ঢাকা ০৩:৫৩ অপরাহ্ন, সোমবার, ০৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

কোন দলের চোখে কারা ‘বিতর্কিত’ উপদেষ্টা

নিজস্ব প্রতিবেদক
  • Update Time : ১১:৩১:১৫ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৪ অক্টোবর ২০২৫
  • / ১৯৪১ Time View

অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক

অন্তর্বর্তী সরকারের কিছু উপদেষ্টার বিরুদ্ধে ‘বিতর্কিত’ ভূমিকার পাল্টাপাল্টি অভিযোগ তুলেছে বর্তমানে প্রভাবশালী দলগুলো। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে দেখা করে বিএনপি সুনির্দিষ্ট কয়েকজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে। সেই সাক্ষাতের পরদিন বুধবার জামায়াতে ইসলামী প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আলাদাভাবে দেখা করে কিছু উপদেষ্টার ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছে। জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপি নেতারাও তাদের অভিযোগ জানিয়েছেন। ‘বিতর্কিত’ উপদেষ্টা কারা, কেন দলগুলো এমন অভিযোগ তুলছে-এসব প্রশ্ন এখন আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে।

এরই মধ্যে কয়েকজন উপদেষ্টার বিরুদ্ধে ‘পক্ষপাতের’ অভিযোগ এনে নির্বাচনের আগে তাদের সরিয়ে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। এই তিন দলের নেতারা অনেক দিন ধরেই কিছু উপদেষ্টার বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ করে আসছেন। তারা কখনো তাদের চোখে নিরপেক্ষ নয় বা বিতর্কিত, এমন উপদেষ্টাদের নাম প্রকাশ করেননি। তাদের অভিযোগও অবশ্য কোনো নির্দিষ্ট এক বা একাধিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে নয়। তবে দলগুলো প্রতিপক্ষ দলকে জড়িয়ে এই অভিযোগ তুলছে। বিএনপির অভিযোগ, কিছু উপদেষ্টা একটি বিশেষ দলের পক্ষে কাজ করছে। বিশেষ দল বলতে তারা জামায়াতের দিকে ইঙ্গিত করছে। জামায়াতও একইভাবে বিএনপিকে ইঙ্গিত করে অভিযোগ করে আসছে।

বর্তমানে এনসিপির অভিযোগ বিএনপি ও জামায়াতকে টার্গেট করে। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, জনপ্রশাসনে বদলি-পদায়নে বড় দলগুলোর ‘ভাগ-বাঁটোয়ারায়’ উপদেষ্টা পরিষদের ভেতর থেকে সহায়তা করা হচ্ছে। ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে প্রভাবশালী তিনটি দল কিছু উপদেষ্টার নিরপেক্ষতার প্রশ্নে তাদের অভিযোগ এখন হাজির করেছে প্রধান উপদেষ্টার কাছে। গত দুই দিনে দল তিনটির নেতারা আলাদা আলাদাভাবে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করে তাদের অভিযোগ তুলে ধরেছেন। বিএনপি তাদের কাছে বিতর্কিত কয়েকজন উপদেষ্টার নামও প্রধান উপদেষ্টাকে জানিয়েছে বলে জানা গেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকার ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে চাপে রাখার কৌশল হিসেবে রাজনৈতিক দলগুলো প্রশাসন এবং উপদেষ্টাদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ প্রধান উপদেষ্টাকে জানিয়েছে। এর আগে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ বিভিন্ন দলের নেতারা প্রকাশ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। সংশোধন না হলে পক্ষপাতে জড়িত উপদেষ্টাদের নাম জনসমক্ষে প্রকাশেরও হুমকি দিয়ে রেখেছে জামায়াত।

