেন।
রংপুরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রবিউল ফয়সাল বীর শহীদ আবু সাঈদের রংপুরে কোন ফ্যাসিবাদী স্বৈরাচার কিংবা তার দোসরদের ঠাঁই হবে না বলে উচ্চকন্ঠে উচ্চারণ করেছেন। কিন্তু কিছুদিন নির্লিপ্ত থেকে তিনি নিজেই রংপুরের মাটিতে খোদ গোপালগঞ্জের ফ্যাসিবাদি আওয়ামী লীগ নেতা লুৎফর রহমানের খুঁটি গেড়ে বসার পথ প্রশস্ত করে দিয়েছেন।
‘দৈনিক নওরোজ’ প্রায় ৪ মাস আগে ‘অধিকাংশ চেম্বারে স্বৈরাচারের ভূত’ এবং ‘মদ নয় বোতল পরিবর্তন হচ্ছে’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ করে তাঁকে অবহিত করে। রংপুর মেট্রোপলিটন চেম্বার আপাদমস্তক যে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের কর্তৃত্বে পরিচালিত একটি প্রতিষ্ঠান এবং সেখানে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা অগ্রাধিকার পায়, সে বিষয়টি জেনেও তিনি শেষ পর্যন্ত আমলে নেননি। তিনি ‘দৈনিক নওরোজ’র প্রতিবেদনের সারবত্তায় সতর্ক না হয়ে বরং তা উপেক্ষা করেছেন।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অগ্রাহ্য করে নির্দিষ্ট তারিখ না দিয়ে ‘উদ্বোধনের দিন’ থেকে এক মাসের জন্য ‘রংপুর শিল্প ও বাণিজ্য মেলা-২০২৪’ করার অনুমতি দিয়ে তিনি মেট্রো চেম্বারের ব্যানারে লুৎফরের ‘বাপ্পী এন্টারপ্রাইজ’ নামীয় প্রতিষ্ঠানকে ‘ঝোপ বুঝে কোপ মারা’র সুযোগ করে দেন। ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা জীবনের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ এসএসসি পরীক্ষা ১৩ মে পর্যন্ত চলমান থাকবে। এরই মধ্যে মেট্রো চেম্বারের আড়ালে ‘বাপ্পী এন্টারপ্রাইজ’ তার মেলা চালু করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই সময়কালে মেলাটি চালু হলে কোমলমতি এসএসসি পরীক্ষার্থীদের মনোযোগে বিঘœ ঘটবে।
মেট্রো চেম্বারের ব্যানারে আওয়ামী লীগ নেতা লুৎফরের ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ‘বাপ্পী এন্টারপ্রাইজ’ মেলার কর্তৃত্ব নিয়েছে। এ পর্যন্ত লুৎফর আড়ালে থাকলেও রংপুর শিল্প ও বাণিজ্যমেলা আয়োজনে তার মালিকানাধীন ‘বাপ্পী এন্টারপ্রাইজ’র প্রবল অস্তিত্ব ২৫ মার্চ মেট্রোপলিটন চেম্বারের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে খুঁটি গাড়া অনুষ্ঠানের সংবাদে অকাট্য প্রমাণ রেখেছে।
লুৎফর আগে মেলা করতে গেলে জেলা প্রশাসন এবং চেম্বারগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ ঘটিয়ে দিতেন বর্তমানে পলাতক শেখ সেলিম, কারারুদ্ধ অবসরপ্রাপ্ত কর্ণেল ফারুক খান এবং এফবিসিসিআইয়ের তদানিতন্তন প্রেসিডেন্ট শেখ সেলিম পুত্র শেখ ফাহিম। এবারে এক্ষেত্রে তাকে এগিয়ে নিচ্ছেন রংপুরের সেই সাংবাদিক ভায়রা। জানা গেছে তিনি লুৎফরের প্রকৃত পরিচয় গোপনে রেখে তার অনুগত চটপটি দোকানদার মিজান মোল্লা এবং