ইলন সফির–ঈমাম হোসাইন সিন্ডিকেটে বিটিভির কোটি টাকার অনিয়ম
- Update Time : ০৮:১৯:২১ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১১ নভেম্বর ২০২৫
- / ১৫ Time View
বাংলাদেশ টেলিভিশন চট্টগ্রাম কেন্দ্রের ভেতরে বহু বছর ধরে গড়ে ওঠা দুর্নীতির অন্ধকার সাম্রাজ্য ক্রমেই নগ্ন হয়ে উঠছে। শিল্পীদের সম্মানী, অনুষ্ঠান বাজেট, পুনঃপ্রচার অনুমোদন, ভ্রমণ ভাতা, ভুয়া শিল্পী তালিকা, নাম-বেনামে প্রোডাকশন বাজেট, সবকিছুই যেন একদল প্রভাবশালী কর্মকর্তার হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল।
এই পুরো প্রক্রিয়ার কেন্দ্রে রয়েছেন ছাত্রলীগ নেতা পরিচয়ে আলোচিত বিটিভির নির্বাহী প্রযোজক মো: সফির হোসাইন ওরফে ইলন সফির এবং চট্টগ্রাম কেন্দ্রের বর্তমান জেনারেল ম্যানেজার (চলতি দায়িত্ব) মো: ঈমাম হোসাইন। দুইজন মিলে এমন এক সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন যা তদন্তে একের পর এক প্রমাণিত হলেও এখনো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানটির ভেতরেই কর্তৃত্ব দেখিয়ে চলেছেন।
বিটিভির প্রধান কার্যালয়ের একাধিক সূত্র জানায়, দুর্নীতি, জালিয়াতি, ছলচাতুরি, শিল্পীদের সম্মানী আত্মসাৎসহ গুরুতর অভিযোগের ভিত্তিতে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় ২০২৫ সালের ২ জানুয়ারি বিটিভির মহাপরিচালককে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেয়। কিন্তু নির্দেশটি প্রায় এক বছর ধরে বিটিভির ভেতর আটকে রাখা হয়।
অভিযোগ ওঠে গাজীপুর এলাকার এক প্রভাবশালী ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার প্রভাব এবং ইলন সফিরের রাজনৈতিক যোগাযোগের কারণে মন্ত্রণালয়ের চিঠি দীর্ঘদিন কৌশলে চাপা দিয়ে রাখা হয়েছিল। এর মধ্যেই ইলন–ঈমাম সিন্ডিকেটের হাতে শিল্পীদের কোটি টাকার সম্মানী, অনুষ্ঠান বাজেট ও ভ্রমণ ভাতা নির্দ্বিধায় লোপাট হতে থাকে।
বিষয়টি একাধিক সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হলে মহাপরিচালক মাহবুবুল আলম বাধ্য হয়ে একটি তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেন। দীর্ঘ তদন্ত শেষে ২০২৫ সালের ২৬ আগস্ট দাখিল করা প্রতিবেদনে উঠে আসে চমকে দেওয়া তথ্য। দেখা যায়, নির্বাহী প্রযোজক সফির হোসাইন চট্টগ্রাম কেন্দ্রেই ভূয়া বাজেট, জাল বিল-ভাউচার ও ভুয়া শিল্পী তালিকার মাধ্যমে অন্তত ১ কোটি ২৩ লাখ টাকার বেশি আত্মসাৎ করেছেন। এসব অনিয়ম তিনি তৎকালীন জেনারেল ম্যানেজার মাহফুজা আক্তারের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় করেছিলেন। তদন্তে আরও উঠে আসে—ইলন সফিরের বিরুদ্ধে পূর্বেও একাধিকবার দুর্নীতি, অনিয়ম, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং শিল্পীদের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ আনা হলেও কখনোই কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
