ঢাকা ১২:১৪ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৩ এপ্রিল ২০২৫, ২৯ চৈত্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
ব্রেকিং নিউজঃ
টঙ্গীতে আওয়ামী লীগের ‘গোপন ষড়যন্ত্রের’ প্রতিবাদে বিএনপির বিক্ষোভ বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং দক্ষতা শীর্ষক সেমিনার অনুষ্ঠিত নোয়াখালীতে বিএনপির এক পক্ষের মানববন্ধনে অপর পক্ষের বাধা, সংঘর্ষে আহত ৫ তিস্তাসহ ৫৪টি নদীর পানির ন্যায্য হিস্যার দাবিতে বাসদের স্মারকলিপি পেশ কুবি ভর্তি পরীক্ষার প্রবেশপত্র ডাউনলোডের সময় বৃদ্ধি বাসা থেকে প্রবেশপত্র আনতে ও পরীক্ষার্থীকে কেন্দ্রে পৌঁছে দি‌য়ে সহায়তা ক‌র‌লেন মান‌বিক পুলিশ ফেসবুকে ইসরাইলী পণ্য বিক্রির গুজব, নিরাপত্তাহীনতায় মালিক-কর্মচারীরা টঙ্গীর শীর্ষ সন্ত্রাসী সৈকতসহ ছয় সহযোগী গ্রেফতার জবিতে ‘মার্চ ফর প্যালেস্টাইন’ কর্মসূচি, মার্কিন ও সৌদি দূতাবাসে স্মারকলিপি প্রদান অতিরিক্ত শুল্কে মার্কিন নাগরিকদের ক্ষতি বেশি
ছেড়ে গেছে স্ত্রী, দুজনের সন্তান মানুষ হচ্ছে অন্যের বাড়িতে

নাটোরে অপহরণের ১২ বছরেও উদ্ধার হয়নি পাঁচ যুবক

সালাহ উদ্দিন, লালপুর (নাটোর) প্রতিনিধি
  • Update Time : ০৩:০৪:৪০ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৮ এপ্রিল ২০২৫
  • / ২৮ Time View

নাটোরের বড়াইগ্রামে ১২বছর আগে অস্ত্রধারীরা প্রকাশ্যে তিন যুবককে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়ার দিন একই এলাকার এক বিজিবি সদস্যসহ আরো দুই যুবক নিখোঁজ হয়।

এদের তিনজনের স্ত্রী অন্যত্র বিয়ে করে শুরু করেছেন নতুন সংসার। একজনের মাতৃগর্ভে রেখে যাওয়া সন্তান আর অপরজনের রেখে যাওয়া সাত মাসের শিশু কন্যা এখন বাবা-মায়ের আদর ছাড়াই বড় হচ্ছে অন্যের বাড়িতে।

ঘটনার পর র‍্যাব বা পুলিশ কোন ব্যবস্থা নেয়নি। নেয়নি কোন মামলা পর্যন্ত। একটি জিডি নিয়েই বিএনপিপন্থী পরিবারের তিন যুবকের অপহরণ ধামাচাপা দেয়া হয়েছে।

স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা ভুক্তভুগি পরিবার ও স্থানীয় সাংবাদিকদের এসব বিষয়ে সংবাদ প্রকাশ না করে চুপ থাকার পরামর্শ দিয়েছেন বার বার। অপহৃতদের স্বজনেরা এখনো তাদের প্রিয়জনের ফেরার অপেক্ষায় রয়েছেন।

ঘটনার পর র‍্যাব বলেছে তারা এদের আটক করেনি। আর নাটোরের তৎকালীন পুলিশ সুপার তখন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, এ বিষয়ে তদন্তে তেমন কিছু পাওয়া না যাওয়ায় কোন ব্যবস্থা নেয়া যায়নি।

