ঢাকা ১১:০১ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৪ মে ২০২৫, ১০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

দক্ষিণ চট্টগ্রামের তথাকথিত দুই ‘বন্দুকযুদ্ধ বিশেষজ্ঞ’!

ইকবাল হোসাইন, উখিয়া (কক্সবাজার) প্রতিনিধি
  • Update Time : ০৫:৫৭:১২ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৪ মে ২০২৫
  • / ২৩ Time View

দক্ষিণ চট্টগ্রামের তথাকথিত ‘বন্দুকযুদ্ধ বিশেষজ্ঞ’ ওসি প্রদীপ। মাদকবিরোধী সাহসী অফিসার হিসেবে বারবার পত্র-পত্রিকার শিরোনামে এসেছেন । কিন্তু এই ওসি প্রদীপের নিচে ছিল গভীর অন্ধকার যে অন্ধকারে লুকানো ছিল হাজারো নিরীহ মানুষের নিথর দেহ, হাজারো মা-বাবা, সন্তান ও স্ত্রীর আর্তনাদ।

২০২০ সালের জুলাই মাসে টেকনাফে এক মর্মান্তিক রাতে পুলিশের গুলিতে নিহত হন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান। সেই রাত শুধু এক তরুণ অফিসারের প্রাণই কেড়ে নেয়নি, বরং খুলে দিয়েছিল বন্দুকযুদ্ধের নামে নির্বিচারে মানুষ হত্যার এক ভয়ংকর জানালা। ঘটনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা টেকনাফ থানার তৎকালীন ওসি প্রদীপ কুমার দাশ তখনই পরিণত হন জাতির আলোচনার কেন্দ্রে।

দীর্ঘ বিচারপ্রক্রিয়া শেষে ২০২২ সালের ৩১ জানুয়ারি কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালত প্রদীপ ও পরিদর্শক লিয়াকত আলীকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করে। সাধারণ মানুষের অনেকে এই রায়কে দেখেছিলেন ন্যায়বিচারের প্রতিফলন হিসেবে। কিন্তু এরপর সময় থেমে যায়নি, বরং ন্যায়বিচার যেন সময়ের মধ্যেই গলে যেতে শুরু করে।

২০২৫ সালে ফাঁসির অনুমোদন (ডেথ রেফারেন্স) প্রক্রিয়ার কারণে আটকে আছে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা। মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যা মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের শুনানি হাইকোর্টে শুরু হয়েছে। ২০২৫ সালের ২৩ এপ্রিল বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমান ও বিচারপতি মো. সগীর হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে এ শুনানি শুরু হয়। তবে এই শুনানি কত দিন চলবে, কখন রায় আসবে—তা নিয়ে জনমনে তৈরি হচ্ছে ধোঁয়াশা।

ডেথ রেফারেন্স একটি আইনি প্রক্রিয়া হলেও, অনেক বিশেষজ্ঞ আইন বিশ্লেষক একে আইনের একটি ‘লোফোল’ বলে থাকেন। অনেক সময় ডেথ রেফারেন্স দীর্ঘ সময় সাপেক্ষ ব্যাপার হওয়ায় মামলার সাক্ষ্য, তথ্য-প্রমাণ দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের বেঁচে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়।

মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যা মামলায় প্রদীপ ও লিয়াকতের মতো আসামিরা এই আইনি ফাঁকগুলোকে কি বাঁচার খুঁটি হিসেবে ব্যবহার করবেন না? এটাই এখন জনমনের প্রশ্ন।

এই হত্যাকাণ্ডের পরপরই একটি ফোনালাপ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে, যেখানে একজন আইনজীবীকে বলতে শোনা যায়, “অবসরপ্রাপ্ত সেনা তো, কোনো সমস্যা নাই।” এই ফোনালাপটি স্পষ্ট করে দিয়েছিল এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড এবং প্রদীপের মতো খুনিদের রক্ষায় বহু ‘আইন-ভক্ষক’ এগিয়ে আসতে পারে।

ওসি প্রদীপের মামলাটি এখন হাইকোর্টের বিচারাধীন। শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষ মামলার পেপারবুক উপস্থাপন করছে, সাক্ষীদের ১৬৪ ধারায় দেওয়া জবানবন্দি পাঠ করছে। এসব অবশ্যই আইনি নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যে পড়ে। তবে জনগণ জানতে চায়—কত দিন লাগবে এই প্রক্রিয়া শেষ হতে? বিচার কি দীর্ঘসূত্রতার জালে আটকে যাবে?

ওসি প্রদীপের মামলায় যা ঘটছে, তা শুধু একটি ব্যক্তির বিচার নয়, এটি বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার এক বড় নিরীক্ষার মুখ। জনগণ চাই বিচার হোক যথাযথ প্রক্রিয়ায়। কিন্তু সেই বিচার হতে হবে সময়োচিত, কার্যকর এবং জনআস্থাসম্পন্ন। সময় যদি বিচারের গলায় দড়ি বেঁধে রাখে, তবে সেটি ন্যায় নয়, নিছক প্রহসন হয়ে ওঠে।

Please Share This Post in Your Social Media

দক্ষিণ চট্টগ্রামের তথাকথিত দুই ‘বন্দুকযুদ্ধ বিশেষজ্ঞ’!