তদন্তে প্রমাণিত হলেও প্রতিবেদনটি আবারও দেরিতে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। বিটিভির ভেতরে নানা চাপ, লবিং ও প্রভাব ব্যবহার করে ফাইল আড়াল করার চেষ্টা চলে বলে প্রধান কার্যালয়ের একাধিক কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন। সর্বশেষ করোনা ছাপিয়ে জনমতের চাপ বাড়ায় মহাপরিচালক তদন্ত প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে পাঠাতে বাধ্য হন।
চট্টগ্রাম কেন্দ্রের ভেতরে দুর্নীতির আরেকটি বড় নাম মো: ঈমাম হোসাইন। ঢাকা কেন্দ্রে অনুষ্ঠানের নামে ভুয়া প্রোডাকশন বাজেট, জাল শিল্পী তালিকা ও পুনঃপ্রচারের নামে কোটি টাকার বাজেট বানানোর ব্যাপারে তার সুনির্দিষ্ট প্রমাণ রয়েছে। ঢাকায় থাকাকালে তিনি ৪১টি মঞ্চনাটক পুনঃপ্রচারের নামে ১ লাখ ১৭ হাজার টাকা করে মোট প্রায় ৪৮ লাখ টাকা উত্তোলন করেছেন। মাত্র দু’মিনিটের একটি গ্রাফিক্স কার্ড “ইতিহাসের এই দিনে”—এটি একইভাবে ২৯ বার প্রচার দেখিয়ে তিন কোটির বেশি বাজেট তিনি অনুমোদন করিয়েছেন। প্রোগ্রামটি আসলে গ্রাফিক্স রিপ্লে হলেও ঈমাম হোসাইন এটিকে “ফিল্ড প্রোডাকশন” দেখিয়ে বিভিন্ন জেলায় ভ্রমণ দেখিয়ে ৭ লাখ টাকার বেশি ভ্রমণ ভাতা নেন। এসব কর্মকাণ্ড তদন্তে প্রমাণিত হলেও তিনি এখনো চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সব ক্ষমতা নিজের নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন।
ঈমাম হোসাইন কীভাবে ‘চলতি দায়িত্বে’ জেনারেল ম্যানেজার হয়েছেন তাও প্রশ্নবিদ্ধ। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিধি অনুযায়ী কোনো কর্মকর্তাকে সিনিয়রদের বাদ দিয়ে চলতি দায়িত্ব দেওয়া যায় না এবং এ দায়িত্ব ছয় মাসের বেশি বহাল রাখা যায় না। কিন্তু এসব আইন-বিধান লঙ্ঘন করেই ঈমাম হোসাইন দীর্ঘদিন ধরে জেনারেল ম্যানেজারের দায়িত্ব দখলে রেখেছেন এবং অবৈধভাবে দায়িত্বভাতাও গ্রহণ করে চলেছেন। অভিযোগ আছে, বিগত আওয়ামী আমলে তিনি বিপুল অংকের আর্থিক বিনিময়ে চাকরি নিয়েছিলেন এবং প্রথম থেকেই প্রভাবশালী নেতা ও আমলাদের পরিচয় ভর করে নিজের প্রশাসনিক ক্ষমতা পোক্ত করেছিলেন। জুলাই অভ্যুত্থানের পর তিনি হঠাৎ রাজনৈতিক অবস্থান পাল্টে নিজের ফেসবুকে ‘জাতীয়তাবাদী সাংস্কৃতিক সংস্থা (জাসাস)’ এর নেতা পরিচয় তুলে ধরেন এবং সেই পরিচয়ের প্রভাবেও প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেন।
