বাংলাদেশি স্পিনারকে ৫ বছরের জন্য নিষিদ্ধ করল আইসিসি

- Update Time : ১০:৩৩:৫৬ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১১ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
- / ১২৭ Time View
বাংলাদেশ নারী দলের স্পিনার সোহেলী আখতারের বিরুদ্ধে আইসিসির অ্যান্টি-করাপশন নীতিমালার ৫টি ধারা লঙ্ঘনের দায়ে সব ধরনের ক্রিকেট থেকে ৫ বছরের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
মঙ্গলবার (১১ ফেব্রুয়ারি) সোহেলীকে নিষেধাজ্ঞার এ ঘোষণা দিয়েছে আইসিসি। তবে তার নিষেধাজ্ঞা চলতি মাসের ১০ ফেব্রুয়ারি থেকে কার্যকর হয়েছে। তিনি সর্বশেষ জাতীয় দলে খেলেছেন ২০২২ সালে।
২০১৩ সালে আন্তর্জাতিক অভিষেক হলেও খুব বেশি ম্যাচ খেলার সুযোগ হয়নি সোহেলি আক্তারের। সর্বশেষ জাতীয় দলের হয়ে খেলেছেন ২০২২ সালে। দেশের হয়ে দুটি ওয়ানডে ও ১৩টি টি–টোয়েন্টি ম্যাচ খেলেছেন ৩৬ বছর বয়সী অফ স্পিনার। সবমিলিয়ে তার উইকেট ১১টি।
জাতীয় দল থেকে বাদ পড়ার পর ৩৬ বছর বয়সী এই ক্রিকেটার ২০২৩ টি-২০ বিশ্বকাপের সময় তৎকালীন জাতীয় দলের ক্রিকেটার লতা মণ্ডলকে ম্যাচ বা স্পট ফিক্সিংয়ের প্রস্তাব দেন। তবে যে ক্রিকেটারকে অসাধু প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, তিনি সেই ফাঁদে পা না দিয়ে আইসিসির দুর্নীতি দমন কমিশনকে (আকসু) বিষয়টি জানান।
অনুসন্ধানের পর আজ (মঙ্গলবার) সোহেলীকে সব ধরনের ক্রিকেট থেকে ৫ বছরের নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা দিয়েছে আইসিসি। ফিক্সিং সংক্রান্ত পাঁচটি ধারা ভঙ্গের দায়ে এই শাস্তি পেয়েছেন তিনি। আইসিসির দুর্নীতি দমন ইউনিটের (আকসু) কাছে দায় স্বীকারও করে নিয়েছেন সোহেলী।
দুই বছর আগে দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত নারী বিশ্বকাপে বাংলাদেশের স্কোয়াডে থাকা এক ক্রিকেটারকে ফিক্সিংয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন দলের বাইরে থাকা সোহেলি আক্তার। তবে যে ক্রিকেটারকে অসাধু প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, তিনি সেই ফাঁদে পা না দিয়ে টিম ম্যানেজমেন্টকে বিষয়টি অবহিত করেন।
বিষয়টি নজর এড়ায়নি আইসিসির দুর্নীতি দমন কমিশনেরও (আকসু)। নিয়ম অনুযায়ী বিষয়টি বছর দুয়েক তদন্ত করেছে আকসু। সেটিরই প্রেক্ষিতে ফিক্সিংয়ের প্রস্তাব দেওয়া সোহেলি আক্তারকে এবার নিষিদ্ধ করল আইসিসি। ৫ বছরের জন্য সব ধরণের ক্রিকেট থেকে নির্বাসনে থাকবেন এই স্পিনার। গতকাল (১০ ফেব্রুয়ারি) থেকে তার এই শাস্তি কার্যকর হয়েছে।
দক্ষিণ আফ্রিকায় নারী বিশ্বকাপে প্রথম দুটি ম্যাচ হেরে ব্যাকফুটে ছিল বাংলাদেশ। এর মধ্যেই ফিক্সিংয়ের বিষয়টি জানাজানি হয়ে যায়। বাংলাদেশি বেসরকারি একটি টেলিভিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বকাপ স্কোয়াডের বাইরে থাকা ক্রিকেটার সোহেলি আক্তার স্পট ফিক্সিংয়ের জন্য প্রস্তাব দেন দলে থাকা লতা মণ্ডলকে। মুঠোফোনে তাদের মধ্যে যে কথাবার্তা হয় সেটিও প্রকাশ করা হয়। সেখানেই শোনা যায় যে লতাকে আউট হওয়ার জন্য প্রস্তাব দিচ্ছিলেন সোহেলি।
মোটা অঙ্কের লোভও দেখানো হয় লতাকে। ব্যাটার লতাকে বলা হয়েছিল যে, হিট আউট হলে তাকে দেওয়ার হবে ২০ লাখ টাকা আর যদি তিনি স্টাম্পিং আউট হন তাহলে দেওয়া হবে ৫ লাখ টাকা। ফিক্সিং কার্যকরের পর তার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে এই টাকা চলে যাবে বলে তাকে আশ্বস্ত করা হয়েছিল।