স্থানীয়রা জানান, ৪র্থ থেকে ৬ষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া জানা অপহৃত এই তিন যুবক কখনো কৃষি কাজ আবার কখনো বা রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন। রাজনীতিতে সক্রিয় না হলেও তারা সকলেই বিএনপির অনুসারী। ভোটের সময় তারা মাঠে ময়দানে ধানের শীষের জন্য ভোট চাইতেন। তাদের সাথে প্রতিবেশী কারো কোন শত্রুতা ছিল না।

নাটোরের নবাগত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আমজাদ হোসাইন গনমাধ্যমকে বলেছেন, তিনি নতুন এসেছেন। বিষয়টি অনেক আগের। গনমাধ্যমের মাধ্যমেই তিনি বিষয়টি জেনেছেন। বিষয়টি জানতে পেরে পুলিশের গোয়েন্দা বাহিনীর মাধ্যমে খোঁজখবর নেয়া শুরু করেছেন। এ বিষয়ে পুলিশের অনুসন্ধান শেষে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিত্বে পরবর্তি  করণীয় নির্ধারণ করবেন।

শনিবার সারাদিন সরেজমিনে এসব পরিবারে গিয়ে জানা যায়, ২০১৩ সালের ১৯ মে রাত ১০টার দিকে বেশ কয়েকটি মাইক্রোবাসে বড়াইগ্রামের গুরুমশৈল ও মহিষভাঙ্গা গ্রাম থেকে পুলিশ ও র‍্যাবের মতো পোষাক পড়ে এবং কয়েকজন সাদা টিশার্ট জিন্স প্যান্ট পড়ে প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে রাস্তা থেকে গুরুমশৈল গ্রামের কৃষক রুহুল আমীন তালুকদারের ছেলে ইব্রাহিম তালুকদার (৩৫) ও শাহজাহান আলীর ছেলে কামাল হোসেন (২৫) কে আটক করে। রাইফেলের বাট দিয়ে মারতে মারতে তাদের বন্ধু মহিষভাঙ্গা গ্রামের একটি মোবাইল কোম্পানীর প্রহরী সুমন আলীর বাড়িতে নিয়ে যান। সেখানে সুমনকে না পেয়ে তার বাবা লঙ্কর প্রামাণিককে বাঁশের লাঠি দিয়ে পেটানো শুরু করে।

স্ত্রী সন্তানদের সামনে নির্মমভাবে মারপিটের একপর্যায়ে তিনি মাটিতে পড়ে যান। লঙ্কর প্রামাণিক  হৃদরোগী জানার পর মারধর বন্ধ করে তারা প্রতিবেশী আবু বক্করের বাড়িতে গিয়ে তার ছেলে তৈয়ব আলী (৩২) কে ধরে নিয়ে যায়।

একই দিন নিখোঁজ হয় কালিকাপুর গ্রামের বাড়িতে ছুটিতে আসা বিজিবি সদস্য গাজী ওমর ফারুকের যুবক ছেলে রাসেল গাজী এবং তার বন্ধু একই এলাকার কাটাশকুল গ্রামের আফতাব উদ্দিন মৃধার ছেলে কলেজ ছাত্র মোঃ সেন্টু হোসেন।

এ সব বিষয়ে অনুসন্ধানে গেলে বড়াইগ্রাম উপজেলার মহিষভাঙ্গা গ্রামের অপহৃত তৈয়ব আলীর পিতা আবু বক্কর বলেন, ঘটনার পর বনপাড়া পৌরসভার মেয়র আওয়ামী লীগ নেতা কে এম জাকির হোসেন জিডির কাগজ নিয়ে দেখা করতে বলেন। দেখা করলে এ বিষয়ে আর বাড়াবাড়ি না করে চুপ থাকতে বলেন।

