বাকৃবির গবেষণা- মুরগি জবাই ও বিক্রিতে অবহেলা, বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি

- Update Time : ০৭:১১:৩৬ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৭ মার্চ ২০২৫
- / ২১ Time View
স্বাস্থ্যসম্মত ও নিরাপদ মাংস প্রাপ্তি মানুষের অন্যতম মৌলিক চাহিদা। বাংলাদেশের মানুষ প্রতিদিন মাথাপিছু ১৪৩ দশমিক ৭৭ গ্রাম মাংস খেতে পায়। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে আমিষের চাহিদা পূরণে মাংসের অবদান অস্বীকার্য। তবে, দেশের অধিকাংশ স্থানীয় পোল্ট্রি বাজারে এখনো অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে মুরগি জবাই করা হয়, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় হুমকি।
সম্প্রতি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) একদল গবেষকের পরিচালিত গবেষণায় ময়মনসিংহ সদরের বিভিন্ন স্থানীয় বাজারে প্রক্রিয়াজাত করা মুরগির মাংসে মিলেছে টাইফয়েড (সালমোনেলা) ও ডায়রিয়ার (ইকোলাই) জীবাণু। এছাড়াও দোকানে মুরগি অসুস্থ হলে বেশিরভাগ দোকান মালিক (৯৬.১৫ শতাংশ) মুরগি আলাদা রাখা বা মেরে ফেলার পরিবর্তে বিক্রি করে দেন বলে ওই গবেষণায় উঠে আসে।
ময়মনসিংহ সদর ও এর আশেপাশের পোল্ট্রি বাজারসমূহের অবস্থা পর্যবেক্ষণ, বায়োসিকিউরিটি এবং পোল্ট্রি জবাইকরণ সম্পর্কে বিক্রেতাদের মনোভাব যাচাইকরণ এবং সেখানে বিক্রয়কৃত মাংসের গুণগতমান যাচাইয়ের জন্য বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) পোল্ট্রি বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. ইলিয়াস হোসেনের নেতৃত্বে গবেষণা কার্যক্রমটি পরিচালিত হয়। গবেষণা প্রতিবেদনটি ওয়ার্ল্ড’স পোল্ট্রি সায়েন্স এসোসিয়েশন, বাংলাদেশ শাখা কর্তৃক আয়োজিত ‘১৩তম আন্তর্জাতিক পোল্ট্রি শো-২০২৫’ এ উপস্থাপিত হয়।
গবেষণায় দেখা গেছে, স্থানীয় বাজারের মাংসে ক্ষতিকর ইকোলাই ও সালমোনেলা উল্লেখযোগ্য পরিমাণ উপস্থিতি রয়েছে যেখানে স্বাভাবিক অবস্থায় মাংসে এইগুলো থাকার কথা না। এসব মাংসের নমুনায় সালমোনেলা ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণ লগারিদম ৪.০২ থেকে লগারিদম ৫.৫৯ সিএফইউ/গ্রাম এবং ইকোলাই ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণ লগারিদম ৪.০১ থেকে লগারিদম ৫.৯৪ সিএফইউ/গ্রাম পর্যন্ত পাওয়া গেছে। স্থানীয় বাজারের নমুনায় মোট কার্যকর ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণ (টিভিসি) ছিল বেশি।
গবেষণাটিতে ময়মনসিংহ সদরের চরপাড়া বাজার, মিন্টু কলেজ বাজার, মেছুয়া বাজার, নতুন বাজার, সানকিপাড়া বাজার, কেওয়াটখালী বাজার, শেষমোড় বাজার, সুতিয়াখালী বাজার, ভাবখালী বাজার, কে আর মার্কেট, শম্ভুগঞ্জ বাজার এবং গাছতলাসহ ১২টি স্থানীয় বাজারের পোল্ট্রি দোকানের তথ্য নেওয়া হয়। একটি সুনির্দিষ্ট প্রশ্নাবলীর তালিকা অনুসরণ করে এই ১২টি বাজারের ২৪টি পোল্ট্রি দোকানের