আ.লীগ কর্মীদের প্রশিক্ষণের অভিযোগে সেনা কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে : সেনাবাহিনী

- Update Time : ১১:১৪:১৩ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩১ জুলাই ২০২৫
- / ৬২ Time View
এক সেনা কর্মকর্তা আওয়ামী লীগের কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে এমন একটি সংবাদ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ও বিভিন্ন গণমাধ্যমে এসেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে মেজর সাদিককে হেফাজতে নিয়েছে সেনাবাহিনী।
আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে সেনা সদরের এক প্রেস ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলা হয়েছে।
ঢাকা সেনানিবাসের অফিসার্স মেস-এ-তে অনুষ্ঠিত এই ব্রিফিংয়ে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিসহ সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেন সেনাবাহিনীর মিলিটারি অপারেশনসের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজিম-উদ-দৌলা এবং সেনা সদরের মিলিটারি অপারেশনস ডাইরেক্টরেটের কর্নেল স্টাফ কর্নেল মো. শফিকুল ইসলাম।
মেজর সাদিক নামে এক কর্মকর্তা আওয়ামী লীগের কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এমন আলোচনার বিষয়ে জনতে চাইলে নাজিম-উদ-দৌলা বলেন, মেজর সাদিকের বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। যদিও বিষয়টি তদন্তাধীন আছে। তারপরেও আমি বলব, যে এরকম একটা ঘটনার কথা জানার পরে সে সেনাবাহিনী হেফাজতে আছে এবং তদন্ত চলমান আছে। তদন্তে তার দোষ প্রমাণিত হলে নিঃসন্দেহে সেনাবাহিনীর প্রচলিত নিয়মে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। যেহেতু বিষয়টি তদন্তাধীন আছে এর বেশি এই মুহূর্তে বলা আমার মনে হয় সমীচীন হবে না।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজিম-উদ-দৌলা বলেন, ‘প্রত্যেকটি জীবন মূল্যবান। যেকোনো কারণেই হোক, কোনো জীবনহানি ঘটবে এটা আমরা আশা করি না। গোপালগঞ্জে যে ঘটনাটি ঘটেছে, এটা অবশ্যই দুঃখজনক। কিন্তু কোন প্রেক্ষাপটে ঘটেছে, কেন সেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বলপ্রয়োগ করতে হয়েছে, সে ব্যাপারেও সরকারের পক্ষ থেকে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।’
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি–সংক্রান্ত আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সকল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে একত্রে কাজ করতে হবে। যাদের অগ্রভাগে কাজ করার কথা তাদের আরও কার্যকর হতে হবে। আর সেনাবাহিনীর কথা বিশেষভাবে বললে, তাদের যে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, সে অনুযায়ী তারা শুধু তল্লাশি ও অপরাধীদের গ্রেপ্তার করতে পারে। গ্রেপ্তারের পর সেনাবাহিনীর করার কিছু থাকে না। এ জন্য সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে।
চাঁদাবাজি–সংক্রান্ত এক প্রশ্নের উত্তরে কর্নেল স্টাফ কর্নেল মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, চাঁদাবাজি বা এ ধরনের ঘটনাগুলো নিয়ন্ত্রণের জন্য যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর দায়িত্ব পালন করার কথা, তারা আরও সক্রিয় হলে এ ধরনের ঘটনা কমে আসবে। এর সঙ্গে সেনাবাহিনীও তার আভিযানিক দায়িত্ব পালন করছে। সবাই একত্রে কাজ করলে চাঁদাবাজি আরও কমে আসবে।