তৈয়বের চাচা আব্দুল কুদ্দুস বলেন, তার চোখের সামনে তার ভাতিজা তৈয়বকে তুলে নেয়া হয়েছে। অপহরণকারীদের মধ্যে তার পূর্ব পরিচিত বড়াইগ্রাম থানার পুলিশ সদস্য তরিকুল ইসলাম ছিলেন। কেন তৈয়বকে ধরা হচ্ছে সে সময় তরিকুলের কাছে জানতে চাইলে তাকে ধমক দিয়ে সরিয়ে দেন তরিকুল।

ঘটনার কয়েকদিনের মধ্যে তরিকুল এই থানা থেকে অন্যত্র বদলী হয়ে চলে যায়। তাদের বাড়ির পাশের বনপাড়া-হাটিকুমরুল মহাসড়কের মুদি দোকানী কোরবান আলী এই প্রতিবেদককে বলেন, ঘটনার সময় অপহরণকারীরা তার দোকানে এসে সিগারেট কিনে। এসময় অপহরণকারীরা তার দোকানে থাকা দুটি মোবাইল সেট নিয়ে নেয়। তবে চলে যাওয়ার সময় মোবাইল দুটি ফেরত দিয়ে যায়। এতে তার মনে হয়েছে ঘটনার সময় এলাকাবাসীকে যেন খবর দিতে না পারে এজন্যই হয়ত মোবাইল দুটি নিয়ে নিয়েছিল। চেষ্টা করেও এসব বিষয়ে কথা বলার জন্য আওয়ামী লীগ নেতা কে এম জাকির হোসেনকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।

উপজেলার গুরুমশৈল গ্রামের অপহৃত ইব্রাহীম তালুকদারের বাড়ি গেলে তার পিতা বৃদ্ধ রুহুল আমিন তালুকদার বলেন, তারা সক্রিয় ভাবে কোন রাজণীতি করেন না। তবে অপহৃত অন্য পরিবার গুলোর মতোই সারাজীবন তারা বিএনপি পরিবার হিসেবে পরিচিত। তারা ধানের শীষে ভোট দেন। তারা প্রকাশ্য রাজপথে নিহত উপজেলা চেয়ারম্যান বিএনপি নেতা সানাউল্লাহ নূর বাবুর অনুসারী।

অপরহরণকান্ডের পর তারা বড়াইগ্রাম থানায় জিডি করতে গেলে পুলিশ জিডি নিতে রাজি হয়নি। অনেক অনুরোধ করার পর অপহৃত তিন যুবকের পরিবারের পক্ষ থেকে তার অপর ছেলে লোকমান তালুকদারের দেয়া একটি জিডি পুলিশ গ্রহণ করে। এটাই শেষ। আর কোন প্রতিকার বা পুলিশী সহযোগীতা তারা পাননি।

একই গ্রামের বাসিন্দা অপহৃত কামাল হোসেনের মা আনোয়ারা বেগম বলেন, তার চার ছেলে মেয়ের মধ্যে কামাল হোসেন সবার বড়। দুনিয়ার কোন মানুষের সাথে তার কোন বিরোধ ছিল না। তবে ঘটনার এক বছর আগে হাসিম মেম্বার নামে এক প্রতিবেশীর বেদখল হওয়া জমি উদ্ধারে তার ছেলে কামাল ও তার অপহৃত দুই বন্ধু ইব্রাহিম এবং তৈয়ব ভুমিকা রেখেছিল। এর জের ধরেই তারা অপহৃত হতে পারেন বলে তিনি মনে করেন। ছেলের সন্ধান করতে তিনি র‍্যাব ও পুলিশের সদর দপ্তরের পাশাপাশি ছুটে গেছেন আয়না ঘরেও। কিন্তু কোন খবর পাননি।

কামাল অপহরনের সময় তার স্ত্রী একমাসের অন্তস্বত্তা ছিলেন। কামালের ছেলে মোবারক হোসেন হৃদয় এখন নাটোর সদরের ঘোড়াগাছা চৌমহনীতে একমাত্র ফুফুর বাড়িতে থেকে চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ে। বাবা নেই মায়ের বিয়ে হয়ে গেছে অন্যত্র তাই ফুফুকেই মা ডাকেন।