ইলন সফিরের দুর্নীতির আরেকটি বড় উৎস ছিল জাপান সরকারের অনুদানে পরিচালিত বিটিভির ‘HDTV’ প্রকল্প। ওই প্রকল্পের পরিচালক মাহফুজা আক্তার, প্রোগ্রাম সেক্রেটারি ইয়াসমিন আক্তার এবং সফির হোসাইন মিলে বুয়া, ড্রাইভার, দারোয়ান, আত্মীয়স্বজনদের নামে কোটি টাকার বিল অনুমোদন নিয়ে আত্মসাৎ করেন। দুর্নীতি দমন কমিশন এই প্রকল্প নিয়ে দীর্ঘ তদন্ত করেছে এবং সূত্র বলছে—মামলার প্রস্তুতি প্রায় শেষ পর্যায়ে। একইসঙ্গে সফির হোসাইন তার নিয়ন্ত্রণাধীন প্রোগ্রাম ম্যানেজার রোমানা শারমিনকে দীর্ঘদিন ‘ছুটিতে’ দেখিয়ে তার নামে শিল্পী সম্মানীর ৬০ লাখ টাকারও বেশি তুলে আত্মসাৎ করেছিলেন, যা অন্য এক তদন্তে উঠে এসেছে।
এমনকি আরও গুরুতর অভিযোগ হলো—মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী ঢাকায় নির্বাহী প্রযোজক পদে যোগদান করার কথা থাকলেও সফির হোসাইন কখনোই সেখানে যোগ দেননি। বরং তিনি গোপনে চট্টগ্রাম কেন্দ্রেই থেকে তৎকালীন জেনারেল ম্যানেজার মাহফুজা আক্তারের সঙ্গে মিলে ৫৫ লাখ টাকার জাল বিল তৈরি করে তা উত্তোলন করেন। এ ঘটনায় তার বিরুদ্ধে প্রশাসনিক শাস্তি দেওয়া হলেও কোনোদিনই কার্যকর অনুসরণ হয়নি। দুর্নীতির এই অবাধ সাম্রাজ্য গড়ে উঠতে পারে বিশেষ রাজনৈতিক পরিচয়, আমলাতান্ত্রিক আশ্রয়–প্রশ্রয় এবং বিটিভির অভ্যন্তরীণ শক্তিশালী চক্রের সমন্বয়ে।
চট্টগ্রাম কেন্দ্রের শিল্পীরা জানান, এখন প্রতিষ্ঠানজুড়ে এমন এক সিন্ডিকেট রাজত্ব প্রতিষ্ঠা পেয়েছে যেখানে টাকা ছাড়া কোনো শিল্পী অনুষ্ঠান করার সুযোগ পান না। বছরের পর বছর ধরে শিল্পী সম্মানী, পুনঃপ্রচার, ভুয়া প্রোডাকশন, ভুয়া শিল্পী তালিকা—সবখান থেকেই টাকা গায়েব হয়ে যাচ্ছে। কেন্দ্রের পরিবেশ শোষণমূলক ও অবিদ্যমান। তারা বলেন, “বিটিভি চট্টগ্রাম কেন্দ্রে এখন আর কোনো প্রোগ্রামিং পরিবেশ নেই। সিন্ডিকেট ছাড়া কাজই পাওয়া যায় না। টাকা না দিলে বছরে এক–দুইটা অনুষ্ঠানও মেলে না।”
বিটিভির মতো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান এত দীর্ঘসময় ধরে এত বড় দুর্নীতির চক্রের কবলে থাকা প্রশাসনিক ব্যর্থতার নগ্ন বাস্তবতা তুলে ধরে। তদন্তে একের পর এক দুর্নীতির প্রমাণ মিললেও অপরাধীরা এখনো দায়িত্বে বহাল। তাদের রাজনৈতিক পরিচয়, প্রশাসনিক শক্তি এবং অভ্যন্তরীণ সুরক্ষা বলয় ভেঙে ব্যবস্থা নেওয়া হবে কিনা—এ প্রশ্নের উত্তর এখনো অজানা। শিল্পী, কলাকুশলী, সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক মহলের বিস্তৃত অংশ দাবি তুলেছেন—এই সিন্ডিকেটের মুখোশ উন্মোচন করে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের এখনই সময়।
Please Share This Post in Your Social Media
-
সর্বশেষ
-
জনপ্রিয়







































































































































































