মঙ্গলবার বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করে কয়েকজন উপদেষ্টার বিষয়ে তাদের আপত্তি জানায়। দলটির ভাষ্য, ওইসব উপদেষ্টাকে সরানো না হলে সরকারের অবস্থান নিরপেক্ষ হবে না এবং নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করা কঠিন হবে। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকের বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘নির্বাচনে জনপ্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রধান ভূমিকা থাকে। তবে সাম্প্রতিককালে এ দুই খাতে যত রদবদল ও পদায়ন হয়েছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে একটি দলের সমর্থকরা প্রাধান্য পেয়েছে।’

দলটির সূত্র জানায়, বিএনপি জনপ্রশাসনবিষয়ক কমিটির উপদেষ্টা পর্যায়ের একজন সদস্যের বিরুদ্ধে সরাসরি পক্ষপাতের অভিযোগ দিয়েছে। তাদের অভিযোগ, তিনি এক সময় ছাত্রশিবিরের রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন। বিভিন্ন জেলা প্রশাসক থেকে শুরু করে নির্বাচনী কাজে সম্পৃক্ত গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন, বদলির বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন এবং জামায়াত-শিবির সমর্থিত কর্মকর্তাদের বেশি প্রাধান্য দিচ্ছেন। বিগত কয়েক মাসে সবগুলো পদায়ন, রদবদলে ওই উপদেষ্টা এ ভূমিকা নিয়েছেন। জনপ্রশাসনবিষয়ক কমিটির আরেক সদস্য যিনি পদমর্যাদায় সচিব, তাঁর বিরুদ্ধেও বিএনপি একটি বিশেষ দলের প্রতি পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ জানিয়েছে। বিএনপির অভিযোগ রয়েছে আইনশৃঙ্খলাবিষয়ক কমিটির এক সদস্যের বিরুদ্ধেও। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে পুলিশের নিয়োগ ও বদলির প্রক্রিয়া নিয়েও কিছু পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন বিএনপি নেতারা।

বিএনপির সূত্র জানায়, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে যেসব উপদেষ্টা আগামী নির্বাচনে অংশ নেবেন অথবা যারা কোনো দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত আছেন কিংবা দলের সঙ্গে নিজের অবস্থান চিহ্নিত করেছেন, তারা থাকলে সরকারের নিরপেক্ষ ভূমিকা থাকবে না বলে জানিয়েছে বিএনপি। এর মধ্যে গণঅভ্যুত্থানে যুক্ত দুজন উপদেষ্টার প্রসঙ্গ তুলেছে বিএনপি।প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে সচিবালয়ে থাকা চিহ্নিত ফ্যাসিস্টের দোসরদের সরিয়ে নিরপেক্ষ কর্মকর্তাকে বসানোরও দাবি জানানো হয়। কেন্দ্র থেকে জেলা প্রশাসনে একই ব্যবস্থা নিতে প্রধান উপদেষ্টাকে অনুরোধ করেছেন বিএনপি নেতারা।

এ ব্যাপারে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘সরকারের ভেতরে ও বাইরে যাদের নিরপেক্ষতা ভঙ্গ করার সুযোগ রয়েছে, তাদের রেখে নিরপেক্ষতা রক্ষা করা সম্ভব নয়। পক্ষপাতের প্রশ্নটা আসছে বিভিন্ন কারণে। অনেকগুলো পদায়ন, বদলির বিষয়ে সরকারের অবস্থানকে তারা প্রভাবিত করেছে এবং করছে। তাই যাদের নিয়ে বিতর্ক, তাদের চলে যেতে হবে। তারা থাকলে সরকারই প্রশ্নবিদ্ধ হবে।’

একজন সচিবসহ কয়েকজন আমলার নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন জামায়াতের
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে জামায়াত নেতারা কয়েকজন উপদেষ্টার নিরপক্ষেতা নিয়ে প্রশ্ন তুললেও, কারও নাম বলেননি। বৈঠক সূত্র জানিয়েছে, সম্প্রত নিয়োগ পাওয়া গুরুত্বপূর্ণ একজন সচিবসহ কয়েকজন আমলার নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে জামায়াতের। প্রধান উপদেষ্টা নিজের তত্ত্বাবধায়নে প্রশাসনে রদবদল করার আশ্বাস দিলেও উপদেষ্টা পরিষদ পরিবর্তনের বিষয়ে কিছু বলেননি।