কর্মীদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছিল। এসব বাজারে সাধারনভাবে জবাইকৃত এবং প্রসেসিং ইউনিটের পদ্ধতি অনুসরণ করে পোল্ট্রি ফার্মে স্বাস্থ্যসম্মতভাবে জবাইকৃত মোট ২৬টি মাংসের (উরু এবং বুকের মাংস) নমুনা এবং ২টি পানির নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছিল। নমুনাগুলো বাকৃবির মাইক্রোবায়োলজি এন্ড হাইজিন ল্যাবে পরীক্ষা করা হয়েছিল বলে জানান অধ্যাপক ড. মো. ইলিয়াস হোসেন।
গবেষণায় উঠে আসা স্থানীয় বাজারের মুরগির দোকান গুলোর অবস্থা সম্পর্কে গবেকষক বলেন, গবেষণার তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে যে ৮৪.৬২ শতাংশ দোকানে মুরগি রাখার পর্যাপ্ত জায়গা নেই, ৯২ শতাংশ দোকানে ময়লা পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা নেই এবং ৪৬.১৫ শতাংশ দোকানে পর্যাপ্ত আলো ছিল না। এছাড়াও, ৩০.৭৭ শতাংশ দোকানে মাংস কাটার জায়গা অস্বাস্থ্যকর ছিল এবং পরিকল্পিত বর্জ্য নিষ্কাশন ব্যবস্থা ছিল না। এরকম পরিস্থিতি ব্যাকটেরিয়া বৃদ্ধি এবং দূষণের জন্য সহায়ক পরিবেশ তৈরি করে।
স্বাস্থ্যকর মাংস প্রাপ্তির বিষয়ে অধ্যাপক ড. মো. ইলিয়াস হোসেন বলেন, বাংলাদেশের স্থানীয় বাজারগুলোর অধিকাংশ পোল্ট্রি দোকানে অপর্যাপ্ত জায়গায় পাখিগুলোকে রাখা হয় এবং অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে মুরগি জবাই করা হয় যা অত্যন্ত স্বাস্থ্য ঝুঁকি সম্পন্ন এবং নানা রোগ বিস্তারের কারণ হতে পারে। এর সমাধানে স্থানীয় বাজারগুলোতে ক্ষুদ্র প্রসেসিং ইউনিট স্থাপনের মাধ্যমে ক্রেতাদের নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত মাংস পৌছে দেওয়া সম্ভব।
বাংলাদেশেও বড় বড় কোম্পানীগুলো প্রক্রিয়াজাতকৃত মাংস উৎপাদনের দিকে ঝুঁকছে। ক্রমবর্ধমান চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে স্থানীয় বাজারগুলোতে ক্ষুদ্র প্রসেসিং ইউনিট প্রতিষ্ঠা করা গেলে তা একইসাথে যেমন নিরাপদ মাংস সরবরাহ নিশ্চিত করতে সাহায্য করবে, পাশাপাশি স্থানীয় পোল্ট্রি দোকানগুলো আরও লাভজনকভাবে ব্যবসা পরিচালনা করতে পারবে।
উল্লেখ্য যে, প্রসেসিং ইউনিটের মাংসে কোনও সালমোনেলা বা কলিফর্ম সনাক্ত করা যায়নি। এটি ইঙ্গিত দেয় যে প্রসেসিং ইউনিট থেকে পাওয়া মাংস খাওয়ার জন্য নিরাপদ।
প্রযুক্তিগত সহযোগিতা প্রদানের মাধ্যমে স্থানীয় বাজারের পোল্ট্রি দোকানীদের ক্ষুদ্র প্রসেসিং ইউনিট স্থাপনে উৎসাহিত করতে হবে। মোবাইল কোর্ট পরিচালনার মাধ্যমে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে পোল্ট্রি মুরগি বিক্রি বন্ধ করতে হবে। ক্রেতা ও বিক্রেতা কে স্বাস্থ্যসম্মতভাবে জবাইকৃত মাংসের উপকারিতা সম্পর্কে সচেতন করার জন্য সরকারি ও বেসরকারিভাবে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া জরুরী, করার দাবি করেন অধ্যাপক ড. ইলিয়াস।
Please Share This Post in Your Social Media
-
সর্বশেষ
-
জনপ্রিয়