কুষ্টিয়া পাবনা নাটোর ও রাজশাহী অঞ্চল
পদ্মার দুর্গম চরে যৌথবাহিনীর একযোগে অভিযান, গ্রেপ্তার ৬৭
- Update Time : ০৩:২০:৪১ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১০ নভেম্বর ২০২৫
- / ২২ Time View
কুষ্টিয়া, পাবনা, নাটোর ও রাজশাহী অঞ্চলে পদ্মার বিস্তীর্ণ দুর্গম চরে টানা ১২ ঘণ্টার অভিযানে ৬৭ জনকে গ্রেপ্তার করেছে যৌথবাহিনী। রোববার অভিযানের সার্বিক তদারকি করেন খুলনা রেঞ্জের এডিশনাল ডিআইজি (অপারেশন) শেখ জয়নুদ্দীন। এতে নেতৃত্ব দেন কুষ্টিয়া জেলা পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান। এ সময় কুষ্টিয়া জেলা পুলিশের বিভিন্ন পদমর্যাদার মোট ৩১৫ জন পুলিশ সদস্য অংশগ্রহণ করেন।
একই সময়ে রাজশাহী রেঞ্জের অধীন রাজশাহী, পাবনা ও নাটোরে প্রায় ১,২০০ পুলিশ সদস্যের অংশগ্রহণে ‘অপারেশন ফার্স্ট লাইট’ নামে আরও একটি অভিযান পরিচালিত হয়। এ সময় রাজশাহীর পদ্মার চর থেকে ১৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়। এর মধ্যে চারজন ওয়ারেন্টভুক্ত আসামি, ছয়জন মাদক মামলার, দুজন সর্বহারা ও দুজন অন্যান্য মামলার আসামি। তাদের কাছ থেকে তিনটি ওয়ান শুটারগান, একটি গুলি ও একটি খোসা, ২০ বোতল ফেনসিডিল, ৫০ পিস ইয়াবা, ৮০০ গ্রাম গাঁজা, পাঁচটি মোটরসাইকেল, একটি হাসুয়া ও একটি ছোরা উদ্ধার করা হয়।

নাটোরে পদ্মার চর থেকে ২০ জনকে গ্রেফতার করা হয়। এর মধ্যে চার জন হ্যাকার, ছয় জন ওয়ারেন্টভুক্ত আসামি, একজন সাজাপাপ্ত আসামি, একজন হত্যা মামলার আসামি, দুজন মাদক ও ছয় জন সন্দেহভাজন আসামি। তাদের কাছ থকে দুটি শুটারগান, একটি রিভলবার, ২২টি হাসুয়া, চারটি চাকু, চারটি চাপাতি, একটি রামদা ও একটি পাইপগান উদ্ধার করা হয়।
পাবনায় পদ্মার চরে অভিযান চালিয়ে ২৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়। এর মধ্যে একজন সর্বহারা, দুজন মামলার আসামি, সাত জন ওয়ারেন্টভুক্ত আসামি, দুজন অন্যান্য মামলার আসামি, চার জন মাদকের ও আট জন নিয়মতি মামলার আসামি। তাদের কাছ থেকে দুটি শুটারগান, তিনটি গুলি, একটি খোসা, দুটি পাইপগান, দুটি চাইনিজ কুড়াল, দুটি রামদা, একটি হাঁসুয়া ও একটি ছোরা উদ্ধার করা হয়।
এ ছাড়া কুষ্টিয়ার ফিলিপনগর, মরিচা ইউনিয়নের পদ্মার চর থেকে নয় জনকে গ্রেফতার করা হয়। এর মধ্যে আট জন ওয়ারেন্টভুক্ত আসামি ও একজন নিয়মিত মামলার আসামি। এ সময় বাঘা থানার জোড়া খুন ও ডাকাতির কাজে ব্যবহৃত একটি ইঞ্জিনচালিত নৌকা, একটি স্পিডবোট, অস্ত্র রাখার একটি সিলিন্ডার, দুটি তাঁবু ও পাঁচটি মোটরসাইকেল উদ্ধার করা হয়।