জামায়াত সূত্র জানায়, বিএনপির তালিকা থেকে নিয়োগ পাওয়া তিন উপদেষ্টাকে নিরপেক্ষ মনে করছে না জামায়াত। নিরাপত্তার বিষয়ে আরেকজন উপদেষ্টার নিরপেক্ষতা নিয়েও সংশয় রয়েছে দলটির। অভ্যুত্থানে যুক্ত একজন উপদেষ্টার বিষয়েও আপত্তি আছে জামায়াতের। বৈঠকে অংশ নেওয়া জামায়াতের এক নেতা বলেন, একজন উপদেষ্টা সামাজিক মাধ্যমে জামায়াতকে বারবার হেয় করছেন। তিনি জামায়াতের আদর্শ এবং প্রভাব নিয়ে বারবার প্রশ্ন তুলছেন। এই উপদেষ্টার পরিবারের কেউ বিএনপির প্রার্থী হতে পারেন– এমন সম্ভাবনার কথাও শোনা যাচ্ছে। তাই তিনি নির্বাচনকালীন সরকারি দায়িত্বে নিরপেক্ষ থাকতে পারবেন না।

জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের বলেন, কয়েকজন উপদেষ্টার কাজকর্মে নিরপেক্ষতা পাওয়া যাচ্ছে না। তবে, প্রধান উপদেষ্টাকে জামায়াত কারও নাম বলেনি। সরকারপ্রধানকে জানিয়েছি, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য উপদেষ্টা পরিষদের রদবদল প্রয়োজন। জামায়াতের দৃষ্টিতে কোন কোন উপদেষ্টা নিরপেক্ষ নন– প্রশ্নে ডা. তাহের বলেন, আপাতত কারও নাম বলছি না। উপদেষ্টারা শোধরাবেন এবং নিজেদের নিরপেক্ষতা প্রমাণ করবেন বলে আশা করি। তা না করলে জামায়াত তাদের নাম প্রকাশে বাধ্য হবে।

কয়েকজন উপদেষ্টার বিরুদ্ধে এনসিপির অভিযোগে
বুধবার বিকেলে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) একটি প্রতিনিধি দল। বৈঠকে উপদেষ্টা পরিষদে কারা কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, তাদের বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টাকে জানিয়েছেন বলে সাংবাদিকদের জানান এনসিপি আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। নাহিদ ইসলাম জানান, সরকার যখন গঠিত হয়, তখন বিভিন্ন দলের রেফারেন্সে উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করা হয়েছিল। অনেকেই সেই সূত্রে এই সরকারের অংশ হয়েছেন। ফলে উপদেষ্টা পরিষদ পুনর্গঠন হলে শুধু ছাত্র উপদেষ্টাদের নয়; সবার ক্ষেত্রেই বিষয়টি বিবেচনায় আনতে হবে। তিনি বলেন, আমরা প্রধান উপদেষ্টাকে জানিয়েছি কারা কোন দলের সঙ্গে যুক্ত বা প্রশাসনের ভাগবাটোয়ারায় জড়িত। এসব বিষয় সার্বিকভাবে বিবেচনা করতে হবে।

সংবাদ সম্মেলনে সেসব উপদেষ্টার নাম নেননি নাহিদ। এ বিষয়ে এনসিপির একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলেছে সমকাল। তারা জানান, বৈঠকে কয়েকজন উপদেষ্টার রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ও অন্যান্য অভিযোগের বিষয়ে নাম উল্লেখ না করে প্রধান উপদেষ্টাকে জানিয়েছে এনসিপি। এনসিপি জানায়, দুজন উপদেষ্ট বিএনপির এক শীর্ষ নেতার বন্ধু। একজন উপদেষ্টার জামায়াত-সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। তিনি আগে ছাত্র সংঘ করতেন। এই উপদেষ্টার বিষয়ে বিএনপি বলেছিল, তিনি ছাত্রশিবির করতেন। মানবাধিকারকর্মী হিসেবে পরিচিত এবং আওয়ামী লীগের সময় হয়রানির শিকার একজন উপদেষ্টার সঙ্গে জামায়াতের খুব ভালো সম্পর্ক রয়েছে। জানা গেছে, বিভিন্ন নিয়োগে জামায়াতকে তিনি প্রাধান্য দিয়েছেন।