এই প্রতিবেদক সেখানে গেলে ছোট্র মোবারক হোসেন হৃদয় আশা প্রকাশ করে বলেন, একদিন তার বাবা ফিরে আসবে। জীবনে এক মুহুর্তের জন্যও না দেখা পিতাকে দেখে তার আশা পুরণ হবে। সাধ মিটবে। অপহৃত তৈয়বের স্ত্রীরও অন্যত্র বিয়ে হয়ে গেছে। অপহরনের সময় তার সংসারে সাত মাস বয়সী কন্যা ইশরাত জাহান মিম এখন নানার বাড়িতে থাকে। ৬ষ্ঠ শ্রেণী পড়ুয়া মিমও স্বপ্ন দেখেন একদিন তার বাবাও ফিরে আসবে। বিদ্যালয়ের অন্য সহপাঠিদের পিতার মতো তার পিতাও বিদ্যালয়ে এসে তাকে আদর করে বাড়ি নিয়ে যাবে, ভালবাসবে। সেদিন সে সব দুঃখ ভুলে যাবে।

উপজেলার কাটাশকুল গ্রামের কলেজ ছাত্র সেন্টু আলী চাচাতো ভাই এরশাদ আলী জানান, সেন্টু নিখোঁজের পর ছেলের শোকে কান্না করতে করতে ইতোমধ্যে তার পিতা আফতাব উদ্দীন মৃধা ও মা শেফালী বেগম মারা গেছেন।

নিখোঁজ বিজিবি সদস্য রাসেল গাজীর পিতা ওমর ফারুক জানান, তার ছেলেকে তার বন্ধু নিখোঁজ সেন্টু ফোন করে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে যায়। তার পর থেকে দুজনই নিখোঁজ। এ বিষয়ে তিনি মামলাও করেছিলেন। তিনি জানতে পারেন তার বিবাহিত এই ছেলের সাথে ঢাকা বাড্ডা এলাকার এক মেয়ের সর্ম্পক আছে। বিষয়টি পুলিশকে জানালে পুলিশ সেই মেয়েকে আটক করে তার মোবাইল ফোনে অপহৃত রাসেল গাজীর সাথে অনেক ছবি ও তথ্য পায়। তারপরও স্থানীয় সাবেক এমপিসহ আওয়ামী লীগের নেতাদের চাপে পুলিশ কিছু করেনি। উলটো তার মামলা খারিজ করে তার বিরুদ্ধেই দুটো মামলা দেয় আসামীরা। এখন সব মামলা খারিজ হয়ে গেছে।

একজন তরুন বিজিবি সদস্য মাত্র সাড়ে তিন বছর চাকুরীর পর এভাবে নিখোঁজ হলেও কেউ কিছু করলো না, এটা ভেবেই তিনি হতাশায় ডুবে যান।

তিনি দাবী করেন এই আসনের সাবেক এমপি জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি মরহুম অধ্যাপক আব্দুল কুদ্দুস ও বড়াইগ্রাম উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল কুদ্দুস মিয়াজীর বিরোধীতার কারণে তিনি কোন বিচার পাননি। আব্দুল কুদ্দুস মিয়াজী দীর্ঘদিন থেকে আত্মগোপনে থাকায় তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।

বড়াইগ্রাম উপজেলার বাসিন্দা একটি বেসরকারি টেলিভিশনের জেলা প্রতিনিধি শেখ তোফাজ্জল হোসেন বলেছেন, এসব পরিবারের অনুরোধে বার বার এই বিষয়ে সংবাদ প্রকাশ করতে তিনি উদ্যোগ নিয়েছেন। স্থানীয়দের বক্তব্য নিয়ে কাজ শুরু করলেই উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতারা বাঁধা দিয়েছেন। এ বিষয়ে ঘাটাঘাটি না করতে বলেছেন।