গোপালগঞ্জে সেনাবাহিনীর তৎপরতা সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে নাজিম-উদ-দৌলা বলেন, ‘কোনো দলকে নয়, কোনো ব্যক্তিকে নয়, বরং যাদের জীবন হুমকির মুখে পড়েছে, সেটি বিবেচনা করেই তাদেরকে উদ্ধার করেছি। ইতিপূর্বেও একই কাজ করেছি। কোনো দল নয়, জীবন রক্ষার্থেই এই কাজটি করতে হয়েছিল।’
নাজিম-উদ-দৌলা আরও বলেন, সেনাবাহিনীর আয়ত্তের ভেতরে আছে, কাছাকাছি বা দায়িত্বের ভেতরে আছে এমন সময় কারও জীবন বিপন্ন হবে, এ সময় সেনাবাহিনী চুপ থাকতে পারে না। এ ক্ষেত্রে যে কারও বিষয়ে আমাদের অবস্থান একই। ‘সিনিয়র লিডারশিপের’ (ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বের) নির্দেশনা একইভাবে দেওয়া। কোনো একটা জীবন মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছে, এ সময় তাকে মৃত্যুর মুখে রেখে বা তার প্রতি নজর না দিয়ে সেনাবাহিনী দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। অবশ্যই সেনাবাহিনীর জন্য জীবন রক্ষা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সেই কাজটিই করেছি এবং করব।
সেনাবাহিনীর মিলিটারি অপারেশনসের পরিচালক বলেন, ‘একটা বিপৎসংকুল সময় আমরা পার করছি। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সবার সহযোগিতা দরকার। আমরা যেন সম্মিলিতভাবে কাজ করে এ অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাতে পারি।’
গোপালগঞ্জের ঘটনার বিষয়ে আগাম কোনো তথ্য ছিল কি না, থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া গেল না কেন—এসব বিষয়ে সংবাদ সম্মেলনে সেনাবাহিনীর বক্তব্য জানতে চাওয়া হয়। জবাবে সেনা কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘যেকোনো রাজনৈতিক দল কোথায় তাদের সভা, সমাবেশ বা বৈঠক করবে এটা মূলত স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশের কাছ থেকে ক্লিয়ারেন্স নিতে হয়। এ বিষয়ে তারা জানত, আমাদের কাছে আগাম কোনো তথ্য ছিল না।’
এনসিপির প্রসঙ্গ উল্লেখ করে এক সাংবাদিক জানতে চান একটি রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর বিশেষ কোনো দুর্বলতা আছে কি না—জবাবে এই সেনা কর্মকর্তা বলেন, ‘বিশেষ কোনো দলের ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর আলাদা কোনো নজর নেই। দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সবাই সমান। তবে যেখানে জনদুর্ভোগ ও জীবননাশের হুমকি থাকে সেখানে সেনাবাহিনী কঠোর হয়। জনসাধারণকে সহায়তা করে থাকে। সেখানে (গোপালগঞ্জ) সেনাবাহিনী যদি সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন না করত, তাহলে আরও হতাহত বা জীবননাশের শঙ্কা থাকত। সেই হিসেবে সেনাবাহিনী সেটা করেছে।’
বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার ‘টাইগার লাইটনিং’ কর্মসূচি নিয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, এটি একটি প্রশিক্ষণ। এটা বাংলাদেশ সেনাবাহিনী যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর সঙ্গে করে থাকে। এটা মূলত জ্ঞান ও প্রশিক্ষণ বিনিময়ের একটি কর্মসূচি। নিয়ম অনুসারে এটি প্রতিবছরই হয়ে থাকে। এটা নতুন কোনো কিছু না।
পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন গোষ্ঠীর সমসাময়িক সহিংসতার বিষয়ে তার ভাষ্য, সেখানে ইউপিডিএফ, জেএসএসের মতো যে দলগুলো আছে, তাদের আধিপত্য বিস্তার ও চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন সময় মারামারি হয়। অবশ্য সেনাবাহিনী কাজ করছে এবং সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা করছে যাতে করে এটা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকে। সেনাবাহিনী একাই কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের স্টেক হোল্ডার নয়। বেসামরিক প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন সবাই কিন্তু এটার অংশ। সবাই যদি সমন্বিতভাবে কাজ করে আমি নিশ্চিত যে এটাকে আরও নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নিয়ে যাওয়া সম্ভব এবং এটা অবশ্যই প্রয়োজন।