মেলা ভিত্তিক পারিশ্রমিকে কাজ করা কর্মচারী মো: স্বপনকে সামনে উপস্থাপন করে তাদেরকে রংপুরের বাণিজ্য মেলা প্রদানের ব্যপারে রংপুর বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা সাবেক মন্ত্রী আসাদুল হাবীব দুলুর সুপারিশ আদায় করেন। সেই মোতাবেক মিজান আর স্বপনের নাম সামনে রেখে প্রায় অর্ধ কোটি টাকার দফারফায় লুৎফরকে বাণিজ্য মেলা প্রদান করে রংপুর মেট্রোপলিটন চেম্বার। ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার নিজ বাসায় বসে মেট্রো চেম্বারের প্রেসিডেন্ট রেজাউল ইসলাম মিলন অত্যন্ত গোপনে লুৎফরের সাথে মূল চুক্তি করেন। আর রংপুরে বসে ডামি চুক্তি হয় মিজান মোল্লার সাথে। সেই সময়ই ৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ লুৎফরের পক্ষে মেলার অনুমতির জন্য রংপুর মেট্রোপলিটন চেম্বারের প্যাডে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ কমিশনারের কাছে আবেদন করা হয়। সময়ের সুবিধা বিবেচনায় সেই আবেদনে স্বাক্ষর করানো হয় মিলনের নেতৃত্বাধীন চেম্বার পরিচালকদের একদম নিচের সারির একজন ব্যক্তি নুরুল ইসলাম পটুকে দিয়ে। ওদিকে মেলা লীগ প্রধানের পক্ষে আর একটি আবেদন করে রংপুরের মূল চেম্বার।
২০২৪ সালের ৯ সেপ্টেম্বরে করা মেট্রোপলিটন চেম্বারের মেলার আবেদনের পক্ষে বিএনপির কেন্দ্রীয় প্রভাবশালী নেতাসহ বিভিন্ন মহলের সুপারিশের প্রেক্ষিতে রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার ৪৯২১/(সিটিএসবি রংপর) স্মারক মূলে ২৯ অক্টেবর “রংপুর শিল্প ও বাণিজ্য মেলা-২০২৪”-এর জন্য জেলা প্রশাসকের নিকট তাঁর মতামত দাখিল করেন।
সে সময় মেলা ব্যবসা বন্ধের হাহাকারের মধ্যে দেশের অন্যতম প্রধান লাভজনক ভেন্যু রংপুরে আওয়ামী লীগ নেতা লুৎফরের বাণিজ্য মেলা প্রাপ্তির সংবাদ ঐ অঙ্গনে ব্যপক আলোড়ন তোলে। স্টল/প্যাভিলিয়ন প্রাপ্তির জন্য লুৎফরের পক্ষে অনুগত চটপটি দোকানদার মিজান মোল্লা, কর্মচারী স্বপন, রাশিদুল হাসান বাবুল ওরফে ড্রাইফুড বাবুল, সানোয়ার হোসেন রকিসহ বিশ^স্ত কর্মচারীরা (মেলা পরিচালক পরিচয়ে) প্রচার শুরু করেন। এতে করে মেলা ব্যবসা সংশ্লিষ্ট পরিচিত মহলে হৈ চৈ পড়ে যায়। লক্ষণীয় যে, মিজান মোল্লা, মো: স্বপন, রকি ও বাবুলরা তাঁর আগের সব মেলায় লুৎফরের কর্মী ছিলেন।
স্বৈরাচার পতনের এক থেকে দেড় মাসের মধ্যেই সবার আগে সেই গোপালগঞ্জী আওয়ামী লীগের সক্রিয় নেতা লুৎফরের বীর শহীদ আবু সাঈদের রংপুরে মেলা বাণিজ্য বাগিয়ে নেওয়ার খবরে অনেকেই অবাক হন। জানতে পেরে ‘দৈনিক নওরোজ’ এই বিষয়ে “মাঠে নামছে মেলা লীগ! সুতরাং সাধু সাবধান”, “সরকারকে বেকায়দায় ফেলার গভীর ষড়যন্ত্র-অধিকাংশ চেম্বারে স্বৈচারারের ভূত”, “স্বৈরাচারের দোসরদের আওয়ামী চেম্বারে জামাই আদর, রংপুরে বাণিজ্য মেলা, ফের সেই নতুন বোতলে পুরানো মদ” শিরোনামে