পুলিশরাও মানুষ,কোন যন্ত্র নয়! তাদেরও আছে পরিবার

- Update Time : ০৩:৫৩:৫১ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৩ জুলাই ২০২৫
- / ৩৬৭ Time View
পুলিশরাও মানুষ কোন যন্ত্র নয়। তাদের সাধারণ মানুষের মত ঘরসংসার ও পরিবার পরিজন আছে। দেশের সরকার ও জনগণকে এটা মাথায় রাখতে হবে।
গনতান্ত্রিক দেশে সকলের সমান অধিকার থাকার কথা থাকলেও পুলিশের ক্ষেত্রে কিছুটা ব্যতিক্রম।সরকারি চাকরিজীবীরা দিনে ৮ ঘন্টা ডিউটি করলে পুলিশকে করতে হয় ১২ ঘন্টা।কিন্তু কিছু কিছু সময় অন ডিউটি সার্ভিসের জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়।
সরকারি চাকরিজীবীরা সরকারি ছুটি ভোগ করেন। কিন্তু পুলিশ তা থেকে বঞ্চিত। যারা রাষ্ট্রের শান্তি শৃঙ্খলায় নিয়োজিত তাদের সুযোগ সুবিধাটা বেশি হওয়া দরকার বলে মনে করেন বিজ্ঞজনরা। অতিরিক্ত ডিউটির চাপে ইতিপূর্বেও অনেক পুলিশ মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন। এটা কারো অজানা নয়।
২৮ বছর আগে পুলিশ বাহিনীতে কনস্টেবল পদে যোগ দিয়েছিলেন জনৈক এক পুলিশ সদস্য। এই দীর্ঘ সময়ে তিনি ঝিনাইদহ,খুলনা, বাগেরহাট, শেরপুর, মুন্সিগঞ্জ ও খাগড়াছড়ি হয়ে বর্তমানে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশে দায়িত্ব পালন করছেন।
তবে ২৮ বছরের চাকরিজীবনে কখনও কর্মস্থল এলাকায় পরিবার নিয়ে বসবাস করতে পারেননি।বছরে যেটুকু সরকারি ছুটি মেলে, সেটাও ভালোভাবে কাটানোর সুযোগ পাননি।
২০১৫ সালে দুই দফায় স্ট্রোক হয় সেই পুলিশ সদস্যের। এতে বেশ কিছুদিন হাসপাতালে থেকে চিকিৎসা নিতে হয় তাকে। তারপরও জীবনের তাগিদে রোদ-বৃষ্টি ও শীত-গরমকে উপেক্ষা করে প্রতিদিন ১২ ঘণ্টা ডিউটি করে যাচ্ছেন তিনি।
শুধু জনৈক এই সদস্যই নন। পুলিশ বাহিনীর বেশির ভাগ সদস্যই এমন কষ্ট নিয়ে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।কিন্তু ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ তাদের সুযোগ-সুবিধা-আবেদন নিয়ে বরাবরই উদাসীন।
আলাপকালে সেই জনৈক পুলিশ সদস্য বলেন, শরীর এখন আর আগের মতো চলে না। প্রতিদিন ওষুধ খেতে হয়। বিশ্রাম নিতে মন চাইলেও সুযোগ নেই। নিয়মিত দায়িত্ব পালন শেষে নিজের মতো করে একটু বিশ্রাম নিতে পারি না। স্ট্রোক করার পর চিকিৎসক আমাকে বলেছেন সময় করে বিশ্রাম নিতে। কিন্তু সেটা আর হয়ে ওঠে না। অতিরিক্ত দায়িত্বের জন্য বাড়তি কোনও টাকা দেওয়া হয় না। সাপ্তাহিক ছুটি তো নেই-ই।
২০১০ সালে কনস্টেবল হিসেবে যোগ দিয়েছেন আরেক জনৈক পুলিশ সদস্য। এ পর্যন্ত পুলিশের ছয়টি ইউনিটে কাজ করেছেন।কিছুদিন হলো পদোন্নতি পেয়ে সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) হয়েছেন।পদ বাড়লেও কষ্ট কমেনি। এখন তিন মাস পরপর কয়েক দিনের জন্য ছুটি মিললেও, গত ১১ বছরে সাপ্তাহিক ছুটি পাননি। এখন স্ত্রী-সন্তান ও পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে পারেন না।এই আক্ষেপ নিয়েই দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন সেই পুলিশ সদস্য।
তিনি বলেন,মানুষ চাকরি করে পরিবারকে আর্থিক ও মানসিকভাবে স্বস্তি দেওয়ার জন্য। কিন্তু আমরা কি সেটা পারি? পুরো বছরে মাত্র ২০ দিন ছুটি পাই। মাঝেমধ্যে যদি কোনও স্বজনের মৃত্যুসংবাদ আসে, তখন আবেদন করলে দু-এক দিনের জন্য ছুটি পাই। সেটাও বার্ষিক ছুটি থেকে কেটে নেওয়া হয়। আবার দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খারাপ হলে বা বড় কোনও রাজনৈতিক কর্মসূচি থাকলে তখন সব ছুটি বন্ধ। আর বর্তমান প্রেক্ষাপটের কথাতো বলাই যাবেনা! মোটকথা আমাদের যখন ছুটি দরকার হয়, তখন ছুটি মেলে না।