জাতীয় নাগরিক পার্টি সূত্র জানায়, আলোচিত দুজন নারী উপদেষ্টার বিরুদ্ধে একটি দেশের দূতাবাসের সঙ্গে সখ্যের অভিযোগ আছে। ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার শপথ নেওয়ার ৩০ মিনিট আগেও এদের একজন সেই দূতাবাসে ছিলেন। সেখান থেকে উপদেষ্টা হওয়ার নিশ্চয়তা পেয়ে তিনি শপথ নিতে আসেন।

বিএনপির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের অভিযোগ আরেকজন উপদেষ্টার বিরুদ্ধে। তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আছেন। অভ্যুত্থান ও সরকার গঠনের সময় তিনি সক্রিয় ছিলেন। এ অবস্থায় তাঁর দলীয় যোগাযোগ সরকারের ক্ষতির কারণ হচ্ছে।

শেষের দিকে উপদেষ্টা পরিষদে যুক্ত হয়ে নানাভাবে আলোচিত হয়েছেন– এমন একজনের বিরুদ্ধেও আপত্তি জানিয়েছে এনসিপি। তাঁর বিরুদ্ধে নিজের ঘরানার লোকদের মন্ত্রণালয়ের নানা কাজ দেওয়ার অভিযোগও তোলা হয়েছে। এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব বলেন, যেসব উপদেষ্টা বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়ন করছেন, প্রধান উপদেষ্টার কাছে তাদের বিষয়ে বলা হয়েছে।

Please Share This Post in Your Social Media

কোন দলের চোখে কারা ‘বিতর্কিত’ উপদেষ্টা

নিজস্ব প্রতিবেদক
Update Time : ১১:৩১:১৫ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৪ অক্টোবর ২০২৫

অন্তর্বর্তী সরকারের কিছু উপদেষ্টার বিরুদ্ধে ‘বিতর্কিত’ ভূমিকার পাল্টাপাল্টি অভিযোগ তুলেছে বর্তমানে প্রভাবশালী দলগুলো। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে দেখা করে বিএনপি সুনির্দিষ্ট কয়েকজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে। সেই সাক্ষাতের পরদিন বুধবার জামায়াতে ইসলামী প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আলাদাভাবে দেখা করে কিছু উপদেষ্টার ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছে। জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপি নেতারাও তাদের অভিযোগ জানিয়েছেন। ‘বিতর্কিত’ উপদেষ্টা কারা, কেন দলগুলো এমন অভিযোগ তুলছে-এসব প্রশ্ন এখন আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে।

এরই মধ্যে কয়েকজন উপদেষ্টার বিরুদ্ধে ‘পক্ষপাতের’ অভিযোগ এনে নির্বাচনের আগে তাদের সরিয়ে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। এই তিন দলের নেতারা অনেক দিন ধরেই কিছু উপদেষ্টার বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ করে আসছেন। তারা কখনো তাদের চোখে নিরপেক্ষ নয় বা বিতর্কিত, এমন উপদেষ্টাদের নাম প্রকাশ করেননি। তাদের অভিযোগও অবশ্য কোনো নির্দিষ্ট এক বা একাধিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে নয়। তবে দলগুলো প্রতিপক্ষ দলকে জড়িয়ে এই অভিযোগ তুলছে। বিএনপির অভিযোগ, কিছু উপদেষ্টা একটি বিশেষ দলের পক্ষে কাজ করছে। বিশেষ দল বলতে তারা জামায়াতের দিকে ইঙ্গিত করছে। জামায়াতও একইভাবে বিএনপিকে ইঙ্গিত করে অভিযোগ করে আসছে।