এছাড়া নাটোর সদরের রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু মডেল স্কুলের প্রধান শিক্ষক মোঃ শহীদুল ইসলাম এসব ঘটনার কাছাকাছি সময়ে নিখোঁজ হন। আজ পর্যন্ত তারও কোন সন্ধান মেলেনি।

বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা ও সাবেক মন্ত্রী অ্যাডভোকেট এম রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু বলেছেন, ফ্যাসীবাদি সরকারের আমলে সাধারণ বিএনপি কর্মীদের সাথে ঘটে যাওয়া এসব গুমের ঘটনায় এখন নতুন করে মামলা নিয়ে পুলিশের তদন্ত শুরু করা উচিত। গুম কমিশনকেও এসব বিষয়ে এগিয়ে আসার জন্য তিনি দাবী জানিয়েছেন।

Please Share This Post in Your Social Media

ছেড়ে গেছে স্ত্রী, দুজনের সন্তান মানুষ হচ্ছে অন্যের বাড়িতে

নাটোরে অপহরণের ১২ বছরেও উদ্ধার হয়নি পাঁচ যুবক

সালাহ উদ্দিন, লালপুর (নাটোর) প্রতিনিধি
Update Time : ০৩:০৪:৪০ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৮ এপ্রিল ২০২৫

নাটোরের বড়াইগ্রামে ১২বছর আগে অস্ত্রধারীরা প্রকাশ্যে তিন যুবককে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়ার দিন একই এলাকার এক বিজিবি সদস্যসহ আরো দুই যুবক নিখোঁজ হয়।

এদের তিনজনের স্ত্রী অন্যত্র বিয়ে করে শুরু করেছেন নতুন সংসার। একজনের মাতৃগর্ভে রেখে যাওয়া সন্তান আর অপরজনের রেখে যাওয়া সাত মাসের শিশু কন্যা এখন বাবা-মায়ের আদর ছাড়াই বড় হচ্ছে অন্যের বাড়িতে।

ঘটনার পর র‍্যাব বা পুলিশ কোন ব্যবস্থা নেয়নি। নেয়নি কোন মামলা পর্যন্ত। একটি জিডি নিয়েই বিএনপিপন্থী পরিবারের তিন যুবকের অপহরণ ধামাচাপা দেয়া হয়েছে।

স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা ভুক্তভুগি পরিবার ও স্থানীয় সাংবাদিকদের এসব বিষয়ে সংবাদ প্রকাশ না করে চুপ থাকার পরামর্শ দিয়েছেন বার বার। অপহৃতদের স্বজনেরা এখনো তাদের প্রিয়জনের ফেরার অপেক্ষায় রয়েছেন।

ঘটনার পর র‍্যাব বলেছে তারা এদের আটক করেনি। আর নাটোরের তৎকালীন পুলিশ সুপার তখন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, এ বিষয়ে তদন্তে তেমন কিছু পাওয়া না যাওয়ায় কোন ব্যবস্থা নেয়া যায়নি।

স্থানীয়রা জানান, ৪র্থ থেকে ৬ষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া জানা অপহৃত এই তিন যুবক কখনো কৃষি কাজ আবার কখনো বা রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন। রাজনীতিতে সক্রিয় না হলেও তারা সকলেই বিএনপির অনুসারী। ভোটের সময় তারা মাঠে ময়দানে ধানের শীষের জন্য ভোট চাইতেন। তাদের সাথে প্রতিবেশী কারো কোন শত্রুতা ছিল না।

নাটোরের নবাগত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আমজাদ হোসাইন গনমাধ্যমকে বলেছেন, তিনি নতুন এসেছেন। বিষয়টি অনেক আগের। গনমাধ্যমের মাধ্যমেই তিনি বিষয়টি জেনেছেন। বিষয়টি জানতে পেরে পুলিশের গোয়েন্দা বাহিনীর মাধ্যমে খোঁজখবর নেয়া শুরু করেছেন। এ বিষয়ে পুলিশের অনুসন্ধান শেষে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিত্বে পরবর্তি  করণীয় নির্ধারণ করবেন।