ফিক্সিংয়ের বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর ক্রিকেট বিষয়ক ওয়েবসাইট ক্রিকবাজের মুখোমুখি হয়েছিলেন সোহেলি আক্তার। গত ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ সালে তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ওই সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশ নারী দলের এই ক্রিকেটার জানান, ফেসবুকে একজনের সাথে পরিচয় হয়েছিল। যার নাম আকাশ বলে উল্লেখ করেন সোহেলি।
টাইগ্রেস এই স্পিনার সে সময় দাবি করেছিলেন, ‘সে (আকাশ) আমাকে বলেছিল, আমি মনে করি আপনাদের অনেকে ফিক্সিংয়ের সাথে জড়িত। বিশেষ করে টপ অর্ডার ব্যাটাররা, যারা রান করতে পারে না। এমনকি বোলাররাও বোলিং ওয়াইডের মাধ্যমে ফিক্সিং করছে। আমি তাকে বলেছিলাম, ‘দেখুন, আমাদের খেলোয়াড়রা এমন কাজ করে না। প্রতিটি ম্যাচে জয়টা আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ কারণ আমরা খুব বেশি খেলায় জিততে পারি না। আমি আমার দেশের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারি না।’
সোহেলি আরও জানান, আকাশের অভিযোগের প্রেক্ষিতে লতাকে একটু বাজিয়ে দেখার জন্যই তিনি খুদে বার্তাটি পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু লতা বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেওয়ায় গোলমাল বেঁধে যায়। সোহেলির দাবি মতে, বিষয়টি ভুল বুঝাবুঝি ছিল। যদিও আইসিসির আজকের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, টাইগ্রেস এই স্পিনার ফিক্সিংয়ের বিষয়টি স্বীকার করে নিয়েছেন।
লতা ও সোহেলির মধ্যে যে কথোপকথন হয়েছিল
বেসরকারি টেলিভিশন যমুনা টিভির প্রতিবেদনে লতা ও সোহেলির একটি কথোপকথন জুড়ে দেওয়া হয়েছিল। যা হুবহু তুলে দেওয়া হচ্ছে-
সোহেলী আক্তার : ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমি তোমার ক্ষতি কখনই করবো না। তোমার যখন ইচ্ছা তুমি খেলবা, যখন ইচ্ছা হবে না খেলবা না। তোমার মন চাইলে তুমি একটা খেলবা। কোন ম্যাচটা খেলবা তোমার ইচ্ছা, তুমি যে ম্যাচ অফার করো, তোমার সুবিধামতো। ধরো একটা ম্যাচ তুমি ভালো খেললা, পরের ম্যাচে তুমি খেলতে পারো। স্ট্যাম্পিং, হিট আউট হতে পারো। তোমার যদি মনে হয় ২০-৩০ লাখ অফারে তুমি হিট আউট হবা না, স্ট্যাম্পিং হইয়ো। তাহলে ধরো ৫ লাখ, তুমি যদি মনে করো কম হয়ে যাচ্ছে তাহলে সেটাও বলতে পারো। তাহলে আমি আমার ভাইকে বলবো। একথা শুধু তোমার আর আমার মাঝেই থাকবে। তুমি কিন্তু ভেবো না যে এ জিনিস প্রথম তুমিই ইয়ে করবা। আমাদের মধ্যে এখানে আছে (আরও ৫ জন ক্রিকেটারের নাম বলেন। তদন্তের স্বার্থে সেগুলো প্রকাশ করা হলো না।) এরা এগুলার মধ্যে আছে, বুঝছো?
লতা মণ্ডল: বান্ধবী আমি এগুলোর মধ্যে নাই। তুমি আমাকে এগুলো বইলো না। এগুলো আমাকে দিয়ে কখনও হবে না। আমাকে এসব বইলো না, প্লিজ।