বর্তমানে এনসিপির অভিযোগ বিএনপি ও জামায়াতকে টার্গেট করে। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, জনপ্রশাসনে বদলি-পদায়নে বড় দলগুলোর ‘ভাগ-বাঁটোয়ারায়’ উপদেষ্টা পরিষদের ভেতর থেকে সহায়তা করা হচ্ছে। ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে প্রভাবশালী তিনটি দল কিছু উপদেষ্টার নিরপেক্ষতার প্রশ্নে তাদের অভিযোগ এখন হাজির করেছে প্রধান উপদেষ্টার কাছে। গত দুই দিনে দল তিনটির নেতারা আলাদা আলাদাভাবে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করে তাদের অভিযোগ তুলে ধরেছেন। বিএনপি তাদের কাছে বিতর্কিত কয়েকজন উপদেষ্টার নামও প্রধান উপদেষ্টাকে জানিয়েছে বলে জানা গেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকার ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে চাপে রাখার কৌশল হিসেবে রাজনৈতিক দলগুলো প্রশাসন এবং উপদেষ্টাদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ প্রধান উপদেষ্টাকে জানিয়েছে। এর আগে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ বিভিন্ন দলের নেতারা প্রকাশ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। সংশোধন না হলে পক্ষপাতে জড়িত উপদেষ্টাদের নাম জনসমক্ষে প্রকাশেরও হুমকি দিয়ে রেখেছে জামায়াত।

মঙ্গলবার বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করে কয়েকজন উপদেষ্টার বিষয়ে তাদের আপত্তি জানায়। দলটির ভাষ্য, ওইসব উপদেষ্টাকে সরানো না হলে সরকারের অবস্থান নিরপেক্ষ হবে না এবং নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করা কঠিন হবে। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকের বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘নির্বাচনে জনপ্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রধান ভূমিকা থাকে। তবে সাম্প্রতিককালে এ দুই খাতে যত রদবদল ও পদায়ন হয়েছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে একটি দলের সমর্থকরা প্রাধান্য পেয়েছে।’

দলটির সূত্র জানায়, বিএনপি জনপ্রশাসনবিষয়ক কমিটির উপদেষ্টা পর্যায়ের একজন সদস্যের বিরুদ্ধে সরাসরি পক্ষপাতের অভিযোগ দিয়েছে। তাদের অভিযোগ, তিনি এক সময় ছাত্রশিবিরের রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন। বিভিন্ন জেলা প্রশাসক থেকে শুরু করে নির্বাচনী কাজে সম্পৃক্ত গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন, বদলির বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন এবং জামায়াত-শিবির সমর্থিত কর্মকর্তাদের বেশি প্রাধান্য দিচ্ছেন। বিগত কয়েক মাসে সবগুলো পদায়ন, রদবদলে ওই উপদেষ্টা এ ভূমিকা নিয়েছেন। জনপ্রশাসনবিষয়ক কমিটির আরেক সদস্য যিনি পদমর্যাদায় সচিব, তাঁর বিরুদ্ধেও বিএনপি একটি বিশেষ দলের প্রতি পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ জানিয়েছে। বিএনপির অভিযোগ রয়েছে আইনশৃঙ্খলাবিষয়ক কমিটির এক সদস্যের বিরুদ্ধেও। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে পুলিশের নিয়োগ ও বদলির প্রক্রিয়া নিয়েও কিছু পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন বিএনপি নেতারা।