পাহাড়ের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী কেএনফের সঙ্গে আরাকান আর্মির যোগসাজশের বিষয়ে করা এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আরাকান আর্মি এখন এমন একটা অবস্থায় আছে, তাদের সঙ্গে কেএনএফের যোগসূত্র সৃষ্টি হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। তারা মোটামুটি একই গোত্রীয় মানুষ এবং একই ধরনের মানসিকতা নিয়ে তারা কাজ করছে। সেক্ষেত্রে কেএনএফ আরাকান আর্মির কাছ থেকে যদি কোনো অস্ত্র পেয়েও যায় এটাতে আমি অবাক হবো না। তবে পূর্বের অবস্থা থেকে বহুলাংশে কেএনএফের আধিপত্য ও কর্মক্ষমতা কমেছে। তারা নাজুক অবস্থায় আছে।
কেএনএফ কোনো অবস্থাতেই আধিপত্য বিস্তার করতে পারছে না জানিয়ে তিনি বলেন, কেএনএফ বলব না নিঃশেষ হয়েছে, কিন্তু বহুলাংশে তাদের আধিপত্য কমেছে। শুরুর দিকে কেএনএফের সঙ্গে সংঘর্ষে সেনাবাহিনীর আটজন সদস্য নিহত হয়েছে, অসংখ্য আহত হয়েছে। গত কয়েক মাসে এরকম কোনো ঘটনা দেখা গেছে কিনা প্রশ্ন রাখেন তিনি।
এই সেনাকর্মকর্তা বলেন, আমরা নিজেদের অভিযান পরিচালনা করার কারণে কেএনএফেরই অনেক সদস্য হতাহত হয়েছে, তাদের অনেকগুলো অস্ত্র উদ্ধার করতে পেরেছি। তাদের যে বিভিন্ন বেইজ বা ট্রেনিং ক্যাম্প সেগুলো আমরা খুঁজে পেতে সক্ষম হয়েছি এবং সেগুলো ধ্বংস করা হয়েছে।
পাহাড়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড–সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে কর্নেল শফিকুল ইসলাম বলেন, যেকোনো দুষ্কৃতকারী দল এটা করবেই। বিভিন্নভাবে মানুষের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করা এগুলো করে থাকে। সেনাবাহিনীর কার্যক্রম ও অভিযান জারি রয়েছে। বর্তমান যে ক্যাম্প আছে সেখান থেকে বা টিওবি (টেম্পোরারি অপারেটিং বেজ) থেকে এই অভিযানগুলো পরিচালনা করা হয়। যাতে চাঁদাবাজিসহ এ ধরনের ঘটনা কমে আসে।
শফিকুল ইসলাম আরও বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে যে ক্যাম্পগুলো গুটিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে, সেখানে বর্তমানে যে ক্যাম্পগুলো আছে, সেখান থেকে আভিযানিক কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। এতে কার্যক্রমে কোনো সমস্যা হচ্ছে না। সেনাবাহিনী খুব ভালোভাবেই সেখানে কাজ করছে।
একটি স্বাধীন দেশে এরকম একটা কোন গোত্রের আধিপত্য কোনো অবস্থাতেই মেনে নেওয়ার নয় জানিয়ে তিনি বলেন, সবমিলিয়ে যদি বলি কেএনএফ কোনো অবস্থাতেই আধিপত্য বিস্তার করছে না বরং কেএনএফ এখন অন্তত নাজুক অবস্থায় আছে। আমাদের অভিযান চলমান আছে। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে চাই সবার সম্মিলিতভাবে কাজ করলে কেএনএফকে সমূলে উৎপাটন করা সম্ভব এবং সেটা অবশ্যই প্রয়োজন।
সবশেষে সেনা সদরের মিলিটারি অপারেশনস ডাইরেক্টরেটের কর্নেল স্টাফ কর্নেল মো. শফিকুল ইসলাম উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের প্রসঙ্গে কথা বলেন। তিনি বলেন, ওই ঘটনায় পার্শ্ববর্তী ক্যাম্পে থাকা সেনাসদস্যরা সবার আগে সাড়া দিয়েছে। সর্বোচ্চ আন্তরিকতা ও পেশাদারত্বের সঙ্গে তারা কাজ করেছে।