নির্দেশ উপক্ষো করে মন্ত্রীর প্রতিষ্ঠানকে এককভাবে কাজ দেয়া হয়
আনিসুল হক ও গোলাম সরোয়ারের বেপরোয়া লুটপাট-২

- Update Time : ০১:১৪:৪২ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৪ অগাস্ট ২০২৫
- / ৭৫ Time View
এবার আসা যাক আইন মন্ত্রণালয়ের ভূমি রেজিস্ট্রেশন কার্যক্রম নিয়ে। এখানেও কোনো রকমের টেন্ডার ছাড়াই সম্পূর্ণ অবৈধ প্রক্রিয়ায় ভূমি রেজিস্ট্রেশনের স্থানীয় সরকার কর আদায়ের কাজ দেওয়া হয়। শুধু তাই নয়, একই সময়ে একই প্রক্রিয়ায় অবৈধভাবে করের টাকা জমাদানের ব্যাংক সরকারি সোনালী ব্যাংকের পরিবর্তে বেসরকারি ব্যাংক এনআরবিসিতে স্থানান্তর করা হয়। এক্ষেত্রে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আপত্তিও উপেক্ষা করা হয়।
২০১০ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত আনিসুল হকের ছোট ভাই আরিফুল হক এনআরবিসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন। আরিফুল হক চেয়ারম্যান পদে থাকলেও নেপথ্যে থেকে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষে সব কাজই করতেন আনিসুল হক। আরিফুল হক ২০১৭ সালের মার্চে মারা যান। আরিফুলের মৃত্যুর পর আনিসুল হকই পুরো কর্তৃত্বে ছিলেন এতদিন, যদিও প্রতিষ্ঠানটিতে তার কোনো পদ ছিল না।
যেভাবে মন্ত্রীর ফার্ম কাজ বাগিয়ে নেয়
আইন অনুযায়ী ভূমি রেজিস্ট্রেশনের সময় জমির অন্যান্য কর ও ফি-এর সঙ্গে জমির মোট মূল্যের শতকরা সর্বোচ্চ ৩ ভাগ (সিটি কর্পোরেশন এলাকায় শতকরা ২ ভাগ এবং সিটি কর্পোরেশনের বাইরে ৩ ভাগ) পর্যন্ত পরিশোধ করতে হয় স্থানীয় সরকার কর হিসেবে। যা মোট করের প্রায় এক তৃতীয়াংশ। ইতিপূর্বে সব ধরনের কর একই সঙ্গে ম্যানুয়ালি আদায় করা হতো।
২০১৪ সালের জানুয়ারিতে আনিসুল হক আইনমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পান। সেই থেকেই তিনি পাঁয়তারা করেন ডিজিটাইজেশন-এর নামে নিজের প্রতিষ্ঠান কম্পিউটার নেটওয়ার্ক সিস্টেম লিমিটেড (সিএনএস)কে টেন্ডার ছাড়াই স্থানীয় কর সংগ্রহের কাজ পাইয়ে দিতে। এভাবে সরাসরি কাজ দেওয়া সম্ভব নয়, তাই তিনি নিজের অনুগত কর্মকর্তা তৎকালীন যুগ্ম সচিব (বাজেট) গোলাম সারওয়ার (পরবর্তীতে যিনি মন্ত্রী আনিসুল হকের অপকর্মের অন্যতম সহযোগী হিসেবে দীর্ঘকাল ধরে মন্ত্রণালয়ের সচিব পদে থেকেছেন)কে সভাপতি করে একটি কমিটি গঠন করেন।
এ কমিটির কাজ ছিল মন্ত্রীর সিএনএস নামক প্রতিষ্ঠানটিকে ডিজিটাইজেশনের নামে স্থানীয় সরকার কর আদায়ের কাজ দেয়া। মন্ত্রীর ইচ্ছাপূরণ করতে গিয়ে কমিটি কোন টেন্ডার ছাড়াই কর আদায়ের কাজ সিএনএস-কে দেওয়ার সুপারিশ করে। একই সঙ্গে স্থানীয় সরকার কর আদায়ের বিষয়ে সরকারি সোনালী ব্যাংককে বাদ দিয়ে বেসরকারি ব্যাংক এনআরবিসি-কে কর আদায়ের দায়িত্ব দেওয়ার জন্য অর্থ মন্ত্রালয় ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন চেয়ে পাঠানো হয়। কিন্তু উভয় মন্ত্রণালয়ই এ বিষয়ে অনুমোদন দেয়নি। উপরন্তু সরকারের অর্থনৈতিক আইনকে এখানে তোয়াক্কা করা হয়নি এক্ষেত্রে। তারপরও ওই কমিটি অতি উৎসাহী হয়ে সিএনএস এবং বেসরকারি এনআরবিসি ব্যাংককে কাজ দেয়। আইন ও বিচার বিভাগ এদের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদী চুক্তি করে।
সংশ্লিস্টরা বলছেন, মন্ত্রী আনিসুল হকের মালিকানাধীন সিটিজেন ব্যাংককে সরাসরি এ কাজের দায়িত্ব দেয়া সম্ভব ছিল না, তাই মন্ত্রী কৌশলে এনআরবিসি ব্যাংকের মাধ্যমে কাজটি অবৈধভাবে হাতিয়ে নেন।