বিএনপির সূত্র জানায়, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে যেসব উপদেষ্টা আগামী নির্বাচনে অংশ নেবেন অথবা যারা কোনো দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত আছেন কিংবা দলের সঙ্গে নিজের অবস্থান চিহ্নিত করেছেন, তারা থাকলে সরকারের নিরপেক্ষ ভূমিকা থাকবে না বলে জানিয়েছে বিএনপি। এর মধ্যে গণঅভ্যুত্থানে যুক্ত দুজন উপদেষ্টার প্রসঙ্গ তুলেছে বিএনপি।প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে সচিবালয়ে থাকা চিহ্নিত ফ্যাসিস্টের দোসরদের সরিয়ে নিরপেক্ষ কর্মকর্তাকে বসানোরও দাবি জানানো হয়। কেন্দ্র থেকে জেলা প্রশাসনে একই ব্যবস্থা নিতে প্রধান উপদেষ্টাকে অনুরোধ করেছেন বিএনপি নেতারা।

এ ব্যাপারে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘সরকারের ভেতরে ও বাইরে যাদের নিরপেক্ষতা ভঙ্গ করার সুযোগ রয়েছে, তাদের রেখে নিরপেক্ষতা রক্ষা করা সম্ভব নয়। পক্ষপাতের প্রশ্নটা আসছে বিভিন্ন কারণে। অনেকগুলো পদায়ন, বদলির বিষয়ে সরকারের অবস্থানকে তারা প্রভাবিত করেছে এবং করছে। তাই যাদের নিয়ে বিতর্ক, তাদের চলে যেতে হবে। তারা থাকলে সরকারই প্রশ্নবিদ্ধ হবে।’

একজন সচিবসহ কয়েকজন আমলার নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন জামায়াতের
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে জামায়াত নেতারা কয়েকজন উপদেষ্টার নিরপক্ষেতা নিয়ে প্রশ্ন তুললেও, কারও নাম বলেননি। বৈঠক সূত্র জানিয়েছে, সম্প্রত নিয়োগ পাওয়া গুরুত্বপূর্ণ একজন সচিবসহ কয়েকজন আমলার নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে জামায়াতের। প্রধান উপদেষ্টা নিজের তত্ত্বাবধায়নে প্রশাসনে রদবদল করার আশ্বাস দিলেও উপদেষ্টা পরিষদ পরিবর্তনের বিষয়ে কিছু বলেননি।

জামায়াত সূত্র জানায়, বিএনপির তালিকা থেকে নিয়োগ পাওয়া তিন উপদেষ্টাকে নিরপেক্ষ মনে করছে না জামায়াত। নিরাপত্তার বিষয়ে আরেকজন উপদেষ্টার নিরপেক্ষতা নিয়েও সংশয় রয়েছে দলটির। অভ্যুত্থানে যুক্ত একজন উপদেষ্টার বিষয়েও আপত্তি আছে জামায়াতের। বৈঠকে অংশ নেওয়া জামায়াতের এক নেতা বলেন, একজন উপদেষ্টা সামাজিক মাধ্যমে জামায়াতকে বারবার হেয় করছেন। তিনি জামায়াতের আদর্শ এবং প্রভাব নিয়ে বারবার প্রশ্ন তুলছেন। এই উপদেষ্টার পরিবারের কেউ বিএনপির প্রার্থী হতে পারেন– এমন সম্ভাবনার কথাও শোনা যাচ্ছে। তাই তিনি নির্বাচনকালীন সরকারি দায়িত্বে নিরপেক্ষ থাকতে পারবেন না।

জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের বলেন, কয়েকজন উপদেষ্টার কাজকর্মে নিরপেক্ষতা পাওয়া যাচ্ছে না। তবে, প্রধান উপদেষ্টাকে জামায়াত কারও নাম বলেনি। সরকারপ্রধানকে জানিয়েছি, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য উপদেষ্টা পরিষদের রদবদল প্রয়োজন। জামায়াতের দৃষ্টিতে কোন কোন উপদেষ্টা নিরপেক্ষ নন– প্রশ্নে ডা. তাহের বলেন, আপাতত কারও নাম বলছি না। উপদেষ্টারা শোধরাবেন এবং নিজেদের নিরপেক্ষতা প্রমাণ করবেন বলে আশা করি। তা না করলে জামায়াত তাদের নাম প্রকাশে বাধ্য হবে।