ইকবাল হোসাইন, উখিয়া (কক্সবাজার) প্রতিনিধি
Update Time : ০৫:৫৭:১২ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৪ মে ২০২৫

দক্ষিণ চট্টগ্রামের তথাকথিত ‘বন্দুকযুদ্ধ বিশেষজ্ঞ’ ওসি প্রদীপ। মাদকবিরোধী সাহসী অফিসার হিসেবে বারবার পত্র-পত্রিকার শিরোনামে এসেছেন । কিন্তু এই ওসি প্রদীপের নিচে ছিল গভীর অন্ধকার যে অন্ধকারে লুকানো ছিল হাজারো নিরীহ মানুষের নিথর দেহ, হাজারো মা-বাবা, সন্তান ও স্ত্রীর আর্তনাদ।

২০২০ সালের জুলাই মাসে টেকনাফে এক মর্মান্তিক রাতে পুলিশের গুলিতে নিহত হন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান। সেই রাত শুধু এক তরুণ অফিসারের প্রাণই কেড়ে নেয়নি, বরং খুলে দিয়েছিল বন্দুকযুদ্ধের নামে নির্বিচারে মানুষ হত্যার এক ভয়ংকর জানালা। ঘটনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা টেকনাফ থানার তৎকালীন ওসি প্রদীপ কুমার দাশ তখনই পরিণত হন জাতির আলোচনার কেন্দ্রে।

দীর্ঘ বিচারপ্রক্রিয়া শেষে ২০২২ সালের ৩১ জানুয়ারি কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালত প্রদীপ ও পরিদর্শক লিয়াকত আলীকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করে। সাধারণ মানুষের অনেকে এই রায়কে দেখেছিলেন ন্যায়বিচারের প্রতিফলন হিসেবে। কিন্তু এরপর সময় থেমে যায়নি, বরং ন্যায়বিচার যেন সময়ের মধ্যেই গলে যেতে শুরু করে।

২০২৫ সালে ফাঁসির অনুমোদন (ডেথ রেফারেন্স) প্রক্রিয়ার কারণে আটকে আছে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা। মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যা মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের শুনানি হাইকোর্টে শুরু হয়েছে। ২০২৫ সালের ২৩ এপ্রিল বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমান ও বিচারপতি মো. সগীর হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে এ শুনানি শুরু হয়। তবে এই শুনানি কত দিন চলবে, কখন রায় আসবে—তা নিয়ে জনমনে তৈরি হচ্ছে ধোঁয়াশা।

ডেথ রেফারেন্স একটি আইনি প্রক্রিয়া হলেও, অনেক বিশেষজ্ঞ আইন বিশ্লেষক একে আইনের একটি ‘লোফোল’ বলে থাকেন। অনেক সময় ডেথ রেফারেন্স দীর্ঘ সময় সাপেক্ষ ব্যাপার হওয়ায় মামলার সাক্ষ্য, তথ্য-প্রমাণ দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের বেঁচে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়।

মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যা মামলায় প্রদীপ ও লিয়াকতের মতো আসামিরা এই আইনি ফাঁকগুলোকে কি বাঁচার খুঁটি হিসেবে ব্যবহার করবেন না? এটাই এখন জনমনের প্রশ্ন।

এই হত্যাকাণ্ডের পরপরই একটি ফোনালাপ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে, যেখানে একজন আইনজীবীকে বলতে শোনা যায়, “অবসরপ্রাপ্ত সেনা তো, কোনো সমস্যা নাই।” এই ফোনালাপটি স্পষ্ট করে দিয়েছিল এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড এবং প্রদীপের মতো খুনিদের রক্ষায় বহু ‘আইন-ভক্ষক’ এগিয়ে আসতে পারে।

ওসি প্রদীপের মামলাটি এখন হাইকোর্টের বিচারাধীন। শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষ মামলার পেপারবুক উপস্থাপন করছে, সাক্ষীদের ১৬৪ ধারায় দেওয়া জবানবন্দি পাঠ করছে। এসব অবশ্যই আইনি নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যে পড়ে। তবে জনগণ জানতে চায়—কত দিন লাগবে এই প্রক্রিয়া শেষ হতে? বিচার কি দীর্ঘসূত্রতার জালে আটকে যাবে?

ওসি প্রদীপের মামলায় যা ঘটছে, তা শুধু একটি ব্যক্তির বিচার নয়, এটি বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার এক বড় নিরীক্ষার মুখ। জনগণ চাই বিচার হোক যথাযথ প্রক্রিয়ায়। কিন্তু সেই বিচার হতে হবে সময়োচিত, কার্যকর এবং জনআস্থাসম্পন্ন। সময় যদি বিচারের গলায় দড়ি বেঁধে রাখে, তবে সেটি ন্যায় নয়, নিছক প্রহসন হয়ে ওঠে।