বিচার বিভাগকে বানিয়েছিলেন আজ্ঞাবহ
আনিসুল হক ও গোলাম সরোয়ারের বেপরোয়া লুটপাট-১

- Update Time : ০১:১১:৩২ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৪ অগাস্ট ২০২৫
- / ৩৭ Time View
বিচার ব্যবস্থাকে ধ্বংসের উদ্দেশ্যে বিচারকদের চাকুরীচ্যুত, হয়রানীমূলক বদলী এবং নানামুখী চাপের মুখে ফরমায়েশী রায়, জামিন বাণিজ্য, নিয়োগ বাণিজ্যসহ সর্বক্ষেত্রে প্রায় প্রকাশ্যে চরম দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছিলেন পতিত সরকারের তৎকালীন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও তার খয়ের খা সাবেক আইন সচিব গোলাম সরোয়ার।
নষ্ট এই মন্ত্রী সচিবদের মনোরঞ্জনের দায়িত্বে থেকে মক্ষিরানীখ্যাত আইনমন্ত্রীর এডভোকেট হিসেবে সাবেক জুনিয়র ঘনিষ্ঠ বান্ধবী তৌফিকা করিম পর্দার অন্তরালে নাটাই ঘুরিয়েছেন ইচ্ছেমত।
এই মক্ষীরানীর তদবিরে চলতো দেদারছে নিয়োগ, বদলীসহ মামলা বাণিজ্য। সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের মালিকানাধীন দুটি ব্যাংক। একটি হচ্ছে সিটিজেন অপরটি এনআরবিসি ব্যাংক। আনিসুলের মন্ত্রীত্বের সময় তার আপন মা ছিলেন সিটিজেন ব্যাংকের চেয়ারম্যান। মায়ের মৃত্যুর পর মক্ষীরানী বান্ধবী এডভোকেট তৌফিকা করিমকে করা হয় পরবর্তী চেয়ারম্যান। ৫ আগস্টের পর তিনি পালিয়ে যান।
আইন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (বাজেট) এর দায়িত্ব পালনকালে ধোঁয়া তুলসী পাতা সেজে নিজেকে ঘুষ দুর্নীতির উর্ধ্বে থাকা একজন মানুষ হিসেবে জাহির করে বেড়াতেন তিনি ঘুষ খান না। আইন সচিবের দায়িত্ব পাবার পর তাকে আর ধরে কে? কারণ আইনমন্ত্রী এবং আইন সচিব উভয়ের বাড়ী বি-বাড়িয়ার কসবা উপজেলায়। সাবেক যুগ্ম সচিব পরবর্তীতে আইজেআর (ইন্সপেক্টর জেনারেল অব রেজিস্ট্রেশন) উম্মে কুলসুমের বাড়ীও একই জায়গায়।
সাবেক আইজেআর আব্দুল মান্নানের সময় গড়ে ওঠা আইজেআর অফিসে ১টি ফিক্সড ডিপোজিট ছিল ১ শত ৩০ কোটি টাকা। রাষ্ট্রায়ত্ত্ব সোনালী ব্যাংকে ঐ টাকা ফিক্সড ডিপোজিট করা ছিল। গোলাম সরোয়ারের কুপ্ররোচনায় এই ত্রি-চক্রের যোগসাজশে একদিন হঠাৎ ফিক্সড ডিপোজিট করা ১ শত ৩০ কোটি টাকা মোটা অংকের কমিশনের বিনিময়ে মন্ত্রীর মালিকানাধীন সিটিজেন ব্যাংকে ট্রান্সফার হয়ে যায়। শুধু তাই নয়, ভূমি রেজিস্ট্রিশনে কর আদায়ের কাজ অবৈধভাবে বাগিয়ে নিয়েছিল আনিসুলের কুখ্যাত ফার্ম ও বেসরকারী ব্যাংক এনআরবিসি। সরকারী মালিকানাধীন সোনালী ব্যাংককে বাদ দিয়ে হাজার কোটি টাকা বাণিজ্যের পাকাপোক্ত ব্যবস্থা এবং লুটপাটের রাজত্ব কায়েম করেন চক্রটি। অথচ এক্ষেত্রে অর্থ মন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞাকেও পাত্তা দেয়া হয়নি।
আসিনুল হকের মালিকানাধীন কম্পিউটার নেটওয়ার্ক সিস্টেম লিমিটেড (সিএনএস) লাগামহীন দুর্নীতি ও অবৈধ ক্ষমতার প্রভাব খাঁটিয়ে সরকারের হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের কারণে ব্যাপকভাবে কুখ্যাতি অর্জন করেছে আলোচ্য ফার্মটি। আওয়ামী লীগ সরকারের শুরুর দিকে বিআরটিএ-র অধীন গাড়ীর লাইসেন্স, ফিটনেস ও ডিজিটাল নেমপ্লেটসহ বিভিন্ন কার্যক্রম টেন্ডার ছাড়াই হাতিয়ে নেয়ার মাধ্যমে এই প্রতিষ্ঠানটির অশুভ যাত্রা শুরু হয়। এরপর সড়ক ও সেতুর টোল আদায়, রেলের টিকেট বিক্রিসহ সড়ক ও রেল যোগাযোগ খাতের অন্যান্য কাজও টেন্ডার ছাড়াই বাগিয়ে নেয় আলোচ্য প্রতিষ্ঠানটি।