সোহেলী আক্তার: বান্ধবী, আমি তোমাকে যেটা বলতেছি এটা তোমার আর আমার মধ্যে থাকবে। তুমি তো আমাকে বিশ্বাস করো হান্ড্রেড পারসেন্ট যে আমি কাউকে বলতেও যাবো না। আর যেহেতু তোমার আমার আমার ব্যাপার। আমার চাচতো ভাই ও ফোনে বেট খেলে। ওখানে তোমাদের যে ওয়ার্ল্ড কাপ চলতেছে সেটা নিয়ে ভালো ভালো মনে হয় অফার দিছে। সে আমাকে ফোন দিয়ে অনেকক্ষণ কথা বলছে। বলছে, আপু লতা আপুর সাথে তো আপনার ভালো সম্পর্ক, ফেসবুকে ছবিটবি দেন দেখি। আপনি একটু লতা আপুর সাথে কথা বলে দেখবেন উনি যদি ৫ নাম্বারে (৩ ডাউন) নেমে হিট আউট হতে পারবেন কি না। পেস বলে তো হিট আউট হওয়া সহজ। খেলা তো এরপর অস্ট্রেলিয়ার সাথে, ভালো ভালো দলের সাথে। সেটা ওনার ইচ্ছা উনি কোন ম্যাচে খেলবে। উনি যেদিন বলবে সেদিন আমরা ধরবো। পেস বলের সময় ধরো ব্যাকফুটে খেলতে গিয়ে তোমার পায়ে লেগে স্ট্যাম্প ভেঙে গেলো। বা স্পিনে সুইপ খেলতে গিয়ে, ফলো থ্রু শেষ হওয়ার সময় ব্যাটে লেগে স্ট্যাম্প ভেঙে গেলো। তাহলে আমি তাকে ২০ লাখ টাকা দেবো। যদি ওনার কম মনে হয়ে যায় তাহলে আরও ৫ লাখ টাকা দেবো।
সোহেলী আক্তার: আমি তাকে বলেছি দেখ এগুলা তো অনেক রিস্কি। একটা প্লেয়ারের ইয়েটিয়ে নিয়ে টানাটানি। যদি জানাজানি হয়ে যায় তাহলে অনেক সমস্যা। ও বলছে আপু উনি তো আপনার সাথে কথা বলবে। আপনি তো আর কাউকে বলতে যাচ্ছেন না। আমার তো প্লেয়ারদের সাথে জানাশোনা নাই। উনি যদি আমার জন্য খেলে আমি কেনো কাউকে বলতে যাবো। তুমি খেলতে চাইলে খেলবা না খেললে নাই। এটা তুমি আর আমি জানবো, আর কেউ জানবে না। আরেকটা কথা হচ্ছে, উনি যদি মনে করেন হিট আউট হওয়াটা ওনার জন্য কষ্ট হয়ে যায় তাহলে উনি চাইলে স্ট্যাম্পিং হতে পারে। উনি কোন আউট হবে এটা আমাকে আগে বলতে হবে। তাহলে আমি ওনাকে ৫ লাখ টাকা দেবো। আপু যদি চায় আগেও টাকা নিয়ে নিতে পারে। অথবা আপু যদি মনে করে আপুর এমন কেউ আছে, আপু আমি আপনার বাসায় আসলাম। আপু যখন আউট হবে সাথে সাথে টাকা নিয়ে চলে যাবে। কোনো সমস্যা নাই। আর আমি তো আপনার ভাই, ঠিক না? এখানে দুই নম্বরি করার কিছু নেই। আর উনি যদি আমার জন্য খেলে দেয় আমি কেনো দুই নম্বরি করবো? উনি তো আমার ভালোর জন্যই করছে। আমি ওকে অনেক কথা বলছি। তুমি খেলো আর না খেলো আমাকে বলতে বলছে আমি মাধ্যম হয়ে বললাম তোমাকে। তুমি খেললে খেললা, না খেললে নাই। তুমি শুধু ইয়েস অর নো বইলো। আর তুমি ভয়েস মেসেজ শুনে ডিলিট করে দিও। আমিও ডিলিট করে দিবো।
আজ (মঙ্গলবার) নিজেদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে আইসিসির তরফে জানানো হয়– দুর্নীতি বিরোধী ইউনিটের ২.১.১, ২.১.৩, ২.১.৪, ২.৪.৪ এবং ২.৪.৭ ধারা লঙ্ঘন করেছেন সোহেলি। যেখানে ২.১.১ ধারায় রয়েছে– ম্যাচ ফিক্সিং বা যেকোনো উপায়ে খেলার ফলাফল, অগ্রগতি, আচরণ বা অন্যান্য দিক অনৈতিকভাবে প্রভাবিত করা বা এর সঙ্গে জড়িত থাকা, যার মধ্যে ইচ্ছাকৃতভাবে খারাপ পারফরম্যান্স করাও অন্তর্ভুক্ত।
এ ছাড়া ২.১.৩ ধারায় বলা আছে—ম্যাচ ফিক্সিং বা বাজির উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট কোনো ঘটনা ঘটানোর জন্য ঘুষ বা অন্য কোনো পুরস্কার গ্রহণ, গ্রহণে সম্মতি প্রদান, প্রস্তাব করা বা গ্রহণের চেষ্টা করা। ২.১.৪ ধারায়, অন্য কোনো অংশগ্রহণকারীকে ওপরের যে কোনো বিধান লঙ্ঘনের জন্য প্ররোচিত করা, উৎসাহিত করা, নির্দেশনা প্রদান করা বা কোনোভাবে সহায়তা করার কথা বলা হয়েছে।
আকসুর ২.৪.৪ ধারামতে– অ্যান্টি-করাপশন ইউনিটকে বিলম্ব না করে দুর্নীতির জন্য করা কোনো প্রস্তাব বা আমন্ত্রণের সম্পূর্ণ তথ্য জানাতে ব্যর্থ হওয়া। ধারা ২.৪.৭-এ আছে, অ্যান্টি-করাপশন ইউনিটকে তদন্তে বাধা সৃষ্টি করা বা বিলম্ব করা, যার মধ্যে প্রাসঙ্গিক নথিপত্র বা অন্যান্য তথ্য গোপন করা, বিকৃত করা বা ধ্বংস করাও অন্তর্ভুক্ত।
Please Share This Post in Your Social Media
-
সর্বশেষ
-
জনপ্রিয়