ইলিশ শিকারে বৈষম্যের শিকার বাংলাদেশি জেলেরা

- Update Time : ০৭:৩৩:৫১ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২১ অক্টোবর ২০২৫
- / ৮৭ Time View
কারও সর্বনাশ কারও পৌষ মাস- ইলিশ শিকারের ক্ষেত্রে এ প্রবাদটি বাংলাদেশ উপকূলের জেলেদের জন্য বেশ প্রযোজ্য। বাংলাদেশে উপকূলীয় জেলেেদের জন্য নিষেধাজ্ঞার সময় ২২ দিন, অথচ পশ্চিমবঙ্গে এ সময় অর্ধেক অর্থাৎ ১১ দিন। এ দেশের জেলেরা যখন বসে থাকে, ভারতের জেলেরা তখন ইলিশ ধরে।
ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুম চলছে। এ সময়ে সাগরের নোনা পানি থেকে নদীর মিঠা পানিতে এসে ডিম ছাড়ে মা ইলিশ। ডিম ছেড়ে আবার সাগরেই ফিরে যায়। এই প্রজনন চক্র যাতে বাধাগ্রস্ত না হয়, সেজন্য সাগর, নদী ও মোহনায় মাছ ধরায় চলছে নিষেধাজ্ঞা। এ কারণে উপকূলের অন্যান্য এলাকার মতো পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালীর মৎস্য ঘাটগুলোতেও নোঙর করা সারি সারি ট্রলার। ইলিশকে ডিম ছাড়ার সুযোগ দিতেই জেলেদের এই বিরতি।
কিন্তু উপকূলের জেলেদের ক্ষেত্রে বৈষম্যটা হচ্ছে- একই বঙ্গোপসাগরে দুই প্রতিবেশী দেশের নিষেধাজ্ঞার সময় এক নয়। বাংলাদেশের নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকার ১৩ দিন আগেই প্রতিবেশী দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গে নিষেধাজ্ঞা শেষ হবে।
বাংলাদেশ সরকার মা ইলিশ সংরক্ষণে ৪ থেকে ২৫ অক্টোবর ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গে তা মাত্র ১১ দিন; ২ থেকে ১২ অক্টোবর। একই বঙ্গোপসাগরে পাশাপাশি দুই দেশের এই ভিন্নতা নিয়ে এখন বাংলাদেশের জেলেদের মনে হতাশা।
উপকূলীয় এলাকার জেলেদের আশঙ্কা- তাদের নিষেধাজ্ঞা চলাকালে যদি প্রতিবেশী দেশের জেলেরা সাগরে মাছ ধরতে নামেন, তাহলে মা ইলিশের প্রজনন বাধাগ্রস্ত হবে কিনা? কিংবা বাংলাদেশের জেলেরা পরবর্তী সময়ে ক্ষতির মুখে পড়বেন কিনা?
তবে মৎস্য বিভাগ বলছে, ৯০ ভাগ ইলিশের বিচরণ বাংলাদেশ জলসীমায়। এই দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের নদী বা মোহনায় এসেই ডিম ছাড়ে মা ইলিশ। পরে আবার সাগরে ফিরে যায়। সুতরাং ইলিশ অন্য কোথাও যাওয়ার শঙ্কা নেই।
বাংলাদেশে ইলিশের মূল প্রজননকাল সাধারণত আশ্বিনী পূর্ণিমা ও অমাবস্যার সময়কে ঘিরে। সে সময় মা ইলিশ ডিম ছাড়তে মোহনা কিংবা নদীমুখে আসে।
মৎস্য বিভাগ জানায়, এ সময় মাছ ধরা বন্ধ রাখলে প্রজনন সফল হয় এবং উৎপাদন বাড়ে। উপকূলীয় পটুয়াখালীর বিভিন্ন মৎস্যঘাটে এখন ট্রলারগুলো নোঙর করে রাখা। ফলে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন হাজার হাজার জেলে।
রাঙ্গাবালী উপজেলার ছোটবাইশদিয়া ইউনিয়নের কোড়ালিয়া মৎস্যঘাটে দেখা যায়, কোড়ালিয়া গ্রামের অনেক ব্যক্তি মালিকানাধীন ট্রলার নোঙর করে ঘাটে রাখা। ওই ট্রলারের জেলে একই ইউনিয়নের গহিনখালী গ্রামের অনেকের সঙ্গে নিষেধাজ্ঞার সময়সীমার বিষয় নিয়ে কথা হয়। জেলেরা আক্ষেপ করে বলেন, আমাদের দেশের নিষেধাজ্ঞা ২২ দিন আর ভারতের ১১ দিন। আমাদের নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়ার প্রায় দুই সপ্তাহ আগে ভারতের নিষেধাজ্ঞা উঠে যাবে। তখন তো ভারতের জেলেরা মাছ ধরবে। আমরা তো ঘাটে বসে আছি। এখন তারা যাতে আমাদের সাগরে এসে মাছ ধরতে না পারে, সেটা ঠেকানো দরকার। তা না হলে নিষেধাজ্ঞা শেষে সাগরে নেমে আমরা কাঙ্ক্ষিত মাছ পাব না।