সচিব হিসেবে পদায়নের পর গোলাম সরোয়ার আইজেআর অফিসের অধস্তন কর্মচারী নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়ে চরম দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে চাকুরী দেয়া হয় বি-বাড়িয়ার আখাউড়া ও কসবা উপজেলার লোককে।
টাকার খনি হিসেবে পরিচিত আব্দুল গনি রোডের আইজেআর অফিসের দোতলায় এক সময় সন্ধ্যার পর টাকার হাট বসতো। সারাদেশের রেজিস্ট্রি এবং সাব রেজিস্ট্রার অফিস থেকে বেহিসেবি টাকা আসতো। সন্ধ্যার পর বস্তায় বস্তায় টাকা জমা হতো আইজেআর অফিসে। গভীর রাত পর্যন্ত অফিসের দোতলায় খোদ আইজেআর-এর বিশালকায় টেবিল ভরে যেতো টাকার বস্তায়। সেখান থেকে বাগ-বাটোয়ারা হয়ে চলে যেতো আনিসুল হক ও গোলাম সরোয়ারের দফতরে। ঐ সময় জেলা রেজিস্ট্রার, সাব রেজিস্ট্রার বদলী হতো টাকা ভর্তি বস্তায় ঘুষ নিয়ে।
জানা যায়, তেজগাঁও সদর গুলশান মিরপুরসহ লোভনীয় সাব রেজিস্ট্রার ১টি পদে বদলীর জন্য ২ কোটি পর্যন্ত ডাক উঠে। পর্দার অন্তরালে আইন সচিব নিজে এসব লেনদেন করতেন।
এছাড়া সারাদেশে নিম্ন আদালতের বিশেষ করে জেলা জজ, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল, চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত, চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে নিয়োগের ক্ষমতা নিম্ন আদালতের বিচারকদের উপর ন্যস্ত থাকলেও আইনমন্ত্রী ও গোলাম সরোয়ারের ইচ্ছার বাইরে একটা নিয়োগও হতো না। টাইপিস্ট, মুদ্রাক্ষরিক, পেশকার, সেরেস্তাদার, জারিকারক, পিওন, ঝাঁড়ুদার এমনকি মালির চাকরীর জন্য আদায় করা হতো শ্রেণি ভেদে ২০ লক্ষ, ১৫ লক্ষ, ১০ লক্ষ ও ৮ লক্ষ টাকা করে। তবে এই নিয়োগের অধিকাংশেরই বাড়ি বি-বাড়িয়ার কসবা, আখাউড়া, ফরিদপুর ও মাদারীপুরের লোকজন।
আনিসুল হকের রাজত্বের শেষের দিকে আইন সচিব গোলাম সরোয়ারের সুপারিশে রেজিস্ট্রেশন ডিপার্টমেন্টের সর্বজনবিদিত ঘুষখোর জেলা রেজিস্ট্রার সাদেকুন নাহারকে ঢাকা জেলার রেজিস্ট্রার পদে কয়েক কোটি টাকার বিনিময়ে নিয়োগ দেয়া হয়। যিনি ৫ আগস্ট পর্যন্ত জেলা রেজিস্ট্রার হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
এমনকি আনিসুল হক, গোলাম সরোয়ার ও উম্মে কুলসুমের সহযোগিতায় সাদেকুন নাহারকে বাংলাদেশ রেজিস্ট্রেশন সার্ভিসের প্রেসিডেন্ট পদে মনোনয়ন দেয়া হয়। অথচ ৫ আগস্ট পর্যন্ত সরকারবিরোধী আন্দোলন দমাতে কাড়ি কাড়ি টাকা দিয়ে আন্দোলন দমনে ব্যর্থ চেষ্টা চালান এই সাদেকুন নাহার।
আনিসুল হকের আনুকুল্যে থেকে পূর্বাচলে ৭ কাঠার প্লট বাগিয়ে নেন গোলাম সরোয়ার। মোহাম্মদপুরে রয়েছে তার নিজস্ব দুটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট। বনানীতে ৪ হাজার ২শ স্কোয়ার ফিটের ১টি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট পেয়েছেন আনিসুল হকের কল্যানে।
জানা গেছে, সরোয়ার তার কন্যার নামে কানাডার বেগমপাড়ায় ১টি বিলাসবহুল বাড়ি ক্রয় করেছেন। গোলাম সরোয়ার ও তার পরিবারের নামে বেনামে প্রচুর সম্পত্তি রয়েছে। তার সময়ে বিচার বিভাগে কর্মরত অনেকেই সরোয়ারের অবৈধ সম্পত্তির খোঁজ-খবর জানেন। দুদক সঠিক তদন্ত করলে এসব বেরিয়ে আসলে বলে অনেকে মনে করেন।(চলবে)