কমিটির বিতর্কিত ও অবৈধ সুপারিশ অনুযায়ী সেই থেকে দলিল রেজিট্রেশন এর সময় জমাকৃত টাকার মধ্যে স্থানীয় সরকার কর (এলাকা ভেদে বিভিন্ন রকম হয়), দলিল ভলিউমে লেখার ফিস, এক্সটা মোহরারদের ফিস এবং মূল দলিল প্রাপ্তির জন্য ফিস-এর টাকা এই ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে জমা হতো। এসব টাকা মাসের পর মাস, এমনকি অনেক সময় বছরের পর বছর ব্যাংকে পড়ে থাকে। ব্যাংক এ টাকা কলমানি হিসাবে বিভিন্ন ব্যাংকের চাহিদা অনুযায়ী চড়া সুদে ঋণ দেয় এবং নিজের গ্রাহকদের ঋণদানের কাজেও ব্যবহার করে। এর পরিমাণ কয়েক হাজার কোটি টাকা। প্রতি বছর শুধু স্থানীয় সরকার কর বাবদই আদায় হয়ে থাকে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার বেশি।
মন্ত্রীর প্রতিষ্ঠান সিএনএস ভূমি রেজিস্ট্রেশনের স্থানীয় সরকার কর আদায়ের দায়িত্ব বাগিয়ে নিলেও সারাদেশে এ কাজগুলো সম্পাদন করার জন্য তাদের বড় রকমের কোনো অর্থ ব্যয় করতে হয়নি। সারাদেশের প্রতিটি রেজিস্ট্রেশন ভবনের একটি রুমে কম্পিউটার ও টাকা জমা নেওয়ার মেশিন বসায় তারা। প্রতিষ্ঠানটি এ বাবদ কোনো রুম ভাড়া বা বিদ্যুৎ বিলের অর্থও পরিশোধ করেনি। কিন্তু এর বিপরীতে বেসরকারি ব্যাংকের সহায়তায় তারা বড় অংকের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
অবৈধ কাজে যারা সহযোগিতা করেছেন
মন্ত্রীর ফার্ম সিএনএস-কে কাজ পাইয়ে দিতে তৎকালীন যুগ্ম সচিব পরবর্তীতে সচিব গোলাম সারওয়ারের নেতৃত্বে যে কমিটি গঠিত হয়েছিল ওই কমিটিকে অবৈধ সুপারিশ তৈরির কাজে পেছন থেকে সহযোগিতা করেছেন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (জেলা জজ) উম্মে কুলসুম। পরবর্তীতে আইজেআর। আনিসুল হক, গোলাম সারওয়ার এবং উম্মে কুলসুম, এই তিনজনের গ্রামের বাড়িই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলায়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, আনিসুল হক, সচিব গোলাম সারওয়ার, উম্মে কুলসুম এই চক্রটি প্রতি মাসে ৫ কোটি করে এনআরবিসি ব্যাংক কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ঘুষ হিসেবে নিতেন। ব্যাংক যেহেতু কর বাবদ আদায়ের হাজার হাজার কোটি টাকা অন্যত্র ব্যবহারের মাধ্যমে বড় অংকের লাভ পেতো তাই চক্রটিকে ঘুষ হিসেবে মাসে ৫ কোটি টাকা দিতো। আনিসুল হকের দুর্নীতির অন্যতম সহযোগী কুলসুমের প্রাইজ পোস্টিং ঐ আমলে।
সিএনএস এবং এনআরবিসি ব্যাংককে ভূমি রেজিস্ট্রেশন বাবদ স্থানীয় সরকার করের এই কাজ দেওয়ায় সহযোগিতা ছাড়াও মন্ত্রণালয়ে যুগ্ম সচিব পদে থেকে আনঅফিসিয়ালি মন্ত্রী আনিসুল হকের আরো নানা অনিয়ম-অপকর্মের সহযোগী হিসেবে কাজ করেছেন বেগম উম্মে কুলসুম। মাঝে এক বছর নিবন্ধন অধিদপ্তরের আইজিআর পদে থাকাকালে প্রায় নয়শ কর্মচারী অবৈধভাবে নিয়োগ দিয়েছেন ওই অধিদপ্তরে। এসব নিয়োগে প্রাপ্ত টাকা মন্ত্রী, সচিব গোলাম সরোয়ার এবং কুলসুমের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা হয়েছে। উম্মে কুলসুমের স্বামী পেশায় একজন ব্যবসায়ী হলেও স্ত্রীর দুর্নীতির অন্যতম সহযোগী ছিলেন। নিয়োগ বাণিজ্য ছাড়াও বদলি বাণিজ্যে তিনি মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব পদে থাকাকালে নিবন্ধন অধিদপ্তর ছাড়াও বিচারসহ মন্ত্রণালয়ের অধীন সকল কর্মকান্ডে মন্ত্রীর হয়ে অবৈধ প্রভাব খাটাতেন কুলসুম। সেই উম্মে কুলসুমকেই বর্তমান অর্ন্তবর্তী সরকার গত ২৮ আগস্ট নতুন করে আইন কমিশনের সচিব হিসেবে প্রাইজ পোস্টিং দেন। দুর্নীতিবাজ এই জেলা জজের চাকরির বয়স শেষ হওয়ায় তিনি এখন এলপিআরে।