একই ইউনিয়নের কোড়ালিয়া গ্রামের ট্রলার মালিক বলেন, আমরা নিষেধাজ্ঞা মানি। আমাদের ট্রলার ঘাটে বেঁধে রাখা। কিন্তু ওপাশে (পশ্চিমবঙ্গ) যদি মাছ ধরা শুরু হয়, তখন ইলিশ তো আর পাসপোর্ট-ভিসা নিয়ে সাঁতরায় না! সীমানা ধরেও চলে না। তখন তো ক্ষতি হবে আমাদেরই। তিনি আরও বলেন, আমরা যদি বসে থাকি, আর ওরা সাগরে নামে, তাহলে মা ইলিশ রক্ষা করা সম্ভব নয়। এ সময় নজরদারি না বাড়ালে নিষেধাজ্ঞার পুরো উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হবে।
স্থানীয় জেলেরা বলছেন, সাধারণ সময়েও ভারত ও মিয়ানমারের জেলেদের বাংলাদেশের জলসীমায় ঢুকে মাছ ধরার বহু নজির রয়েছে। তাই এ সময় যেন কেউ বাংলাদেশের সীমানায় ঢুকে মাছ না ধরে, সে বিষয়ে কোস্ট গার্ড ও নৌবাহিনীর কঠোর নজরদারির দাবি জানিয়েছেন তারা।
পটুয়াখালী জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. কামরুল ইসলাম মোবাইল ফোনে বলেন, আমাদের জলসীমায় যদি কেউ না আসতে পারে, তাহলে কোনো সমস্যা নেই। পার্শ্ববর্তী দেশ কী করল, কী না করল, এটা নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা নেই। ৯০ ভাগ ইলিশই আমাদের অঞ্চলে এসে ডিম ছাড়ে। সুতরাং অন্য কোথাও যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। তিনি আরও বলেন, আমাদের সাগরসীমানা পাহারা দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ নৌবাহিনী ও কোস্ট গার্ড রয়েছে। মা ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুমের ২২ দিন যদি আমরা পাহারা সমুন্নত রাখতে পারি, তাহলে ইলিশগুলো নিরাপদে ডিম ছেড়ে মজুত বৃদ্ধির জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। আর পার্শ্ববর্তী দেশের বিষয়ে আমি কোনো মন্তব্য করতে রাজি নই।
তবে দুই দেশের নিষেধাজ্ঞার সময় আলাদা হওয়ায় বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এতে ইলিশ সংরক্ষণ কার্যক্রমে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। এ বিষয়ে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ অ্যান্ড মেরিন সায়েন্স অনুষদের সহকারী অধ্যাপক ও গবেষক মীর মোহাম্মদ আলী বলেন, সাগর এক, ইলিশের প্রজাতিও এক; তাহলে নিষেধাজ্ঞা কেন এক নয়? আমাদের দেশে ইলিশ ধরার নিষেধাজ্ঞা ২২ দিন, যেটা বিজ্ঞানসম্মত, অথচ প্রতিবেশী দেশ ভারতে তা মাত্র ১১ দিন। ইলিশ সংরক্ষণে নিষেধাজ্ঞার সঠিক প্রয়োগের পাশাপাশি প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক ও প্রশাসনিক সমন্বয় অপরিহার্য। যাতে এক দেশের শিথিলতা অন্য দেশের জেলেদের ক্ষতির কারণ না হয়।
তিনি আরও বলেন, ইলিশ বাংলাদেশের জাতীয় সম্পদ। এটি আমাদের গর্ব; আমাদের অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও জীবিকার প্রতীক। কিন্তু এক বঙ্গোপসাগরে দুই দেশের ভিন্ন সময়ের নিষেধাজ্ঞা এখন সেই সংরক্ষণ অভিযানে নতুন প্রশ্ন তুলছে। জেলেদের আশঙ্কা- আমাদের অবরোধের মাঝপথে ভারতের অবরোধ শেষ হলে তাদের জেলেরা আমাদের জলসীমায় বা সাগরমুখে মাছ ধরতে পারে। ফলে মা ইলিশ নদীমুখে ঢোকার আগেই ধরা পড়ার ঝুঁকি থাকবে। যদি দুই দেশের নিষেধাজ্ঞার সময়সীমা একই করা যায়, তাহলে তা আরও ফলপ্রসূ ও কার্যকর হবে। মা ইলিশও নিরাপদে ডিম ছাড়তে পারবে। ভবিষ্যতে প্রতিবেশী দেশগুলো একযোগে ইলিশ সংরক্ষণের উদ্যোগ নেবে, এই আশাই করছি।
Please Share This Post in Your Social Media
-
সর্বশেষ
-
জনপ্রিয়