রোববার বিকেলে রাজশাহী রেঞ্জ ডিআইজি কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান রাজশাহী রেঞ্জের ডিআইজি মোহাম্মদ শাহজাহান। তিনি জানান, দীর্ঘদিন ধরে পদ্মার চরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কাকন বাহিনীসহ অন্তত ১২টি সন্ত্রাসী বাহিনী অস্ত্র ও মাদক কারবার, জমি দখল, খুন, অপহরণ এবং চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছিল। সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং এই অপরাধচক্রের দৌরাত্ম্য বন্ধ করতেই এ অভিযান পরিচালনা করা হয়। ডিআইজি আরও বলেন, রাজশাহী, নাটোর, পাবনা ও কুষ্টিয়ার চরাঞ্চলে সন্ত্রাসীদের দখল ও আতঙ্ক দীর্ঘদিনের। তাদের দমন করে চরের স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনাই ছিল অভিযানের মূল লক্ষ্য।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ২৭ অক্টোবর কুষ্টিয়ার দৌলতপুর, রাজশাহীর বাঘা ও নাটোরের লালপুর উপজেলার সীমান্তবর্তী দৌলতপুরের মরিচা ইউনিয়নের চৌদ্দহাজার মৌজার নিচ খানপাড়া এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। এতে তিন জন নিহত হন। এ ঘটনায় বাহিনীপ্রধান রোকনুজ্জামান কাকনসহ বাহিনীর সদস্যদের নামে কুষ্টিয়ার দৌলতপুর থানায় একটি মামলা হয়। এটিসহ তাদের বিরুদ্ধে, রাজশাহী, নাটোর, পাবনা ও কুষ্টিয়ায় মোট ছয়টি মামলা হয়েছে।

পুলিশ জানায়, পদ্মার চরের বাসিন্দাদের ওপর দীর্ঘদিন ধরে কাকনসহ ১২টি বাহিনী অত্যাচার, নির্যাতন করে আসছিল। বাহিনীপ্রধান রোকনুজ্জামান কাকন ইঞ্জিনিয়ার কাকন হিসেবে পরিচিত। তার বাহিনীর নির্মমতায় চরাঞ্চলবাসী উদ্বেগ ও উৎকন্ঠায় আছে। পদ্মার চরের অন্যান্য সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে অন্যতম মন্ডল বাহিনী, টুকু ও গিট্টু সোহাগ বাহিনী, হানা ও জাকির প্রামানিক বাহিনী, সাঈদ বাহিনী, লালচাঁদ বাহিনী, রাখি বাহিনী, শরীফ কাইগি বাহিনী, জামিল মালিথা ও জনি মালিথা বাহিনী, চল্লিশ বাহিনী, বাহান্ন বাহিনী, সুখচাঁদ ও নাহারুল বাহিনী। এসব বাহিনীকে ধরতে পুলিশের অভিযান অব্যাহত থাকবে। গত শনিবার গভীর রাতে তিন বাহিনীর প্রায় ১ হাজার ২০০ সদস্য নিয়ে শুরু হওয়া ‘অপারেশন ফার্স্ট লাইট’ চলে গতকাল রবিবার দুপুর পর্যন্ত। সম্প্রতি চরদখল ও কাশবন নিয়ে বিরোধকে কেন্দ্র করে কাকন বাহিনীর গুলিতে বাঘা উপজেলার আমান ও নাজমুল নামের দুই ব্যক্তি নিহত হন। ওই ঘটনায় কাকন বাহিনীর এক সদস্যও নিহত হয়। পরবর্তীতে সশস্ত্র মহড়া, বালুমহল ও কৃষিজমি দখল এবং চাঁদাবাজির ঘটনায় আবারও উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে এ অঞ্চলের মন্ডল বাহিনী ও কাকন বাহিনীর। যৌথ অভিযানের মাধ্যমে চরাঞ্চলে সন্ত্রাসী বাহিনীর আধিপত্য ভেঙে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার প্রথম পদক্ষেপ সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে বলে জানিয়েছেন খুলনা ও রাজশাহী রেঞ্জের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
বাঘা উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, কুষ্টিয়ার ফিলিপনগরের কাছাকাছি হবির চর, মরিচা ইউনিয়নের ১৪ হাজার মৌজা ও বাঘা কৃষি অফিসের আওতাভুক্ত ১ হাজার বিঘা ফসলি জমি রয়েছে। এই চরের জমিতে ধান, গম, ভুট্টা, বাদামসহ ডাল জাতীয় ফসল ফলে। চরে এসব ফসল ফলিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন উল্লেখিত চরবাসী।