তিনি আরও বলেন, ২০১৩ সালে বিয়ে করেছি। দুটি সন্তান আছে। কখনও কর্মস্থল এলাকায় তাদের রাখতে পারিনি। আবার মন চাইলে তাদের কাছেও ছুটে যেতে পারি না।
কুষ্টিয়ার এক কনস্টেবল পুলিশে যোগ দিয়েছেন ১৯৯৮ সালে। তিন ছেলে ও মেয়েকে নিয়ে তার স্ত্রী থাকেন গাজীপুরে গ্রামের বাড়িতে। আর তিনি থাকেন কর্মস্থল যখন যে এলাকায়।
তিনি বলেন, ছুটি পাওয়াই আমাদের বড় সমস্যা। বিজিবিতে (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) বছরে দুই মাস ছুটির ব্যবস্থা রয়েছে। আমাদেরও একই দাবি ছিল,বছরে যাতে দুই মাস ছুটি দেওয়া হয়। কিন্তু সেই দাবি আজও বাস্তবায়িত হয়নি।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি)’র এক অতিরিক্ত উপকমিশনার বলেন,পুলিশের অপর্যাপ্ত ছুটির বিষয়ে সবাই একমত। আর সিনিয়র কর্মকর্তাদের কাজের চাপ তো আরও বেশি। কখন কোন অভিযান পরিচালনা হবে এবং বিশেষ কাজের পুরো দায়িত্ব থাকে সিনিয়রদের ওপর। তখন চাইলেও সিনিয়র কর্মকর্তারা আর ছুটি নিতে পারেন না। তবে যারা অফিসিয়াল কাজ করেন, তারা সাপ্তাহিক ছুটি ভোগ করতে পারেন। কিন্তু জরুরি ডাক এলে সেটাও বন্ধ হয়ে যায়।
এ প্রসঙ্গে পুলিশের সাবেক এক উর্ধতন কর্মকর্তা বলেন,পুলিশে ছুটির সমস্যা আগেও ছিল, এখনও আছে। তবে অনেক সমস্যার সমাধান করা হয়েছে কিছুটা, কিন্তু বাস্তবায়ন হয়নি।পুলিশ সদস্যদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এ কারণে এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে আবাসন ব্যবস্থা। পুলিশের আবাসনের জন্য যে ব্যবস্থা রয়েছে, সেটা পর্যাপ্ত নয়।
পুলিশের অনেকেই পরিবার নিয়ে কর্মস্থলে থাকতে পারেন না। কর্মস্থলে তাদের আবাসের ব্যবস্থাও নেই।এ ছাড়া যে বেতন-ভাতা তারা পান,সবার পক্ষে ভাড়া বাসায় থাকাও সম্ভব নয়। সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন বাড়ানো হয়েছে পাঁচ বছর হয়ে গেছে। বর্তমানে সবকিছুর দাম বেড়েছে। সে জন্য বেতন-ভাতাও বাড়ানো দরকার।
সাবেক এই কর্মকর্তা বলেন,পুলিশের এসব বিষয় নিয়ে সিনিয়র কর্মকর্তাদের আরও সচেতন হতে হবে।সবার ভালো-মন্দ দেখতে হবে। কারণ,জোর করে কাজ আদায় করা যায় না। ছুটি দিলেই যে কাজের সমস্যা হবে, এটা ঠিক নয়। ছুটি চেয়ে কেউ আবেদন করলে সেটি মাসের পর মাস ফেলে রাখা হয়। এগুলো খেয়াল রাখতে হবে।
অন্যান্য দেশে তিনট শিফটে আট ঘণ্টা করে পুলিশ দায়িত্ব পালন করে উল্লেখ করে সেই কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশে এখনও সেটা কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। ১২ ঘণ্টা কাজ করলেও এর জন্য কোনও ওভারটাইম চালু নেই। জানি আমাদের অনেক কিছুর স্বল্পতা রয়েছে। অন্যান্য দেশে পুলিশ বাহিনীর জন্য পর্যাপ্ত লজিস্টিক সাপোর্ট রয়েছে। সেটা বাংলাদেশ পুলিশের নেই।
এ প্রসঙ্গে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সাইকিয়াট্রিস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা.মেখলা সরকার বলেন, যদি আমরা উৎপাদনশীল ক্ষমতা বাড়াতে চাই, তাহলে আমাদের ব্রেইনের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। কিন্তু সেটারও তো বিশ্রাম দেওয়া প্রয়োজন। আট ঘণ্টা কাজ সর্বজনস্বকৃীত, তাই ব্রেইনের সক্ষমতাও সেভাবে তৈরি থাকে। তবে এরপর ব্রেইন আর কাজ করতে চায় না।
এই বিষয়ে কোন কথা বলতে রাজী নয় অনেক উর্ধতন কর্মরত পুলিশ অফিসাররা। তারা শুধু বলেন, রাষ্ট্রের গুরুদায়িত্ব নিয়ে কাজ করাই আমাদের কর্তব্য। জনগণের সেবক হয়ে চাকরি নিয়েছি। সেবা দেওয়াই আমাদের ধর্ম।
Please Share This Post in Your Social Media
-
সর্বশেষ
-
জনপ্রিয়