শনিবার সারাদিন সরেজমিনে এসব পরিবারে গিয়ে জানা যায়, ২০১৩ সালের ১৯ মে রাত ১০টার দিকে বেশ কয়েকটি মাইক্রোবাসে বড়াইগ্রামের গুরুমশৈল ও মহিষভাঙ্গা গ্রাম থেকে পুলিশ ও র‍্যাবের মতো পোষাক পড়ে এবং কয়েকজন সাদা টিশার্ট জিন্স প্যান্ট পড়ে প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে রাস্তা থেকে গুরুমশৈল গ্রামের কৃষক রুহুল আমীন তালুকদারের ছেলে ইব্রাহিম তালুকদার (৩৫) ও শাহজাহান আলীর ছেলে কামাল হোসেন (২৫) কে আটক করে। রাইফেলের বাট দিয়ে মারতে মারতে তাদের বন্ধু মহিষভাঙ্গা গ্রামের একটি মোবাইল কোম্পানীর প্রহরী সুমন আলীর বাড়িতে নিয়ে যান। সেখানে সুমনকে না পেয়ে তার বাবা লঙ্কর প্রামাণিককে বাঁশের লাঠি দিয়ে পেটানো শুরু করে।

স্ত্রী সন্তানদের সামনে নির্মমভাবে মারপিটের একপর্যায়ে তিনি মাটিতে পড়ে যান। লঙ্কর প্রামাণিক  হৃদরোগী জানার পর মারধর বন্ধ করে তারা প্রতিবেশী আবু বক্করের বাড়িতে গিয়ে তার ছেলে তৈয়ব আলী (৩২) কে ধরে নিয়ে যায়।

একই দিন নিখোঁজ হয় কালিকাপুর গ্রামের বাড়িতে ছুটিতে আসা বিজিবি সদস্য গাজী ওমর ফারুকের যুবক ছেলে রাসেল গাজী এবং তার বন্ধু একই এলাকার কাটাশকুল গ্রামের আফতাব উদ্দিন মৃধার ছেলে কলেজ ছাত্র মোঃ সেন্টু হোসেন।

এ সব বিষয়ে অনুসন্ধানে গেলে বড়াইগ্রাম উপজেলার মহিষভাঙ্গা গ্রামের অপহৃত তৈয়ব আলীর পিতা আবু বক্কর বলেন, ঘটনার পর বনপাড়া পৌরসভার মেয়র আওয়ামী লীগ নেতা কে এম জাকির হোসেন জিডির কাগজ নিয়ে দেখা করতে বলেন। দেখা করলে এ বিষয়ে আর বাড়াবাড়ি না করে চুপ থাকতে বলেন।

তৈয়বের চাচা আব্দুল কুদ্দুস বলেন, তার চোখের সামনে তার ভাতিজা তৈয়বকে তুলে নেয়া হয়েছে। অপহরণকারীদের মধ্যে তার পূর্ব পরিচিত বড়াইগ্রাম থানার পুলিশ সদস্য তরিকুল ইসলাম ছিলেন। কেন তৈয়বকে ধরা হচ্ছে সে সময় তরিকুলের কাছে জানতে চাইলে তাকে ধমক দিয়ে সরিয়ে দেন তরিকুল।