পরপর কয়েকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। রংপুরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রবিউল ফয়সাল এবং পুলিশ কমিশনার মো: মজিদ আলী বিপিএমকে হোটসঅ্যাপে সেই রিপোর্টের কপি প্রেরণ করা হয়। জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রবিউল ফয়সাল তাতে “ঘড়ঃবফ” লিখে সেগুলো অবহিত হওয়ার স্বীকৃতি দিয়েছেন। পরে জানতে চাইলে তখন জেলা প্রশাসক খুব দৃঢ়তার সঙ্গে “দৈনিক নওরোজ”-কে বলেন, “কোনো মেলার অনুমতি দেব না। আর স্বৈরাচারের দোসর যারা ১৫/১৬ বছর ব্যবসা বাণিজ্যের বিশেষ সুবিধা পেয়েছে তারা আমার কাছে ঠাঁই পাবে না। যদি মেলার অনুমতি দিতেই হয় তবে যারা দীর্ঘদিন বঞ্চিত ছিল তাদেরকেই দেব।”
ঐ সময় পুলিশ কমিশনার বলেন, সুপারিশকারীরা বিভ্রান্ত করায় মতামত দিয়েছিলাম, ঐটি বাতিল করবো।
অত:পর অবস্থা বেগতিক দেখে লুৎফর রহমান খান তখনকার মতো লেজ গুটিয়ে রংপুর থেকে সটকে পড়েন। আর মেলা লীগ প্রধান আমির হোসেন কিছুদিন গা ঢাকা দিয়ে রংপুরের স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহ-সভাপতি আরিফুল ইসলাম আঙ্গুরের সহযোগীতায় সেনাবাহিনীর ঘাড়ে সওয়ার হয়ে ফেব্রæয়ারীতে রংপুর মেট্রোপলিটন এলাকার ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে একটি বিশাল মেলা করতে সক্ষম হন এবং সেখান থেকে বিপুল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেন।
অবস্থার প্রেক্ষিতে ডিসেম্বরে লুৎফর রংপুর থেকে পালালেও খুব বেশি দিন থেমে থাকেন নি। ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা উদ্বোধন করতে গিয়ে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মোহাম্মদ ইউনুস দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারে জেলা উপজেলার সব জায়গায় মেলা করার কথা বললে ফ্যাসিস্ট লুৎফররাই সেই সুযোগকে সবার আগে লুফে নেন। তারুণ্যের উৎসবের কথা বলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ দিদারুল আলমের কাছে নিজের পরিচয় গোপন করে সেখানকার মেলা বাণিজ্য করায়ত্ত¡ করেন। কিন্তু বিপত্তি বাঁধে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একই মাঠে এর আগে পরপর ৪/৫ বার মেলা করার সুবাদে লুৎফর সেখানকার মানুষের কাছে আওয়ামী লীগের নেতা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। এই পরিচিতির বিপত্তির কারণে স্বৈচারারের সহযোগী লুৎফর আবার মেলা করছে জানতে পেরে স্থানীয় জনগণ তাকে ধাওয়া করে। শেষ পর্যন্ত অনুগত কর্মচারী মো: স্বপন, চটপটি দোকানদার মিজান মোল্লা, রাশিদুল হাসান বাবুল ওরফে ড্রাইফুড বাবুলদের মালিক-পরিচালকের গেটআপ দিয়ে মেলা পরিচালনা করে শেষ পর্যন্ত অর্থনৈতিকভাবে একটা বড় ধাক্কা খান। (চলবে)
Please Share This Post in Your Social Media
-
সর্বশেষ
-
জনপ্রিয়