কয়েকজন উপদেষ্টার বিরুদ্ধে এনসিপির অভিযোগে
বুধবার বিকেলে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) একটি প্রতিনিধি দল। বৈঠকে উপদেষ্টা পরিষদে কারা কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, তাদের বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টাকে জানিয়েছেন বলে সাংবাদিকদের জানান এনসিপি আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। নাহিদ ইসলাম জানান, সরকার যখন গঠিত হয়, তখন বিভিন্ন দলের রেফারেন্সে উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করা হয়েছিল। অনেকেই সেই সূত্রে এই সরকারের অংশ হয়েছেন। ফলে উপদেষ্টা পরিষদ পুনর্গঠন হলে শুধু ছাত্র উপদেষ্টাদের নয়; সবার ক্ষেত্রেই বিষয়টি বিবেচনায় আনতে হবে। তিনি বলেন, আমরা প্রধান উপদেষ্টাকে জানিয়েছি কারা কোন দলের সঙ্গে যুক্ত বা প্রশাসনের ভাগবাটোয়ারায় জড়িত। এসব বিষয় সার্বিকভাবে বিবেচনা করতে হবে।

সংবাদ সম্মেলনে সেসব উপদেষ্টার নাম নেননি নাহিদ। এ বিষয়ে এনসিপির একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলেছে সমকাল। তারা জানান, বৈঠকে কয়েকজন উপদেষ্টার রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ও অন্যান্য অভিযোগের বিষয়ে নাম উল্লেখ না করে প্রধান উপদেষ্টাকে জানিয়েছে এনসিপি। এনসিপি জানায়, দুজন উপদেষ্ট বিএনপির এক শীর্ষ নেতার বন্ধু। একজন উপদেষ্টার জামায়াত-সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। তিনি আগে ছাত্র সংঘ করতেন। এই উপদেষ্টার বিষয়ে বিএনপি বলেছিল, তিনি ছাত্রশিবির করতেন। মানবাধিকারকর্মী হিসেবে পরিচিত এবং আওয়ামী লীগের সময় হয়রানির শিকার একজন উপদেষ্টার সঙ্গে জামায়াতের খুব ভালো সম্পর্ক রয়েছে। জানা গেছে, বিভিন্ন নিয়োগে জামায়াতকে তিনি প্রাধান্য দিয়েছেন।

জাতীয় নাগরিক পার্টি সূত্র জানায়, আলোচিত দুজন নারী উপদেষ্টার বিরুদ্ধে একটি দেশের দূতাবাসের সঙ্গে সখ্যের অভিযোগ আছে। ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার শপথ নেওয়ার ৩০ মিনিট আগেও এদের একজন সেই দূতাবাসে ছিলেন। সেখান থেকে উপদেষ্টা হওয়ার নিশ্চয়তা পেয়ে তিনি শপথ নিতে আসেন।

বিএনপির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের অভিযোগ আরেকজন উপদেষ্টার বিরুদ্ধে। তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আছেন। অভ্যুত্থান ও সরকার গঠনের সময় তিনি সক্রিয় ছিলেন। এ অবস্থায় তাঁর দলীয় যোগাযোগ সরকারের ক্ষতির কারণ হচ্ছে।

শেষের দিকে উপদেষ্টা পরিষদে যুক্ত হয়ে নানাভাবে আলোচিত হয়েছেন– এমন একজনের বিরুদ্ধেও আপত্তি জানিয়েছে এনসিপি। তাঁর বিরুদ্ধে নিজের ঘরানার লোকদের মন্ত্রণালয়ের নানা কাজ দেওয়ার অভিযোগও তোলা হয়েছে। এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব বলেন, যেসব উপদেষ্টা বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়ন করছেন, প্রধান উপদেষ্টার কাছে তাদের বিষয়ে বলা হয়েছে।