ঘটনার কয়েকদিনের মধ্যে তরিকুল এই থানা থেকে অন্যত্র বদলী হয়ে চলে যায়। তাদের বাড়ির পাশের বনপাড়া-হাটিকুমরুল মহাসড়কের মুদি দোকানী কোরবান আলী এই প্রতিবেদককে বলেন, ঘটনার সময় অপহরণকারীরা তার দোকানে এসে সিগারেট কিনে। এসময় অপহরণকারীরা তার দোকানে থাকা দুটি মোবাইল সেট নিয়ে নেয়। তবে চলে যাওয়ার সময় মোবাইল দুটি ফেরত দিয়ে যায়। এতে তার মনে হয়েছে ঘটনার সময় এলাকাবাসীকে যেন খবর দিতে না পারে এজন্যই হয়ত মোবাইল দুটি নিয়ে নিয়েছিল। চেষ্টা করেও এসব বিষয়ে কথা বলার জন্য আওয়ামী লীগ নেতা কে এম জাকির হোসেনকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।

উপজেলার গুরুমশৈল গ্রামের অপহৃত ইব্রাহীম তালুকদারের বাড়ি গেলে তার পিতা বৃদ্ধ রুহুল আমিন তালুকদার বলেন, তারা সক্রিয় ভাবে কোন রাজণীতি করেন না। তবে অপহৃত অন্য পরিবার গুলোর মতোই সারাজীবন তারা বিএনপি পরিবার হিসেবে পরিচিত। তারা ধানের শীষে ভোট দেন। তারা প্রকাশ্য রাজপথে নিহত উপজেলা চেয়ারম্যান বিএনপি নেতা সানাউল্লাহ নূর বাবুর অনুসারী।

অপরহরণকান্ডের পর তারা বড়াইগ্রাম থানায় জিডি করতে গেলে পুলিশ জিডি নিতে রাজি হয়নি। অনেক অনুরোধ করার পর অপহৃত তিন যুবকের পরিবারের পক্ষ থেকে তার অপর ছেলে লোকমান তালুকদারের দেয়া একটি জিডি পুলিশ গ্রহণ করে। এটাই শেষ। আর কোন প্রতিকার বা পুলিশী সহযোগীতা তারা পাননি।

একই গ্রামের বাসিন্দা অপহৃত কামাল হোসেনের মা আনোয়ারা বেগম বলেন, তার চার ছেলে মেয়ের মধ্যে কামাল হোসেন সবার বড়। দুনিয়ার কোন মানুষের সাথে তার কোন বিরোধ ছিল না। তবে ঘটনার এক বছর আগে হাসিম মেম্বার নামে এক প্রতিবেশীর বেদখল হওয়া জমি উদ্ধারে তার ছেলে কামাল ও তার অপহৃত দুই বন্ধু ইব্রাহিম এবং তৈয়ব ভুমিকা রেখেছিল। এর জের ধরেই তারা অপহৃত হতে পারেন বলে তিনি মনে করেন। ছেলের সন্ধান করতে তিনি র‍্যাব ও পুলিশের সদর দপ্তরের পাশাপাশি ছুটে গেছেন আয়না ঘরেও। কিন্তু কোন খবর পাননি।

কামাল অপহরনের সময় তার স্ত্রী একমাসের অন্তস্বত্তা ছিলেন। কামালের ছেলে মোবারক হোসেন হৃদয় এখন নাটোর সদরের ঘোড়াগাছা চৌমহনীতে একমাত্র ফুফুর বাড়িতে থেকে চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ে। বাবা নেই মায়ের বিয়ে হয়ে গেছে অন্যত্র তাই ফুফুকেই মা ডাকেন।

এই প্রতিবেদক সেখানে গেলে ছোট্র মোবারক হোসেন হৃদয় আশা প্রকাশ করে বলেন, একদিন তার বাবা ফিরে আসবে। জীবনে এক মুহুর্তের জন্যও না দেখা পিতাকে দেখে তার আশা পুরণ হবে। সাধ মিটবে। অপহৃত তৈয়বের স্ত্রীরও অন্যত্র বিয়ে হয়ে গেছে। অপহরনের সময় তার সংসারে সাত মাস বয়সী কন্যা ইশরাত জাহান মিম এখন নানার বাড়িতে থাকে। ৬ষ্ঠ শ্রেণী পড়ুয়া মিমও স্বপ্ন দেখেন একদিন তার বাবাও ফিরে আসবে। বিদ্যালয়ের অন্য সহপাঠিদের পিতার মতো তার পিতাও বিদ্যালয়ে এসে তাকে আদর করে বাড়ি নিয়ে যাবে, ভালবাসবে। সেদিন সে সব দুঃখ ভুলে যাবে।