পদ্মা নদীর চরে মুদি দোকানের ব্যবসায়ী আমিরুল ইসলাম বলেন, ‘দোকানে তেমন বেচাকেনা নাই। গত দিনের ট্রিপল মাডারের পর থেকে মানুষের মনে ভয় ঢুকে গেছে। সবার মনে একটাই ভয় যদি তারা আবার দুই বাহিনী হামলা করে! রাজশাহীর বাঘা উপজেলা কৃষি অফিসার শফিউল্লাহ সুলতান বলেন, ‘কুষ্টিয়ার কাছাকাছি হবির চরে আমাদের প্রায় ১ হাজার বিঘা জমিতে ফসল ফলে। এই চরে আগে শুধু বাদাম হতো। বর্তমানে সেখানে ধান, গম, ভুট্টা, বাদামসহ ডাল জাতীয় ফসল ফলে। সেখানে কৃষি অফিসের লোক পাঠানো হবে। যাতে কোনও কারণে চাষাবাদ ব্যাহত না হয় সেই চেষ্টা করা হবে।’
বাঘা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাম্মী আক্তার বলেন, ‘তারা যদি নিরাপত্তাহীন বোধ করে তাহলে আমাদের জানালে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এ ছাড়া চরে চাষাবাদের ক্ষেত্রে কোনও ধরনের সমস্যার বিষয়টি জানা নেই। তবে তারা জানালে কৃষি কর্মকর্তাদের নিয়ে কৃষকদের সঙ্গে কথা বলবো।

নাটোরের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ তারিকুল ইসলাম এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানান, পদ্মার চরাঞ্চলের সন্ত্রাস নির্মূলে নদীতে ও স্থলভাগে বড় ধরনের অভিযান পরিচালনা করে পুলিশ। অভিযান পরিচালনা করা হয় লালপুরের সীমান্তবর্তী চার দিয়াড় বাহাদুরপুর, চর জাজিরা ও চর লালপুর এলাকায়। ১৪টি নৌকায় ১০টি দলে বিভক্ত হয়ে অভিযান পরিচালনা করা হয় বলে জানিয়ে পুলিশ সুপার বলেন, আটক ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তাঁদের আদালতে হাজির করা হবে। জব্দ করা মালামালের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। চর দিয়াড় বাহাদুরপুরের মৎস্যজীবী আনোয়ার হোসেন বলেন, এলাকা থেকে পুলিশ যাঁদের ধরে নিয়ে গেছে, তাঁরা প্রায় সবাই ‘কাকন বাহিনী’র সদস্য।
এ বিষয়ে কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার (এসপি) মিজানুর রহমান জানান, চরাঞ্চলে গড়ে ওঠা বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে এই অভিযান শুরু করা হয়েছে। সন্ত্রাসী নির্মল না হওয়া পর্যন্ত এ অভিযানে চলমান থাকবে। দৌলতপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সোলাইমান শেখ বলেন, সকাল থেকে চলা অভিযানে দৌলতপুর থানা এলাকা থেকে আমরা ৫ জন আসামিকে গ্রেপ্তার করেছি। এছাড়া জেলায় মোট ৯ জনকে আটক করা হয়েছে। এ অভিযান অব্যাহত থাকবে। এর আগেও কুষ্টিয়া জেলা পুলিশের সমন্বয়ে পদ্মা নদীর চরাঞ্চলে একাধিকবার বিশেষ অভিযান পরিচালিত হয়েছে। বর্তমানে এসব চরাঞ্চলে পুলিশের টহল ও গোয়েন্দা নজরদারি আরও জোরদার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
Please Share This Post in Your Social Media
-
সর্বশেষ
-
জনপ্রিয়





































































































































































