উপজেলার কাটাশকুল গ্রামের কলেজ ছাত্র সেন্টু আলী চাচাতো ভাই এরশাদ আলী জানান, সেন্টু নিখোঁজের পর ছেলের শোকে কান্না করতে করতে ইতোমধ্যে তার পিতা আফতাব উদ্দীন মৃধা ও মা শেফালী বেগম মারা গেছেন।

নিখোঁজ বিজিবি সদস্য রাসেল গাজীর পিতা ওমর ফারুক জানান, তার ছেলেকে তার বন্ধু নিখোঁজ সেন্টু ফোন করে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে যায়। তার পর থেকে দুজনই নিখোঁজ। এ বিষয়ে তিনি মামলাও করেছিলেন। তিনি জানতে পারেন তার বিবাহিত এই ছেলের সাথে ঢাকা বাড্ডা এলাকার এক মেয়ের সর্ম্পক আছে। বিষয়টি পুলিশকে জানালে পুলিশ সেই মেয়েকে আটক করে তার মোবাইল ফোনে অপহৃত রাসেল গাজীর সাথে অনেক ছবি ও তথ্য পায়। তারপরও স্থানীয় সাবেক এমপিসহ আওয়ামী লীগের নেতাদের চাপে পুলিশ কিছু করেনি। উলটো তার মামলা খারিজ করে তার বিরুদ্ধেই দুটো মামলা দেয় আসামীরা। এখন সব মামলা খারিজ হয়ে গেছে।

একজন তরুন বিজিবি সদস্য মাত্র সাড়ে তিন বছর চাকুরীর পর এভাবে নিখোঁজ হলেও কেউ কিছু করলো না, এটা ভেবেই তিনি হতাশায় ডুবে যান।

তিনি দাবী করেন এই আসনের সাবেক এমপি জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি মরহুম অধ্যাপক আব্দুল কুদ্দুস ও বড়াইগ্রাম উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল কুদ্দুস মিয়াজীর বিরোধীতার কারণে তিনি কোন বিচার পাননি। আব্দুল কুদ্দুস মিয়াজী দীর্ঘদিন থেকে আত্মগোপনে থাকায় তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।

বড়াইগ্রাম উপজেলার বাসিন্দা একটি বেসরকারি টেলিভিশনের জেলা প্রতিনিধি শেখ তোফাজ্জল হোসেন বলেছেন, এসব পরিবারের অনুরোধে বার বার এই বিষয়ে সংবাদ প্রকাশ করতে তিনি উদ্যোগ নিয়েছেন। স্থানীয়দের বক্তব্য নিয়ে কাজ শুরু করলেই উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতারা বাঁধা দিয়েছেন। এ বিষয়ে ঘাটাঘাটি না করতে বলেছেন।

এছাড়া নাটোর সদরের রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু মডেল স্কুলের প্রধান শিক্ষক মোঃ শহীদুল ইসলাম এসব ঘটনার কাছাকাছি সময়ে নিখোঁজ হন। আজ পর্যন্ত তারও কোন সন্ধান মেলেনি।

বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা ও সাবেক মন্ত্রী অ্যাডভোকেট এম রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু বলেছেন, ফ্যাসীবাদি সরকারের আমলে সাধারণ বিএনপি কর্মীদের সাথে ঘটে যাওয়া এসব গুমের ঘটনায় এখন নতুন করে মামলা নিয়ে পুলিশের তদন্ত শুরু করা উচিত। গুম কমিশনকেও এসব বিষয়ে এগিয়ে আসার জন্য তিনি দাবী জানিয়েছেন।